আজকের বন্দরনগরী চট্টগ্রাম যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক হৃৎপি- হিসেবে সক্রিয় রয়েছে, স্বাধীনতার পূর্বকালে, এমনকি দুই-আড়াই হাজার বছর ধরেই এ বন্দরনগরী এই বাংলার প্রাণের আধান হিসেবে কাজ করে আসছে। বাঙালির ইতিহাস বিশ্বের প্রাচীন যেকোনো জাতির মতোই এক উত্থান-পতনের ইতিহাস। সুপ্রাচীনকাল থেকে ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে অনবদ্য গৌরবের গল্প জড়িয়ে আছে এই জাতির খেরোখাতায়। মহান মুক্তিযুদ্ধ তার মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ। আর বঙ্গবন্ধু সেই স্বাধীনতার রূপকার। বঙ্গবন্ধুর জীবনের সাথেও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের নাম। নানা প্রয়োজনে বারবারই তিনি চট্টগ্রামের আতিথ্যগ্রহণ করেছেন। চট্টগ্রামও তাকে নিয়েছিল আপন করে। বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফার প্রথম আনুষ্ঠানিক জনসভা চট্টগ্রামেই হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হিসেবে উপাধি পাওয়ার আগেই চট্টগ্রামের নেতাকর্মীরা তাকে ‘বঙ্গশার্দুল’ উপাধিতে ভূষিত করেন। আবার স্বাধীনতার পরপরই অনন্য কূটনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে বন্ধুদেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় ধ্বংসপ্রাপ্ত জাহাজ ও মাইন অপসারণ করে পরিত্যক্ত চট্টগ্রাম বন্দরকে দ্রুততম সময়ে পুরোপুরি সচল করেন বঙ্গবন্ধু।

শুরুটা হয়েছিল স্বপ্নদর্শী তরুণ নেতা হিসেবে

পাকিস্তান সৃষ্টির পর ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং পরের বছর আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এজন্য শুরু থেকে দেশব্যাপী সাংগঠনিক সফরের অংশ হিসেবে রাজধানী ঢাকার বাইরে সফরে বের হন স্বপ্নদর্শী তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। প্রথম গন্তব্যই ছিল চট্টগ্রাম। পরের বছর তিনি চট্টগ্রামে আসেন আওয়ামী মুসলিম লীগের সাংগঠনিক কাজে। এর মধ্যে প্রথমদিকে কয়েকবার আসেন তৎকালীন আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর প্রধান রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে। সেই থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে-পরে অনেকবার চট্টগ্রাম আসেন তিনি। রাজনীতির সূত্র ধরে এখানকার তৎকালীন অনেক নেতাকর্মীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাঁর। অনেকের সাথে গড়ে ওঠে পারিবারিক সম্পর্কও। আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক গুরুত্ব বিবেচনায় বাংলাদেশে ঢাকার পরেই চট্টগ্রামের স্থান। বঙ্গবন্ধু সেটা জানতেন এবং বুঝতেন বলেই চট্টগ্রামের নেতাকর্মীদের তিনি সেভাবে গুরুত্ব দিয়ে তাঁদের সাথে যোগাযোগ ও সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন। বঙ্গবন্ধু একটা কথা প্রায়ই বলতেন, ‘তোরা দেখিস, যেদিন আমার চট্টগ্রাম জাগবে সেদিনই আমার বাঙালি জাগবে, আমার স্বাধীনতা আসবে, আমার বিজয় আসবে।’

১৯৫০ সালে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে

১৯৫০ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রচার ও চট্টগ্রামে এসেছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, আতাউর রহমান খান, আব্দুল জব্বার খান ও যুব নেতা শেখ মুজিব। এসময় লালদীঘি মাঠে জনসভায় বক্তৃতা করেন তাঁরা।

১৯৫৫ সালে আমিরাবাদে জনসভা

১৯৫৫ সালের ৯ জুন পাকিস্তান অবজারভার এ প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য আবদুল হামিদ চৌধুরি ৫ জুন সাতকানিয়া গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু আমিরাবাদে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরীর সভাপতিত্বে এক জনসভায় ভাষণ দেন। সংবাদ সংস্থা এপিপির বরাত দিয়ে রিপোর্টে বলা হয়, সভায় শেখ মুজিব আওয়ামী মুসলিম লীগের গত সাত বছরের কর্মকা-ের বিবরণ তুলে ধরেন এবং সংগ্রামের মনোভাব নিয়ে আন্তরিকতার সাথে কাজ করার জন্য দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান।

