পদ্মা সেতু বাংলাদেশের সক্ষমতা ও মর্যাদার প্রতীক

দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের কয়েক দশকের স্বপ্ন ও প্রাণের দাবি ছিল পদ্মা নদীর ওপর একটি সেতু। মাওয়া-জাজিরাকে যুক্ত করা পদ্মা সেতু কেবল যে সেই স্বপ্নই পূরণ করেছে তা নয়। বরং বাংলাদেশ যে মাথা নোয়াবার নয়, সেই বিষয়টি আবারও প্রমাণ করেছে। দেশের জনগণের আত্মমর্যাদার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে এই সেতু।

আধুনিক বাংলাদেশের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় একটি দিন হয়ে থাকবে ২৫ জুন। আমাদের আত্মমর্যাদার প্রতীক হয়ে দাঁড়ানো পদ্মা সেতু এদিন উদ্বোধন করা হয়। বিদেশি ঋণদাতা সংস্থাগুলোর পশ্চাদপসরণে ভীত না হয়ে নিজেদের অর্থায়নে সেতু নির্মাণের সাহসী ঘোষণা দিয়েছিলেন যিনি, সেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরেই যাত্রা করল বাংলাদেশিদের গর্বের প্রতীক হয়ে দাঁড়ানো এই সেতু।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দিলেন সেই পরম সত্য-পদ্মা সেতু কেবল ইট-সিমেন্ট-স্টিল-লোহা-কংক্রিটের একটি অবকাঠামো নয়, এ সেতু আমাদের অহংকার। এ সেতু আমাদের গর্ব, আমাদের সক্ষমতা ও মর্যাদার প্রতীক। সেতুর ৪২টি স্তম্ভ যেন স্পর্ধিত বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। সকল বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ ও এটি চালু করাটা যেন বাংলাদেশিদের জন্য নতুন এক বিজয়।

ঢাকা-চট্টগ্রামের সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জন্য এই উপলক্ষটি বাড়তি আনন্দের। দীর্ঘদিন পেছনে পড়ে থাকার পর এখন মাথা তুলে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন এই অঞ্চলের অধিবাসীরা।

বাংলার ভূমিরূপ গঠনে বড় ভূমিকা রয়েছে পদ্মা নদীর। গাঙ্গেয় পললভূমিতে গড়ে ওঠা এই বদ্বীপের অর্থনৈতিক ক্রমবিকাশেও অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পৃক্ত এই নদী। পদ্মার স্রোতে তবাহিত পলি যেমন কৃষি খাতের উৎকর্ষে অবদান রেখেছে, তেমনি নৌবাণিজ্যে নদীটির সমৃদ্ধ ইতিহাস সর্বজনবিদিত। তবে মুদ্রার অন্য পিঠও রয়েছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে রাজধানী ঢাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল প্রমত্ত পদ্মা। যার ফলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় পদ্মার দুই পাড়ের মধ্যে রয়েছে স্পষ্ট অসমতা।

পদ্মা সেতু সেই বিভেদ দূর করার ক্ষেত্রে টনিক হিসেবে কাজ করবে। এটি দেশের সার্বিক জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখবে। প্রবৃদ্ধি হবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মোট দেশজ উৎপাদনেও। আঞ্চলিক যোগাযোগেও গুরুত্বপূর্ণ হিস্যা হবে এই সেতু। রেল সংযোগ থাকায় পদ্মার ওপারে থাকা সমুদ্র ও স্থলবন্দরগুলো থেকে পণ্য পরিবহন সহজতর ও সাশ্রয়ী হবে।

পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে অনেকে অভিহিত করছেন ‘দখিনা দুয়ার খুলে যাওয়া’ হিসেবে। প্রকৃতই এই সেতু বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতির জন্য সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মুক্ত করেছে।

পদানত হলো প্রমত্ত পদ্মা

গঙ্গা, যমুনা ও মেঘনা নদী অববাহিকা এলাকা বাংলাদেশ, ভারত, চীন, নেপাল ও ভুটানের প্রায় সাড়ে ১৭ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। এ মধ্যে সবচেয়ে বিস্তৃত গঙ্গা বা পদ্মার অববাহিকা প্রায় ১১ লাখ বর্গকিলোমিটারের। এই অববাহিকার সিংহভাগই পড়েছে ভারত ও নেপালে। বাংলাদেশে পড়েছে ৪ শতাংশ।

ভারতের গঙ্গা বাংলাদেশ অংশে এসে হয়েছে পদ্মা। হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপন্ন গঙ্গার প্রধান ধারা এটি। উৎপত্তির পর নদীটি ২ হাজার ৫২০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। গঙ্গা নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা দিয়ে। সেখান থেকেই নদীটির নাম হয় পদ্মা। বাংলাদেশে প্রবেশের পর এটি রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী হয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর দৌলতদিয়ায় গিয়ে যমুনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এরপর এই মিলিত ধারা চাঁদপুরের কাছে মেঘনার সঙ্গে মিলে মেঘনা নামে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে।

