মেরিটাইম নিরাপত্তা টেকসই সমুদ্র শিল্পের পূর্বশর্ত

বৈশ্বিক অর্থনীতির অন্যতম প্রভাবক হয়ে উঠছে সমুদ্র শিল্প। একই সঙ্গে এই খাতে নিরাপত্তাঝুঁকির মাত্রা ও ধরনও ক্রমশ বাড়ছে। অনাদিকালের জলদস্যুতা থেকে শুরু করে হাল আমলের সাইবার হামলার ঝুঁকি-বর্তমানে মেরিটাইম খাতকে মাথা ঘামাতে হচ্ছে বহুমুখী নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে। সমুদ্র নিরাপত্তায় এরই মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে বৈশ্বিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যার ইতিবাচক ফলাফলও দৃশ্যমান। তবে এই শিল্পের টেকসই ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে আরও অনেক কাজ বাকি রয়েছে।

ঐতিহ্যগতভাবে বাংলার অর্থনীতিতে কৃষির পাশাপাশি বাণিজ্যেরও অবদান ছিল। আমাদের বিভিন্ন লোককাহিনিতেও সওদাগরদের প্রবল উপস্থিতি দেখা যায়। বাংলার অনেক অঞ্চলেই বাণিজ্যের প্রাধান্য ছিল। এই বাণিজ্য যে কেবল অভ্যন্তরীণ ছিল, তা নয়। বরং বাংলার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিস্তৃত ছিল বিশ্বজুড়ে। কিন্তু বিশ্ব-পরিস্থিতি পাল্টে যাওয়ায় বাংলার বণিকদের সুদিনও একসময় ফুরিয়েছে। বিশেষ করে আরব দস্যুদের আক্রমণের ফলে বাংলার ব্যবসায়ী সমাজ পশ্চিমের দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বর্জন করে সিংহল, মালয় প্রভৃতি দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করতে শুরু করেছিল। কিন্তু এ পরিস্থিতিও ষোড়শ শতক থেকে পরিবর্তিত হতে শুরু করে পর্তুগিজ ও মগ দস্যুদের আক্রমণের ফলে। বস্তুত সেই শতকের পর থেকে বাঙালি বণিকরা আর বাণিজ্য করতে বিদেশ যেতেন না। জলদস্যুদের আক্রমণে অতিষ্ঠ হয়ে বাংলার বণিক সমাজ ধীরে ধীরে বৈদেশিক বাণিজ্যে আগ্রহ হারাতে থাকে।

উপরিল্লিখিত প্রেক্ষাপটে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, জলদস্যুতা একটি অঞ্চলের বাণিজ্যে কতটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। প্রাচীনকাল থেকেই সমুদ্র অভিযাত্রী ও বণিকদের কাছে আতঙ্কের এক নাম জলদস্যুতা। দস্যুদের কবলে পড়ে কত যে বণিক তাদের বাণিজ্যলব্ধ ধনসম্পদ হারিয়েছেন, তার ইয়াত্তা নেই।

কেবল জলদস্যুতাই যে সমুদ্র শিল্পের প্রাচীনতম নিরাপত্তা সংকট, তা নয়। আরেকটি বিষয়ের কাছে সমুদ্রজীবীরা বরাবরই অসহায় ছিল। সেটি হলো প্রতিকূল পরিবেশ। সাগরের মেজাজ-মর্জি ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন হয়। শান্ত সাগর যে কখন রুদ্রমূর্তি ধারণ করবে, সেই বিষয়ে আগাম ধারণা লাভ করা প্রায় অসম্ভব ছিল প্রাচীনকালে। অনুকূল পরিবেশ দেখে যাত্রায় বেরিয়ে কত জাহাজের যে উত্তাল ঢেউয়ের কবলে পড়ে সলিল সমাধি হয়েছে, তার হিসাব নেই।

দেড়-দুইশ বছর আগ পর্যন্তও এই দুটি বিষয় ছিল সমুদ্র নিরাপত্তার জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ। তবে যত সময় গড়িয়েছে, সাগর-মহাসাগরে নিরাপত্তাঝুঁকির ধরন ও বিস্তৃতি বেড়েছে। ঔপনিবেশিক শাসন বিস্তারের যুগে বিভিন্ন অঞ্চলে নৌ-সামরিক উত্তেজনা মাঝেমধ্যেই দেখা গেছে। গত শতকের বিশ্বযুদ্ধের সময়ও সমুদ্রগুলো ছিল অন্যতম রণক্ষেত্র।

আধুনিক যুগে সামুদ্রিক নিরাপত্তাঝুঁকি আরও বহুমাত্রিক রূপ ধারণ করেছে। যত সময় গড়াচ্ছে, সাগরের ওপর চাপ তত বাড়ছে। বিশ্বায়নের যুগে সমুদ্র বাণিজ্যের প্রসারের সুবাদে জাহাজ চলাচলের ব্যস্ততা বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে জাহাজে জাহাজে সংঘর্ষের ঘটনাও। অন্যদিকে সাপ্লাই চেইনের স্বাভাবিকতা বজায় রাখার স্বার্থে অনেক সময় বন্দরগুলোকে বাড়তি চাপ নিয়ে কাজ করতে হয়। অল্প সময়ে বেশি সংখ্যক জাহাজকে সেবা দিতে গিয়ে কখনো কখনো বন্দরে কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের সময় দুর্ঘটনায় ঘটে। আবার ব্যস্ত সূচির কারণে বেশি সংখ্যক জাহাজকে বন্দরে ডকিংয়ের সুযোগ দিতে গিয়ে মাঝেমধ্যে সংঘর্ষের খবরও পাওয়া যায়।

গত শতকের শেষার্ধ থেকে বিশ্বজুড়ে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে কনটেইনারের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। ধীরে ধীরে ভোগ্যপণ্য পরিবহনের প্রধান অবলম্বন হয়ে উঠেছে কনটেইনার। তবে এতেও কিছু ঝুঁকি রয়েছে। উত্তাল সাগরে জাহাজ থেকে কনটেইনার পড়ে যাওয়ার ঘটনা সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অনেক বেড়েছে। এছাড়া কনটেইনারে করে অনেক সময় বিপজ্জনক রাসায়নিকসহ অন্যান্য দাহ্য পদার্থ পরিবহন করা হয়। কখনো কখনো এসব কনটেইনার বিস্ফোরিত হয়ে পুরো জাহাজে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এ ধরনের দুর্ঘটনার প্রকোপও বেড়েছে।

তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে আরেকটি বড় নিরাপত্তা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে সাইবার অপরাধ। এখন হ্যাকাররা বিভিন্ন মেরিটাইম সার্ভিসের সিস্টেমে প্রবেশ করে এর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়, সেটি অকার্যকর করে দেয় এবং তা পুনরায় সচল করার জন্য র‌্যানসমওয়্যার দাবি করে। আবার বিভিন্ন সংবেদনশীল তথ্য হাতিয়ে নিয়ে সেগুলোর বিনিময়েও মোটা অংকের অর্থ আদায় করে তারা।