পরের বছর ১৫ থেকে ১৭ মে পুনরায় চট্টগ্রাম সফরে আসেন বঙ্গবন্ধু। এ সময় তিনি জনসভায় বক্তৃতা ছাড়াও জেলার খাদ্যশস্যের চাহিদা প্রণয়ন এবং দায়িত্ব পালনে সমস্যা সম্পর্কে জেলা নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এই সফরের সময় বঙ্গবন্ধু তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন।

কালুরঘাট ইস্পাহানি জুট মিলের সংঘর্ষের ঘটনায়

কালুরঘাট এলাকায় অবস্থিত জুট মিলে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের ওপর পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামে ছুটে আসেন। এতে উভয়পক্ষের মধ্যে হতাহতের ঘটনা ঘটে। এ সময় তিনি বাণিজ্য, শ্রম ও শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। তিনি সরাসরি ঘটনাস্থলে গিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের আ শ্বাস দেন। এর আগে তিনি আহত শ্রমিকদের দেখতে হাসপাতালে যান। পরে কালুরঘাট চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে এসে জেলা ও শহর আওয়ামীলীগের নেতা এবং শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং শান্তিপূর্ণ অবস্থান বজায় রেখে আলোচনার মাধ্যমে দাবি আদায়ের আহ্বান জানান।

১৯৫৭ সালে লালদীঘিতে ভাষণ

মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করার পর বঙ্গবন্ধু ১৯৫৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর লালদীঘি ময়দানে আওয়ামী লীগের জনসভায় ভাষণ দেন। সভায় তিনি দুর্নীতি রোধে সদ্যবিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের বিবরণ দেন। ওই সময় ৩৪ জন গেজেটেড অফিসারকে দুর্নীতির দায়ে বরখাস্ত করা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘির ময়দানে বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ৬-দফার সমর্থনে প্রথম জনসভায় বক্তৃতাদানরত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

ব্যবসার আড়ালে রাজনীতি

১৯৫৮ সালের মার্শাল ল’র পর দেশে রাজনৈতিক তৎপরতার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক যোগাযোগের জন্য বঙ্গবন্ধু এক অভিনব উপায় বের করে ফেললেন। সেটি হলো একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু করা। নতুন এজেন্সিস নামের এই ক্লিয়ারিং ফরওয়ার্ডিং ও ইভেন্টিং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আড়ালেই চট্টগ্রামে তিনি রাজনৈতিক কর্মকা- চালিয়ে যান। ননী গোপাল দত্ত ব্যবসাটি পরিচালনা করলেও এর অংশীদার ছিলেন চারজন- মানিক চৌধুরী, এম এ আজিজ, ননী গোপাল দত্ত এবং বঙ্গবন্ধু। ষাটের দশকের প্রথম দিক থেকে দ্বিতীয় অর্ধ পর্যন্ত এটি চালু ছিল। অনেকের মতে, এই প্রতিষ্ঠানের আয়ের সিংহভাগ খরচ হতো আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাজে।

ছয় দফার প্রথম জনসভা

১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু লাহোরের ছয় দফা ঘোষণা করলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সরকার ও আওয়ামী লীগ বিরোধী মহল তো বটে, আওয়ামী লীগের ভেতরের একটি অংশও ছয় দফার বিরোধিতা করতে থাকে। দলীয় ফোরামে কোনো আলোচনা ছাড়াই হঠাৎ ছয় দফা ঘোষণাকে অনেকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঢাকায় ফিরে আসেন ১১ ফেব্রুয়ারি। ঢাকায় ছয় দফার বিরোধিতার মুখে এগিয়ে আসেন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ। ছয় দফাকে সমর্থন করে প্রথম বিবৃতি দেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ আজিজ, আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল্লাহ আল হারুন চৌধুরী, এম এ হান্নান, জানে আলম দোভাষ ও আবুল কাশেম প্রমুখ। ১৩ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকে এ খবর প্রকাশিত হয়। পরের দিন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিও ছয় দফা সমর্থনে বিবৃতি দেয়। এই ঘটনায় কয়েকদিনের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নেন চট্টগ্রামে জনসভার মাধ্যমে তিনি ছয় দফা ঘোষণা করবেন।