একদা পদ্মা নদী ছিল প্রমত্ত, বিশাল ও প্রলয়ঙ্করী। এই সেতুকে বশে আনার চিন্তা করাটা একসময় ছিল অলীক স্বপ্নের মতো। যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই নদীর খামখেয়ালি আচরণের ওপর নির্ভর করতে হবে না-আজ থেকে দুই-তিন দশক আগে এমন দৃশ্যপট কল্পনা করাও আমাদের জন্য ছিল স্বপ্নবিলাস।

বিশালাকারের জন্য পদ্মাকে বলা হয় ‘মাইটি রিভার’। কোনো কোনো স্থানে নদীর এক পাড়ে দাঁড়িয়ে অন্য পাড় দেখা যায় না। আর বর্ষায় পদ্মার ভয়ঙ্কর রূপের কথা সবাই জানে। বলা হয়, আমাজনের পর সবচেয়ে বেশি পানি প্রবাহিত হয় পদ্মায়। ভরা বর্ষায় এই নদীতে স্রোতের গতি থাকে প্রতি সেকেন্ডে ৪ থেকে সাড়ে ৪ মিটার। সেই নদীতে সেতু? প্রবল স্বপ্নবিলাসী মানুষই কেবল এই চিন্তা করতে পারে।

কালের আবর্তে উজানে পদ্মা খানিকটা বিগতযৌবনা হলেও রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ থেকে ভাটির দিকে এটি এখনো খরস্রোতা ও গভীর। ফলে দেশের মধ্য, উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগের ক্ষেত্রে এতদিন বড় বাধা হয়ে ছিল এই খরস্রোতা নদী পারাপার। ভরা বর্ষা কিংবা ঘন কুয়াশায় নদীতে ফেরি, লঞ্চ, স্পিডবোট বা অন্যান্য নৌযান চলাচল প্রায়ই ব্যাহত হতো।

পদ্মা, যমুনা ও মেঘনা-এই তিন নদী বাংলাদেশের ভূখ-কে মূল তিনটি ভাগে ভাগ করেছে। ঢাকা ও পাশ্ববর্তী কয়েকটি জেলা নিয়ে মধ্যভাগ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগ নিয়ে পূর্বাংশ এবং রাজশাহী, রংপুর, খুলনা ও বরিশাল নিয়ে পশ্চিমাংশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পর্যায়ক্রমে সড়ক যোগাযোগ বিস্তৃত হয়েছে। মেঘনা সেতু, মেঘনা-গোমতী সেতু, যমুনার ওপর বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু, পাকশীতে পদ্মার ওপর লালন শাহ সেতু, চট্টগ্রামে কর্ণফুলীর ওপর শাহ আমানত সেতু, খুলনার রূপসা সেতু, পটুয়াখালীর লেবুখালীতে পায়রা সেতু, ভৈরব সেতু নির্মাণের ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ নেটওয়ার্ক স্থাপনের কাজে অগ্রগতি হয়েছিল আগেই। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার মাধ্যমে সেই উদ্যোগ আরও পূর্ণতা পেল।

স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উদ্যাপন উপলক্ষ

২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে উৎসবমুখর হয়েছিল গোটা দেশ। কেনইবা হবে না! স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় অর্জন এটি। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করেই বলেছেন, সকল প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণের মাধ্যমে আমরা বড় এক বিজয় অর্জন করেছি।

নির্ধারিত দিনে বেলা ১১টা ৫৮ মিনিটে মাওয়া প্রান্তে ফলক উন্মোচনের মাধ্যমে পদ্মা সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। তার আগে সকাল ১০টায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রবেশ করেন তিনি। সেখানে আয়োজিত সুধীসমাবেশে বক্তব্য দেন তিনি। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম।

অনুষ্ঠানে পদ্মা সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে স্মারক ডাকটিকিট, স্যুভেনির শিট, উদ্বোধনী খাম ও সিলমোহর এবং ১০০ টাকা মূল্যের স্মারক নোট অবমুক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় পদ্মা সেতুর নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডের (এমবিইসি) পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে সেতুর একটি রেপ্লিকা উপহার দেওয়া হয়।

এরপর প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহর টোল দিয়ে সেতু এলাকায় প্রবেশ করে। টোল প্রদানের পর মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী ফলক ও ম্যুরাল-১ উন্মোচন এবং মোনাজাতে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী। সর্বপ্রথম টোল দিয়ে গাড়িবহর নিয়ে পদ্মা সেতু পার হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাজিরা প্রান্তে ম্যুরাল-২ উদ্বোধন করেন এবং সেখানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় বক্তব্য রাখেন।

