সংকটে বৈশ্বিক অর্থনীতি উত্তরণে প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ

বৈশ্বিক অর্থনীতি ও বাণিজ্যের যেকোনো সংকট স্বাভাবিক নিয়মেই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে। নভেল করোনাভাইরাস অতিমারির সময়ে আমরা তা দেখেছি। সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সংকটের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম কিছু হয়নি। তবে বাংলাদেশের অর্থনীতি যে আগের মতো ভঙ্গুর অবস্থায় নেই, তার প্রমাণ আমরা এরই মধ্যে পেয়ে গেছি। করোনা অতিমারির কারণে যখন সারা বিশ্বেই অর্থনীতির করুণ দশা,  উন্নত অনেক দেশকে যেখানে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে,  সেখানে বাংলাদেশ জিডিপিতে প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। আর দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা কার্যক্রম চালু রাখার মাধ্যমে দেশের বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক গতিশীলতা ধরে রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে চট্টগ্রাম বন্দর।

বিশ্বায়নের যুগে যুদ্ধের প্রভাবকে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখা খুবই কঠিন। গত ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতি ফের টালমাটাল হয়ে পড়েছে। যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন খাতে মস্কোর ওপর অবরোধ দেওয়া হয়। অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের কারণে রাশিয়া,  ইউক্রেন,  যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো যে সংকটে পড়েছে, তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে অন্যান্য দেশের ওপরও। বর্তমান সংকট সারা বিশে^র জন্যই নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও জ্বালানি সরবরাহ খাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি পটপরিবর্তনকারী প্রেক্ষাপট হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নভেল করোনাভাইরাস অতিমারির ধাক্কা কাটিয়ে মাত্রই উত্তরণের ধারায় ফিরতে শুরু করেছিল বিশ্ব অর্থনীতি। দুই বছরের সংকটের রেশ কাটানো এমনিতেই কঠিন কাজ। এর মধ্যে নতুন চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে মূল্যস্ফীতির বোঝা। পাশাপাশি আমদানিনির্ভর দেশগুলোর বিপদ বাড়িয়েছে অবরোধের প্রভাবে সৃষ্ট সরবরাহ সংকট। বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে শান্তি-সমঝোতার কোনো পথ তৈরি না হলে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট আরও জটিল রূপ ধারণ করবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।

ইউক্রেন ইস্যুকে কেন্দ্র করে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক ছিন্ন করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো অর্থনৈতিক পরাশক্তিগুলো। রাশিয়ার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে বাধাগ্রস্ত করতে তারা দেশটির আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আরোপ করেছে নিষেধাজ্ঞা। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম জ্বালানি তেল উৎপাদক দেশটির বিরুদ্ধে আরোপিত এই নিষেধাজ্ঞার চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে বিশ্বকে। এই ঘটনার পর সারা বিশ্বেবেড়ে গেছে জ্বালানি তেলের দাম। উন্নত দেশগুলো না হয় বিকল্প উৎস থেকে চড়া মূল্যে তেল আমদানি করতে পারছে, কিন্তু নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে তাদের সীমিত আর্থিক সম্পদের কারণে জ্বালানি চাহিদা পূরণ করতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে।

বৈশ্বিক অর্থনীতির এই দুরবস্থার প্রভাব বাংলাদেশের ওপরও পড়েছে। করোনাকালীন সময়ের মতো এবারও সরকার অর্থনীতি, শিল্প ও ভোক্তাবাজারকে সুরক্ষা দিতে সহায়ক নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আর আপৎকালীন সময়ে কীভাবে দেশের সমুদ্র বাণিজ্যের চাকা সচল রাখা যায়, সেই লক্ষ্যে সব ধরনের সহায়ক পদক্ষেপ গ্রহণ করে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর।

বাংলাদেশের ওপর বৈশ্বিক সংকটের প্রভাব

বিভিন্নভাবে বাংলাদেশের ওপর বৈশ্বিক এই সংকটের প্রভাব পড়েছে। একদিকে বাংলাদেশের রপ্তানি কমে গেছে, অন্যদিকে আমদানি খরচ বেড়ে গেছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে গ্যাস, সার ও অন্যান্য নিত্যপণ্যের মূল্যও বেড়ে গেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এরই মধ্যে ৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতির চাপ তৈরি হয়েছে। কয়েক দশকের মধ্যে মূল্যস্ফীতির এই হার সর্বোচ্চ।

কেন এই মূল্যস্ফীতি? এটির সঙ্গে ইউক্রেন যুদ্ধের সম্পর্কইবা কী? সেটি জানতে হলে বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের রীতিনীতি সম্পর্কে খানিকটা ধারণা লাভ করা দরকার। বাণিজ্য এখন আর কেবল নির্দিষ্ট কোনো দেশ বা অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বরং বাণিজ্য এখন বিশ্বজনীন। এক দেশের পণ্য সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিয়ে চলে যাচ্ছে অন্য দেশে। এই যে বাণিজ্য ও পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা সারা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে সমুদ্র পরিবহন খাত।

ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্রের বন্দরগুলোয় রাশিয়ায় নিবন্ধিত অথবা রুশ মালিকানাধীন অথবা দেশটির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সব ধরনের জাহাজের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এর ফলে জ্বালানি ও অন্যান্য ভোগ্যপণ্য পরিবহন ব্যবস্থায় তৈরি হয়েছে জটিলতা। অনেক ক্ষেত্রে জ্বালানি তেল উৎপাদক দেশগুলো রপ্তানি গন্তব্যে তেল পাঠানোর জন্য পর্যাপ্ত ট্যাংকার পাচ্ছে না। ফলে জ্বালানির বাজারে তৈরি হয়েছে অস্থিরতা। আবার ইউরোপীয় বন্দরগুলোয় পোর্ট কল দিতে না পেরে অনেক রুশ ট্যাংকারকে ঘোরাপথে অনেকটা বাড়তি পথ পাড়ি দিয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেতে হচ্ছে। এসব সমস্যার কারণে জ্বালানি বাজারের স্বাভাবিক সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে।

অন্যান্য ভোগ্যপণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য । জ্বালানি  তেলের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় জাহাজের ভাড়া বেড়েছে। এতে করে আমদানি খরচ গেছে বেড়ে। স্বাভাবিকভাবেই দেশের ভোক্তাবাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আবার জ্বালানি কেনার খরচ বেড়ে যাওয়ায় দেশীয় ম্যানুফ্যাকচারাররাও বিপাকে পড়েছেন। একদিকে তাদের মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে, অন্যদিকে উৎপাদন প্রক্রিয়ার খরচ বেড়ে গেছে। উৎপাদিত পণ্য ভোক্তাপর্যায়ে পৌঁছে দিতে গিয়ে পরিবহন ব্যয়ও ঊর্ধ্বমুখী। এসব ব্যয় বৃদ্ধির চাপ শেষ পর্যন্ত গিয়ে পড়ছে ভোক্তাদের ওপর; পণ্যের খুচরা মূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে।

আরেকটি বিষয় গোটা বিশ্বের জন্যই উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেটি হলো খাদ্যনিরাপত্তা। রাশিয়া ও ইউক্রেন দেশ দুটির পরিচিতি রয়েছে ‘বিশ্বের খাদ্যঝুড়ি’ হিসেবে। বাংলাদেশের গম আমদানিরও বড় উৎস দেশ দুটি। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ ইউক্রেন থেকে গম আমদানি করেছে ২৩ লাখ টন, যা দেশের মোট গম আমদানির ১৭ শতাংশের কিছু বেশি। এ সময় বাংলাদেশে রাশিয়া থেকে গম এসেছে মোট আমদানির প্রায় ২১ শতাংশ।

বাংলাদেশের কৃষি খাতে সার অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। দেশের মোট পটাশ সারের সিংহভাগ (প্রায় ৭৫ শতাংশ) আমদানি হয় বেলারুশ (৪১ শতাংশ) ও রাশিয়া (৩৪ শতাংশ) থেকে। অবরোধের ফলে সার সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে, যার তীব্র নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাজারে।

ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কৃষ্ণ সাগর হয়ে সমুদ্র বাণিজ্য প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। এর ফলে এই রুট দিয়ে আগে যেসব পণ্য আসত বাংলাদেশে, সেগুলোর জন্য এখন আমাদের ভিন্ন উৎসের সন্ধান করতে হচ্ছে। এতে করে একদিকে যেমন আমদানি খরচ বাড়ছে, অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের মুনাফাও কমে যাচ্ছে।

২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে ৪৬ কোটি ৬৭ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। বিপরীতে এ সময়ে দেশটিতে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৫৫ কোটি ডলার। ১ হাজার ২৬৫ কোটি ডলার ব্যয়ে রূপপুরে নির্মাণ করা হচ্ছে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এটির নির্মাণকাজে রয়েছে রাশিয়া। ২০২৫ সাল নাগাদ প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা। তবে ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে এবং রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ অব্যাহত থাকলে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের কাজও পিছিয়ে যেতে পারে, যার ফলে বাড়তি ব্যয়ের বোঝা টানতে হবে বাংলাদেশকে।

আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ার একটি বড় অসুবিধা হলো, এটি পেমেন্ট ব্যালান্সের ওপর চাপ তৈরি করে। আর চলতি হিসাবের ঘাটতির কারণে মুদ্রা বিনিময় হারও চাপে পড়ে যায়। জাতীয় মুদ্রার ওপর তৈরি হওয়া চাপ সামাল দিতে গিয়ে ডলারের সঙ্গে বিনিময়মূল্য সমন্বয় করা তখন জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। আর এই সমন্বয়ের ফলে ভোগ্যপণ্যের মূল্য বেড়ে যায়,  যার বোঝা টানতে হয় প্রান্তিক ভোক্তাদের। বাংলাদেশেও অর্থনীতির এই মৌলিক চর্চা ও প্রভাব দৃশ্যমান হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে।

তবুও অদম্য বাংলাদেশ

সর্বশেষ তিন বছরে টালমাটাল অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতিকে। প্রথমে করোনা অতিমারি, পরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অর্থনীতিকে অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। তবে বাংলাদেশ করোনাকালীন অর্থনৈতিক সংকট উতরে গেছে সাফল্যের সঙ্গে। আইএমএফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়।

করোনার প্রভাবে গোটা বিশ্বের মতো দেশের অর্থনীতি, শিক্ষা,  স্বাস্থ্য,  ব্যবসা-বাণিজ্য,  কর্মসংস্থান,  ক্ষুদ্র,  কুটির শিল্পসহ অর্থনীতির সব খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩১ দফা নির্দেশনাসহ বিভিন্ন দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। এসব নির্দেশনা অনুযায়ী গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে দেশের রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা সম্ভব হয়েছে।

সরকার সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দক্ষতা ও উৎকর্ষ সাধন এবং প্রাজ্ঞ রাজস্বনীতি ও সহায়ক মুদ্রানীতি অনুসরণের মাধ্যমে করোনা সংকটের সময়েও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। গত এক দশকে গড়ে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ ও পরপর তিন বছর ৭ শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি অর্জনের পর বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশে উন্নীত হয়। বাংলাদেশের এই ধারাবাহিক অর্জন বিশ্বব্যাপী

প্রশংসিত হয়েছে। করোনার কারণে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমলেও এ সময়ে মাথাপিছু জাতীয় আয় ৮ দশমিক ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৪ মার্কিন ডলারে। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতিও সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব হয়েছে।

করোনার প্রভাব কাটিয়ে অর্থনীতি গতিশীল হওয়া শুরু করতে না করতেই ইউক্রেন যুদ্ধের এই সংকট। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান ইউক্রেন থেকে অনেক দূরে। তবে ইউক্রেন যুদ্ধ ও এর জেরে আরোপিত পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে জ্বালানি, খাদ্য, ওষুধসহ অন্যান্য জরুরি পণ্য পরিবহনে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, তার প্রভাব দেশের অর্থনীতি ও ভোক্তাবাজারেও পড়েছে।

ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে যে নতুন করে সংকট তৈরি হয়েছে, তা মোকাবিলার সময়োপযোগী প্রস্তুতি এরই মধ্যে নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। এর অংশ হিসেবে ১০০ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা তহবিল গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই তহবিলের অর্থ প্রধানত সামাজিক সুরক্ষা,  ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা (এসএমই), বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও শিল্প খাতকে সুরক্ষা দেওয়ার কাজে ব্যয় করা হবে।

এছাড়া সরকার বর্তমানের বিশ্ববাজারের হালচালও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। টালমাটাল এই বাজারে নতুন কোন উৎস থেকে তুলনামূলক  দ্রুত ও কম মূল্যে পণ্য আমদানি সম্ভব হবে, সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। এছাড়া অভ্যন্তরীণ বাজারের স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে ভোক্তাদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মতো সংস্থার মাধ্যমে উন্মুক্ত বাজারে যথাসম্ভব কম মূল্যে পণ্য সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে সরকার। আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতরা সুযোগ নিয়ে ভোগ্যপণ্যের মূল্য নিয়ে যেন কোনো ধরনের কারসাজি না হয়,  সে লক্ষ্যে নিয়মিত বাজার মনিটরিং কার্যক্রম চালাচ্ছে সরকারি সংস্থাগুলো।

দেশের অর্থনীতি করোনাকালীন সংকট যেভাবে সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করেছে, বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিও একইভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। আন্তর্জাতিক লেনদেন ব্যবস্থায় উদ্ভত জটিলতা সত্তে¡ও দেশের চলমান অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পগুলো এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে এরই মধ্যে সফলতার প্রমাণ দিয়েছে সরকার।

থেমে নেই চট্টগ্রাম বন্দর

আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে বঙ্গোপসাগরের গুরুত্বপূর্ণ বন্দরগুলোর একটি হলো চট্টগ্রাম বন্দর। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই বন্দরের গুরুত্ব আরও বেশি। দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য চাপের সিংহভাগই সামাল দিতে হয় এই বন্দরকে। ফলে করোনা অতিমারির বাধা কাটিয়ে দেশের অর্থনীতি ও সমুদ্র বাণিজ্যকে চাঙ্গা করার গুরুদায়িত্বও পড়ে চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর। সেই দায়িত্ব বেশ ভালোভাবেই সামাল দিয়েছে বন্দরটি।