জনসভা আয়োজনের ব্যাপক প্রস্তুতি নেন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতারা। ১৯৬৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক লালদীঘি মাঠে বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করেন বঙ্গশার্দুল শেখ মুজিবুর রহমান। লালদিঘির সবাই সেদিন সভাপতি সভাপতিত্ব করেন তৎকালীন সিটি আওয়ামী লীগের সভাপতি ও শ্রমিক আন্দোলনের অন্যতম কা-ারী জহুর আহমদ চৌধুরী। সভা পরিচালনা করেন এম এ আজিজ।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযোগপত্রের ২৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘১৯৬৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ১ নম্বর আসামি শেখ মুজিবুর রহমান চট্টগ্রাম সফর করেন এবং লালদীঘি ময়দানে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় ভাষণ দেন।’ দেশব্যাপী ছয় দফার প্রচার করতে গিয়ে পাকিস্তান সরকারের হাতে ৮ মে সারাদেশে যে আটজন নেতা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তাদের মাঝে অন্যতম ছিলেন চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী ও এম এ আজিজ।

মামলা পরিচালনায় শেখ মুজিব ফান্ড

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তার হওয়ার পর সারাদেশে এক শ^াসরুদ্ধকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। চারদিকে শুরু হয় গ্রেপ্তার ও মামলা দায়ের। মামলা পরিচালনা, বঙ্গবন্ধুর মুক্তির আন্দোলন ইত্যাদি নিয়ে অনেক পরিস্থিতিতে নেতাকর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দেয়। বিশেষ করে মামলা পরিচালনার জন্য অর্থ জোগাড় করা ছিল অন্যতম সমস্যা। সরকারের রোষানলের ভয়ে আওয়ামী লীগকে সাহায্য করার জন্য সহজে কেউ এগিয়ে আসতে চাইছিল না। এই সমস্যা মোকাবিলার জন্য চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম এ আজিজের নেতৃত্বে ‘শেখ মুজিব ফান্ড’ নামে কুপন ছেপে অর্থ সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

১৯৬৮ সালের ২৬ এপ্রিল আমিনুল হকের সভাপতিত্বে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরী সংসদের এক সভায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ আজিজকে চেয়ারম্যান করে ১৫ সদস্যের শেখ মুজিব ফান্ড গঠনের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ শুরু করা হয়। কুপনের ডিজাইন করেন শিল্পী সবিহ উল আলম। কুপনটি তখন বেশ সাড়া ফেলে। কুপনে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য শৈল্পিকভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়। তখনকার দিনে প্রায় ২০ হাজার টাকা বেশি চাঁদা তুলে বঙ্গবন্ধুর মামলা পরিচালনার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল।

চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার খরচ পরিচালনার জন্য গঠিত ‘শেখ মুজিব ফান্ড’ এর কুপন

স্বাধীনতার পর নতুন করে শুরু

নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর স্বাধীনতার সোনালি সূর্যটাকে করায়ত্ত করে বাঙালি। শত্রুর কারাগার থেকে দেশে ফেরেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু দেশটা তখন পুরোপুরি বিপর্যস্ত-বিধ্বস্ত। এক কোটি লোক দেশান্তরে। বিরান হয়ে গেছে গ্রামের পর গ্রাম। যোগাযোগ ব্যবস্থা নাজুক। কলকারখানা অকেজো। স্তব্ধ হয়ে আছে অর্থনীতি। দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু দেশের সব প্রান্তে দৌড়ে বেড়াতে লাগলেন। সেখানেও তিনি অগ্রাধিকারে রেখেছিলেন চট্টগ্রামকে। দেশের প্রধান হয়েও চট্টগ্রামের সহকর্মী ও নেতাকর্মীদের তিনি ভুলে যাননি। ১৯৭২ থেকে ৭৫ সাল পর্যন্ত অন্তত ছয় বার তিনি চট্টগ্রামে এসেছিলেন। প্রথমবার আসেন ১৯৭২ সালের ২৯ মার্চ। ৩০ মার্চ সকালে তিনি চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে স্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের সাথে মতবিনিময় করেন। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের আগেও তিনি চট্টগ্রাম সফর করেন। পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরীর বিশাল নির্বাচনী সমাবেশে ভাষণ দেন তিনি।

স্বাধীন দেশের প্রথম মন্ত্রিসভায় চট্টগ্রামের দুই নেতাকে স্থান দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। একজন জহুর আহমদ চৌধুরী, অন্যজন এম আর সিদ্দিকী। এছাড়া প্রতিমন্ত্রী করা হয় অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরীকে।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত হওয়ার পর চট্টগ্রামে সংবর্ধনা সভায় সামনের সারিতে আবদুল মোমেন, তাজউদ্দিন আহমদ,
বঙ্গবন্ধু, এম এ আজিজ, জহুর আহম্মদ চৌধুরী ও মোল্লা জালালউদ্দিন

