সমুদ্রশিল্পে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় নৌ-বিমা: জলবায়ু পরিবর্তন বদলে দিচ্ছে হালচাল

বৈশ্বিক আর্থিক সংস্কৃতিতে অন্যতম প্রাচীন একটি চর্চা হলো নৌ বিমা। বিশ্বায়নের যুগে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার হাতিয়ারটির ব্যবহার আরও বেড়েছে। দীর্ঘ সময়ের আবর্তে নৌ বিমা কাঠামোয় বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। চালু হয়েছে আন্তর্জাতিক আইন। বেড়েছে সুরক্ষা-ছায়ার বিস্তৃতি। শিগগিরই নৌ বিমা খাতে আরও কিছু পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা রয়েছে। আর সম্ভাব্য এই পরিবর্তনের নেপথ্যে রয়েছে শিপিং খাতে জ্বালানি রূপান্তর।

বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে উন্মেষ ঘটেছিল যে বিশ্বায়নের, একুশ শতকে এসে তা তুমুল গতি পেয়েছে। সংস্কৃতি থেকে শুরু করে অর্থনীতি-সবকিছুতেই এর প্রভাব আজ প্রকট। বিশেষ করে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি বিশ্বকে একটি শৃঙ্খলে আবদ্ধ করার পর অর্থনৈতিক কার্যক্রম আরও বেশি বিশ্বজনীন রূপ ধারণ করেছে। বাণিজ্য আজ আর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ গিতে আবদ্ধ নেই। একটি দেশের পণ্য এখন অন্য দেশের বাজারে আধিপত্য করতে পারছে এই বিশ্বায়নের প্রভাবেই।

বিশ^বাণিজ্যে মোট পণ্যের ৯০ শতাংশ পরিবহন হয় সমুদ্রপথে। ফলে ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের চাপও বেশি সামাল দিতে হচ্ছে সমুদ্র পরিবহন খাতকে। চাহিদা মেটাতে বৈশ্বিক বহরে জাহাজের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এছাড়া একটি শিপমেন্টে অধিক পরিমাণে বাণিজ্য পণ্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে একের পর এক মেগা কনটেইনার শিপ। সমুদ্রবন্দরগুলোয় কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের চাপ বেড়ে যাওয়ায় সেগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বন্দর থেকে পণ্য দ্রুত গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বাড়ানো হচ্ছে ইন্টারমোডাল কানেক্টিভিটি।

অবশ্য বিশ্ববাণিজ্য ও সমুদ্র পরিবহন খাতের গতি যে সবসময় সুষম থাকে, তা নয়। গত দুই-তিন বছরের হালচালের দিকে তাকালেই  বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ২০২০ সালের শুরুতে করোনা মহামারির ভয়াল থাবায় থমকে গিয়েছিল বিশ্ববাণিজ্য। মুখ থুবড়ে পড়েছিল সমুদ্র পরিবহন খাত। মোটা অংকের লোকসান গুনতে হয়েছিল স্টেকহোল্ডারদের। ঠিক পরের বছরই দেখা গেল মুদ্রার উল্টা পিঠ। হঠাৎ করেই চাঙ্গা হলো ভোক্তাবাজার। বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোয় খুচরা বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় চাপ তৈরি হলো সাপ্লাই চেইনে। বাড়তি চাহিদা সামাল দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হলো শিপিং খাতসংশ্লিষ্টদের। আগের বছর লোকসান করা কোম্পানিগুলো ২০২১ সালে দেখল আকর্ষণীয় মুনাফা।

মুনাফা-ক্ষতির এই উত্থান-পতন শিপিং অপারেটরদের জন্য একটি বড় ঝুঁকি। এছাড়া আরও কিছু ঝুঁকি মাথায় নিয়েই কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয় সমুদ্র পরিবহন খাতসংশ্লিষ্টদের। যেমন অননুমেয় গতিপ্রকৃতির সমুদ্রে চলাচল করতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের বিপদের মুখে পড়তে হয় জাহাজগুলোকে। উত্তাল সাগরে জাহাজডুবি, জাহাজ থেকে কনটেইনার সাগরে পড়ে যাওয়া, জাহাজে আগুন লেগে যাওয়া, জলদস্যুদের কবলে পড়া-এসব ঘটনা ঘটছে অহরহ। এছাড়া জাহাজ পৌঁছাতে বিলম্ব হওয়া, বন্দরে বার্থিংয়ের সুযোগ পেতে অপেক্ষমাণ থাকা, বন্দরে হ্যান্ডলিংয়ের সময় কার্গোর ক্ষয়ক্ষতি হওয়া, পণ্য হারিয়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণেও আর্থিক লোকসান গুনতে হয় উৎপাদক ও শিপিং অপারেটরদের।

এই যে এত ঝুঁকি নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করেই সচল রাখা হচ্ছে বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনকে, সেই ঝুঁকি প্রশমন করার জন্য যে টুলস কার্যকর ভূমিকা রাখে, সেটি হলো নৌ-বিমা। ক্ষয়ক্ষতি প্রশমনের এই নিশ্চয়তাটুকু না পেলে পাহাড়সম ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসা করা অনেকের জন্যই কঠিন হয়ে যেত।

বিভিন্ন দুর্ঘটনার ঝুঁকি থেকে সমুদ্র পরিবহন খাতকে সুরক্ষিত রাখার স্বার্থে নৌ-বিমার আধুনিক কাঠামোর প্রচলন হয়েছিল কয়েকশ বছর আগে। এই দীর্ঘ সময়ে বিমাসংশ্লিষ্ট অনেক ক্ষেত্রেই এসেছে পরিবর্তন। নিকট ভবিষ্যতে নৌ-বিমা খাতে আরেকটি বড় ধরনের পটপরিবর্তনের ধারণা করছেন বাজার বিশ্লেষকরা। আর এই পরিবর্তনে নিয়ামক ভূমিকা পালন করবে জলবায়ু পরিবর্তন।

