বিশ্বের ১০ বৃহদাকার জাহাজ

পণ্য ও যাত্রী পরিবহন, প্রমোদ শিল্প, অফশোর ড্রিলিং, সামুদ্রিক গবেষণা, সমুদ্র প্রতিরক্ষা-সব খাতেই জাহাজের বহর ক্রমবর্ধিষ্ণু। পাশাপাশি পণ্য পরিবহন ও প্রমোদ শিল্পে বৃহদাকার জাহাজের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনের জট খুলতে বর্তমানে শিপিং অপারেটররা একসঙ্গে বেশি সংখ্যক কনটেইনার পরিবহনের দিকে ঝুঁকছেন। ফলশ্রুতিতে সাম্প্রতিক সময়ে ২৪ হাজার টিইইউ কনটেইনার ধারণক্ষমতার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জাহাজ নির্মাণের কার্যাদেশ পেয়েছে শিপইয়ার্ডগুলো। একই সঙ্গে নির্মাণ করা হচ্ছে দানবাকৃতির সব বাল্ক ক্যারিয়ার ও অয়েল ট্যাংকার। আর প্রমোদতরীগুলোকে যেন বিনোদনের একেকটি রাজ্য হিসেবে গড়ে তুলছে ক্রুজ অপারেটররা। ফলে এগুলো বিশালতার দিক থেকে প্রতিনিয়ত একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে। আকার-আকৃতির শ্রেষ্ঠত্বে তাক লাগিয়ে দেওয়া ১০টি জাহাজ সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক-

১. ওয়ান্ডার অব দ্য সিজ

রয়েল ক্যারিবিয়ান ইন্টারন্যাশনালের। দানবীয় ক্রুজ শিপ ওয়ান্ডার অব দ্য সিজ। তাদের ওয়েসিস ক্লাসের পঞ্চম এই প্রমোদতরীটি চলতি বছর বাণিজ্যিক সেবা শুরু করেছে। ওয়ান্ডার অব দ্য সিজ গ্রস টনেজের দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রমোদতরী। ২ লাখ ৩৬ হাজার ৮৫৭ গ্রস টনের জাহাজটি ৩৬২ মিটার দীর্ঘ। এর মোট ১৮টি ডেকের মধ্যে ১৬টিতে রয়েছে ২০টি রেস্তোরাঁ, চারটি পুল ও ২ হাজার ৮৬৭টি কেবিন।

সর্বোচ্চ ৬ হাজার ৯৮৮ জন যাত্রী ও ২ হাজার ৩০০ ক্রু পরিবহনে সক্ষম জাহাজটি যেন ভাসমান এক বিনোদনজগৎ। কী নেই এতে? শিশুদের জন্য ওয়াটার পার্ক, খেলার মাঠ, পূর্ণ আকৃতির বাস্কেটবল কোর্ট, আইস-স্কেটিং রিংক, সার্ফ সিম্যুলেটর, ১০টি ডেকের সমান উচ্চতার জিপ লাইন, ১ হাজার ৪০০ আসনের থিয়েটার, ৩০ ফুট উচ্চতার প্লাটফর্মবিশিষ্ট আউটডোর অ্যাকোয়াটিক থিয়েটার, ৪৩ ফুট উচ্চতার দুটি রক-ক্লাইম্বিং ওয়াল-অনবোর্ড বিনোদনের জন্য যা যা থাকা সম্ভব, তার সবই রয়েছে ওয়ান্ডার অব দ্য সিতে।

আরও একটি বিশেষ আকর্ষণ রয়েছে ওয়ান্ডার অব দ্য ওয়ার্ল্ডে-সেন্ট্রাল পার্ক। ১০ হাজারের বেশি প্রাকৃতিক গাছ লাগানো রয়েছে সেখানে। রয়েল ক্যারিবিয়ানের ওয়েসিস ক্লাসের সব প্রমোদতরীতেই এই সেন্ট্রাল পার্ক রয়েছে।

২. এভার অ্যালট

বর্তমানে ধারণক্ষমতার বিচারে বিশ্বের বৃহত্তম কনটেইনার জাহাজ হলো এভার অ্যালট। চীনা জাহাজনির্মাতা হুডং-ঝংহুয়া শিপবিল্ডিং (গ্রুপ) কোম্পানি লিমিটেডের তৈরি করা জাহাজটির মালিক তাইওয়ানভিত্তিক শিপিং কোম্পানি এভারগ্রিন মেরিন। তাদের এ-ক্লাসের সপ্তম মেগাশিপটির কনটেইনার পরিবহন ক্ষমতা ২৪ হাজার ৪ টিইইউ। এই প্রথম কোনো কনটেইনার জাহাজ ২৪ হাজার টিইইউর মাইলফলক পেরোলো। জাহাজটির গ্রস টনেজ ২ লাখ ৩০ হাজার ৭৫৭। দৈর্ঘ্য ৪০০ মিটার।