চট্টগ্রাম বন্দরকে নবজন্ম দান

স্বাধীনতার পর দেশে ফিরেই বঙ্গবন্ধু ঠিক করলেন, প্রথমেই মানুষকে বাঁচাতে হবে। অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে হবে। বিদেশ থেকে জাহাজে করে মানুষের জন্য সাহায্য আনার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু বিদেশের সঙ্গে দেশের প্রধান যোগাযোগ স্থাপনা চট্টগ্রাম বন্দর তখন পুরোপুরি অচল। কর্ণফুলী তীরবর্তী বন্দর থেকে বহির্নোঙর অবধি জাহাজ চলাচলের পুরো চ্যানেলজুড়ে মাইন ফেলে গেছে পরাজিত পাকিস্তানি সেনারা। এই চ্যানেল ঝুঁকিমুক্ত না করলে অর্থনৈতিক চাকার পুনরুজ্জীবন ঘটানো অসম্ভব। না খেয়ে মারা যাবে দেশের মানুষ। বাঙালির প্রাণ বাঁচাতে এবার ফের প্রতিবেশীসহ মিত্র শক্তির শরণাপন্ন হলেন বঙ্গবন্ধু।

২ মার্চ ১৯৭২, ক্রেমলিনে সেদেশের প্রধান লিওনিদ ব্রেজনেভের সাথে সাক্ষাৎকালে চট্টগ্রাম বন্দরকে ব্যবহারোপযোগী করার কাজে
নিঃশর্তভাবে মাইন অপসারণে সহায়তার আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেওয়া হলে বঙ্গবন্ধু এ প্রস্তাব সাদরে গ্রহণ করেন

এখানেও বঙ্গবন্ধু দেখালেন তাঁর ক্যারিশমাটিক কূটনৈতিক প্রজ্ঞা। ১৯৭২ সালের মার্চের প্রথম সপ্তাহে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেন এবং  দ্রুততম সময়ে বন্ধুরাষ্ট্রটিকে রাজি করিয়ে ফেললেন, একদম বিনা পারিশ্রমিকে বন্দরকে ধ্বংসপ্রাপ্ত জাহাজ ও মাইনমুক্ত করতে। ১৯৭২ সালের ২১ মার্চ ৯ সদস্যের একটি সোভিয়েত প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসে এবং ৩৪ ঘণ্টা আলোচনার পর বাংলাদেশ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে পরদিনই এ সংক্রান্ত একটি আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। রিয়ার এডমিরাল জুয়েনকোর নেতৃত্বে এপ্রিলের ৩ তারিখ থেকেই খুব কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম বন্দরে মাইন ও বিধ্বস্ত জাহাজ অপসারণের কাজ শুরু হয়। ধাপে ধাপে এই উদ্ধারকারী দলে আসা ৮০০ সদস্যের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় মাত্র মাত্র চার মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে সচল হয় চট্টগ্রাম বন্দর এবং দুই বছর তিন মাসে হয় সম্পূর্ণ ব্যবহার উপোযোগী। এসময়ে তাঁরা মোট ১ লাখ টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ২৬টি জাহাজ উত্তোলন এবং বঙ্গোপসাগরের জলসীমায় বন্দরসংলগ্ন ১ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকার মাইন অপসারণ করে। এত স্বল্প সময়ে এই সাফল্য ছিল অভাবিত। এটা শুধু বাংলাদেশ নয়, বরং পৃথিবীর ইতিহাসেই কোনো বন্দর থেকে এত সংখ্যক মাইন ও ধ্বংসপ্রাপ্ত জাহাজ অপসারণের এক অনবদ্য কাহিনী হয়ে থাকবে।