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য জীবাশ্ম জালানির বেহিসাবি ব্যবহারকে দায়ী করা হয়। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের অন্যতম প্রধান কারণ এই জীবাশ্ম জ্বালানি। এ কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি মোকাবিলায় অন্য সব খাতের মতো সমুদ্র পরিবহন খাতেও পরিবেশবান্ধব জালানির ব্যবহারকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। আর এই পরিবেশবান্ধব জ্বালানিতে রূপান্তর প্রক্রিয়ায় কিছু অনাহূত ঝুঁকি রয়েছে। নৌ-বিমা খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে এই ঝুঁকিগুলোই।

সমুদ্র বাণিজ্যের সুরক্ষায় নৌ-বিমা

নৌ-বিমা হলো এক ধরনের সম্পত্তি বিমা। অর্থের মাধ্যমে পরিমাপযোগ্য কোনো সম্পত্তির সম্ভাব্য ক্ষতির জন্য যে বিমা করা হয়, তাকে সম্পত্তি বিমা বলে। নৌ-বিমা চুক্তি বিমাকারী ও বিমাগ্রহীতার মধ্যে সম্পাদিত এমন এক চুক্তি, যার মাধ্যমে সমুদ্রগামী জাহাজ ও জাহাজসংশ্লিষ্ট স্বার্থের কোনো ক্ষতির জন্য বিমাকারী চুক্তি অনুযায়ী ক্ষতিপূরণের দায়িত্ব গ্রহণ করে। নৌ-বিমা মূলত সামুদ্রিক বিপদজনিত ক্ষতির জন্য নির্ধারিত হলেও সমুদ্রপথে পরিবহনের উদ্দেশ্যে বন্দর পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য অভ্যন্তরীণ নৌপথ বা স্থলপথে পণ্য পরিবহন কার্যক্রমও এই বিমার আওতাভুক্ত। অর্থাৎ কেবল যে সাগরে অবস্থানকালে কোনো ক্ষতি হলেই সেটি নৌ-বিমার আওতাভুক্ত হবে, তা নয়। বরং পণ্য উৎপত্তিস্থল থেকে গ্রাহকের কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত এর কোনো ক্ষতি হলে সেটিও কভার করবে এই বিমা।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে নিরাপত্তাঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায় বিএসসির জাহাজ এমভি বাংলার সমৃদ্ধি ও এর ক্রুরা। একপর্যায়ে জাহাজটির ওপর রকেট হামলা হয়, যাতে প্রাণ হারান থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমান। (ইনসেটে) রকেট হামলার পর জ্বলছে বাংলার সমৃদ্ধি

নৌ-বিমা চর্চা শুরুর সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। বিশ শতকের একেবারে গোড়ার দিকে প্রত্নতাত্ত্বিকরা আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার বছরের পুরনো তিনটি লিপিখের সন্ধান পান। সেগুলোয় বিখ্যাত ব্যাবিলন শাসক হাম্মুরাবির কিছু আইন চিত্রলিপির মাধ্যমে উৎকীর্ণ রয়েছে। এই আইনগুলোর মধ্যে কয়েকটি ছিল সমুদ্র পরিবহন খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ঋণের দায়মুক্তির বিষয়ে। প্রাকৃতিক দুর্ঘটনা অথবা চুরি-জলদস্যুতার কারণে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে শিপিং এজেন্ট ও চার্টারারদের ঋণের কী পরিমাণ অংশ পরিশোধ করতে হবে, তা স্পষ্ট করে উল্লেখ ছিল সেই আইনে। এ থেকে ধারণা করা যায়, আর্থিক ঝুঁকি থেকে নৌ পরিবহন খাতকে সুরক্ষা দেওয়ার চর্চা কয়েক হাজার বছর আগেই শুরু হয়েছিল।

মধ্যযুগে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে পুরনো ও কাঠামোবদ্ধ চর্চা দেখা যায় মেরিন লোন, কমেন্ডা কন্ট্রাক্ট ও বিল অব এক্সচেঞ্জ আকারে। চতুর্দশ শতকে ইতালির বিভিন্ন শহরে নৌ-বিমার উন্মেষ ঘটে ও তা পরে উত্তর ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৫৩ সালে ইতালির জেনোয়ার নিকটবর্তী গ্রাম ক্যামোলিতে মেরিন ইন্স্যুরেন্স কন্ট্রাক্টের প্রচলন হয়। অবশ্য আধুনিক নৌ-বিমা ধারণার সূতিকাগার ব্রিটেন। মধ্যযুগে সেখানে বাণিজ্যিক আইনের সুরক্ষায় গঠন করা হয় দ্য ল’ মার্চেন্ট। এছাড়া ১৬০১ সালে স্বতন্ত্র একটি বিশেষায়িত চেম্বার অব অ্যাশিউরেন্স প্রতিষ্ঠা করা হয় ইংল্যান্ডে। সপ্তদশ শতকের শেষের দিকে বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্ব বাড়তে থাকে লন্ডনের। ফলে সেখানে নৌ-বিমার চাহিদাও বেড়ে যায়। ১৬৮০-এর দশকের শেষের দিকে লন্ডনের টাওয়ার স্ট্রিটে একটি কফি হাউস চালু করেন এডওয়ার্ড লয়েড। শিগগিরই সেটি জাহাজ মালিক, মার্চেন্ট ও নাবিকদের মিলনস্থলে পরিণত হয়। এই লয়েড’স কফি হাউসই ছিল প্রথম মেরিন ইন্স্যুরেন্স মার্কেট।

নৌ-বিমার শুরুর ইতিহাস তো জানা হলো। এখন জানা যাক এটি কত ধরনের হয়। নৌ-বিমা প্রধানত চার প্রকারের হয়। যথা :

১. জাহাজ বিমা : বাণিজ্যিক জাহাজ ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট উপকরণের জন্য সম্ভাব্য ক্ষতির যে বিমা গ্রহণ করা হয়, তাকে জাহাজ বিমা বলা হয়।

২. পণ্য বিমা : বাণিজ্যিক জাহাজে বহনকৃত পণ্যের ক্ষতির জন্য যে বিমা গ্রহণ করা হয়, তাকে পণ্য বিমা বলে।