এই যে মেরিটাইম খাতের নিরাপত্তা নিয়ে বহুমাত্রিক সব সংকট, তা কোনো নির্দিষ্ট দেশ বা অঞ্চলের নয়। বরং তা সারা বিশ্বের জন্যই বড় চ্যালেঞ্জের নাম। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সমুদ্র নিরাপত্তা বাড়াতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আইনি বিধিবিধান চালু, নজরদারি বৃদ্ধিসহ অবশ্যপালনীয় বিভিন্ন সুরক্ষামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা গেছে। তারপরও মাঝেমধ্যেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের মাধ্যমে সমুদ্র শিল্পকে পুরোপুরি ঝুঁকিমুক্ত করার জন্য প্রয়োজন সময়োপযোগী কর্মপরিকল্পনা ও নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ। আর তা হতে হবে সমন্বিতভাবে।

সমুদ্র নিরাপত্তার ঝুঁকিসমূহ

ব্রিটিশ স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন কোম্পানি ইনমারস্যাটের একটি প্রতিবেদন বলছে, ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে সাগরে চলাচলের সময় জাহাজের বিপদে পড়ার ঘটনা বেড়েছে। সংস্থাটির ‘দ্য ফিউচার অব মেরিটাইম সেফটি রিপোর্ট ২০২২’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ সময়ে সবচেয়ে বেশি সাহায্য চেয়ে বার্তা পাঠিয়েছে ট্যাংকার, মাছ ধরার জাহাজ ও বাল্ক ক্যারিয়ারগুলো।

বিভিন্ন পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিশ্বজুড়ে সমুদ্রে যত দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়, তার প্রায় ৮০ শতাংশেরই কারণ মানবসৃষ্ট। বাকি যে ২০ শতাংশ নিরাপত্তা সংকট প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বিরাজমান, তার ক্ষেত্রেও মানুষের অপরিণামদর্শী কার্যকলাপ অনেকাংশে দায়ী।

সমুদ্রের নিরাপত্তাঝুঁকি যে কেবল জাহাজ চলাচল, বন্দর কার্যক্রম বা পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, তা নয়। সুনীল অর্থনীতির যুগে সাগরের বহুমুখী ব্যবহার হচ্ছে। ফলে নিরাপত্তা ঝুঁকিগুলোও তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন উপায়ে। সেগুলো নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক-

২০২১ সালের মে মাসে শ্রীলংকা উপকূলে ৪৬ ধরনের রাসায়নিক নিয়ে ডুবে যায় সিঙ্গাপুরে নিবন্ধিত কনটেইনার জাহাজ এক্সপ্রেস পার্ল। শ্রীলংকার ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ সামুদ্রিক বিপর্যয় এটি

সামুদ্রিক পরিবেশের সুরক্ষাজনিত ঝুঁকি : অগ্নিকা- বা অন্য কোনো ধরনের দুর্ঘটনায় পতিত হওয়া জাহাজ থেকে তেল, রাসায়নিক বা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক অন্যান্য পদার্থ সাগরের পানিতে ছড়িয়ে পড়ার খবর প্রায়ই শোনা যায়। এই ধরনের বিপর্যয়ের ফলে জাহাজ মালিক, অপারেটর ও শিপারদের মোটা অংকের আর্থিক ক্ষতি তো হয়ই, পরিবেশের ক্ষতি হয় তার চেয়ে বেশি। তেল, রাসায়নিক ছড়িয়ে পড়ার ফলে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র বিনষ্ট হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। একই সঙ্গে সেই অঞ্চলের সমুদ্রজীবীদের জীবিকা অর্জনের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার শঙ্কাও দেখা দেয়। গত বছর শ্রীলংকা উপকূলে এক্সপ্রেস পার্ল নামের একটি রাসায়নিকভর্তি কনটেইনার জাহাজের অগ্নিদুর্ঘটনার শিকার হওয়া এবং সেটি ডুবে যাওয়ার ঘটনাতেও আমরা সেটির প্রমাণ পেয়েছি।

জাহাজ থেকে তেল সাগরের পানিতে ছড়িয়ে পড়ার ফলে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি কেমন হতে পারে, তার একটি ধারণা পাওয়া যেতে পারে কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার ফিশারিজ সেন্টার পরিচালিত একটি গবেষণা প্রতিবেদন থেকে। প্রতিবেদনটিতে যে হিসাব দেওয়া হয়েছে, তা আনুমানিক। কারণ একটি দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির সুনির্দিষ্ট পরিমাণ হিসাব করা প্রায় অসম্ভব। এছাড়া একেকটি ঘটনার আর্থিক ঝুঁকিও ভিন্ন ভিন্ন হয়।

ফিশারিজ সেন্টারের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার উত্তর উপকূলে একটি মাঝারি পর্যায়ের তেল নিঃসরণের ঘটনায় আঞ্চলিক অর্থনীতির ক্ষতি হতে পারে প্রায় ১৯ কোটি ডলার। এছাড়া উপকূল দূষণমুক্ত করতে বাড়তি খরচ হবে ২৪০ কোটি ডলার। আর যদি নিঃসরণের পরিমাণ বেশি হয়, তবে আঞ্চলিক অর্থনীতির ক্ষতি ও উপকূল দূষণমুক্ত করার ব্যয় বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৩১ কোটি ডলার ও ৯৪০ কোটি ডলার।

প্রশ্ন উঠতে পারে, প্রতি বছর কী পরিমাণ তেল সাগরে নিক্ষেপিত অথবা নিঃসৃত হচ্ছে? ধারণা করা হয় প্রতি বছর প্রায় ৭০ কোটি ৬০ গ্যালন তেল সাগরে পতিত হয়। এর প্রায় অর্ধেক আসে ল্যান্ড ড্রেনেজ ও ওয়েস্ট ডিসপোজাল (যেমন ব্যবহৃত মোটর অয়েল অনুপযুক্ত উপায়ে সাগরে ফেলে দেওয়া) থেকে। আর অফশোর ফার্মগুলোর ড্রিলিং ও উত্তোলন কার্যক্রম এবং জাহাজ অথবা ট্যাংকার লিক হয়ে তেল ছড়িয়ে পড়ার হার ৮ শতাংশের মতো। আর বাকিটা আসে জাহাজের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম (প্রায় ২০ শতাংশ), ভূখণ্ডের বায়ুদূষণ থেকে উৎপাদিত ভারী হাইড্রোকার্বন পার্টিকেল পানিতে মিশে যাওয়া (প্রায় ১৩ শতাংশ) এবং প্রাকৃতিক উৎসের (৮ শতাংশের বেশি) মাধ্যমে।

