শেখ রাসেল অঙ্কুরেই থামিয়ে দেওয়া অমিত সম্ভাবনা

১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর। ঢাকার ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু ভবনে ঘর আলো করে জন্ম নিল ফুটফুটে এক শিশু। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কনিষ্ঠ পুত্র। নাম শেখ রাসেল। খ্যাতিমান দার্শনিক, নোবেল বিজয়ী ব্যক্তিত্ব, লেখক বার্ট্রান্ড রাসেলের নামানুসারে বঙ্গবন্ধু পরিবারের নতুন এই সদস্যের নাম রাখা হয় শেখ রাসেল। বঙ্গবন্ধুর অনেক পছন্দের ব্যক্তিত্ব ছিলেন বার্ট্রান্ড রাসেল। এছাড়া এই নামকরণে বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

শেখ রাসেলের জন্মের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তার মমতাময়ী বড় বোন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘রাসেলের জন্মের আগের মুহূর্তগুলো ছিল ভীষণ উৎকণ্ঠার। আমি, কামাল, জামাল, রেহানা ও খোকা চাচা বাসায়। বড় ফুফু ও মেজো ফুফু মার সাথে। একজন ডাক্তার ও নার্সও এসেছেন। সময় যেন আর কাটে না। জামাল আর রেহানা কিছুক্ষণ ঘুমায়, আবার জেগে ওঠে। আমরা ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে জেগে আছি নতুন অতিথির আগমনবার্তা শোনার অপেক্ষায়। মেজো ফুফু ঘর থেকে বের হয়ে এসে খবর দিলেন, আমাদের ভাই হয়েছে। খুশিতে আমরা আত্মহারা। কতক্ষণে দেখব। ফুফু বললেন, তিনি ডাকবেন। কিছুক্ষণ পর ডাক এল। বড় ফুফু আমার কোলে তুলে দিলেন রাসেলকে। মাথাভরা ঘন কালো চুল। তুলতুলে নরম গাল। বেশ বড়সড় হয়েছিল রাসেল।’ (সূত্র: শেখ হাসিনা, ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’)

কণ্টকাকীর্ণ জীবন

জাতির পিতার অতিআদরের সন্তান। পরিবারের সব সদস্যের নয়নের মণি। স্বাভাবিকভাবে নিষ্কণ্টক একটি জীবন পাওয়ার কথা ছিল শেখ রাসেলের। কিন্তু এতটুকু বয়সেই তাকে সামলাতে হয়েছে অচিন্ত্যনীয় ঝড়-ঝাপটা। ১৯৭১ সালে যখন মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলো, তখন তাঁর বয়স মাত্র সাত বছর। এই বয়সেই মা এবং দুই বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ধানমন্ডির ১৮ নম্বর সড়কের একটি বাড়িতে বন্দিজীবন কাটাতে হয়েছে তাঁকে। বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। বড় দুই ভাই শেখ কামাল ও শেখ জামাল চলে গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে।

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব শিশু রাসেলের বিপদসংকুল জীবনের আঁচ আগেই করতে পেরেছিলেন। ১৯৬৬ সালের মে মাসে ছয় দফা দাবির জেরে বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানি শাসকদের হাতে গ্রেপ্তার হলেন, সেই সময়টায় বঙ্গমাতা বেশ ক্ষোভের সঙ্গেই বলেছিলেন, ‘বাপের পেছনে গোয়েন্দা লেগেছিল ২৮ বছর বয়সে, কিন্তু ছেলের পেছনে লাগল দেড় বছর বয়সেই।’ কারণ কারাবন্দি বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎপ্রার্থীদের সম্পর্কে অনুসন্ধান শুরু করেছিল পাকিস্তানি গোয়েন্দারা, যা থেকে বাদ পড়েনি ছোট্ট শিশু শেখ রাসেলও।

কারাগারে দেখা করার সময় শেখ রাসেল কিছুতেই তার বাবাকে রেখে আসতে চাইতেন না। এ কারণে তার মন খারাপ থাকত। কারাগারের রোজনামচায় ১৯৬৬ সালের ১৫ জুনের দিনলিপিতে রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “১৮ মাসের রাসেল জেল অফিসে এসে একটুও হাসে না-যে পর্যন্ত আমাকে না দেখে। দেখলাম দূর থেকে পূর্বের মতোই ‘আব্বা আব্বা’ বলে চিৎকার করছে। জেল গেট দিয়ে একটা মালবোঝাই ট্রাক ঢুকেছিল। আমি তাই জানালায় দাঁড়াইয়া ওকে আদর করলাম। একটু পরেই ভেতরে যেতেই রাসেল আমার গলা ধরে হেসে দিল। ওরা বলল আমি না আসা পর্যন্ত শুধু জানালার দিকে চেয়ে থাকে, বলে ‘আব্বার বাড়ি’। এখন ধারণা হয়েছে এটা ওর আব্বার বাড়ি। যাবার সময় হলে ওকে ফাঁকি দিতে হয়।”