৩. মাসুল বিমা : ঝড়ের কবল থেকে জাহাজ রক্ষার্থে পণ্য সমুদ্রে ফেলে দিলে তার মাসুল পাওয়া যায় না। এ মাসুল ক্ষতির জন্য যে বিমা গ্রহণ করা হয়, তাকে মাসুল বিমা বলে। এটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অতিপ্রচলিত একটি নৌ-বিমা।

৪. দায় বিমা : সমুদ্রে অনিচ্ছাকৃতভাবে কিছু নিয়মকানুন অমান্য করার ফলে আর্থিক ক্ষতি হতে পারে। এ ধরনের ক্ষতির জন্য যে বিমা করা হয়, তাকে দায় বিমা বলা হয়। এছাড়া সমুদ্রে দুটি জাহাজের মধ্যে সংঘর্ষ, ডুবে যাওয়া ইত্যাদি ক্ষয়ক্ষতিও হতে পারে। এ ধরনের ক্ষতির জন্য দায় বিমা করা যায়।

সাগরে চলাচলকারী জাহাজগুলোকে প্রধানত দুই ধরনের ঝুঁকির মোকাবিলা করতে হয়-প্রাকৃতিক ও অপ্রাকৃতিক। প্রাকৃতিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে সামুদ্রিক ঝড়, জাহাজ ডুবে যাওয়া, ভাসমান বরফখণ্ডের সঙ্গে ধাক্কা লাগা ইত্যাদি। আর অপ্রাকৃতিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে জলদস্যুর হামলা, বিস্ফোরণ, অগ্নিকাণ্ড, সাগরে পণ্য পড়ে যাওয়া, যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি ইত্যাদি।

ধরা যাক একটি জাহাজ ১২ হাজার টিইইউ কনটেইনার নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছে। যাত্রাপথে বৈরী আবহাওয়ার কারণে জাহাজটি ডুবে যেতে পারে। অথবা উত্তাল ঢেউয়ের কারণে সেটি থেকে কিছু কনটেইনার সাগরে পড়ে যেতে পারে। অনেক সময় কনটেইনারবাহী জাহাজ ও ট্যাংকারে করে বিপজ্জনক রাসায়নিক ও জ্বালানি পণ্য পরিবহন করা হয়। এগুলো থেকে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও ঘটে মাঝেমধ্যে।

আধুনিক যুগে আন্তঃদেশীয় পণ্য বাণিজ্যের চাপ যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে জাহাজ চলাচলের চাপ। বিভিন্ন চ্যানেলে অধিক সংখ্যক জাহাজ চলাচল করতে গিয়ে অথবা বন্দরের সংকীর্ণ জায়গায় ডকিং করতে গিয়ে অনেক সময় জাহাজে-জাহাজে অথবা জাহাজের সঙ্গে বন্দর অবকাঠামোর সংঘর্ষ হয়।

ভূরাজনৈতিক অস্থিরতায় কারণে সমুদ্র পরিবহন খাত কতটা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়, তার নমুনা তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দামামায় কয়েকটি জাহাজ গোলাবর্ষণের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্দরগুলো অবরুদ্ধ হয়ে পড়ায় শতাধিক জাহাজকে সেখানে দীর্ঘদিন আটকা পড়ে থাকতে হয়েছে। এতে জাহাজমালিকদের বিপুল অংকের লোকসান গুনতে হয়েছে। আবার সময়মতো পণ্য পরিবহন করতে না পারায় উৎপাদকরাও বেশ লোকসানের মধ্যে পড়েছে। এই যে এতসব লোকসান ও ক্ষয়ক্ষতি, তা প্রশমন করাই নৌ-বিমার কাজ।

নৌ-বিমাপত্র বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। যেমন-সমুদ্রযাত্রার বিমাপত্র, মিশ্র বিমাপত্র, মূল্যায়িত ও অমূল্যায়িত বিমাপত্র, ভাসমান বিমাপত্র, স্বার্থ বিমাপত্র, যৌগিক ঝুঁকির বিমাপত্র, যুগ্ম বিমাপত্র, মুদ্রা বিমাপত্র, ছাউনি বিমাপত্র, বন্দরঝুঁকি বিমাপত্র ইত্যাদি।

নৌ-বিমার অর্থনৈতিক গুরুত্ব

সমুদ্র বাণিজ্যের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় উৎকৃষ্ট একটি টুলস হলো নৌ-বিমা। কয়েকশ বছরের বহুল ব্যবহৃত চর্চা এটি। অর্থনৈতিক গুরুত্ব না থাকলে সমুদ্র পরিবহন খাতসংশ্লিষ্টরা বছরের পর বছর ধরে এর ওপর আস্থা রাখতে পারত না। নৌ-বিমা জাহাজমালিক, পণ্যের ক্রেতা ও বিক্রেতাদের ব্যবসা পরিচালনার ঝুঁকি অনেকটাই কমিয়ে দেয়। ফলে তারা অনেকটাই নিশ্চিন্ত হয়ে তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন।

বিশ্বায়নের যুগে সমুদ্র বাণিজ্য ও জাতীয় অর্থনীতি অনেকটাই একে অন্যের পরিপূরক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে কোনো জটিলতা তৈরি হলে বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন স্থবির হয়ে পড়ে। অন্যদিকে অর্থনৈতিক মন্দা শিপিং খাতের জন্যও দুর্দশার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অর্থনৈতিক মন্দাভাবসহ অন্যান্য প্রতিকূল পরিস্থিতি অথবা দুর্ঘটনার কারণে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হওয়া থেকে রক্ষায় বিমার আশ্রয় নেওয়া আধুনিক সমাজব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমুদ্রশিল্পেও এর ব্যতিক্রম নয়।

জাহাজ নির্মাণ, ভোগ্যপণ্য উৎপাদন ও সরবরাহের কাজে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন হয়। এসব কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তা ও ঋণদাতাদের জন্য সম্পদের সুরক্ষা অনেক বড় একটি বিষয়। দুর্ঘটনা তো আর প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়; আবার দুর্ঘটনার আশঙ্কায় কার্যক্রম বন্ধ রাখলেও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের জোর সম্ভাবনা রয়েছে। তবে যে কাজটি করা যায়, সেটি হলো দুর্ঘটনার কারণে ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া। আর এই কাজটি সবচেয়ে ভালোভাবে করতে পারে নৌ-বিমা।