পদ্মা সেতু নির্মাণকাজের গুণগত মান নিয়ে কোনো আপস করা হয়নি মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, এ সেতু নির্মিত হয়েছে বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও উপকরণ দিয়ে; সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা বজায় রেখে। পুরো নির্মাণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে সর্বোচ্চ মান বজায় রেখে।’

২৫ জুন বেলা ১১টা ৫৮ মিনিটে মাওয়া প্রান্তে ফলক উন্মোচনের মাধ্যমে পদ্মা সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর তিনি সর্বপ্রথম টোল দিয়ে গাড়িবহর নিয়ে পদ্মা সেতু পার হন

স্বপ্ন দেখার শুরু

বড় আকারের যেকোনো অবকাঠামো নির্মাণই ব্যয়সাপেক্ষ। বিশেষ করে ¯্রােতস্বিনী বড় নদীর ওপর কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু নির্মাণের ব্যয় অনেক বেশি। বাংলাদেশে যে এত ব্যয়বহুল প্রকল্প গ্রহণ করা সম্ভব, সেই সক্ষমতার প্রমাণ প্রথম পাওয়া যায় যমুনা নদীর ওপর ৩ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু সেতু চালুর মাধ্যমে। ১৯৯৮ সালে সেতুটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে সময় তিনি পদ্মা নদীতেও একটি সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেন।

১৯৯৯ সালের মে মাসে পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা শুরু হয়। বলা যায়, এটাই দালিলিকভাবে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের সূত্রপাত। সে হিসেবে স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণের যাত্রা প্রায় দুই যুগের।

পদ্মা সেতুর প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই হয় দেশীয় অর্থায়নে। ২০০১ সালের ৪ জুলাই সেতুটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর জাপানের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকার অর্থায়নে ২০০৩ সালের মে থেকে পদ্মা সেতু প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষার কাজ শুরু হয়।

পদ্মা সেতুর প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ছিল আরপিটি-নেডকো-বিসিএল। যৌথ উদ্যোগের প্রতিষ্ঠানটি মতামত দেয়, পাটুরিয়ার তুলনায় মাওয়ায় সেতু হলে যাতায়াত খরচ কমবে, পুনর্বাসনে ব্যয় কম হবে এবং নদীশাসন সহজ হবে। সেতু নির্মাণের পরিবর্তে নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণের বিষয়টিও তাদের আলোচনায় আসে। কিন্তু টানেলের প্রযুক্তিগত জটিলতা ও ব্যয় বেশি হওয়ার কারণে তা নির্মাণের সুপারিশ করেনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। তারা চার লেনের সেতু ও এর মধ্যে রেলসংযোগ রাখার পরামর্শ দেয়।

মূল সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের দায়িত্ব পায় জাপানের নিপ্পন কোয়েই লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তারাও সেতুর স্থান হিসেবে মাওয়া-জাজিরাকে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রতিবেদন জমা দেয়।

সমীক্ষায় দেখা যায়, মাওয়া-জাজিরা ও পাটুরিয়া-গোয়ালন্দ দুই পথেই মূল সেতুর দৈর্ঘ্য হবে ৬ কিলোমিটারের কিছু বেশি। তবে মাওয়া প্রান্তে নদীর তীর তুলনামূলক বেশি স্থিতিশীল। ফলে নদীশাসনে ব্যয় কম পড়বে। প্রক্ষেপণ অনুসারে, মাওয়া-জাজিরা দিয়ে সেতু নির্মিত হলে যানবাহনও বেশি চলবে। রেলসংযোগ বাদ দিয়ে মাওয়ায় সেতু নির্মাণে সম্ভাব্য ব্যয় দেখানো হয় ১১৫ কোটি ডলার, যেখানে পাটুরিয়া দিয়ে সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য ব্যয় দাঁড়াবে ১৪৫ কোটি ডলার।

চড়াই-উতরাইয়ের গল্প

পদ্মা সেতু নির্মাণের নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকল্প নিতে চলে যায় আট বছর। এরপর অর্থায়ন জটিলতায় কেটে যায় আরও পাঁচ বছর। ২০১২ সালে দেশীয় অর্থায়নে সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর শুরু হয় নির্মাণকাজ।

২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার ক্ষমতা গ্রহণের ২২ দিনের মাথায় পদ্মা সেতুর পূর্ণাঙ্গ নকশা তৈরির জন্য নিউজিল্যান্ডভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মনসেল এইকমকে নিয়োগ দেওয়া হয়। শুরুর নকশায় সেতু প্রকল্পে রেল চলাচলের সুবিধা ছিল না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রেল সুবিধা যুক্ত করে চূড়ান্ত নকশা প্রণয়নের নির্দেশনা দেন। এর মধ্যেই সরকার জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করে দেয়।