দেশের ক্রমবর্ধমান আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের চাহিদা সামাল দিতে গিয়ে রেকর্ড পরিমাণ কনটেইনার, কার্গো ও জাহাজ হ্যান্ডলিং করেছে চট্টগ্রাম বন্দর। অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজনের মাধ্যমে বন্দরের কার্যক্রমে গতিশীলতা আনতে দূরদর্শী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান। চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত তিন মাসে বন্দরে মোট ১৬টি হ্যান্ডলিং যন্ত্রপাতি যুক্ত হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে চারটি কি গ্যান্ট্রি ক্রেন, ছয়টি রাবার-টায়ারড গ্যান্ট্রি ক্রেন, দুটি ১০০ টন সক্ষমতার মোবাইল ক্রেন, দুটি ৫০ টন সক্ষমতার মোবাইল ক্রেন ও দুটি কনটেইনার মুভার রয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বর নাগাদ আরও ১৯টি যন্ত্রপাতি যুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে। নতুন চারটি যুক্ত হওয়ায় বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে কি গ্যান্ট্রি ক্রেনের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮টি। আর রাবার-টায়ারড গ্যান্ট্রি ক্রেনের সংখ্যা উন্নীত হয়েছে ৪৯টিতে।

বর্তমান যুদ্ধকালীন সংকটের অব্যবহিত পূর্বে বাংলাদেশ থেকে সরাসরি ইউরোপে পণ্য পরিবহন চালু হয়। আর এই উদ্যোগে অগ্রণী ভূমিকা ছিল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের। ফেব্রুয়ারিতে ইতালির রেভেনা বন্দরের উদ্দেশে কনটেইনার জাহাজ এমভি সোঙ্গা চিতার যাত্রা করাটা বাংলাদেশের সমুদ্র পরিবহন খাতে নতুন এক যুগের সূচনা করেছে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে ইউরোপের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রপথে নতুন এক বাণিজ্য রুট উন্মুক্ত হলো। দেশের রপ্তানিকারকরা এখন কলম্বো, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও অন্যান্য ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর এড়িয়ে সরাসরি ইউরোপে পণ্য পাঠানোর সুযোগ পাচ্ছেন।

জাহাজশূন্য ইউক্রেনের মারিউপোল বন্দর। ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর পর আজোভ সাগরের তীরবর্তী এই বন্দরসহ দেশটির সব সমুদ্রবন্দরের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। অবশ্য জুলাইয়ে মানবিক করিডোর চালুর পর কৃষ্ণসাগরীয় কয়েকটি বন্দর দিয়ে খাদ্যশস্য পরিবহন হচ্ছে

১৯৭৭ সালে কনটেইনার পরিবহন শুরুর পর এটাই কোনো কনটেইনারবাহী জাহাজের চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ইউরোপের পথে প্রথম সরাসরি যাত্রা। অর্থাৎ কনটেইনার পরিবহন শুরুর ৪৫ বছর পর বাংলাদেশ থেকে ইউরোপের কোনো বন্দরে সরাসরি গেছে এমভি সোঙ্গা চিতা। জাহাজটিতে করে ৯৫২ একক কনটেইনারে তৈরি পোশাক পাঠানো হয় ১২ হাজার ১৪৫ কিলোমিটার দূরের দেশ ইতালিতে। সোঙ্গা চিতা কর্ণফুলী ছেড়ে বঙ্গোপসাগর হয়ে শ্রীলংকার হাম্বানটোটা বন্দরের সামনে দিয়ে গেছে। এরপর আরব সাগর, ভারত মহাসাগর, এডেন উপসাগর, লোহিত সাগর, সুয়েজ খাল ও ভূমধ্যসাগর হয়ে পৌঁছেছে ইতালির রেভেনা বন্দরে।

সোঙ্গা চিতার হাত ধরে যে ঐতিহাসিক যাত্রার সূচনা, তার ধারাবাহিকতায় সাম্প্রতিক সময়ে আরও দুটি সরাসরি কনটেইনার শিপিং সার্ভিস চালু হয়েছে চট্টগ্রাম ও ইউরোপীয় বন্দরের মধ্যে। এছাড়া ইইউর আরও কয়েকটি গন্তব্যে এই সার্ভিস চালুর বিষয়েও কাজ চলছে।