আশার কথা হলো, গত পাঁচ দশকে ট্যাংকার থেকে তেল নিঃসরণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। ইন্টারন্যাশনাল ট্যাংকারস ওনার্স পলিউশন ফেডারেশনের (আইটিওপিএফ) উপাত্ত অনুসারে, ১৯৭০-এর দশকে বড় পর্যায়ের তেল নিঃসরণের ঘটনার বার্ষিক গড় সংখ্যা ছিল ২৪ দশমিক ৫। গত দশকে সেই গড় ১ দশমিক ৭টিতে নেমে এসেছে।

জলদস্যুতা : বরাবরই সাগরে নাবিকদের কাছে সবচেয়ে বড় আতঙ্কের নাম জলদস্যুতা। গিনি উপসাগর, সিঙ্গাপুর প্রণালিসহ কিছু অঞ্চলে এই প্রবণতা তুলনামূলক বেশি। জলদস্যুরা সমুদ্রগামী বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা চালিয়ে কখনো কখনো তাতে উঠে পড়তে সক্ষম হয়। এরপর তারা জাহাজের ক্রুদের জিম্মি করে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম লুট করাসহ ক্রুদের অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ও করে থাকে। মাঝেমধ্যে জলদস্যুদের হাতে ক্রুদের প্রাণ হারানো অথবা আহত হওয়ার খবরও পাওয়া যায়।

শিগগিরই সাগর দাপিয়ে বেড়াতে দেখা যাবে শত শত স্বয়ংচালিত জাহাজকে। তবে আন্তর্জাতিকভাবে উপযুক্ত আইন ও বিধিবিধান কার্যকর না থাকলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা প্রবল

অবশ্য আইসিসি ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ব্যুরোর (আইএমবি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে বিশ্বজুড়ে সমুদ্রে জলদস্যুতা ও ডাকাতির ঘটনা ১৯৯৪ সালের পর সর্বনিম্নে নেমেছে। গত বছর জলদস্যুতা ও সশস্ত্র ডাকাতির মোট ১৩২টি ঘটনার খবর পেয়েছে আইএমবি পাইরেসি রিপোর্টিং সেন্টার। ২০২০ সালে এ সংখ্যা ছিল ১৯৫টি। ২০১৯ সালে ছিল ১৬২টি।

তবে সারা বিশ্বে কমলেও জলদস্যুতার প্রকোপ বেড়েছে এশিয়ায়। রিক্যাপ ইনফরমেশন শেয়ারিং সেন্টারের (আইএসসি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে এশিয়ায় মোট ৪০টি জলদস্যুতার ঘটনা ঘটেছে, আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় যা ১১ শতাংশ বেশি। ২০২১ সালের প্রথমার্ধে এই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল ৩৮টি। জানুয়ারি-জুন মেয়াদে এশিয়ায় মোট জলদস্যুতার অর্ধেকের বেশি ঘটেছে সিঙ্গাপুর প্রণালিতে। আলোচ্য সময়ে এই প্রণালি পাড়ি দিতে গিয়ে ২৭টি জাহাজকে জলদস্যুদের কবলে পড়তে হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে এ সংখ্যা ছিল ২০।

সাইবার হামলা : গত বছর সাইবার হামলার কবলে পড়ে ফরাসি কনটেইনার পরিবহন ও শিপিং কোম্পানি সিএমএ সিজিএম। সেই ঘটনায় তাদের গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য বেহাত হয়ে যায়। শুধু তা-ই নয়, কোম্পানিটিকে তাদের পুরো সিস্টেম অপারেশনাল করতেও বেশ বেগ পেতে হয়েছিল।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে সাইবার হামলার শিকার হয় ইউরোপের শীর্ষ চার অয়েল হাব। এই সাইবার হামলার ফলে সপ্তাহখানেকের বেশি সময় ধরে ইউরোপে অয়েল ট্যাংকার ও বার্জের শিপমেন্টে বিলম্ব হয়। হামলার পর কোম্পানিগুলো কিছু কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়।

সমুদ্র শিল্পে সাইবার হামলা এখন অন্যতম মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে এই শিল্পের অনেক খাতেই প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে। কার্যক্রমে গতিশীলতা আনা, মানবীয় ত্রুটি-বিচ্যুতি এড়ানো ইত্যাদি উদ্দেশ্যে অটোমেশনের পথে হাঁটছে মেরিটাইম খাত। তবে এটি উপকারের পাশাপাশি সমুদ্র শিল্পকে ভয়ানক ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিয়েছে। আর সেটি হলো সাইবার হামলার ঝুঁকি।

বর্তমান যুগ সুনীল অর্থনীতির। ফলে সাইবার হামলাকারীদের কাছে আকর্ষণীয় ও লাভজনক একটি খাতে পরিণত হয়েছে এটি। কোনো একটি সিস্টেমের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সেটি সচল করার বিনিময়ে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে হ্যাকাররা। আবার বিভিন্ন সংবেদনশীল তথ্য হাতিয়ে নিতে পারলে সেগুলোর মুক্তিপণ হিসেবেও বিপুল অর্থ আদায় করছে তারা।

হ্যাকিংয়ের ফলে শিপিং খাতে যে ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে-

● জাহাজ পরিচালনাকারী কোম্পানি ও জাহাজের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হওয়া, যার ফলে ত্রুটিপূর্ণ নেভিগেশন চার্ট ট্রান্সফার হয়ে যেতে পারে এবং জাহাজের যাত্রায় বিলম্ব দেখা যেতে পারে।

● অনলাইনের মাধ্যমে সংযুক্ত অনবোর্ড সিস্টেমের বিভিন্ন সরঞ্জাম ও হার্ডওয়্যারের ফাংশনাল সমস্যা তৈরি হতে পারে। সাধারণত একটি জাহাজে স্থাপিত প্রতিটি অপারেশনাল ইকুইপমেন্ট সম্পর্কে ক্রুরা পুরোপুরি অবগত থাকে না। ফলে মাঝসাগরে কোনো সমস্যা তৈরি হলে সেটি ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

● জাহাজ পরিচালনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এক্সটার্নাল সেন্সর ডেটা বেহাত হয়ে যেতে পারে।