২০১০ সালের মধ্যে নকশা চূড়ান্ত হয়। পরের বছরের জানুয়ারিতে ডিপিপি সংশোধন করা হয়। সংশোধনীতে প্রকল্পের ব্যয় প্রথমবারের মতো বেড়ে দাঁড়ায় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। ব্যয় বৃদ্ধির পেছনে কয়েকটি কারণ উল্লেখ করে সেতু বিভাগ। সেতুর দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি এর অন্যতম। শুরুতে সেতুর দৈর্ঘ্য ধরা হয়েছিল ৫ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার। পরে তা বাড়িয়ে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার করা হয়। প্রথম ডিপিপিতে সেতুর ৪১টি স্প্যানের মধ্যে কেবল তিনটির নিচ দিয়ে নৌযান চলাচলের ব্যবস্থা রেখে নকশা করা হয়েছিল। পরে ৩৭টি স্প্যানের নিচ দিয়ে নৌযান চলাচলের সুযোগ রাখার বিষয়টি যুক্ত করা হয়।

প্রথম সংশোধিত ডিপিপিতে বেশি ভার বহনের ক্ষমতাসম্পন্ন রেল সংযোগ যুক্ত করা হয়। কংক্রিটের বদলে ইস্পাতের অবকাঠামো যুক্ত হয়। সেতু নির্মাণে পাইলিংয়ের ক্ষেত্রেও বাড়তি গভীরতা ধরা হয়। বাড়ে পুনর্বাসন ব্যয়ও।

৩ হাজার ১৪০ টন ওজনের স্প্যানকে সেতুর পিয়ারের ওপর নির্দিষ্ট জায়গায় স্থাপন করছে চীন থেকে ভাড়ায় আনা বিশে^র সবচেয়ে বড় ভাসমান ক্রেন তিয়ান-ই

নিজস্ব অর্থায়নে সেতু

প্রকল্পের নকশা চূড়ান্ত হওয়ার পর ২০১১ সালের এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে সেতু প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়ে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) ও ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (আইডিবি) সঙ্গে কয়েকটি ঋণচুক্তি সই করে সরকার। কিন্তু নির্মাণকাজের তদারকিতে পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ আনে বিশ্বব্যাংক। এরপর একে একে সব অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান প্রতিশ্রুত অর্থায়ন স্থগিত ঘোষণা করে।

এরপর প্রকল্পে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে আসে মালয়েশিয়ার সরকার। এ নিয়ে কিছুদিন আলোচনা চলার পর তা আর এগোয়নি। ২০১২ সালের ৯ জুলাই মন্ত্রিপরিষদের এক বৈঠকে যুগান্তকারী এক সিদ্ধান্ত নেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরমুখাপেক্ষী না থেকে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সাহসী ঘোষণা দেন তিনি। এই সিদ্ধান্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য সঞ্জীবনী শক্তি হিসেবে কাজ করে। এরপর আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে পদ্মা সেতুতে বিনিয়োগের বিষয়ে না করে দেয় সরকার।

যে দুর্নীতির অভিযোগে সরে দাঁড়িয়েছিল বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান, ২০১৪ সালে তদন্ত শেষে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জানিয়ে দেয়, তারা এর কোনো প্রমাণ পায়নি। ২০১৭ সালে কানাডার টরন্টোর এক আদালতও অভিযোগটির সপক্ষে প্রমাণ না পাওয়ার কথা জানান।

মুন্সিগঞ্জের মাওয়া প্রান্ত থেকে শরিয়তপুরের জাজিরা প্রান্ত পর্যন্ত মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার। এর সংযোগ সড়ক প্রায় ১২.১২ কিলোমিটার

আত্মমর্যাদা রক্ষার যাত্রা

২০১৬, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে আরও তিন দফা ডিপিপি সংশোধন করা হয়। এর মধ্যে ২০১৬ সালের সংশোধনীতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে তা বেড়ে হয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। শেষ পর্যন্ত সেই ব্যয়ের পরিমাণই বহাল আছে।

পদ্মা সেতুর জন্য ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনের কাজ নিজস্ব অর্থায়নে করতে হবে, সেটা পূর্বনির্ধারিত। কারণ এই কাজে উন্নয়ন সহযোগীরা অর্থায়ন করে না। পদ্মা সেতু প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু ২০০৬ সাল থেকেই। আর অধিগ্রহণ শুরু হয় ২০০৯ সালে। অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সব মানদণ্ড মেনে চলা হয়েছে।

নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণ করা হবে-এই সিদ্ধান্ত তো নেওয়া হলো, কিন্তু অর্থ আসবে কোত্থেকে? ২০১২ সালের আগস্টে সরকার দুটি ব্যাংক হিসাব খোলে, যেখানে সরাসরি অনুদান জমা দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংগঠনগুলো তাদের এক দিনের বেতনের সমপরিমাণ অর্থ অনুদান হিসেবে দেওয়ার ঘোষণা দেয়। মন্ত্রী-সংসদ সদস্য, সচিবরাও বেতনের অংশ অনুদান হিসেবে দেওয়ার কথা জানান।

সরকার পদ্মা সেতু নির্মাণে বড় অংকের বাজেট বরাদ্দ দেয় ২০১৩-১৪ অর্থবছরে। এর পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। এরপর প্রতি বছরের বাজেটেই বড় অংকের অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

শুরু থেকেই প্রকল্পের কাজ পাঁচটি বড় প্যাকেজে ভাগ করা হয়েছিল। এগুলো হলো-মূল সেতু, নদী শাসন, মাওয়া প্রান্তে টোল প্লাজাসহ সংযোগ সড়ক নির্মাণ, জাজিরা প্রান্তে টোল প্লাজাসহ সংযোগ সড়ক নির্মাণ এবং সার্ভিস এরিয়া নির্মাণ। সবগুলো প্যাকেজেরই দরপত্র প্রক্রিয়া ২০১০ ও ২০১১ সালে শুরু হয়েছিল। নিজস্ব অর্থায়নের সিদ্ধান্তের পর নতুন করে দরপত্র আহ্বান না করে এসব কাজ আগের অবস্থা থেকেই এগিয়ে নেওয়া হয়। শুধু মূল সেতু নির্মাণের পরামর্শক নিয়োগের নতুন দরপত্র আহ্বান করা হয়।

মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তের সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এরিয়া নির্মাণের ঠিকাদার নিযুক্ত হয় বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান আবদুল মোনেম লিমিটেড। তারা সহযোগী হিসেবে নেয় মালয়েশিয়ার এইচসিএম নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে।

বিভিন্ন কাজের তদারকিতে চারটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও তিনটি বেসরকারি সংস্থাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর মধ্যে দুই পাড়ে সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এরিয়া নির্মাণে পরামর্শকের দায়িত্ব পায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)।

মূল সেতু নির্মাণে ঠিকাদারদের প্রাক-যোগ্যতা যাচাই দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল ২০১০ সালে। শেষ পর্যন্ত চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (এমবিইসি) ১২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকায় সেতুটি নির্মাণের প্রস্তাব দিয়ে নির্বাচিত হয়। ২০১৪ সালের ১৭ জুন এমবিইসির সঙ্গে সরকারের চুক্তি সই হয়। ওই বছরের নভেম্বরে তারা কাজ শুরু করে।

পদ্মা সেতুর নদী শাসনের দরপত্রে ৮ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা প্রস্তাব করে চীনের সিনোহাইড্রো সর্বনিম্ন দরদাতা নির্বাচিত হয়। ২০১৪ সালের নভেম্বরে চুক্তির পর ডিসেম্বরে তারা কাজ শুরু করে।

সেতু নির্মাণে যত চ্যালেঞ্জ

মূল সেতু নির্মাণের প্রথম ধাপ পাইলিং। খরস্রোতা পদ্মায় এটি ছিল অন্যতম জটিল কাজ। ২০১৫ সালের ১ মার্চ পরীক্ষামূলক পাইলিংয়ের কাজ শুরু করে এমবিইসি।

মূল সেতুতে পাইল রয়েছে ২৬৪টি। সেতুর পানির অংশে ৪০টি পিয়ারের নিচে এগুলো বসানো হয়েছে। নদীর পাইলগুলো ভেতরে ফাঁপা, ইস্পাতের তৈরি। প্রতিটির ব্যাসার্ধ তিন মিটার। পুরুত্ব ৬২ মিলিমিটার। একেকটি পিয়ারের নিচে ছয় থেকে সাতটি পাইল বসানো হয়েছে। এই পাইল নদীর তলদেশের মাটি থেকে ১২২ মিটার পর্যন্ত গভীরে বসানো হয়েছে। বিশ্বে আর কোনো সেতুতে এত গভীরতায় পাইল বসানোর প্রয়োজন হয়নি।