মোট ১৩টি এ-ক্লাস আল্ট্রা-লার্জ কনটেইনার জাহাজ বহরে যোগ করার পরিকল্পনা রয়েছে এভারগ্রিনের। এভার অ্যালোট এর মধ্যে সপ্তম জাহাজ। এর আগে ছয়টি মেগাশিপ যোগ হয়েছে তাদের বহরে। সবগুলোর ধারণক্ষমতাই ২৪ হাজার টিইইউর কিছুটা কম।

হুডং-ঝংহুয়া শিপবিল্ডিং (গ্রুপ) কোম্পানি লিমিটেডের তৈরি করা এ-ক্লাসের সপ্তম মেগাশিপ এভার অ্যালট

৩. এভার এইস

এভার অ্যালট চলতি বছর যে তকমা অর্জন করেছে, এভার এইস তা পেয়েছিল গত বছর। অর্থাৎ বিশে^র বৃহত্তম কনটেইনার জাহাজের পরিচিতি খুব বেশিদিন দখলে রাখতে পারেনি এভারগ্রিন মেরিনের এ-ক্লাসের জাহাজটি। এতেই বোঝা যাচ্ছে, বৃহদাকার মেগাশিপ নিজেদের বহরের যোগ করার ওপর কতটা জোর দিয়েছে শিপিং কোম্পানিগুলো।

২ লাখ ৩৫ হাজার ৫৭৯ গ্রস টনের এভার এইসের দৈর্ঘ্য ৪০০ মিটার। এর কনটেইনার ধারণক্ষমতা ২৩ হাজার ৯৯২ টিইইউ। জাহাজটি পানামার পতাকাবাহী।

এভারগ্রিন মেরিনের এ-ক্লাসের জাহাজ এভার এইস

৪. এইচএমএম আলজেসিরাস

এটি আরেকটি মেগা কনটেইনার শিপ। আলজেসিরাসের মালিক দক্ষিণ কোরীয় শিপিং কোম্পানি এইচএমএম কোম্পানি লিমিটেড। ৪০০ মিটার দীর্ঘ জাহাজটির গ্রস টনেজ ২ লাখ ২৮ হাজার ২৮৩ টন। এর ধারণক্ষমতা ২৩ হাজার ৯৬৪ টিইইউ। ২০২০ সালে জাহাজটি বাণিজ্যিক সেবা শুরু করে। সে সময় এটি বিশ্বের বৃহত্তম কনটেইনার জাহাজের মর্যাদা পেয়েছিল। পরে এভার এইসের কাছে অবস্থান হারায় আলজেসিরাস।

পানামার পতাকাবাহী আলজেসিরাস নির্মাণ করেছে দক্ষিণ কোরিয়ার দাইয়ু শিপবিল্ডিং অ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং। এইচএমএমের আলজেসিরাস ক্লাসের লিড শিপ এটি। এছাড়া এই ক্লাসের আরও ছয়টি জাহাজ দাইয়ু এবং পাঁচটি জাহাজ স্যামসাং হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ নির্মাণ করেছে।

এইচএমএম কোম্পানি লিমিটেডের আলজেসিরাস ক্লাসের লিড শিপ এইচএমএম আলজেসিরাস

৫. সিম্ফনি অব দ্য সিজ

ওয়ান্ডার অব দ্য সিজ যাকে সরিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম প্রমোদতরীর জায়গা দখল করে নিয়েছে, তার নাম সিম্ফনি অব দ্য সিজ। রয়েল ক্যারিবিয়ানের ওয়েসিস ক্লাসের চতুর্থ ও সব মিলিয়ে ২৫তম প্রমোদতরী এটি। দানবাকৃতির জাহাজটির গ্রস টনেজ ২ লাখ ২৮ হাজার ৮১ টন। এতে রয়েছে মোট ১৮টি ডেক। এর মধ্যে অতিথিদের জন্য ১৬টি ডেকে রয়েছে ২ হাজার ৭৫৯টি কেবিন, ২২টি রেস্তোরাঁ ও চারটি পুল। এছাড়া ওয়ান্ডার অব দ্য সিতে যেসব বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে, সেগুলোর প্রায় সবই রয়েছে সিম্ফনিতে।