নৃশংস ১৫ আগস্ট

মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তির বিষাক্ত ষড়যন্ত্রের ছোবলে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে শেখ রাসেলের সম্ভাবনাময় দুরন্ত শিশুমন নীল হয়ে যায়। রাতের শিউলি, ভোরের বকুল ঝরে পড়ার আগেই ঘাতকের বুলেটে রক্তের সাগরে ডুবে যায় সবার প্রিয় পাখিটি। রাসেলের নির্মম মৃত্যুতে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে বিশ্বমানবতা। কুয়াশার চাদরে ঢেকে যায় বাংলার মাঠ-ঘাট-প্রকৃতি।

১৫ আগস্টের সেই কালরাতে পরিবারের সদস্যদের সাথে শেখ রাসেলকেও হত্যা করা হয়। রাসেল তখন ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। বিশ্বে যুগে যুগে বহু রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। কিন্তু এমন নির্মম, নিষ্ঠুর ও পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা খুবই বিরল।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে রাসেলকে নিয়ে পালানোর সময় তার ব্যক্তিগত কর্মচারীসহ রাসেলকে আটক করা হয়। আতঙ্কিত হয়ে শিশু রাসেল কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন, ‘আমি মায়ের কাছে যাব’। পরবর্তী সময়ে মায়ের মরদেহ দেখার পর অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে মিনতি করেছিলেন, ‘আমাকে হাসু আপার (শেখ হাসিনা) কাছে পাঠিয়ে দিন।’ মা, বাবা, দুই ভাই, ভাবি, চাচা সবার নিথর মরদেহের পাশ দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে সবার শেষে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয় রাসেলকে। যাদের সান্নিধ্য, স্নেহ ও আদরে হেসে-খেলে দিন কাটছিল রাসেলের, তাদের নিথর দেহগুলো পড়ে থাকতে দেখে ছোট্ট শিশুমনের কী অবস্থা হয়েছিল, তা চিন্তা করলেও চোখ ভারী হয়ে আসে।

অপার সম্ভাবনার অপমৃত্যু

মাত্র ১১ বছরের আয়ু নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন শেখ রাসেল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বর্বর ঘাতক চক্রের চরম নিষ্ঠুরতার বলি না হলে আজকে আমরা পেতাম বহু অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ এক রাসেলকে। পিতার আদর্শে দীক্ষিত শেখ রাসেল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে পারতেন। ১৫ আগস্টের সেই নিকৃষ্টতম ঘটনা সেই সম্ভাবনাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দিয়েছে।

যে পরিবারে শেখ রাসেলের জন্ম, যে পরিমণ্ডলে লালন-পালন ও বেড়ে ওঠা, তাতে তাঁর নেতা হওয়া অবধারিতই ছিল। শৈশবে তার লক্ষণও প্রকাশ পেয়েছিল। শেখ রাসেল ছিলেন শিশুদের বন্ধু ও গরিব-দুঃখী মানুষের সাহায্যকারী। আর্তমানবতার সেবা যে তাঁর রক্তে মিশে রয়েছে, সেটি প্রকাশ পেতে শুরু করে অতটুকু বয়স থেকেই।

শেখ রাসেলের মানবতাবোধ, ব্যক্তিত্বের উৎকর্ষ, নেতৃত্বের সৌকর্য, পরোপকারী মনোভাব আর দশজন শিশু থেকে তাকে স্বতন্ত্র অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছিল। টুঙ্গিপাড়ায় বেড়াতে গেলে শিশু রাসেল তার সমবয়সীদের জড়ো করে তাদের জন্য খেলনা বন্দুক বানাতেন আর সেগুলো দিয়ে প্যারেড করাতেন। বন্ধুদের জামাকাপড়ও কিনে দিতেন তিনি।

শেখ রাসেল ছিলেন বঙ্গবন্ধুর মতোই দৃঢ়চেতা ও আত্মপ্রত্যয়ী। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মা-বোনদের সঙ্গে ধানমন্ডির বাড়িতে বন্দিজীবন কাটাতে হলেও তার প্রত্যয় ও উদ্দীপনা এতটুকু কমেনি। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হলে একাত্তরের ১৭ ডিসেম্বর পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে মুক্ত হন শেখ রাসেলও। বাইরে তখন বিজয় উৎসব চলছে। ছোট্ট রাসেলও সেই উৎসবে শামিল হলেন। ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় তাঁর মুখে ছিল ‘জয় বাংলা’  স্লোগান।