পদ্মা সেতুর পাইলিং শুরু হয়েছিল মাওয়া প্রান্তে। শুরুতে পরিকল্পনা ছিল প্রতিটি পিয়ারের নিচে ছয়টি করে পাইল বসানো হবে। কিন্তু সেতুর ৬ ও ৭ নম্বর পিয়ারের নিচে তিনটি করে পাইল বসাতে গিয়ে নরম মাটির স্তর পাওয়া যায়। সাধারণত মাটির গভীরে যেখানে পাথর বা শক্ত মাটির স্তর পাওয়া যায়, সেই পর্যন্ত গভীরতায় পাইলিং করা হয়। কিন্তু ৬ ও ৭ নম্বর পিয়ারের পাইলিংয়ের সময় পরিকল্পনামতো গভীরতায় গিয়েও মাটি নরম পাওয়ায় কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে মাওয়া প্রান্তে কাজ বন্ধ রেখে জাজিরা প্রান্তে পাইল বসানো শুরু হয়।

এদিকে মাওয়া প্রান্তে নির্দিষ্ট স্থানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা শুরু করে কর্তৃপক্ষ। একপর্যায়ে দেখা যায়, আরও ১২টি পিয়ারের নিচে পূর্বনির্ধারিত গভীরতায় নরম মাটি রয়েছে। সব মিলিয়ে ১৪টি পিয়ারের নিচে পাইলিং নিয়ে নতুন করে পরিকল্পনার জন্য যুক্তরাজ্যের কাউই নামের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারা মাটি পরীক্ষার প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন তথ্য যাচাই করে। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বেশকিছু বিকল্প প্রস্তাব দেওয়া হয়, যার একটি ছিল কিছু পিয়ারের নিচে একটি করে পাইল বাড়িয়ে দেওয়া। পাশাপাশি পিয়ারের গোড়ায় খাঁজ কাটা পাইল দিয়ে অতিমিহি সিমেন্টের মিশ্রণে নরম মাটি শক্ত করার পরামর্শ দেওয়া হয়। সেতুর বিশেষজ্ঞ কমিটি ও সরকার এই বিকল্প বেছে নেয়। শেষ পর্যন্ত মূল সেতুর ২২টি পিয়ারের প্রতিটির নিচে সাতটি করে পাইল বসানো হয়। ১৮টি পিয়ারের নিচে বসানো হয় ছয়টি করে। আর দুই প্রান্তের দুটি পিয়ারে রডের পাইল বসানো হয় ১৬টি করে।

পাইলিং-সংক্রান্ত এই জটিলতার কারণে সেতুর পিয়ার স্থাপনের কাজও পিছিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ২০২০ সালের ৩১ মার্চ সেতুর সব পিয়ারের নির্মাণকাজ শেষ হয়। সাবস্ট্রাকচার বা নিচের অংশের কাজ শেষ হওয়ার পর শুরু হয় সুপারস্ট্রাকচার বা ইস্পাতের স্প্যান বসানোর কাজ।

পদ্মা সেতুর ৪১টি স্প্যানের প্রতিটির দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার। এগুলো আয়তাকার, ধূসর রঙের। স্প্যানের ওপরে তৈরি করা হয়েছে যানবাহন চলাচলের পথ। আর স্প্যানের ভেতর দিয়ে থাকবে রেলপথ। একেকটি স্প্যানের ওজন ৩ হাজার ২০০ টন। ভারী এসব স্প্যান বসাতে চীন থেকে আনা দানবাকার ক্রেন ব্যবহার করতে হয়েছে।

পদ্মা সেতুতে ব্যবহৃত স্প্যান তৈরি হয়েছে চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হেবেই প্রদেশের শিংহুয়াংডাও শহরের বড় একটি কারখানায়। চীন থেকে স্প্যানের চালানগুলো বাংলাদেশের মোংলা বন্দরে আসতে সময় লেগেছে ২১ থেকে ৩০ দিন। পরিবহনের সুবিধার্থে স্প্যানগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে ভাগ করে বাংলাদেশে আনা হয়েছে। পরে সেগুলো মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায় স্থাপিত কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে জোড়া দিয়ে সম্পূর্ণ স্প্যান তৈরি করা হয়। এরপর অত্যাধুনিক ওয়ার্কশপে চূড়ান্ত ওয়েল্ডিং করা হয়।

পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

প্রথম দিকে দিনে পদ্মা সেতু দিয়ে গড়ে আট হাজার যানবাহন চলাচলের প্রত্যাশা করছে সেতু বিভাগ। পরে এই সংখ্যা পর্যায়ক্রমে বাড়বে। পদ্মা সেতুর সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, ২০২৫ সালে দিনে সেতু দিয়ে ৪১ হাজার যানবাহন চলাচল করবে। সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, শুরুতে লক্ষ্যমাত্রা কম ধরা হলেও ২০২৫ সালে গাড়ি চলাচলের সংখ্যা বাড়বে। কারণ সেতু চালুর তিন-চার বছরের মধ্যে শিল্পকারখানার সংখ্যা বাড়বে। নতুন নতুন বাস রুট তৈরি হবে।