সুইজারল্যান্ডভিত্তিক মেরিটাইম লজিস্টিকস সেবাদাতা কমোডিটি সাপ্লাইজ এজি সম্প্রতি ভাড়াকৃত তিনটি জাহাজ দিয়ে ইউরোপের সঙ্গে সরাসরি শিপিং সার্ভিস চালু করেছে। এমভি স্পাইসা, এমভি অ্যান্ড্রোমেডা জে ও এমভি মিউজিক নামের জাহাজ তিনটি পরিচালিত হচ্ছে স্পেনের বার্সেলোনা থেকে। এগুলো চট্টগ্রাম বন্দরে এসে রপ্তানিমুখী পণ্যের কনটেইনার নিয়ে নেদারল্যান্ডসের রটারডাম বন্দরের উদ্দেশে যাত্রা করছে।

মূল্যস্ফীতির চাপ নিয়ন্ত্রণে কয়েক দশকের ধারা ভেঙে সুদের হার বাড়িয়েছে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ। আর্থিক বাজারের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ার আশঙ্কা সত্তেও এ ধরনের স্বভাববিরুদ্ধ পদক্ষেপ নিতে পারে আরও কয়েকটি দেশ

এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত, পর্তুগালসহ কয়েকটি দেশের বন্দরসমূহ এরই মধ্যে চট্টগ্রামের সঙ্গে সরাসরি শিপিং সার্ভিস চালুর বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে। এসবের পাশাপাশি চলতি বছরের এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি নতুন কনটেইনার শিপিং সার্ভিস চালু হয়েছে। সাপ্তাহিক এই সার্ভিসটি চালু করেছে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আন্তর্জাতিক শিপিং কোম্পানি এমএসসি। ‘বেঙ্গল সার্ভিস’ নামের এই সেবা চট্টগ্রাম বন্দর ও চীনের দক্ষিণাঞ্চলীয় বন্দরগুলোর মধ্যে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করবে। এতে করে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য নতুন গতি লাভ করবে বলে আশা করা হচ্ছে। বেঙ্গল সার্ভিসে জাহাজগুলো প্রথমে হংকং থেকে দক্ষিণ চীনের ইয়ানতিয়ান ও শেকোউ বন্দরে যাবে। সেখান থেকে সিঙ্গাপুর ও তেনজুং পেলেপাস হয়ে চট্টগ্রামে আসবে জাহাজগুলো।

সরাসরি শিপিং সার্ভিস চালুর ফলে রপ্তানি গন্তব্যে পণ্য পাঠাতে সময় অনেক কম লাগবে। এতে করে সময় ও ব্যয় দুটোই সাশ্রয় হবে। এছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক শিপিং খাতে যেসব প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে, সেগুলোও এড়ানো সম্ভব হবে। এক কথায়, কেবল এই একটি দূরদর্শী পরিকল্পনা ও উদ্যোগের কারণে বিভিন্নভাবে উপকৃত হবেন বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য খাত।

অবরুদ্ধ সমুদ্র পরিবহন

যুদ্ধের শুরুতেই ইউক্রেনের আজোভ সাগর ও কৃষ্ণ সাগরীয় বন্দরগুলো অবরুদ্ধ হয়ে যায়। খাদ্যশস্যের বড় জোগানদাতা ইউক্রেনের বন্দরগুলোয় এ সময় অবস্থান করছিল শতাধিক জাহাজ ও সহস্রাধিক নাবিক। বন্দর চ্যানেলে ভাসমান মাইন ছড়িয়ে পড়া, জাহাজে গোলাবর্ষণের কয়েকটি ঘটনা ইত্যাদি কারণে জাহাজগুলো ইউক্রেনের বন্দর ছাড়তেও পারছিল না। সে সময় অলভিয়া বন্দর চ্যানেলে নোঙর করা অবস্থায় রকেট হামলার শিকার হয় বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের জাহাজ ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’। ওই ঘটনায় জাহাজটির সামনের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং জাহাজটিতে কর্মরত থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমান মারা যান। পরে জাহাজটির ২৮ জন নাবিককে নিরাপদে সরিয়ে রোমানিয়ায় নেওয়া হয়। আটদিন পর ১০ মার্চ তারা নিরাপদে বাংলাদেশে ফেরেন।

বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে আটকা পড়া জাহাজগুলোর কিছু নাবিককে স্থলপথে ইউক্রেন থেকে সরিয়ে নেওয়া গেলেও অনেকেই সেখানে আটকা পড়েন। এতে করে সেসব নাবিকদের সুরক্ষা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়, যার জেরে বিষয়টি নিয়ে বিশেষ কাউন্সিল সেশনের আয়োজন করতে বাধ্য হয় ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (আইএমও)। শুধু যে ইউক্রেনে আটকা পড়া নাবিকদের নিয়েই দুশ্চিন্তা রয়েছে, তা নয়। বরং কৃষ্ণ সাগর হয়ে রাশিয়া, রোমানিয়ার বন্দরগুলোর উদ্দেশে চলাচলকারী জাহাজগুলোর নাবিকদের নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে।