সাইবার নিরাপত্তার দিক থেকে ২০২১ সাল খুব একটা ভালো যায়নি মেরিটাইম ও লজিস্টিকস শিল্পের জন্য। গত বছর জাহাজে হ্যাকারদের হামলার ঘটনা বেড়েছে ৩৩ শতাংশ। অবশ্য তার আগের বছরটা ছিল আরও ভয়াবহ। ২০২০ সালে জাহাজ ও পোর্ট সিস্টেমে সাইবার হামলার ঘটনা বেড়েছিল ৯০০ শতাংশ। আর চলতি বছর এরই মধ্যে আমরা কিছু হ্যাকিংয়ের ঘটনা দেখতে পেয়েছি। ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন লজিস্টিকস কোম্পানি এক্সপেডিটরস ইন্টারন্যাশনালের সার্ভারে হ্যাকারদের প্রবেশ কিংবা মুম্বাইয়ের জওহরলাল নেহরু পোর্ট কনটেইনার টার্মিনালের সিস্টেমে সাইবার হামলা খাত-সংশ্লিষ্টদের উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

সাম্প্রতিক একটি জরিপ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মেরিটাইম খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ৪৪ শতাংশ পেশাজীবী স্বীকার করেছেন যে, গত তিন বছরের মধ্যে তাদের প্রতিষ্ঠান একবার হলেও সাইবার হামলার শিকার হয়েছে। তাদের মধ্যে ৩ শতাংশ মুক্তিপণ দিতে রাজি হয়েছে, যার গড় পরিমাণ প্রায় ৩০ লাখ ডলার। ওই জরিপে আরও দেখা যায়, ৩২ শতাংশ প্রতিষ্ঠান সাইবার সুরক্ষা নিয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে না এবং ৩৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের কোনো ধরনের সাইবার রেসপন্স পরিকল্পনাই নেই।

প্রাকৃতিক দুর্যোগে জাহাজের বিপদে পড়া ও প্রাণহানি : সেই প্রাচীন আমল থেকেই সাগরে জাহাজগুলো চলাচল করে প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যে পড়ার ঝুঁকি মাথায় নিয়ে। সাধারণ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সাগরে মোট যে পরিমাণ জাহাজ দুর্ঘটনা ঘটে, তার প্রায় এক-চতুর্থাংশের জন্য দায়ী প্রতিকূল আবহাওয়া। বিশ্বের মোট বাণিজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশই সম্পন্ন হয় সমুদ্রপথে। সুতরাং পণ্য পরিবহনকারী জাহাজগুলোর নিরাপত্তা খুবই সংবেদনশীল একটি বিষয়।

অবশ্য আধুনিক নেভিগেশন এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির কল্যাণে বর্তমানে জাহাজগুলো গভীর সাগরে আগের তুলনায় অনেকটাই নিরাপদ। তা সত্ত্বেও মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন জাহাজের প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত কারণে বিপদে পড়ার খবর পাওয়া যায়। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ছোট নৌযানে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের গাদাগাদি করে সাগর পাড়ি দেওয়ার প্রচেষ্টা এই ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

১৯৯০-এর দশকে বছরে গড়ে দুই শতাধিক জাহাজডুবির ঘটনা ঘটেছে। গত চার বছরে এই সংখ্যা গড়ে ৫০-৭০টিতে নেমে এসেছে। এই উন্নতি আরও ভালোভাবে অনুধাবন করা যাবে যখন বৈশ্বিক বহরের আকার সামনে আনা হবে। আজ থেকে তিন দশক আগে বিশ্বে মোট জাহাজ ছিল ৮০ হাজার। আর বর্তমানে তা উন্নীত হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজারে। অর্থাৎ আনুপাতিক হিসাবে এখন জাহাজডুবির ঘটনা ঘটছে অনেক কম।

বিপজ্জনক পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের সময় দুর্ঘটনার ঝুঁকি : অনেক সময় জাহাজে করে জ¦ালানি, রাসায়নিক, দাহ্য গ্যাসসহ বিপজ্জনক সব কার্গো পরিবহন করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে এসব কার্গো রক্ষণাবেক্ষণ বা হ্যান্ডলিংয়ের সঠিক নিয়ম প্রতিপালন করা হয় না। সেক্ষেত্রে ভয়াবহ ও প্রাণঘাতী বিস্ফোরণের ঝুঁকি থেকে যায়। বিশেষ করে বন্দরে কার্গো ওঠানো-নামানো অথবা মজুদকালে বিস্ফোরণ ঘটলে সেটি বন্দর ও আশপাশের এলাকার জন্য ভয়াবহ বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

এই বিষয়ে দুটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যাক। গত জুনে জর্ডানের আকাবা বন্দরে একটি জাহাজে তরলীকৃত ক্লোরিন গ্যাসভর্তি ট্যাংক বোঝাই করার সময় একটি ট্যাংকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় জাহাজ ও পাশ্ববর্তী ডক এলাকায় বিষাক্ত রাসায়নিক ছড়িয়ে পড়ার কারণে অন্তত ১২ জন প্রাণ হারান। হতাহত হন আড়াইশ জনের বেশি।

গত জুনে জর্ডানের আকাবা বন্দরে জাহাজীকরণের সময় তরলীকৃত ক্লোরিন গ্যাসভর্তি ট্যাংক বিস্ফোরণে অন্তত ১২ জনের প্রাণহানি হয়। ছবিটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে নেওয়া

গত বছরের ২৭ জুন অর্গানিক পার-অক্সাইডভর্তি তিনটি কনটেইনার চীন থেকে দুবাইয়ের জেবেল আলি বন্দরে পৌঁছায়। এরপর কনটেইনারগুলো টার্মিনাল ইয়ার্ডে সূর্যালোকের নিচে রাখা হয়। দুবাইয়ের তীব্র তাপমাত্রায় দশ দিনের বেশি সময় খোলা পড়ে থাকার পর ৭ জুলাই রাতে কনটেইনারগুলো ওশান ট্রেডার নামের একটি ফিডার জাহাজে তোলা হচ্ছিল। এ সময় একটি কনটেইনারে আগুনের সূত্রপাত হয় এবং জাহাজটির ডেকে স্থাপনের কিছুক্ষণ পরই এতে বিস্ফোরণ হয়। সৌভাগ্যক্রমে ওই দুর্ঘটনায় বড় ধরনের কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। কেবল পাঁচজন সামান্য আহত হয়েছিলেন।

অন্যান্য যেসব নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ : উপরিল্লিখিত বিষয়গুলোর বাইরে আরও বিষয় রয়েছে, যেগুলো সমুদ্র নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। যেমন ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে মাঝেমধ্যে সমুদ্রে নৌশক্তি প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা দেখা যায়। নৌ-সামরিক এই বিষয়গুলো হলো প্রথাগত নিরাপত্তাঝুঁকি। আর অপ্রথাগত নিরাপত্তাঝুঁকির মধ্যে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত বিপর্যয়, মানব পাচার, অবৈধ মাদক চোরাচালান, অস্ত্র চোরাচালান, অবৈধ মৎস্য আহরণ ইত্যাদি। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়ার ফলে খাদ্য, পানি, স্বাস্থ্য ও আবাসন নিরাপত্তা মারাত্মক হুমকির মধ্যে পড়ে গেছে।