২০১৮ সালে প্রথম বাণিজ্যিক যাত্রা করে সিম্ফনি অব দ্য সিজ। খুব দ্রুত এটি অবকাশপ্রেমীদের কাছে আকর্ষণীয় গন্তব্যে পরিণত হয়। তবে ২০২০ সালে নভেল করোনাভাইরাস মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার পর স্থবির হয়ে পড়ে বৈশ্বিক পর্যটন ও ভ্রমণ খাত। স্বাভাবিকভাবে ক্রুজ শিল্পকেও এই ধাক্কা খেতে হয়েছে। সেই সংকটকালে অন্য সব প্রমোদতরীর মতো সিম্ফনির রোশনাইও নিভে গিয়েছিল। অবশ্য ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে ক্রুজ শিল্প। একই সঙ্গে অবকাশপ্রেমীদের কোলাহলে মুখর হয়ে উঠেছে সিম্ফনি অব দ্য সিজ।

রয়েল ক্যারিবিয়ানের ওয়েসিস ক্লাসের চতুর্থ ও সব মিলিয়ে ২৫তম প্রমোদতরী সিম্ফনি অব দ্য সিজ

৬. হারমোনি অব দ্য সিজ

ক্রুজ শিল্পে রয়েল ক্যারিবিয়ানের শ্রেষ্ঠত্বের আরেকটি নিদর্শন হলো হারমোনি অব দ্য সিজ। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম প্রমোদতরীটিও তাদের ওয়েসিস ক্লাসের। জাহাজটির প্রথম বাণিজ্যিক যাত্রা ২০১৬ সালে। এর গ্রস টনেজ ২ লাখ ২৬ হাজার ৯৬৩ টন এবং দৈর্ঘ্য ৩৬২ মিটার। ২ হাজার ৭৪৭ কেবিনের জাহাজটি ৫ হাজার ৪৭৯ জন যাত্রী পরিবহন করতে পারে।

ওয়েসিস ক্লাসের অন্য জাহাজগুলোর মতো হারমোনিতেও রয়েছে সেন্ট্রাল পার্ক ও ব্রডওয়াক। আরও রয়েছে লার্জ ড্রাই স্লাইড কমপ্লেক্স, দুটি সার্ফ সিম্যুলেটর, তিনটি ওয়াটার স্লাইড ও তিনটি সুইমিং পুল। রয়েল ক্যারিবিয়ানের প্রমোদতরীতে প্রথম ওয়াটার স্লাইডের দেখা মেলে এই হারমোনিতেই। ২০টি ডাইনিং ভেন্যু, একটি ১ হাজার ৪০০ সিটের থিয়েটার ও ১১ হাজার ২৫২টি শিল্পকর্ম বিশালাকার প্রমোদতরীটির আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম প্রমোদতরীটি রয়েল ক্যারিবিয়ানের ওয়েসিস ক্লাসের হারমোনি অব দ্য সিজ

৭. অ্যাল্যুর অব দ্য সিজ

রয়েল ক্যারিবিয়ানের ওয়েসিস ক্লাসের আরেকটি বিশালাকার প্রমোদতরী হলো অ্যাল্যুর অব দ্য সিজ। এটি তুলনামূলক পুরনো একটি ক্রুজ শিপ। ২০১০ সালে বাণিজ্যিক সেবা শুরু করে এটি। সে সময় বিশ্বের বৃহত্তম ক্রুজ শিপের তকমা দখল করে জাহাজটি। ২০১৬ সালে হারমোনি অব দ্য সিজের কাছে অবস্থানটি হারায় তারা।

৩৬২ মিটার দীর্ঘ জাহাজটির গ্রস টনেজ ২ লাখ ২৫ হাজার ২৮২ টন। ওয়েসিস ক্লাসের প্রথম জাহাজ ওয়েসিস অব দ্য সিজ ও অ্যাল্যুর বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে সমপর্যায়ের। তবে ওয়েসিসের চেয়ে অ্যাল্যুর দৈর্ঘ্যে মাত্র ৫০ মিলিমিটার বেশি ছিল।