টোল বাবদ সেতুর যে আয় হবে, তা দিয়ে নির্মাণব্যয় উঠে আসতে সাড়ে ৯ বছর সময় লাগবে। বিশ^ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আগামী ৩১ বছরে যোগাযোগ খাতে পদ্মা সেতু থেকে আয় হবে ১৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার (নির্মাণ খরচের ৫.৫ গুণ)। এছাড়া সামাজিক অগ্রগতি ও অর্থনীতিতে ২৫ বিলিয়ন ডলার যোগ করবে। দুই পারে নদী শাসনের মাধ্যমে যে জমি রক্ষা হয়েছে, তার মূল্য প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। সেতুর মাধ্যমে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও ইন্টারনেট লাইন গিয়ে সাশ্রয় করবে ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। ফেরি চলাচল না হওয়ায় খরচ সাশ্রয় হবে ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। চুক্তি অনুযায়ী সেতু কর্তৃপক্ষকে আগামী ৩৫ বছরে ৩৬ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, টোল থেকে আদায়কৃত অর্থের অধিকাংশ দিয়ে ঋণ পরিশোধ করা হবে এবং বাকি অর্থ দিয়ে সেতু রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে।

পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় সড়কপথে ঢাকার কাছাকাছি চলে আসছে মোংলা বন্দর। এতে বন্দরটি দিয়ে কনটেইনারে পণ্য আমদানি-রপ্তানি বাড়বে। বর্তমানে বন্দরটির হ্যান্ডলিং সক্ষমতার বড় একটি অংশ অব্যবহৃত রয়েছে। ফলে বর্তমান কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের চাপ সামাল দিতে পারবে মোংলা। তবে ভবিষ্যতে এই চাপ নিশ্চিতভাবেই বাড়বে। সেই অনুযায়ী মোংলা বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর কাজ চলছে।

বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, ২০২৫ সাল নাগাদ বন্দরে আট লাখ কনটেইনার ওঠানো-নামানোর সক্ষমতা তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। এজন্য সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে একটি টার্মিনাল নির্মাণের কাজ চলছে। এছাড়া বন্দরের যন্ত্রপাতির সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। খননকাজও চলছে।

বর্তমানে মোংলা দিয়ে সবচেয়ে বেশি গাড়ি আমদানি হয়। সেতু চালু হওয়ায় গাড়ি আমদানি আরও বাড়বে। এখন কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ক্রেতাকে গাড়ি সরবরাহ করা যাবে, যার ফলে গাড়ি ব্যবসায়ীরা মোংলা বন্দর ব্যবহারে উৎসাহিত হবেন।

পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় পায়রা বন্দরের প্রথম কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের কাজ শেষ হবে আগামী বছর। টার্মিনালটি চালু হলে বন্দরের জেটিতে ভিড়তে পারবে কনটেইনারবাহী জাহাজ। এতে বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামালসহ অন্যান্য সরঞ্জামাদি আমদানি-রপ্তানি করা যাবে।

নির্মাণাধীন কনটেইনার টার্মিনালে একসঙ্গে তিনটি কনটেইনার জাহাজ ভেড়ানো যাবে। বছরে আট লাখ একক কনটেইনার ওঠানো-নামানো সম্ভব হবে। পদ্মা সেতু চালু হয়ে গেছে। এখন টার্মিনাল নির্মাণ সম্পন্ন হয়ে গেলে পায়রা বন্দরের কার্যক্রমেও গতি আসবে। সেতু চালুর পূর্ণ সুফল নিতে আগামী সেপ্টেম্বরে বন্দরের সার্ভিস জেটিতে গাড়িবাহী জাহাজ ভেড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। সেই লক্ষ্যে খননকাজ এগিয়ে চলছে।

পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের পূর্বাভাস অনুসারে, পদ্মা সেতু থেকে প্রথম বছরে আয় হবে ১ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। এ হিসাবে ৩৫ বছরে এই সেতু থেকে আয় হবে ৯০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এই ৩৫ বছরের আয়ের ওপর ভিত্তি করেই অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ঋণচুক্তি করে সেতু কর্তৃপক্ষ।

পদ্মা সেতুর সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, এই সেতুর কারণে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের যে সম্প্রসারণ হবে, তাতে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২৩ শতাংশ বাড়বে। আর দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি প্রবৃদ্ধি দাঁড়াবে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। জিডিপিতে অবদান বাড়লে স্বাভাবিকভাবে তা দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক হবে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পদ্মা সেতুর আশীর্বাদে দারিদ্র্য বিমোচনের হার বাড়বে শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ।