নিরাপত্তা বাড়াতে রয়েছে বৈশ্বিক উদ্যোগ

সামুদ্রিক জলদস্যুতার প্রসঙ্গ এলেই যে অঞ্চলের নাম সবার আগে আসে, সেটি হলো গিনি উপসাগর। গত এক দশকে এটি ছিল জলদস্যুতার প্রধান হটস্পট। গত বছর স্টেবল সিজ কর্তৃক প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, এই অঞ্চলে জলদস্যুরা অপহরণ, চুরির মতো অপকর্মের মাধ্যমে প্রতি বছর ৫০ কোটি ডলার প্রত্যক্ষ আয় করে। বিশেষ করে নাইজার ডেল্টায় জলদস্যুতার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি।

জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে তিন দশকের সর্বনি¤œ পর্যায়ে নেমে এসেছে জলদস্যুতা

তবে পরিস্থিতি এখন পাল্টেছে। গিনি উপসাগরে বছর দুয়েক আগের আর বর্তমান চিত্রের মধ্যে অনেক ফারাক। জলদস্যুতা প্রতিরোধ সক্ষমতা বাড়াতে গিনি উপসাগরে চলমান রয়েছে নাইজেরিয়ার বিভিন্ন কর্মসূচি। এটা তো রয়েছেই, পাশাপাশি সেখানে আন্তর্জাতিক মেরিটাইম ফোর্সের যুদ্ধজাহাজও মোতায়েন রয়েছে। এই অঞ্চলে জলদস্যুতা প্রতিরোধের লক্ষ্যে বাল্টিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম কাউন্সিলের (বিমকো) উদ্যোগে ২০২১ সালের মে মাসে গ্রহণ করা হয়েছে গালফ অব গিনি ডিক্লারেশন অন সাপ্রেশন অব পাইরেসি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরকারী অংশীজনের সংখ্যা বাড়ছে। এদিকে গিনি উপসাগরে নিরাপত্তা টহল অব্যাহত রাখার জন্য নিজেদের কয়েকটি সদস্য রাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজ আরও দুই বছর মোতায়েন রাখার ঘোষণা দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। কো-অর্ডিনেটেড মেরিটাইম প্রেজেন্সেস (সিএমপি) পাইলট প্রোগ্রামের অধীনে গত দুই বছর গিনি উপসাগরে যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন রেখেছিল ইইউ সদস্য দেশগুলো।

এসব সমন্বিত উদ্যোগ এই অঞ্চলে সোমালি জলদস্যুদের উৎপাত মোকাবিলায় কতটা কার্যকর ভূমিকা রেখেছে, তা পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট। ২০২১ সালের প্রথম তিন মাসে সারা বিশ্বে মোট যে পরিমাণ জলদস্যুতার ঘাটনা ঘটেছিল, তার ৪৩ শতাংশই ঘটে গিনি উপসাগরে। সেখান থেকে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে এই হার নেমে এসেছে ১৯ শতাংশে।

অবশ্য গিনি উপসাগর নিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়ার মতো সময় এখনো আসেনি। সম্প্রতি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ গিনি উপসাগর ঘিরে একটি নতুন সিকিউরিটি রেজোল্যুশন সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করেছে। এর অর্থ হলো গিনি উপসাগরের জলদস্যুতা নিয়ে সংস্থাটির উদ্বেগ এখনো শেষ হয়ে যায়নি। বরং তারা নতুন করে সেখানকার নিরাপত্তার বিষয়টি পর্যালোচনাধীন রাখার উদ্যোগ নিয়েছে। গিনি উপসাগর নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদ সর্বশেষ রেজোলিউশন গৃহীত হয়েছিল প্রায় এক দশক আগে।

নতুন রেজোলিউশনে নিরাপত্তা পরিষদ বলেছে, গিনি উপসাগরে জলদস্যুতা ও সশস্ত্র ডাকাতি প্রতিরোধের জন্য এর উপকূলীয় দেশগুলোকেই প্রাথমিক দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সহযোগিতার ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, সেগুলো দূর করার উদ্যোগও নিতে হবে তাদের। এই অঞ্চলে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলোর প্রতি তাদের দেশীয় আইনে জলদস্যুতা ও সশস্ত্র ডাকাতিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। একই সঙ্গে উপকূলীয় দেশগুলোর আইনি কাঠামোতে যেসব উল্লেখযোগ্য অসামঞ্জস্য রয়েছে, সেগুলোও দূর করতে বলা হয়েছে রেজোলিউশনে।

জলদস্যুতা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সাইবার হামলা থেকে সমুদ্র শিল্পকে সুরক্ষা দিতেও বিভিন্ন উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে। বিভিন্ন স্টার্টআপ কোম্পানি সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে নিত্যনতুন সব সলিউশন নিয়ে হাজির হচ্ছে। এই খাতের সর্বশেষ উদ্ভাবন ও অগ্রগতি তুলে ধরা এবং জ্ঞান বিনিময়ের জন্য নিয়মিত আয়োজন করা হচ্ছে বিভিন্ন প্রদর্শনী ও সেমিনার।

সাগরে চলাচলের সময় একাধিক জাহাজের মধ্যে সংঘর্ষ কিংবা বন্দরে ডকিংয়ের সময় পাশ্ববর্তী জাহাজ অথবা বন্দর অবকাঠামোর সঙ্গে ধাক্কা লাগার খবর প্রায়ই শোনা যায়। কিন্তু এমনটি কেন হয়? একটি জরিপ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ৪৫ শতাংশ নাবিক স্বীকার করেছেন যে তারা নিরাপত্তামূলক সব প্রক্রিয়া সঠিকভাবে পালন করেননি। অর্থাৎ মানবসৃষ্ট কারণে দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে। এক্ষেত্রে সমাধান হতে পারে স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি। নিরাপত্তা বৃদ্ধির পাশাপাশি এই প্রযুক্তি কার্যদক্ষতা বৃদ্ধি ও পরিবেশগত সুরক্ষাতেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

তবে সমুদ্র পরিবহন খাতে স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির সর্বাত্মক ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমেই বলা যায় আন্তর্জাতিক কিছু বিধিবিধান মেনে চলার বাধ্যবাধকতার কথা। সাগরে চলাচলের সময় জাহাজগুলোর সংঘর্ষ এড়ানোর লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে কনভেনশন অন দ্য ইন্টারন্যাশনাল রেগুলেশনস ফর প্রিভেনটিং কলিশনস অ্যাট সি (সিওএলআরইজি) গ্রহণ করে ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (আইএমও), যা বাস্তবায়িত হয় ১৯৭৭ সালে। এই কনভেনশন হলো আন্তর্জাতিক রুটগুলোয় জাহাজ চলাচলের জন্য কিছু অবশ্য পালনীয় বিধিবিধান। জাহাজের স্বয়ংক্রিয় নেভিগেশন সর্বজনীন করার ক্ষেত্রে এই কনভেনশনের শর্তগুলো প্রতিপালনের বিষয়টি প্রাথমিকভাবে বড় একটি চ্যালেঞ্জই বটে।