নাবিকরা একদিকে যেমন নিজেদের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন, তেমনই তাদের পরিবারের সুরক্ষা নিয়েও উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন। এসব কারণে নাবিকদের প্রসন্নতার সূচকে নিম্নমুখী যে প্রবণতা আগে থেকেই চলে আসছিল, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর তা আরও পতনমুখী হয়।

এদিকে ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসন চালানোর অভিযোগে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র। পরবর্তীতে রুশ-সংশ্লিষ্টতা থাকা জাহাজগুলোর পোর্ট কলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ ইউরোপের শীর্ষ বন্দরগুলো। এতে সব জায়গায় পণ্য পরিবহন করতে পারবে, বৈশ্বিক বহরে এমন জাহাজের সংখ্যা কমে যায়। সবচেয়ে বিপাকে পড়ে জ্বালানি রপ্তানিকারকরা। অনেক অয়েল ট্যাংকারের হয় মালিকানা অথবা নিবন্ধনের মাধ্যমে রুশ-সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। নিষেধাজ্ঞার ফলে অনেক রপ্তানিকারক এসব ট্যাংকার ব্যবহার করতে পারছে না। ফলে জ্বালানি পরিবহন ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

যেসব বাল্কার জাহাজ ইউক্রেনে খাদ্যশস্য নিতে গিয়ে আটকা পড়েছে, সেগুলো আর বৈশ্বিক বহরে যুক্ত হতে পারছিল না। সাম্প্রতিক সময়ে মানবিক করিডোর চালু হওয়ার পর ইউক্রেনের কৃষ্ণ সাগরীয় বন্দরগুলো কিছুটা সচল হলেও পরিস্থিতি এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। রাশিয়া ও ইউক্রেনের যেসব নাগরিক বৈশ্বিক বহরের বিভিন্ন জাহাজে সেবা দিয়ে থাকেন,  তাদের নিরাপত্তা নিয়ে রয়েছে উদ্বেগ। রুশ-সংশ্লিষ্টতা থাকা জাহাজগুলো ইউরোপ-আমেরিকার বন্দর ব্যবহারের সুযোগ না পাওয়ায় তুলনামূলক দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে রপ্তানি গন্তব্যের উদ্দেশে যেতে হচ্ছে। এতে সময় ও ব্যয় দুটোই বেড়েছে। এসব প্রেক্ষাপটে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক শিপিং খাতকে ভয়ানক সংকটের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে।

বৈশ্বিক অর্থনীতিতে প্রভাব

সামগ্রিক অর্থনীতিতে চাপ: আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে বিশ্ব অর্থনীতির গতিপ্রকৃতির। বাণিজ্যের গতি শ্লথ হলে বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিও কমে যাবে। বিষয়টি উপলব্ধি করে বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়েছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডবিউটিও)। আগের পূর্বাভাসে সংস্থাটি জানিয়েছিল, চলতি বছর বিশ্ব অর্থনীতিতে ৪ দশমিক ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখা যেতে পারে। তবে এখন তারা বলছে এই হার ২ দশমিক ৫ শতাংশে সীমাবদ্ধ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। সংস্থাটি আরও ধারণা করছে, যুদ্ধকালীন সংকটের কারণে মধ্যম মেয়াদে বিশ্বে মূল্যস্ফীতির চাপ অব্যাহত থাকবে।

পূর্বাভাসে ডবিউটিওর অভিমত, করোনার কারণে বিশ^ব্যাপী সরবরাহ ব্যবস্থায় যে সংকট দেখা দিয়েছিল, তা চলমান থাকবে। খাদ্য সরবরাহে বিঘ্ন ঘটায় খাদ্যপণ্যের দাম আরও বাড়বে। বিশ্বে খাদ্যপণ্য সংকটের সময় ঘনিয়ে এসেছে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, ভঙ্গুর অর্থনীতির মধ্যে এই যুদ্ধ মূল্যস্ফীতিকে ত্বরান্বিত করবে, আর্থিক বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলবে এবং ইউরোপীয় গ্রাহক থেকে শুরু করে আফ্রিকার দরিদ্র পরিবারগুলোকে উচ্চ খাদ্যমূল্যের চাপে ফেলে দেবে। এরই মধ্যে নানা অনিশ্চয়তার শঙ্কায় জ্বালানির দাম নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।

বিশ্বের অন্যতম শস্যভাণ্ডার ইউক্রেনের বন্দরগুলোর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেখান থেকে খাদ্যশস্য রপ্তানিও বন্ধ হয়ে যায়। এতে বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা বিপর্যস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়