দেশে আটটি রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) ও একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু রয়েছে। এর মধ্যে পদ্মার ওপারে রয়েছে শুধু মোংলা ইপিজেড। পদ্মা সেতু ঘিরে যশোর ও পটুয়াখালীতে আরও দুটি ইপিজেড করার প্রস্তাব আছে। এগুলো নির্মাণ হলে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে রপ্তানিমুখী খাতে নিয়োগ হবে, বাড়বে কর্মসংস্থান।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) সূত্র অনুযায়ী, মোংলা, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর ও পায়রা বন্দর এলাকায় চারটি অর্থনৈতিক অঞ্চল করার পরিকল্পনা রয়েছে। গোপালগঞ্জ ও ফরিদপুরের ভাঙ্গায় দুটি বিসিক শিল্পনগরী স্থাপন হচ্ছে। মাদারীপুরে তাঁতপল্লি নির্মাণের কাজও চলছে। পর্যটন অর্থনীতিতেও অবদান রাখবে পদ্মা সেতু। সুন্দরবন, কুয়াকাটাসহ অন্যান্য পর্যটন এলাকায় মানুষের আনাগোনা বাড়বে।

মাল্টিমোডাল কানেক্টিভিটি বাড়বে

নিরাপদ, দ্রুত ও সাশ্রয়ী যোগাযোগে রেল নেটওয়ার্কের কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে পণ্য পরিবহনে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা যুগান্তকারী ভূমিকা রাখে। পদ্মা সেতুতে আগামী বছরের প্রথমার্ধেই ট্রেন চলাচল শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এদিকে খুলনা থেকে মোংলা পর্যন্ত নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে, যার অধীনে নির্মিত হচ্ছে দেশের আরও একটি মেগাস্ট্রাকচার রূপসা রেলসেতু। এই রেলসেতুর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হলে এবং পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ চালু হলে মোংলা বন্দরের সঙ্গে রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রাম বন্দরের সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপন হবে। সড়ক ও রেলপথের এই মাল্টিমোডাল কানেক্টিভিটি দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের গতি বাড়াতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্প পায়রা বন্দরকেও মাল্টিমোডাল কানেক্টিভিটিতে যুক্ত হওয়ার সুযোগ করে দেবে। এই সেতুর ফলে বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলকে রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আনার সুবর্ণ সুযোগ তৈরি হয়েছে।

যশোরের বেনাপোলে রয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় স্থলবন্দর। এতদিন স্থলবন্দরটি থেকে রাজধানী ও আশপাশের এলাকার আসতে সড়কপথে ফেরিঘাটে লম্বা সময়ের অপেক্ষা ও রেলে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার ভোগান্তি ছিল। পদ্মা সেতু হওয়ার ফলে উভয় সমস্যারই সমাধান হবে। পাশাপাশি রেল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বেনাপোল স্থলবন্দর থেকে পণ্য পরিবহনের নতুন সম্ভাবনা তৈরি হবে। সেক্ষেত্রে আমদানি-রপ্তানিতে খরচ ও সময় দুটোই বাঁচবে।

আঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রেও পদ্মা সেতু বিশেষ ভূমিকা রাখবে। এশিয়ান হাইওয়ে এএইচ-১-এর সঙ্গে যুক্ত হবে পদ্মা সেতু। আর ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্প। এসবের ফলে ভারত, ভুটান, নেপালসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হবে। এছাড়া ট্রান্স-এশিয়ান নেটওয়ার্ক ধরে সিঙ্গাপুর থেকে ইউরোপ পর্যন্ত ট্রেন চলাচলের কথা রয়েছে, যার গুরুত্বপূর্ণ হিস্যা হবে পদ্মা সেতু। এই সেতুর ফলে কলকাতা থেকে ঢাকা হয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় ট্রানজিটের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন সহজ হবে। ফলে আঞ্চলিক বাণিজ্যের সম্ভাবনা আরও বাড়বে।

উপসংহার

পদ্মা সেতু নির্মাণ আমাদের জন্য নিজেদের সামর্থ্য প্রমাণের একটি উপলক্ষ। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার বড় একটি উদাহরণ এই সেতু। এই প্রকল্পে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক দেশীয় প্রকৌশলী, কর্মকর্তা ও শ্রমিক কাজ করেছেন। এটি তাদের জন্য ছিল অভিজ্ঞতা অর্জনের বড় একটি প্লাটফর্ম। এই অভিজ্ঞতা পরবর্তীতে নিজস্ব দক্ষতায় সেতু নির্মাণে কাজে লাগবে। অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা কার্যকর ভূমিকা রাখে। প্রধানমন্ত্রীর রূপকল্প-২০৪১ অনুযায়ী বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে দেখতে হলে আমাদের অবশ্যই যোগাযোগব্যবস্থাকে এগিয়ে নিতে হবে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মাধ্যমে সেই যাত্রারই সূচনা হলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here