আরেকটি বড় প্রতিবন্ধকতা হলো জাতিসংঘের একটি বিধান। ১৯৮২ সালে গৃহীত ইউএন কনভেনশন অন দ্য ল’ অব দ্য সি অনুযায়ী প্রতিটি জাহাজের অবশ্যই একজন মাস্টার থাকতে হবে এবং তাকে অবশ্যই সর্বদা দায়িত্বরত থাকতে হবে। তবে সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জ, সেটি হলো সাইবার নিরাপত্তা। স্বয়ংচালিত জাহাজগুলোর স্বয়ংক্রিয় নেভিগেশন সিস্টেম যে সাইবার অপরাধীরা হ্যাক করবে না, সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে জাহাজের ‘ভার্চুয়াল নিয়ন্ত্রণ’ হ্যাকারদের দখলে চলে যেতে পারে।

নাবিকদের সুরক্ষা

সমুদ্র শিল্পের প্রাণ নাবিকরা। অথচ এই খাতে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকতে হয় তাদেরই। বিশেষ করে চলতি বছর নাবিকদের সুরক্ষার বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। এমনিতেই ২০২০ সালে করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, ক্রু পরিবর্তনে জটিলতা, জাহাজ থেকে বন্দরে নামার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ ইত্যাদি কারণে নিম্নমুখী ছিল নাবিকদের প্রসন্নতা সূচক। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর পর নাবিকদের নিরাপত্তা নিয়ে তৈরি হওয়া সংকটে এই সূচক আরও পতনমুখী হয়েছে।

রাশিয়ার অভিযান শুরুর পর ইউক্রেনে আটকা পড়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জাহাজ ও নাবিক। কৃষ্ণসাগর ও আজোভ সাগরে আটকা পড়া এসব জাহাজ ও ক্রুদের নিরাপত্তা নিয়ে বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ তৈরি হয়। এমন পরিস্থিতিতে গত মার্চে নাবিকদের নিরাপত্তা, বিশেষ করে ইউক্রেনে আটকা পড়া নাবিকদের সুরক্ষা নিয়ে আলোচনার জন্য বিশেষ কাউন্সিল সেশনে বসে ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (আইএমও)। সেই সেশনে সংস্থাটি নাবিকদের সর্বোচ্চ সহায়তা প্রদানে এগিয়ে আসার জন্য সদস্য রাষ্ট্র ও পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর প্রতি আহ্বান জানায়।

আইএমওর সেই সভায় আন্তর্জাতিক সমুদ্র পরিবহন ও সাপ্লাই চেইনের স্বাভাবিকতা বজায় রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। একই সঙ্গে ইউক্রেনে আটকা পড়াদের জন্য জরুরি খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করার ওপরও জোর দেওয়া হয়। একটি ফ্ল্যাগ স্টেট, বন্দরসমৃদ্ধ দেশ ও উপকূলীয় রাষ্ট্র হিসেবে আইএমওর ফ্রেমওয়ার্কের অধীনে যেসব অধিকার ইউক্রেনের পাওনা, অনতি বিলম্বে সেগুলো সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয় সেই বিশেষ কাউন্সিল সেশনে।

কেবল আইএমওই নয়, নাবিকদের স্বাস্থ্যগত সুরক্ষা ও কল্যাণে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সরকারগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের চারটি সংস্থা আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও), ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (আইএমও), জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন-বিষয়ক কনফারেন্স (আঙ্কটাড) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। এক যৌথ বিবৃতিতে তারা আন্তর্জাতিক শিপিং খাতে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য দশটি বিষয়ে নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।

বাংলাদেশের জন্য সমুদ্র নিরাপত্তার গুরুত্ব

দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ পেয়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি টেরিটোরিয়াল সমুদ্র এলাকা, ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইইজেড) এবং বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার। অর্থাৎ ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটার স্থলভাগের প্রায় কাছাকাছি আয়তনের জলসীমার আইনসঙ্গত নিয়ন্ত্রণ পেয়েছি আমরা।

বাংলাদেশের প্রাণিজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে মৎস্যসম্পদ, সামুদ্রিক প্রাণী, আগাছা-গুল্মলতা ইত্যাদি। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় রয়েছে চারটি মৎস্যক্ষেত্র। অপ্রাণিজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে খনিজ ও খনিজ-জাতীয় সম্পদ যেমন- তেল, গ্যাস, চুনাপাথর ইত্যাদি। এছাড়া রয়েছে ১৭ ধরনের মূল্যবান খনিজ বালি। সমুদ্রসৈকতের বালিতে মোট খনিজের মজুদ ৪৪ লাখ টন। প্রকৃত সমৃদ্ধ খনিজের পরিমাণ প্রায় ১৭ লাখ ৫০ হাজার টন, যা বঙ্গোপসাগরের ১৩টি স্থানে পাওয়া গেছে।

আধুনিক যুগে অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে জ্বালানি তেল ও গ্যাস। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য জ্বালানি নিরাপত্তার কোনো বিকল্প নেই। এতদিন স্থলভাগের গ্যাস উত্তোলনের ফলে বাংলাদেশের এই জ্বালানি সম্পদটির মজুদ কমে গেছে। সেক্ষেত্রে নতুন করে আশার আলো দেখাচ্ছে বঙ্গোপসাগরের অফশোর গ্যাসক্ষেত্রগুলো। আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের রায়ের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ ১৭টি ব্লকের মধ্যে ১২টির আইনগত অধিকার পেয়েছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে ভারতের কাছ থেকে দাবিকৃত ১০টি ব্লকের সবগুলোই পাওয়া গেছে। সমুদ্রসীমা নির্ধারণের ফলে এই ব্লকগুলোয় গ্যাস অনুসন্ধানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

প্রাণিজ-অপ্রাণিজ সম্পদ আহরণের বাইরে সমুদ্র থেকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার মতো আরও কিছু ক্ষেত্র রয়েছে বাংলাদেশের। সমুদ্রগামী জাহাজ নির্মাণে গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য রয়েছে বাংলার। এই ঐতিহ্যকে কাজে লাগিয়ে বৈশ্বিক জাহাজ নির্মাণ শিল্পে অংশীদারিত্ব বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের সামনে। আর জাহাজ ভাঙা শিল্পে তো এরই মধ্যে শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। গত টানা তিন বছর জাহাজ ভাঙায় প্রথম অবস্থান ধরে রাখার কীর্তি গড়া বাংলাদেশের মূল অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে এই শিল্প।