কিছু বিশ্লেষক অবশ্য মনে করছেন, এই সংকট হয়তো করোনার মতো বৈশ্বিক মন্দার কারণ হয়ে দাঁড়াবে না। কারণ বৈশ্বিক জিডিপিতে এই দুই দেশের অবদান ২ শতাংশের কম। এছাড়া অনেক আঞ্চলিক অর্থনীতি কোভিডের বিপর্যয় কাটিয়ে শক্ত অবস্থানে রয়েছে। তবে তারা বলছেন, যুদ্ধের প্রভাব নিশ্চিতভাবেই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়বে। এরই মধ্যে কিছু দেশের অর্থনীতি ও শিল্পের ওপর মারাত্মক ক্ষতির ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

সাপ্লাই চেইনের জন্য নতুন প্রতিবন্ধকতা: গত বছর করোনার মন্দাভাব কাটিয়ে আকাশচুম্বী হতে শুরু করে ভোক্তা চাহিদা। এই চাহিদা মোকাবিলা করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে সরবরাহকারী ও শিপিং  খাতসংশ্লিষ্টদের। বিভিন্ন উদ্যোগের কারণে গতিশীল হতে শুরু করলেও সাপ্লাই চেইনের জট এখনো পুরোপুরি কাটেনি। এমনই এক অবস্থায় ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া। এই ঘটনা বিশ্বজুড়ে বিদ্যমান জট আরও ঘনীভূত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করেছে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা।

খাদ্যনিরাপত্তা সংকট: রাশিয়া বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম জ্বালানি তেল উৎপাদনকারী ও প্রাকৃতিক গ্যাসের অন্যতম শীর্ষ রপ্তানিকারক। অন্যদিকে ইউক্রেনের খামারগুলো বিশ্বের লাখ লাখ মানুষের খাদ্যের জোগান দেয়।

বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম গম রপ্তানিকারক দেশ হলো ইউক্রেন। কিছু দেশ এই গমের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। যেমন লেবাননের প্রায় ৫০ শতাংশ, লিবিয়ার প্রায় ৪৩ ও ইয়েমেনের ২২ শতাংশ গমের চাহিদা পূরণ হয় ইউক্রেন থেকে আমদানির মাধ্যমে।

যুদ্ধ শুরুর পর পূর্ব ইউক্রেনের খামারগুলোর জন্য যে হুমকি তৈরি হয়েছে, সেটি এবং কৃষ্ণসাগরের বন্দরগুলোর মাধ্যমে রপ্তানিতে তৈরি হওয়া প্রতিবন্ধকতা বিশ্ববাজারে গমের সরবরাহ কমিয়ে দিতে পারে। এটি খুবই উদ্বেগজনক একটি বিষয়; বিশেষ করে এমন একসময়ে, যখন বিশ্বজুড়ে খাদ্যমূল্য ২০১১ সালের পর সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।

বাংলাদেশ থেকে ইতালি পর্যন্ত প্রথম সরাসরি শিপিং লাইনার সার্ভিস উদ্বোধন করছেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও দূরদর্শী পরিকল্পনায় বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে রপ্তানি পণ্য পরিবহনে গতিশীলতা অর্জন হয়েছে

অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার নিয়ে শঙ্কা: এমন একসময় এই অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হলো, যখন করোনা অতিমারির বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে বিশ্ব। কয়েকটি দেশের অর্থনীতি এরই মধ্যে করোনা-পূর্ব পর্যায়ে ফিরে এসেছে। তবে বিশ্বের আর্থিক বাজারগুলোও এখন কিছুটা অনিশ্চিত অবস্থানে রয়েছে। যেসব কেন্দ্রীয় ব্যাংক এতদিন সুদের হার রেকর্ড সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখার নীতি নিয়ে এগিয়েছে, তারাই এখন বাজার নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বাড়াতে শুরু করেছে। এই পদক্ষেপ ভোক্তা ব্যয়ের গতি কমিয়ে দিতে পারে। এই সংকটময় অবস্থা ইউরোপের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার গতি ধীর করে দিতে পারে।

জ্বালানির উচ্চমূল্যে উদ্বেগ: সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানির দাম কয়েক বছরের শীর্ষে পৌঁছেছে। স্পট মার্কেটে ২০২১ সালের মার্চে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দর ছিল ব্যারেলপ্রতি ৬৫ ডলার ২ সেন্ট। এখন তা ১০০ ডলার ছুঁইছুঁই।

ইউরোপ বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারের অন্যতম আমদানিকারক অঞ্চল। আর এই আমদানির বড় একটি অংশ (প্রায় ৪০ শতাংশ) আসে রাশিয়া থেকে।  রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার অংশ হিসেবে দেশটি থেকে জ্বালানি আমদানি সীমিত করেছে ইউরোপ। এর ফলে সেখানকার সার উৎপাদনকারী ও অন্যান্য ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো উৎপাদন কমাতে বাধ্য হয়েছে।