বঙ্গবন্ধুর সমুদ্র অধ্যাদেশ ১৯৭৪

দূরদর্শী নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেন সীমিত আয়তনের প্রাকৃতিক আশীর্বাদে পুষ্ট হলেও বাংলাদেশের ভূখ- তুলনামূলক সীমিত আয়তনের। কিন্তু দেশটির দক্ষিণে রয়েছে বিপুল সদাচঞ্চলা আদিগন্ত জলরাশিসমৃদ্ধ বঙ্গোপসাগর। সাগরের অতলে লুকিয়ে থাকা সম্পদ সদ্ব্যবহার করতে পারলে এই দেশের মেহনতি মানুষের মুখে হাসি ফোটানো সম্ভব। এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন রাতারাতি ঘটবে না, কিন্তু এর শিকড় ছড়িয়ে দেওয়া তো সম্ভব। সে লক্ষ্যে এক অনন্য পদক্ষেপ হাতে নিলেন জাতির পিতা। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে এর একটি আইনগত ভিত্তি তৈরি করতে হবে সবার আগে। পরবর্তী পর্যায়ে উপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য হাসিল করা যাবে। বিশেষজ্ঞদের সাথে পরামর্শপূর্বক তিনি এমন একসময়ে ‘টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস অ্যান্ড মেরিটাইম জোন অ্যাক্ট, ১৯৭৪’ নামে এই সমুদ্র অধ্যাদেশটি যখন প্রণয়ন করেন, তখন এ নিয়ে বৈশ্বিক মহল, যেমন জাতিসংঘ অগ্রবর্তী কোনো চিন্তাও শুরু করেনি। বঙ্গবন্ধুর সমুদ্র অধ্যাদেশ প্রণয়নের প্রায় আট বছর পর আন্তর্জাতিক সমুদ্র বিধিমালা আনক্লজ প্রণয়ন করে জাতিসংঘ।

বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রাম বন্দরে কাস্টমসে আটককৃত কৃত্রিম আশে প্রস্তুত উন্নতমানের কাপড় দেখছেন।
এই কাপড় অপারেশন সিগ্যল অভিযানে ধরা পড়ে। ডানে যোগাযোগ মন্ত্রী মনসুর আলী ও
মাঝখানে তথ্য ও বেতার প্রতিমন্ত্রী তাহেরউদ্দিন ঠাকুর।

বঙ্গবন্ধুকন্যার সমুদ্রবিজয়

একুশ শতকের বিশ্বের দিকে যখন পালাবদলের আহ্বান শোনা যাচ্ছে, পরিবেশ ও প্রকৃতি বাঁচিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আরও বাসযোগ্য একটি পৃথিবী গড়ার মানসে মানুষ যখন ধীরে ধীরে ফিরছে পরিবেশবান্ধব অর্থনীতির দিকে, সময়ের দিকদর্শী হিসেবে শেখ হাসিনা সাদরে আমন্ত্রণ জানালেন এই অর্থনীতিকে। সমুদ্র উপকূলবর্তী দেশ হিসেবে যে বিপুল সম্ভাবনার আধার সঞ্চিত রয়েছে বঙ্গোপসাগরে, তার সদ্ব্যবহারে যতœবান হলেন তিনি।

বঙ্গবন্ধুকন্যার প্রজ্ঞা আর কূটনৈতিক সাফল্য ২০১২ সালে মিয়ানমার এবং ২০১৪ সালে ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা-সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে তিনি বঙ্গোপসাগরে ১ লাখ ১৯ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের জলরাশি আর তার অতলে সঞ্চিত সম্পদের ওপর একচ্ছত্র অধিকার। চট্টগ্রাম বন্দরকে কেন্দ্র করে এই সুবিশাল জলরাশির মধ্যে আগামী দিনের অর্থনৈতিক স্বপ্ন ছড়িয়ে দিল বাঙালি। বন্দরের আধুনিকায়ন শুরু হলো। প্রযুক্তিগত সামর্থ্য বৃদ্ধির পাশাপাশি নতুন নতুন টার্মিনাল নির্মাণের মাধ্যমে বন্দর সম্প্রসারণ হতে থাকল। রাতারাতি বন্দরের সামর্থ্য বেড়ে গেল বহুগুণ।