সুনীল অর্থনীতির যুগে গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও আহরণ কার্যক্রম বাড়ছে। তবে সম্ভাবনার সাথে সাথে এই খাতে নিরাপত্তা ও দুর্ঘটনার ঝুঁকিও কম নয়

বিশ্বের দীর্ঘতম অখ- সমুদ্রসৈকত রয়েছে বাংলাদেশের। রয়েছে বিশাল উপকূলীয় সীমারেখা। প্রাকৃতিক প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন, সাগরকন্যা কুয়াকাটা, বিশ্বের বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চল সুন্দরবন, অতল গিরিখাত সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড- এগুলো সবকিছুই নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে অনন্য। বাংলাদেশের রয়েছে সমুদ্র ও উপকূলীয় পর্যটনের অফুরন্ত সম্ভাবনা।

এই যে সমুদ্রভিত্তিক অর্থনৈতিক কার্যক্রমের এত সম্ভাবনা, তা থেকে দীর্ঘমেয়াদি সুফল পেতে হলে সমুদ্রনিরাপত্তা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই বাংলাদেশের জন্য।

অনুসরণীয় চট্টগ্রাম বন্দর

অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাংলাদেশ। একসময়কার তলাবিহীন ঝুড়ির পরিচয় পাওয়া বাংলাদেশ আজ অর্থনৈতিক উন্নয়নের রোল মডেল। ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত টানা তিন বছরে ৭ শতাংশের বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। ২০১৯ সালে তো এই হার ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। তবে করোনা মহামারি, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট, চাহিদার মন্দা ইত্যাদি বৈশ্বিক কারণে পরের দুই বছর জিডিপির প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমলেও সেই ধাক্কা কাটিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। এই যে প্রবৃদ্ধির গতিশীলতা ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের সক্ষমতা, তার মূলে রয়েছে তৈরি পোশাক শিল্পের সম্প্রসারণ। পোশাক তৈরির কাঁচামাল আমদানি ও বহির্বিশ্বে পোশাক রপ্তানির প্রায় পুরোটাই পরিবাহিত হয় চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় সর্বদাই মূল চালিকাশক্তি হিসেবে ভূমিকা রেখেছে চট্টগ্রাম বন্দর, যাকে বলা হয় দেশের অর্থনীতির প্রাণভোমরা। দেশের বাইরে থেকে আমদানিকৃত পণ্যবাহী যেকোনো জাহাজকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিরাপদে বন্দর জেটিতে এনে পণ্য খালাসের মাধ্যমে স্থিতিশীল রাখছে দেশের পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা। চট্টগ্রাম বন্দর  থেকে সড়ক ও নৌপথে আমদানি পণ্য পৌঁছে যাচ্ছে  দেশের আনাচে-কানাচে ভোক্তাদের হাতের নাগালে। অন্যদিকে দেশে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী বিশেষত গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিম-লে দেশের সুনাম বৃদ্ধি করে চলেছে চট্টগ্রাম বন্দর।

দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যকে সচল রাখতে বাণিজ্যিক জাহাজের নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষও বিষয়টিতে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে বহির্নোঙরে নজরদারি জোরদার করেছে। একই সাথে ভেসেল ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (ভিটিএমআইএস) স্থাপনের মাধ্যমে বহির্নোঙরে প্রতিটি জাহাজের নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ ২৪/৭ নিরবচ্ছিন্নভাবে তদারকি করা হচ্ছে। এর ফলশ্রুতিতে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পাইরেসির হার শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে, যা ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (আইএমও) সহ অন্যান্য সমুদ্র সংস্থা কর্তৃক স্বীকৃতি লাভ করেছে। এ ধরনের অর্জন বহির্বিশে^ চট্টগ্রাম বন্দরের সুনাম বহুলাংশে বৃদ্ধি করেছে।

প্রকৃতির কাছে মানুষ কতটা অসহায়, তার প্রমাণ শত শত বছর ধরে পেয়ে আসছে সমুদ্র খাত। উত্তাল সাগরে সলিল সমাধি হয়েছে অগুনতি জাহাজের

চট্টগ্রাম বন্দর ২০০৪ সালের ১ জুলাই থেকে ইন্টারন্যাশনাল শিপ অ্যান্ড পোর্ট ফ্যাসিলিটি সিকিউরিটি (আইএসপিএস) কোড বাস্তবায়ন ও দক্ষতার সাথে প্রতিপালন করে আসছে। ফলে আইএসপিএস কমপ্লায়েন্স পোর্ট হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দর বিশ্বে সুপরিচিত। তাছাড়া টু-স্টেজ গেট স্থাপন, ভ্রাম্যমাণ ভেহিকল দ্বারা কনটেইনার স্ক্যানিং সিস্টেম, সিসি ক্যামেরা ও ফায়ার অ্যালার্ম সিস্টেম স্থাপনসহ নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং ব্যাপক সংস্কারের ফলে দেশে ও বিদেশে বন্দরের ভাবমূর্তি সমুন্নত য়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে ২০১২ সালে চট্টগ্রাম বন্দরকে নিরাপদ বন্দর হিসেবে আখ্যায়িত করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ব্যুরো (আইএমবি)। তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘কর্তৃপক্ষের যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণের ফলে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের টেরিটোরিয়াল সমুদ্রসীমায় জলদস্যুতা ও ডাকাতির মতো ঘটনা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে’। জলদস্যুতা রোধের ফলে দেশে ও বিদেশে বন্দরের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে এবং বিষয়টি রিজিওনাল কো-অপারেশন এগ্রিমেন্ট অন কম্ব্যাটিং পাইরেসি অ্যান্ড আর্মড রবারি এগেইনস্ট শিপস ইন এশিয়ার (রিক্যাপ) রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১২ সালের রিক্যাপ অ্যানুয়াল রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘আরব সাগর ও বাংলাদেশে সুস্পষ্ট উন্নতি লক্ষ করা গেছে। গত চার বছরের (২০০৮-২০১১) তুলনায় ২০১২ সালে বাংলাদেশে জলদস্যুতা সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে।’

চট্টগ্রাম বন্দর শতভাগ দস্যুতামুক্ত হয় ২০১৯ সালে। সে বছর বিশ্বের একমাত্র সমুদ্র বন্দর ছিল এটি, যেখানে কোনো ধরনের দস্যুতা অথবা চুরি-ডাকাতির ঘটনা ঘটেনি। গত দুই বছরও চট্টগ্রাম বন্দরের জলসীমায় কোনো দস্যুতার ঘটনা ঘটেনি।