কারাগারের রোজনামচায় ১৯৬৭ সালের ২৭ ও ২৮ মের দিনলিপিতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আড়াই বছরের ছেলে আমাকে বলছে ছয় দফা মানতে হবে সংগ্রাম, সংগ্রাম, চলবে, চলবে… ভাঙা ভাঙা করে বলে, কী মিষ্টি শোনায়। জিজ্ঞাসা করলাম, ও শিখল কোথা থেকে। রেণু বলল, বাসায় সভা হয়েছে, তখন কর্মীরা বলেছিল, তাই শিখেছে।’

দেশে ফিরেই যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্র্নির্মাণের কাজে মন দেন বঙ্গবন্ধু। জীবনের সাতটি বছর পেরিয়ে, এই প্রথম পরিবারের সবাইকে কাছে পেয়েছিলেন শেখ রাসেল। পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের সৌজন্যে বিশ্বনেতাদের সঙ্গেও করমর্দনের সুযোগ হয় রাসেলের। শিশু রাসেলের আত্মবিশ্বাসী বাচনভঙ্গি, বুদ্ধিদীপ্ত চাহনি ও নির্মল অভিব্যক্তি মুগ্ধ করে তাদের। রাসেলের প্রতিটি নির্ভীক পদচারণে ফুটে উঠত বঙ্গবন্ধুর প্রতিচ্ছবি।

স্মৃতিতে অম্লা

ক্ষণজন্মা শেখ রাসেলের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তার জন্মদিন ১৮ অক্টোবর তারিখটিকে জাতীয়ভাবে ‘শেখ রাসেল দিবস’ হিসেবে উদযাপন করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয়, বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে উপলক্ষটি উদ্যাপনের লক্ষ্যে ২০২১ সালে দিবসটিকে ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত দিবস হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ হিসাবে চলতি বছর দ্বিতীয়বারের মতো ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত হিসেবে দিবসটি উদ্যাপন করা হচ্ছে। এবারের শেখ রাসেল জাতীয় দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হলো ‘শেখ রাসেল নির্মলতার প্রতীক, দূরন্ত প্রাণবন্ত নির্ভীক’।

জাতীয়ভাবে শেখ রাসেল দিবস উদ্যাপনের উদ্যোগ রাসেলের মমতাময়ী বড় বোন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। লক্ষ্য সকল শিশুর মাঝে শেখ রাসেলের স্মৃতি অম্লান করে রাখা। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের কর্ণধার তথা বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষার্থী ও শিশু-কিশোরদের জন্য নিরাপদ পৃথিবী গড়ে তোলা এবং তাদের উন্নত বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রত্যয় নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশ ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত বিশ্বে পরিণত হওয়ার পথে হাঁটছে। শেখ রাসেলের স্মরণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী দেশজুড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় স্থাপিত কম্পিউটার ল্যাবগুলোকে ‘শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব’ নামকরণ করা হয়েছে। দেশের তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের আইসিটি জ্ঞান সম্প্রসারণ ও দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি শেখ রাসেলের অমর স্মৃতি লাখো শিক্ষার্থী, শিশু-কিশোর ও আপামর জনসাধারণের মাঝে জাগ্রত করতে অপরিসীম ভূমিকা রেখে চলেছে এই ‘শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব’। শেখ রাসেলের স্মৃতির প্রতি সম্মানার্থে আরও গড়ে তোলা হয়েছে ‘শেখ রাসেল ক্রীড়াচক্র’ ও ‘শেখ রাসেল ফান্ড’।

উপসংহার

শেখ রাসেল আজ আমাদের মাঝে নেই। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রচেষ্টায় তার স্মৃতি আজও অমর হয়ে আছে। আজও আমরা বঙ্গবন্ধুর সপরিবারের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শিশু রাসেলের করুণ পরিণতির কথা মনে করে অশ্রুসিক্ত হই। বর্তমানের শিশু-কিশোররা এই শোককে শক্তিতে পরিণত করে বলীয়ান হয়ে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেবে এটাই তাদের কাছে প্রত্যাশা।

অনেক সম্ভাবনাময় যে শিশুটি অকালে হারিয়ে গেল, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার প্রাণশক্তি ছড়িয়ে গেছে এ দেশের প্রতিটি শিশুর মাঝে। প্রতিটি বাঙালি শিশুর দামাল দুরন্তপনায় বেঁচে আছে শিশু রাসেল। এদেশের সব শিশুই বেড়ে উঠুক নির্মল চিত্তে, নিরাপদ পরিবেশে। বিকশিত শৈশব শেষে প্রতিটি শিশুই পরিণত হোক একেকজন দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here