এখন আসা যাক সামুদ্রিক যেকোনো নেতিবাচক অথবা দুর্ঘটনায় কারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সে প্রসঙ্গে। একটি জাহাজডুবি হলে কি কেবল এর মালিকপক্ষেরই আর্থিক ক্ষতি হয়? কিংবা কোনো কারণে জাহাজ চলাচল ব্যাহত অথবা তাতে বিলম্ব হলে কি কেবল শিপার ও অপারেটরদেরই আর্থিক লোকসান গুনতে হয়? তা নয়। এসব ঘটনার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এর ধাক্কা শেষ পর্যন্ত সামাল দিতে হয় ভোক্তা ও প্রান্তিক পর্যায়ের জনগোষ্ঠীকেই।

একটি জাহাজে আগুন লাগা অথবা সেটি ডুবে যাওয়ার মাধ্যমে পরিবেশ বিপর্যয়ের ঝুঁকি তৈরি হয়। বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক ও জ্বালানি তেল ছড়িয়ে পড়লে জলজ বাস্তুসংস্থানের ক্ষতি তো হয়ই, স্থানীয় মৎস্যজীবীদের আয়ের সংস্থানও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। গত বছর শ্রীলংকা উপকূলে সংঘটিত এক্সপ্রেস পার্ল দুর্ঘটনাই তার প্রমাণ। সে বছরের মে মাসে কলম্বো উপকূলে অগ্নিদুর্ঘটনার শিকার হয় রাসায়নিকভর্তি কনটেইনার জাহাজটি। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে জালার পর সেটি সাগরে ডুবে যায়। এক্সপ্রেস পার্লের এই দুর্ঘটনাকে বলা হচ্ছে শ্রীলংকার ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ সামুদ্রিক বিপর্যয়, যার প্রভাব দেশটিকে কয়েক দশক ধরে বহন করতে হতে পারে।

জাহাজটির কনটেইনারগুলোয় যেসব রাসায়নিক পরিবহন করা হচ্ছিল, তার কিছু ছিল পরিবেশের জন্য ভয়ানক ক্ষতিকর। জাহাজটি ডুবে যাওয়ার পর কিছু কনটেইনার থেকে রাসায়নিক নিঃসৃত হয়ে সাগরের পানিতে ছড়িয়ে পড়ে। এই রাসায়নিকের কারণে সাগরের জীববৈচিত্র্যের পাশাপাশি জেলেদের মৎস্য আহরণ কার্যক্রম কয়েক বছরের জন্য হুমকির মুখে পড়ে গেছে। জেলেদের এই ক্ষতি পূরণে অন্তর্বর্তীকালীন সমাধান হিসেবে এখন পর্যন্ত তিন দফায় শ্রীলংকা সরকারকে মোট ৩৬ লাখ ডলার দিয়েছে এক্সপ্রেস পার্লের বিমা কোম্পানি। এই অন্তর্বর্তীকালীন ক্ষতিপূরণ ছাড়াও শ্রীলংকা সরকার এক্সপ্রেস পার্লের কারণে পরিবেশগত যে ক্ষতি হয়েছে, তার জন্য পৃথক ক্ষতিপূরণ চেয়ে বিমা কোম্পানি ও জাহাজটির মালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।

ভোক্তাবাজারের স্বাভাবিক গতিশীলতার জন্য প্রয়োজন পণ্য পরিবহনে গতিময়তা, জাহাজ চলাচল নির্বিঘ্ন করা ছাড়া যা সম্ভব নয়। বিভিন্ন দুর্ঘটনার কারণে মাঝেমধ্যে কোনো কোনো চ্যানেল জাহাজ চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সাপ্লাই চেইনে। এছাড়া জাহাজের শিডিউল বিপর্যয়ের কারণে শিপিং-সংশ্লিষ্টদের বাড়তি কিছু খরচ গুনতে হয়, যার প্রভাব অনেক সময় শেষ পর্যন্ত পণ্যের মূল্যের ওপর গিয়ে পড়ে। নৌ-বিমার মাধ্যমে এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া গেলে ভোক্তাদের ওপর চাপ তো বটেই, পুরো বাজার পরিস্থিতিই সামাল দেওয়া যায়।

২০২১ সালের ২৩ মার্চ লোহিত সাগর থেকে ভূমধ্যসাগরে যাওয়ার সময় সুয়েজ খালে আড়াআড়িভাবে আটকা পড়ে এভারগ্রিন মেরিনের মালিকানাধীন ২০ হাজার টিইইউ কনটেইনার ধারণক্ষমতার জাহাজ এভার গিভেন। ৪০০ মিটার দীর্ঘ জাহাজটি ছয়দিন আটকে থাকার পর মুক্ত হয়। সুয়েজ খাল অতিক্রমের সময় এতে ১৮ হাজার ৩০০ কনটেইনার ছিল। এভার গিভেন আটকা পড়ায় সুয়েজ খাল দিয়ে জাহাজ চলাচল বিঘিত্ন হয়েছিল, যা সাপ্লাই চেইনের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল।

খালে আটকা পড়া অবস্থা থেকে ছয় দিনে মুক্ত হলেও এভার গিভেন নাটক চলেছিল আরও মাস তিনেক। সুয়েজ খাল কর্তৃপক্ষ দাবি করে, জাহাজটি আটকে যাওয়ায় দৈনিক এক থেকে দেড় কোটি ডলার রাজস্ব হারাতে হয়েছে তাদের। এ ঘটনায় জাহাজটির মালিকপক্ষের কাছে মোটা অংকের ক্ষতিপূরণ দাবি করে মিশর সরকার। প্রায় তিন মাস এ নিয়ে মালিকপক্ষ, বিমা কোম্পানি ও খাল কর্তৃপক্ষের মধ্যে দর-কষাকষি হয়। অবশেষ একটি চুক্তি সম্পাদিত হলে ৭ জুলাই মিশর থেকে ছাড়া পায় এভার গিভেন।

যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে জাহাজগুলোকে চলাচল করতে হয় অনেক ঝুঁকি নিয়ে। নাবিক-ক্রুদের অমূল্য জীবনের ঝুঁকি তো রয়েছেই, পাশাপাশি জাহাজের ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। তবে এই ঝুঁকির কারণে শিপিং সার্ভিস বন্ধ রাখলে তো আর চলবে না। বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন ও ভোক্তাবাজারে ভয়াবহ বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে তাতে। এই যে পাহাড়সম ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র পরিবহনসেবা চালু রাখা হয়, ক্ষতিপূরণের নিশ্চয়তা না থাকলে তা হয়তো সম্ভব হতো না। নৌ-বিমার সুরক্ষা আছে বলেই অপারেটররা প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যায়।

চলতি বছরের ২ মার্চ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দর চ্যানেলে নোঙর করা অবস্থায় রকেট হামলার শিকার হয় বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের জাহাজ ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’। পরবর্তী সময়ে এর জন্য তারা বিমাকারী প্রতিষ্ঠান সাধারণ বিমা করপোরেশনের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করে।

বিএসসির দাবিকৃত ক্ষতিপূরণের পরিমাণ ২ কোটি ২৪ লাখ ডলার। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর এটাই প্রথম বড় ধরনের সামুদ্রিক বিমার ক্ষতিপূরণ দাবি।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিএসসি ছয়টি জাহাজ কেনে, যার মধ্যে তিনটি বাল্ক ক্যারিয়ার। বাংলার সমৃদ্ধি এই তিনটি বাল্কারের অন্যতম। চীনের কাছ থেকে প্রায় ৩০০ কোটি টাকায় জাহাজটি কেনা হয়। ২০১৮ সালে সেটি শিপিং করপোরেশনের বহরে যুক্ত হয়। দুর্ঘটনার সময় জাহাজটি ডেনমার্কের চার্টারার ডেলটা করপোরেশনের অধীনে পরিচালিত হচ্ছিল।

উল্লেখ্য, ওই রকেট হামলায় জাহাজটির সামনের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং জাহাজটিতে কর্মরত থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমান মারা যান। পরে জাহাজটির ২৮ জন নাবিককে নিরাপদে সরিয়ে রোমানিয়ায় নেওয়া হয়। আটদিন পর ১০ মার্চ তারা নিরাপদে বাংলাদেশে ফেরেন।

শ্রীলংকার ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ সামুদ্রিক বিপর্যয় এক্সপ্রেস পার্লের বিস্ফোরণ ও অগ্নিকা-। এই ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত জেলেদের অন্তর্বর্তীকালীন ক্ষতিপূরণ হিসেবে এখন পর্যন্ত তিন দফায় শ্রীলংকা সরকারকে মোট ৩৬ লাখ ডলার দিয়েছে জাহাজটির বিমাকারী কোম্পানি

আন্তর্জাতিক আইন

সমুদ্র পরিবহন খাতে ঝুঁকি দাবি নিষ্পত্তি বা এনফোর্সমেন্ট অব মেরিটাইম ক্লেইমসের বিষয়ে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক কনফারেন্স আঙ্কটাডের পৃষ্ঠপোষকতায় দুটি আন্তর্জাতিক আইন বর্তমানে চালু রয়েছে। এর একটি হলো ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন অন মেরিটাইম লিয়েনস অ্যান্ড মর্টগেজেস ১৯৯৩, যা ২০০৪ সালে কার্যকর হয়। আরেকটি আইন হলো ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন অন অ্যারেস্ট অব শিপস ১৯৯৯, যেটি ২০১১ সালে কার্যকর হয়।

একটি প্রশ্ন উঠতে পারে, নৌ-বিমার আন্তর্জাতিক আইন কতটা প্রয়োজনীয়? এটি জানার জন্য একটু পেছনে তাকানো যাক। বিশ্বে নৌ-বিমা চর্চার প্রাচীনতম যেসব ঘটনার কথা জানা যায়, ব্রিটিশ মেরিন ইন্স্যুরেন্স লিগ্যাল রেজিম তার অন্যতম। আধুনিক সময়ে নৌ-বিমা নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে ব্রিটেন ও অন্যান্য দেশের জাতীয় বিমা আইন কাঠামোর তুলনামূলক পর্যালোচনা করা হয়। এতে দেখা যায় একেক দেশের নৌ-বিমা আইনের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। অথচ সমুদ্র ঝুঁকির ধরন বিশ্বের প্রায় সব অঞ্চলেই মোটামুটি অভিন্ন। সমুদ্র বাণিজ্যের বিস্তারের যুগে জাহাজগুলোকে পণ্য নিয়ে বিভিন্ন দেশের সমুদ্রসীমা পাড়ি দিতে হয়। ভিন্ন ভিন্ন আইন দিয়ে এসব জাহাজের অভিন্ন ঝুঁকি ও ক্ষয়ক্ষতি প্রশমন করা জটিল একটি কাজ। এ কারণেই নৌ-বিমার একটি আন্তর্জাতিক আইন ও চর্চা থাকা অত্যন্ত জরুরি।   

সমুদ্র পরিবহনে ঝুঁকি বাড়াচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন

জাতিসংঘের দুর্যোগ ঝুঁকি প্রশমনবিষয়ক দপ্তরের (ইউএনডিআরআর) পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সর্বশেষ দুই দশকে প্রতি বছর ৩৫০ থেকে ৫০০টি মধ্যম থেকে ভয়াবহ মাত্রার দুর্যোগের শিকার হয়েছে বিশ^বাসী, যা আগের তিন দশকের গড় ঘটনার তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি। আশঙ্কার কথা হলো, সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বে ঘনঘন এসব দুর্যোগ দেখা যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, আগামী দিনগুলোয় এ ধরনের দুর্যোগের প্রকোপ আরও বাড়তে পারে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বজুড়ে এমন দুর্যোগের সংখ্যা দাঁড়াতে পারে বছরে ৫৬০টি, যা গড়ে দৈনিক দেড়টির কাছাকাছি।

ইউএনডিআরআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত দশকে বিশ^জুড়ে দুর্যোগ প্রতিরোধ ও ক্ষতি প্রশমনে বছরে প্রায় ১৭ হাজার কোটি ডলার ব্যয় হয়েছে। সমস্যা হলো, জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সংঘটিত দুর্যোগের বেশির ভাগ আঘাত হেনেছে নি¤œ আয়ের দেশগুলোয়। এসব দেশ তাদের জিডিপির ১ শতাংশেরও কম অর্থ দুর্যোগ প্রশমনে ব্যয় করে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগের ক্ষতির জেরে ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের ৩ কোটি ৭৬ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যের মুখোমুখি হতে পারে বলে সংস্থাটির পক্ষ থেকে সতর্ক করা হয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্র পরিবহন খাতে বিপুল পরিমাণে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়। যেসব অঞ্চলে উষ্ণম-লীয় ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক ঢেউয়ের প্রভাব বেশি হয়, সেসব অঞ্চলের বন্দরে অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি ও কার্যক্রমে বিলম্ব দেখা দেয়। আর এর কারণে পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনের লোকসান চরম পর্যায়ে গিয়ে ঠেকতে পারে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ২০১৭ সালের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা উল্লেখ করা যায়। সে বছর ক্যারিবীয় অঞ্চলে হারিকেনের তা-ব অনেক বেশি ছিল। আর এর কারণে অনেক স্মল আইল্যান্ড ডেভেলপিং স্টেটসই (এসআইডিএস) তাদের জিডিপির বড় একটি অংশ হারিয়েছিল। সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক লোকসানের পরিমাণ ছিল আনুমানিক ৩২ হাজার কোটি ডলার।

২০১৯ সালে হারিকেন ডোরিয়ানের কারণে কেবল বাহামা দ্বীপপুঞ্জকেই প্রায় ৩৪০ কোটি ডলার ক্ষতি মেনে নিতে হয়েছিল। এই ক্ষতির বড় একটি অংশই হয়েছিল পরিবহন অবকাঠামো খাতে। ২০১২ সালে হারিকেন স্যান্ডির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক, নিউজার্সি ও কানেক্টিকাটের ক্ষতি হয়েছিল ৬ হাজার ২০০ কোটি ডলার। সেই দুর্যোগের কারণে নিউইয়র্ক/নিউজার্সির কনটেইনার পোর্টের কার্যক্রম প্রায় সপ্তাহখানেক বন্ধ ছিল।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্র এখন অনেক বেশি অননুমেয় হয়ে উঠেছে। সামুদ্রিক ঝড়, উত্তাল ঢেউয়ের কারণে জাহাজের বিপদে পড়ার খবরও পাওয়া যায় নিয়মিত। বিপুল ব্যয়ে নির্মিত জাহাজ ও তাতে থাকা বিশাল মূল্যমানের পণ্য সাগরে ডুবে গেলে অংশীজনদের কতটা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়, তা সহজেই অনুমেয়। এর পাশাপাশি দুর্যোগকালীন সময়ে বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ থাকলে জাহাজের শিডিউল বিপর্যয় তৈরি হয়। এতে জাহাজের পরিচালন ব্যয়ও বেড়ে যায়। এসব লোকসানের ঝুঁকি থেকে সুরক্ষা দিতে কার্যকর ভূমিকা রাখে নৌ-বিমা। তবে তাতেও শিপিং অপারেটরদের বিপদ থেকে মুক্তি মেলে না। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব যত বেশি হচ্ছে, বিমা কোম্পানিগুলোর প্রিমিয়ামের পরিমাণও তত বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে পণ্য পরিবহনের ভাড়া ও পণ্যের মূল্য যুগপৎ বেড়ে যাচ্ছে।  

উত্তাল সাগরে এমনই ঝুঁকি নিয়ে চলতে হয় জাহাজগুলোকে

আলোচনায় জ্বালানি রূপান্তর

২০১৮ সালে সমুদ্রগামী জাহাজের বৈশ্বিক বহর থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোর যুগোপযোগী লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করেছে আইএমও। ২০৩০ সাল নাগাদ এই নিঃসরণের মাত্রা ২০০৮ সালের তুলনায় ৪০ শতাংশ ও ২০৫০ সাল নাগাদ ৫০ শতাংশ কমানোর টার্গেট ঠিক করেছে সংস্থাটি। এছাড়া ২০৩০ সাল নাগাদ জাহাজগুলোর কার্বন ইনটেনসিটি অন্তত ৪০ শতাংশ কমানোর লক্ষ্যে গত বছর একটি স্বল্পমেয়াদি কর্মপরিকল্পনাও গ্রহণ করেছে আইএমও।

অবশ্য আইএমওর এই লক্ষ্যমাত্রা জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধের জন্য যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। অন্যদিকে আইএমওর এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এখন পর্যন্ত অগ্রগতি হয়েছেও খুব সামান্য। এই পরিস্থিতিতে আগামী বছর নিজেদের গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কৌশল নতুন করে পর্যালোচনার পরিকল্পনা রয়েছে আইএমওর।

সমুদ্র শিল্পে নিঃসরণ কমানোর তোড়জোড় চলছে বেশ ভালোভাবেই। এর অংশ হিসেবে জীবাশ্ম জালানির ব্যবহার কমিয়ে সবুজ জালানির ব্যবহার বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে গবেষণা ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়নের কাজও চলছে আশাব্যঞ্জক গতিতে। পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহারকারী জাহাজগুলোকে প্রণোদনা দিচ্ছে বিভিন্ন বন্দর কর্তৃপক্ষ। আবার একাধিক বন্দরের নিজস্ব সমঝোতায় গ্রিন শিপিং করিডোর গড়ে তোলার উদ্যোগও চোখে পড়েছে সাম্প্রতিক সময়ে।