চট্টগ্রাম বন্দরের জলসীমায় এখন আর বড় ধরনের কোনো জলদস্যুতার ঘটনা ঘটে না। কালেভদ্রে যেসব ঘটনার খবর পাওয়া যায়, সেগুলোকে নিছক ছিঁচকে চুরি বলা চলে। তাও আবার সব খবরের যে সত্যতা থাকে, তাও নয়। এই যেমন সম্প্রতি কোটা রঞ্চক নামের সিঙ্গাপুরের পতাকাবাহী একটি কনটেইনার জাহাজ ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্সের (আইসিসি) সমুদ্র নিরাপত্তা নজরদারি সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ব্যুরোর (আইএমবি) কাছে অভিযোগ দাখিল করে যে, চট্টগ্রামের বহির্নোঙরে দুস্যতার শিকার হয়েছে তারা। অথচ জাহাজটির মাস্টার বা কোনো নাবিক চট্টগ্রাম বন্দরের পোর্ট কন্ট্রোল বা কোস্ট গার্ডকে এ বিষয়ে অবহিতই করেনি।

তবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহানের অনুরোধে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড পূর্ব জোনের একটি দল জাহাজটিতে কথিত পাইরেসির বিপরীতে তদন্ত শুরু করে। অনুসন্ধানে জানা যায়, এটি ছিল জাহাজের নাবিকদের যোগসাজশে চুরির ঘটনা। এমনকি কোটা রঞ্চকের মাস্টার আইএমবিতে দাখিল করা অভিযোগটি ভুল এবং জাহাজে কোনোরূপ পাইরেসি ঘটেনি বলে স্বীকার করেন। বলা যায়, বন্দর চেয়ারম্যানের সাহসী ভূমিকার কারণেই পাইরেসির একটি অপবাদের হাত থেকে রক্ষা পায় চট্টগ্রাম বন্দর।

নিরাপত্তা তৎপরতার সাম্প্রতিক উদাহরণ

চলতি বছরের মে মাসে প্রায় ৮০০ কোটি ডলারের রপ্তানি পণ্য নিয়ে ডুবতে বসেছিল ভিয়েতনামের পতাকাবাহী জাহাজ এমভি হাইয়ান সিটি। ১ হাজার ১৫৬ একক কনটেইনার নিয়ে সিঙ্গাপুরে যাচ্ছিল জাহাজটি। এর মধ্যে প্রায় ৭০০ একক কনটেইনারে ছিল রপ্তানি পণ্য। যাত্রাপথে বঙ্গোপসাগরের কুতুবদিয়ার কাছে একটি তেলবাহী ট্যাংকারের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় জাহাজটির। এতে একটি খালি কনটেইনার জাহাজ থেকে সাগরে পড়ে যায়। পেছনের অংশ ফুটো হয়ে পানি ঢুকে প্রায় সাত ডিগ্রি কৌণিকভাবে কাত হয়ে পড়ে হাইয়ান সিটি। দুমড়ে-মুচড়ে যায় জাহাজটির এক পাশে থাকা কনটেইনার।

দুর্ঘটনার পর জাহাজটির আর চলাচলের সক্ষমতা ছিল না। এছাড়া ক্ষতিপূরণের বিষয়ে সমঝোতা না হওয়ায় বন্দর ত্যাগের অনুমতি দেওয়া হয়নি জাহাজটিকে। ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকা জাহাজটিকে উদ্ধার করতে চট্টগ্রাম বন্দরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, জাহাজের মালিক প্রতিনিধি, স্থানীয় এজেন্ট, উদ্ধারকারী সংস্থা, জাহাজের বিমাকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ডসহ সব সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক করেন বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান। এরপরই জাহাজটিকে বিশেষ ব্যবস্থায় জেটিতে ভেড়ানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বিশেষ উদ্যোগে বেসরকারি কর্ণফুলী ড্রাইডক জেটিতে মেরামতের জন্য নেওয়া হয় হাইয়ান সিটিকে।

বিশ্বায়নের যুগে সমুদ্র বাণিজ্যের চাপ ও জাহাজ চলাচল সমানতালে বেড়েছে। একই সাথে বেড়েছে জাহাজে-জাহাজে সংঘর্ষের ঝুঁকি

আরেকটি ঘটনা ঘটে গত জুলাইয়ে। ভোলার মনপুরা উপজেলার দক্ষিণে অবস্থিত চরনিজাম সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে ভেসে আসে নাবিকবিহীন একটি বিদেশি পুরনো জাহাজ। এটির আকার বড় পন্টুনের মতো। জাহাজের ওপরে ছিল একটি খননযন্ত্র (ভেকু), একটি পাথর ভাঙার মেশিন ও বড় বড় পাথরের খ-সহ বেশ কিছু সরঞ্জাম।

স্থানীয়রা জানান, জাহাজটির গায়ে নাম লেখা রয়েছে আল কুবতান। এর ওপরের অংশ খোলা। জাহাজটিতে কয়েক কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে বলে ধারণা করেন তারা। নাবিকবিহীন জাহাজটিকে ভাসতে দেখে স্থানীয়রা প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিকে বিষয়টি জানান। প্রশাসন বিষয়টি বাংলাদেশ নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড ও নৌপুলিশকে অবহিত করে। খবর পেয়ে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের একটি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে জাহাজটিকে উদ্ধার করে।

উপসংহার

সমুদ্র শিল্প এখন বিশ্বজনীন। এর অংশীদারও বহু। একটা সময় ছিল, যখন কেবল বাণিজ্য ও মৎস্য আহরণেই সীমিত ছিল সমুদ্রজীবিকা। তবে সুনীল অর্থনীতির এই যুগে তা বহুমাত্রিক রূপ নিয়েছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমুদ্র নিরাপত্তার ঝুঁকিও বহুমুখী আকার ধারণ করেছে।

সমুদ্র নিরাপত্তা এখন অত্যন্ত জটিল একটি বিষয়। এত বেশি সংখ্যক অংশীদার যে শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত, সেই শিল্পের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সহজ বিষয় নয়। আর এই কঠিন কাজটি কার্যকরভাবে সম্পন্ন করতে হলে আমাদের প্রচলিত ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন করে ভাবতে হবে।

এক্ষেত্রে আমাদের প্রথমেই অনুধাবন করতে হবে, সমুদ্র নিরাপত্তা আমাদের জন্য কেন এত গুরুত্বপূর্ণ। এরপর খুঁজে বের করতে হবে কোন কোন ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ঘাটতি রয়েছে এবং কেন রয়েছে। সবার শেষে আমাদের এই ঘাটতিগুলো দূর করার উপায় সন্ধান করতে হবে এবং সেগুলোর কার্যকর প্রয়োগ ঘটাতে হবে।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সঠিক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করতে পারলে সাগরে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনা সম্ভব। আর সমুদ্র শিল্পের টেকসই ভবিষ্যৎ নির্মাণে এই উন্নতির যে কোনো বিকল্প নেই, তা আর না বললেও চলে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here