মাথাব্যথার কারণ মূল্যস্ফীতি: জ্বালানি মূল্যের সঙ্গে ভোক্তাবাজারের আরও অনেক পণ্যের মূল্য প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কযুক্ত। এ কারণে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় সারা বিশে^ই মূল্যস্ফীতির চাপ বেড়েছে। বিশেষ করে ইউরোপীয় দেশগুলোর জন্য মূল্যস্ফীতির সংকট চরমে পর্যায়ে পৌঁছেছে। অবশ্য অঞ্চলটিকে আগে থেকেই এই সংকটের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। জানুয়ারিতে ইউরো মুদ্রা ব্যবহারকারী ১৯টি দেশে বার্ষিক মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত হয়, যা ১৯৯৭ সালে মূল্যস্ফীতি হারের হিসাব সংরক্ষণ শুরু করার পর সর্বোচ্চ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান সংকট বিশ্ব অর্থনীতির দুটি প্রধান ভিত্তিতে ঝুঁকি তৈরি করেছে। এগুলো হলো ভোক্তা ব্যয় ও শিল্পোৎপাদন। জ্বালানির ঊর্ধ্বগতি ধনী দেশগুলোর বার্ষিক মূল্যস্ফীতিতে ২ শতাংশীয় পয়েন্ট যুক্ত করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রাম বন্দরে যুক্ত হয়েছে সার্ভিস জেটি। মাননীয় নৌপ্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী জেটিটি উদ্বোধন করেন

উপসংহার

যুদ্ধ-সংঘাত কখনই মঙ্গল বয়ে আনে না। বরং তা মানবসভ্যতা, বৈশ্বিক অর্থনীতি, বিশ্ববাণিজ্য, খাদ্যনিরাপত্তা, সরবরাহ শৃঙ্খলা সবকিছুর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তা কেবল যুদ্ধরত দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। বিশ্বায়নের কারণে এই দ্বন্দ্বের রেশ ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। বর্তমানেও তাই ঘটেছে। বিশেষ করে খাদ্যশস্য ও জ্বালানির বৈশ্বিক বাজারের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হওয়ার কারণে ইউক্রেনের বন্দরগুলোর অবরুদ্ধ হয়ে পড়া এবং রাশিয়ার আর্থিক ও রপ্তানি খাতের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রভাব পড়েছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর জন্য পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ আমদানিনির্ভর এসব দেশের জন্য হঠাৎ করে বিকল্প উৎস থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় খুচরা, জ্বালানি ও খাদ্যপণ্য আমদানির ব্যবস্থা করাটা সহজ কোনো বিষয় নয়।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের মোট চাহিদার বেশিরভাগই পূরণ হয় আমদানির মাধ্যমে। ফলে বাংলাদেশকেও এই সংকটের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এছাড়া দেশের শিল্পোৎপাদিত পণ্যগুলোর প্রধান রপ্তানি গন্তব্য যেসব দেশ, সেসব দেশকেও বিভিন্ন সংকটের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। যুক্তরাজ্য অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রেও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদের হার বৃদ্ধির প্রভাবে ভোক্তাব্যয় পড়তির দিকে। ইউরোপের বাকি দেশগুলোও জ্বালানি নিরাপত্তা নিয়ে বাড়তি চিন্তা করতে হচ্ছে। ফলে ভোক্তাব্যয়ে লাগাম টানার প্রবণতা রয়েছে এসব দেশেও। তার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতেও।

নতুন নতুন গ্যান্ট্রি ক্রেন, কনটেইনার মুভার ইত্যাদি যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম যুক্ত করার মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়নে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান

এই সংকট থেকে উত্তরণে আমদানি-রপ্তানিকে বাড়তি কিছু সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। এতে করে বৈশ্বিক অস্থিতিশীলতার কারণে যে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে, তা থেকে উত্তরণের জন্য কিছুটা প্রণোদনা মিলবে। বাংলাদেশ সরকার বাজেট সহায়তাসহ অন্যান্য সহায়ক নীতিগত পদক্ষেপের মাধ্যমে সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের প্রধান গেটওয়ে চট্টগ্রাম বন্দরও বৈদেশিক বাণিজ্যের চাকা সচল রাখার স্বার্থে বিভিন্ন সহায়ক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ইতিবাচক যে পদক্ষেপ বন্দর কর্তৃপক্ষ নিয়েছে, সেটি হলো ইউরোপ ও চীনের সঙ্গে সরাসরি শিপিং সার্ভিস চালুর অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া। এর ফলে অবরোধকৃত ও অনিরাপদ অঞ্চল এড়িয়ে বাণিজ্য সচল রাখার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here