২০২০ সালের ১ জানুয়ারি কার্যকর হয় আইএমওর গ্লোবাল সালফার ক্যাপ রেগুলেশন। এটি চালুর ফলে বিদ্যমান সালফার এমিশন কন্ট্রোল এরিয়ার (ইসিএ) বাইরে চলাচলকারী জাহাজগুলোকেও এখন এমন জ্বালানি ব্যবহার করতে হচ্ছে, যেগুলো কম সালফার নিঃসরণ করে।

যেসব জাহাজ জ্বালানি হিসেবে এলএনজি ব্যবহার করে অথবা এগজস্ট গ্যাস ক্লিনিং সিস্টেম (স্ক্রাবার) স্থাপন করেছে, সেগুলো এমনিতেই সালফার কম নিঃসরণ করে। তবে এগুলোর সংখ্যা তুলনামূলক কম। এসব জাহাজের বাইরে অন্যান্য জাহাজে যেন এমন সব জ্বালানির ব্যবহার করা হয়, যেগুলোয় সালফারের পরিমাণ শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ অথবা তার কম থাকে, তা নিশ্চিত করার জন্যই সালফার ক্যাপ রেগুলেশন কার্যকর করা হয়েছে। এর আগে ইসিএর বাইরের অঞ্চলে সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ৫ শতাংশ সালফারযুক্ত জ্বালানি ব্যবহারের অনুমতি ছিল।

সমুদ্রশিল্পে বিকল্প জালানির ব্যবহার এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জাহাজ তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ব্যবহার করা শুরু করেছে। অন্যান্য বিকল্প জ্বালানি যেমন অ্যামোনিয়া, হাইড্রোজেন ও মিথানল ব্যবহারের সুযোগ তৈরির জন্য গবেষণা ও উন্নয়নের কাজও চলছে জোরেশোরে। এছাড়া বৈদ্যুতিক শক্তিচালিত জাহাজকেও সম্ভাবনাময় পরিবহন মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এদিকে শক্তির সর্বোচ্চ কার্যদক্ষতা নিশ্চিতের লক্ষ্যে কাইট, সেইল ও রোটর ব্যবহারের মাধ্যমে বাতাসের শক্তিকে কাজে লাগানোর বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে কার্গো ভেসেল ও ট্যাংকারগুলো।

বলা যায়, এখন পর্যন্ত নিঃসরণ কমানোর উদ্ভাবনী আইডিয়া যথেষ্ট পাওয়া গেছে। তবে সুনির্দিষ্ট কোনো টেকনিক্যাল সলিউশন এখনো পাওয়া যায়নি, যেটি শিপিং খাতকে ২০৫০ সালের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছে দিতে সক্ষম। তাই নিঃসরণ কমানোর উদ্যোগকে সফল করতে হলে সবুজ জ্বালানি ও সহায়ক প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহারের বাইরে বিকল্প আর কোনো পথ এখন পর্যন্ত নেই এই খাতের জন্য।

জ্বালানি রূপান্তর যেভাবে নৌ-বিমা খাতে পরিবর্তন আনবে

প্রথাগত ঝুঁকির পাশাপাশি সমুদ্র পরিবহন খাতে সাম্প্রতিক সময়ে নতুন একটি ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। সেটি হলো জ্বালানি রূপান্তর প্রক্রিয়ার ঝুঁকি। জলবায়ু পরিবর্তন সারা বিশ্বের জন্য আজ এক মাথাব্যথার নাম। এই ব্যথা সারাতে বিশ্বনেতারা টোটকা হিসেবে বেছে নিয়েছেন গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোকে। বৈশ্বিক শিপিং খাতও এই উদ্যোগের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। সমুদ্র পরিবহন কার্যক্রমকে কীভাবে নিঃসরণমুক্ত করা যায়, সেই লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেওয়া হচ্ছে, যার মধ্যে জ্বালানি রূপান্তর অন্যতম।

জীবাশ্ম জালানির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার যে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের অন্যমত কারণ, সে বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। এ কারণে প্যারিস জলবায়ু চুক্তির লক্ষ্যমাত্রার প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে সমুদ্র পরিবহন খাতে জীবাশ্ম জালানির ব্যবহার কমানোর ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। বিকল্প জ্বালানি হিসেবে বেছে নেওয়া হচ্ছে তুলনামূলক কম নিঃসরণকারী তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), বায়োফুয়েল, হাইড্রোজেন, অ্যামোনিয়া ইত্যাদিকে।

জ্বালানি রূপান্তরের এই প্রক্রিয়াটি খুব একটা সহজ কাজ নয়। রাতারাতি প্রচলিত জ্বালানি ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে পরিবেশবান্ধব জালানির ব্যবহার শুরু করা সম্ভব না। এর জন্য সবুজ জ্বালানিচালিত নতুন জাহাজ নির্মাণ করতে হবে অথবা বিদ্যমান জাহাজগুলোকে কনভারশন করতে হবে। এছাড়া পাইপলাইন স্থাপন, স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের মতো কাজে মোটা অংকের অবকাঠামো বিনিয়োগেরও প্রয়োজন রয়েছে।

প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অনুযায়ী বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য বিকল্প জালানির ব্যবহার নিশ্চিতকরণ ও সমুদ্র খাতে কার্যদক্ষতা বাড়ানোর জন্য বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন। কেবল আইএমওর ২০৫০ সালের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ অর্থাৎ সমুদ্র পরিবহন খাতে নিঃসরণ ৫০ শতাংশ কমানোর জন্যই প্রয়োজন ১ লাখ কোটি থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি ডলার। আর এই খাতকে পুরোপুরি নিঃসরণমুক্ত করতে আগামী ২০ বছরে প্রয়োজন আরও ৪০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ।

পরিবেশবান্ধব জালানি ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অন্যতম বড় প্রতিবন্ধকতা এই বিপুল বিনিয়োগ। খাতসংশ্লিষ্টরা যে বিপুল পরিমাণ অর্থ লগ্নি করবেন, তার প্রণোদনার জন্য প্রয়োজন ঝুঁকি প্রশমনের নিশ্চয়তা। বিকল্প জালানির প্রযুক্তিগত ও অবকাঠামোগত অনেক বিষয়ই এখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে। বাণিজ্যিক পর্যায়ে সংবেদনশীল এসব জ্বালানির পরিবহন ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটার ঝুঁকি একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