রয়েল ক্যারিবিয়ানের ওয়েসিস ক্লাসের বিশালাকার ক্রুজ শিপ অ্যাল্যুর অব দ্য সিজ

৮. কোস্তা স্মেরালদা

কার্নিভাল করপোরেশনের সাবসিডিয়ারি কোস্তা ক্রুজেস পরিচালিত বিশালাকার একটি প্রমোদতরী হলো কোস্তা স্মেরালদা। এর দৈর্ঘ্য ৩৩৭ মিটার। গ্রস টনেজ ১ লাখ ৮৫ হাজার ১০ টন। এক সাথে ৬ হাজার ৫৫৪ যাত্রী ও ১ হাজার ৬৪৬ ক্রু পরিবহন করতে পারে জাহাজটি। ২০১৯ সালে প্রথম বাণিজ্যিক সেবা শুরু করে এটি।

করোনার ধাক্কা কাটিয়ে তিনটি ইনোভেটিভ ক্রুজ শিপ নিয়ে নিজেদের ফিরে পাওয়ার পরিকল্পনা সাজিয়েছে কোস্তা ক্রুজেস। স্মেরালদা তার একটি। বাকি দুটি হলো কোস্তা ফিরেঞ্জা ও কোস্তা তোসানা। তিনটি জাহাজকেই গড়ে তোলা হয়েছে একেকটি স্মার্ট ফ্লোটিং সিটি হিসেবে, যার কারণে সেগুলো দর্শকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।

কার্নিভাল করপোরেশনের সাবসিডিয়ারি কোস্তা ক্রুজেস পরিচালিত বিশালাকার একটি প্রমোদতরী হলো কোস্তা স্মেরালদা

৯. এমএস আইওনা

যুক্তরাজ্যভিত্তিক পিঅ্যান্ডও ক্রুজেস পরিচালিত ১ লাখ ৮৪ হাজার ৮৯ গ্রস টনেজের প্রমোদতরী এমএস আইওনা। এটিও কার্নিভাল করপোরেশনের একটি সাবসিডিয়ারি। গত বছর বাণিজ্যিক সেবা শুরু করা জাহাজটির দৈর্ঘ্য ৩৪৫ মিটার। মোট ১৮টি ডেকের জাহাজটিতে রেস্তোরাঁ, সুইমিং পুল, স্কাইডোম, ওয়ার্লপুলসহ বিনোদনের বিভিন্ন ব্যবস্থা রয়েছে।

পিঅ্যান্ডওর সবচেয়ে বড় ক্রুজ শিপ আইওনা। এলএনজি-চালিত জাহাজটি ২০২০ সালের মে মাসে বাণিজ্যিকভাবে যাত্রা করার কথা ছিল। তবে করোনা মহামারি সেই পরিকল্পনা ভেস্তে দেয়। ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত জাহাজটির হস্তান্তর কার্যক্রম স্থগিত করা হয়।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক পিঅ্যান্ডও ক্রুজেস পরিচালিত ১ লাখ ৮৪ হাজার ৮৯ গ্রস টনেজের প্রমোদতরী এমএস আইওনা

১০. ইনডিপেনডেন্স অব দ্য সিজ

এই জাহাজটির মালিকও রয়েল ক্যারিবিয়ান। তবে এটি ফ্রিডম ক্লাসের প্রমোদতরী। জাহাজটির দৈর্ঘ্য ৩৩৯ মিটার। গভীরতা ৮ দশমিক ৫৩ মিটার। গ্রস টনেজ ১ লাখ ৫৫ হাজার ৮৮৯ টন। যাত্রীদের জন্য এতে ডেক রয়েছে ১৫টি।

২০০৮ সালে প্রথম যাত্রা করে ইনডিপেনন্ডেন্স। ওয়েসিস ক্লাসের আবির্ভাবের আগে এটিই ছিল বিশ্বের বৃহত্তম প্রমোদতরী। ইন্টার‌্যাক্টিভ ওয়াটার পার্ক, শিশুদের জন্য নির্ধারিত ওয়াটার এরিয়া, থিয়েটার, আইস স্কেটিং রিংকসহ বিনোদনের বিভিন্ন ব্যবস্থা রয়েছে জাহাজটিতে। এটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল ৫৯ কোটি ডলার। ইনডিপেনন্ডেন্স অব দ্য সিতে রয়েছে ইন্টার‌্যাক্টিভ ওয়াটার পার্ক, শিশুদের জন্য নির্ধারিত ওয়াটার এরিয়া, আইস স্কেটিং রিংক, রক ক্লাইম্বিং ওয়ালসহ বিনোদনের অন্যান্য ব্যবস্থা।

রয়েল ক্যারিবিয়ানের ফ্রিডম ক্লাসের প্রমোদতরী ইনডিপেনেডেন্স অব দ্য সিজ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here