কনটেইনার হ্যান্ডলিং দক্ষতা এবং নিরাপত্তা ও আনুষঙ্গিক মান বিচারে অভিজাত লয়েডস ক্লাবের সেরা শত বন্দরের তালিকায় নাম উঠল তার। শনৈঃ শনৈঃ বৃদ্ধি পেল বন্দরের সুনাম আর প্রতি বছর আরও বেশি জাহাজ ভিড়তে শুরু করল বন্দরে। বর্তমান সরকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ এক নতুন অভিযাত্রা শুরু করেছে, যার লক্ষ্য ২০২১ সালে মাঝারি আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বিশে^র কাতারে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা। এসব লক্ষ্য অর্জনে দেশের মধ্যে শুরু হয়েছে বিপুল কর্মযজ্ঞ। উৎপাদন সামর্থ্য বাড়াতে দেশের মধ্যে শতাধিক বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে। পোশাক শিল্পে অনেক দশক ধরেই শীর্ষকাতারে রয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমান সময়ে তার পাশাপাশি জাহাজ নির্মাণ শিল্প, চামড়াসহ অন্যান্য শিল্পের অভাবনীয় উন্নতি ঘটেছে। জ্বালানি সামর্থ্য অর্জনের লক্ষ্যে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উন্নয়ন প্রকল্পসহ বহুবিধ প্রকল্প চলমান রয়েছে। যোগাযোগ বৃদ্ধিও লক্ষ্যে সুবিশাল সেতু নির্মিত হচ্ছে। পায়রা ও মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলা হচ্ছে। এর জন্য একদিকে ক্রমবর্ধমান উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী বিদেশে রপ্তানি আর বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ নির্মাণসামগ্রী আমদানি করা হচ্ছে। বলা বাহুল্য, এসব কার্যক্রমের ৯০ শতাংশের বেশি সম্পাদন হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে।

চট্টগ্রাম বন্দর আজ কেবল বাংলাদেশের জন্যই নয়, প্রতিবেশী দেশসমূহ যেমন নেপাল, ভুটান, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিকাশেও হয়ে উঠেছে অপরিহার্য। বৈশ্বিক গ্রামের ধারণাচালিত বর্তমান বিশে^ দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে শক্তিশালী আঞ্চলিক হাব বা প্রাণকেন্দ্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে এই বন্দর। পাশাপাশি তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন, মৎস্য সম্পদের সুরক্ষা বিকাশ, সমুদ্র পর্যটন এবং জীববৈচিত্র্য গবেষণা ও সম্ভাবনাসহ সুনীল অর্থনীতিকেন্দ্রিক যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে বর্তমান সরকার, সেখানেও প্রধান ভৌগোলিক অবস্থানগত প্ল্যাটফর্ম হিসেবেই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরকে।

সোনার বাংলার সোনালি দিন অদূরেই

স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু বাংলার স্বাধীনতার। তার বাস্তবায়ন করেছিলেন। স্বপ্ন দেখেছিলেন চট্টগ্রাম বন্দর সচল করার মাধ্যমে জাতিকে বাঁচিয়ে তোলার। তার বাস্তবায়ন করেছিলেন। স্বপ্ন দেখেছিলেন বাংলার হাজার বছরের পড়শি বঙ্গোপসাগরের নিহিত অগাধ সমুদ্রসম্পদের সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে বাঙালির টেকসই উন্নতির। হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন বাংলার মেহনতি মানুষের মুখে। আমাদের দুর্ভাগ্য, সেটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি তিনি। তবে আজ তাঁর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের কা-ারি হয়ে দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন তাঁরই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন দূরদর্শী, স্বপ্নদ্রষ্টা, শক্তিশালী ও বিচক্ষণ নেতৃত্বের ব্যক্তিত্ব। মৃত্যুর আগে মাত্র সাড়ে তিন বছরের জন্য দেশ পরিচালনা করার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। এরই মধ্যে ধ্বংসপ্রাপ্ত, নন-অপারেশনাল দুই সমুদ্রবন্দরকে বিপদমুক্ত করে উন্নয়নের পথে নিয়ে আসেন বঙ্গবন্ধু। সেই পথ ধরে চট্টগ্রাম বন্দর আজ নন্দিত লয়েডস লিস্টে ৫৮তম স্থানে, অভিজাত ৩ মিলিয়ন টিইইউস কনটেইনার হ্যান্ডলার পোর্ট ক্লাবের সদস্য হিসেবে বিশ্বদরবারে মর্যাদার আসনে আসীন। এ সাফল্যের পেছনে সে সময়ের ত্বড়িৎ সিদ্ধান্ত এবং সঠিক বাস্তবায়নের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। বঙ্গবন্ধুর কূটনৈতিক প্রজ্ঞার এক অনন্য নিদর্শন হয়ে সাফল্যের ধারা অব্যাহত রেখে চলেছে চট্টগ্রাম বন্দর, হয়ে উঠেছে দেশের সমৃদ্ধির স্বর্ণদুয়ার।

তথ্যসূত্র:

লেখাটি মুহাম্মদ শামসুল হকের ‘চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সঙ্গীরা’ ও বন্দরবার্তার বিভিন্ন লেখা থেকে নির্বাচিত অংশ নিয়ে রচিত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here