জালানি রূপান্তরের অংশ হিসেবে নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনের ওপর বেশ জোর দেওয়া হচ্ছে। আর এই নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস হিসেবে অফশোর উইন্ড বা গভীর সমুদ্র বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পের কদর সাম্প্রতিক কয়েক বছরে অনেক বেড়েছে। পশ্চিমা দেশগুলোর পাশাপাশি এশিয়ার অগ্রসর অর্থনীতিগুলোও একের পর এক অফশোর মেগা প্রজেক্ট হাতে নিচ্ছে। এসব প্রকল্পে বিনিয়োগও আসছে প্রচুর। কিন্তু কেবল বিনিয়োগ এলেই তো চলবে না। বরং সেই বিনিয়োগের সুরক্ষাও চাই। জাহাজের মতো অফশোর ফার্মগুলোরও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এছাড়া জলদস্যুতার কারণে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ বেহাত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে সাম্প্রতিক সময়ে। এসব ফার্মের নিরাপত্তা ব্যবস্থা বৃদ্ধির পাশাপাশি ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এখন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বিষয়টিও নৌ-বিমা খাতের পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে।

সাগরে দুর্ঘটনা বা অন্য কারণে কনটেইনার পড়ে যাওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটে। নৌ-বিমা এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অনেকটাই সহায়তা করে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে

আরেকটি বিষয় রয়েছে। এতদিন নৌ-বিমা নিয়ে যেসব গবেষণা ও বিশ্লেষণধর্মী কাজ হয়েছে, সেগুলো মূলত প্রথাগত ক্ষতিপূরণের ধারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তবে অতি সাম্প্রতিক সময়ে আরেকটি বিষয় বিশেষভাবে বিবেচনায় নেওয়া শুরু হয়েছে। সমুদ্রে জাহাজ চলাচলের কারণে জলজ পরিবেশ কীরূপ দূষণের  শিকার হচ্ছে, এর দায় কার ওপর বর্তাবে এবং ক্ষতিপূরণের অংক কত হবে-বিমা দাবি নিষ্পত্তির সময় এই বিষয়গুলোরও হিসাব-নিকাশ করা হচ্ছে। এছাড়া সমুদ্র ও এর সম্পদের সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবহার বিশেষ করে আন্তর্জাতিক জলসীমায় থাকা জীববৈচিত্র্যের সুরক্ষাকে বেশ প্রাধান্য দিচ্ছে নৌ-বিমা খাতসংশ্লিষ্টরা।

উপসংহার

ফিরিঙ্গি জলদস্যুদের লুটতরাজের ইতিহাস এ দেশের মানুষের অজানা নয়। বর্তমানে জলদস্যুদের উৎপাত কমে গেলেও নৌপথে বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের দাপট কমেনি; বরং বেড়েই চলছে। সমুদ্রপথে বাণিজ্যিক জাহাজগুলোকে চলাচলের সময়ে প্রবল ঝড়, উত্তাল ঢেউ, জলদস্যুর আক্রমণ ইত্যাদি বিভিন্ন বিপদের মুখে পড়তে হয়। এগুলোর কারণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও একেবারে কম নয়। বিমা ছাড়া এসব ক্ষয়ক্ষতির প্রভাব প্রশমন সম্ভব নয় খাতসংশ্লিষ্টদের জন্য। এজন্যই আধুনিক কালে নৌ-বিমার ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

নৌ-বিমা ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার আদিতম একটি হাতিয়ার। বিশ্বায়নের যুগে তা আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়েছে। নৌ-বিমা না থাকলে অনেক শিপিং অপারেটরই লোকসান গুনতে গুনতে ব্যবসা থেকে ছিটকে যেত। সেক্ষেত্রে বাজার প্রতিযোগিতাও হুমকির মুখে পড়ে যেত। এছাড়া কোনো বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানের পণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হলে তারা সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পরবর্তী পণ্যগুলোর দাম বাড়িয়ে দিত। এতে ক্রেতাদের ওপরও বাড়তি চাপ তৈরি হতো। সব মিলিয়ে ভোক্তা বাজার ও সাপ্লাই চেইনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ত। নৌ-বিমা কার্যকরভাবে ঝুঁকি প্রশমনের মাধ্যমে বাজারের স্বাভাবিকতা বজায় রাখতে বড় ভূমিকা রাখে।

বিশে^র অন্যতম হাইড্রোজেন হাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চাইছে নেদারল্যান্ডসের রটারডাম বন্দর। এই লক্ষ্যে বড় অংকের অবকাঠামোগত বিনিয়োগও করছে তারা। এই বিনিয়োগকে সুরক্ষা দিতে প্রয়োজন বিমা কভারেজ

তবে ঝুঁকি সবসময়ই পরিবর্তনশীল। এ কারণে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাতেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন আসে। নৌ-বিমা খাতেও সেই পরিবর্তন এসেছে। সামনেও আসবে। বাজার বিশেষজ্ঞরা নিকটতম ভবিষ্যতে যে পরিবর্তনের ধারণা করছেন, তাতে সবচেয়ে বেশি প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে জলবায়ু পরিবর্তন ও জালানি রূপান্তর। বড় বড় শিপিং অপারেটররা এরই মধ্যে পরিবেশবান্ধব সমাধান হিসেবে সবুজ জালানিচালিত জাহাজ হাজির করেছে। পানিতে ভেসেছে বিদ্যুচ্চালিত জাহাজও। হাইড্রোজেন, অ্যামোনিয়ার মতো বিকল্প জালানি পরিবহনের উদ্যোগ নিয়েছে বিভিন্ন দেশ ও প্রতিষ্ঠান। এই যে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসতে চলেছে, তাতে প্রকৃতিগতভাবেই কিছু ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এসব ঝুঁকির কারণে নৌ-বিমা খাতে নতুন কিছু সংযোজন ও পরিমার্জনের দেখা মিলবেÑতা অনেকটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here