বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক খাতে অগ্রসরমান একটি দেশ। একসময়ের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর দেশটি আজ সারা বিশে^র জন্য উন্নয়নের রোলমডেল। মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জনের পথে অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে বাংলাদেশকে। দেশের সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো অর্জিত অবস্থান সংহত করা এবং নতুন লক্ষ্যে পৌঁছানো। এজন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হলো ভৌগোলিক অবস্থানগত সুযোগ কাজে লাগানো। বর্তমান যুগ যোগাযোগ বা কানেক্টিভিটির। যোগাযোগ খাতে অগ্রসর হতে পারলে ব্যবসার ব্যয় বা কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস কমবে। বাড়বে উৎপাদন সক্ষমতা। এছাড়া বিশ্ববাজার ও একই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতাও বাড়বে। মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে অভ্যন্তরীণ বাজারে নিজ দেশের উৎপাদকের পাশাপাশি অন্য দেশের উৎপাদকের সঙ্গেও প্রতিযোগিতা করতে হয়। কানেক্টিভিটি এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।

বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারত এখন বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। আর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীনও আমাদের কাছের দেশ। এ দুটি দেশ থেকে আমাদের প্রয়োজনীয় পণ্যের বেশির ভাগ আমদানি হয়। চীন থেকে বছরে প্রায় এক হাজার কোটি ডলার ও ভারত থেকে ৬০০ কোটি ডলারের পণ্য আসে বাংলাদেশে। বিপরীতে জনবহুল এ দেশ দুটিতে আমাদের জন্যও রয়েছে সম্ভাবনাময় বিশাল বাজার। বাংলাদেশ সেখানে প্রচুর পণ্য রপ্তানি করতে পারে। যদিও এখন পর্যন্ত দেশ দুটি থেকে আমদানির তুলনায় রপ্তানি অনেক কম। এক্ষেত্রে অবশ্যই কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। তবে শুল্ক বাধার চাইতে অশুল্ক বাধাই অনেক বড়। সেটা দূর করা বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ উতরাতে হলে আঞ্চলিক সংযোগ বা কানেক্টিভিটি উন্নত করতে হবে। বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার (বিসিআইএম) অর্থনৈতিক করিডোর সেই সুযোগটাই করে দেবে।

বিসিআইএম হলো একটি আঞ্চলিক অর্থনৈতিক করিডোর, যার উদ্যোক্তা চীন। বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার নিয়ে এই করিডোর গঠনের প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত। এটি বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দ্বার খুলে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

বিআরআই: সিল্ক রোডের পুনরুত্থান

বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) বা ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড (ওবিওআর) যে নামেই ডাকা হোক না কেন, প্রকৃত অর্থে এটি হলো প্রাচীন সিল্ক রোডেরই নতুন সংস্করণ। এক কথায় বলা যায়, পুরনো কাঠামোর ওপর ভিত্তি করেই কোনো কিছুর নতুন রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা এটি।

অর্থনৈতিক শক্তি বজায় রাখতে যতগুলো বাণিজ্যিক যোগাযোগ সুবিধা থাকা দরকার, তার সবটা কাজে লাগাতে চায় বেইজিং। এজন্য চীনের বিআরআই প্রস্তাবনাটি কৌশলগত কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে এ উদ্যোগ নতুন কোনো বিষয় নয়। প্রাচীনকালে চীনের বণিকরা এশিয়া ও ইউরোপের সঙ্গে সিল্ক রোড দিয়ে ব্যবসা করতেন। মূলত তারই পুনরুত্থান হচ্ছে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং প্রস্তাবিত বিআরআই।

চীনে খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ অব্দের দিকে হান সা¤্রাজ্যের সময়ে সিল্ক রোড বা সিল্ক রুট নামের এই বাণিজ্য পথটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এ পথ দিয়ে শুধু চীনা ব্যবসায়ীরাই নন, বরং আরব, তুরস্ক, ভারত, ইরান, সিরিয়া, আর্মেনিয়াসহ বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ীরা মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, আরব, ইউরোপ ও আফ্রিকায় বাণিজ্য করতেন। এই পথের নাম সিল্ক রোড হওয়ার কারণ হলো এ পথে চীনের উৎকৃষ্ট মানের রেশম বিশে^র বিভিন্ন দেশে পাঠানো হতো।

বিআরআই ও বিসিআইএম

১৯৩০ সালে ব্রিটিশ সরকার দুই হাজার বছরের পুরনো সিল্ক রোড চালুর উদ্যোগ নিয়েছিল। চট্টগ্রাম বন্দরের পণ্য কক্সবাজার, টেকনাফ, মিয়ানমারের আকিয়াব, মান্দালয় হয়ে চীনের কুনমিং পর্যন্ত পৌঁছানোই ছিল এ পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের কারণে এ উদ্যোগের বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এর প্রায় সাত দশক পর ১৯৯৯ সালে বাণিজ্যিক শহর কুনমিংয়ে সিল্ক রোড পুনরুজ্জীবিত করার ঘোষণা দেয় চীন। ১৪ বছর ধরে প্রস্তাবটি নিয়ে কাজ করে চীন। কিন্তু অন্য দেশগুলো তখন তেমন সাড়া দেয়নি। তবে অর্থনৈতিক লাভের বিষয়টি ভেবে বর্তমানে সব দেশই ইতিবাচক সাড়া দিচ্ছে।

বিসিআইএম মূলত চীনের বিআরআই উদ্যোগেরই একটি অংশ। প্রাচীন সিল্ক রোড একসময় এ অঞ্চলের মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটিয়েছিল। ওবিওআর বা বিআরআইয়ের মাধ্যমে সেই সমৃদ্ধিই আবার ফিরিয়ে আনতে চাইছে চীন। পার্থক্য কেবল একটাই-বর্তমান ভূ-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই করিডোর নতুনভাবে সম্প্রসারণের ছক এঁকেছে তারা। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে চীন একটি ইকোনমিক ল্যান্ড বেল্ট গঠনের বিষয়ে কাজ করছে, যার ফলে প্রাচীন সিল্ক রোডের আওতাধীন দেশগুলোর সঙ্গে মধ্য এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ যুক্ত হবে। এছাড়া চীন একটি মেরিটাইম ট্রান্সপোর্ট নেটওয়ার্কও গড়ে তুলতে চাইছে, যার মাধ্যমে দেশটির বন্দরগুলোর সঙ্গে আফ্রিকান ঊপকূলের সংযোগ স্থাপন হবে।

ওবিওআর ধারণা প্রথমে সামনে আসে ২০১৩ সালে। সংগত কারণেই অনেক দেশ এ উদ্যোগকে স্বাগত জানায়। তারা উপলব্ধি করে, যদি এশিয়া ও বিশে^র অন্যান্য স্থানে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি বাড়াতে হয়, তাহলে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও মানুষে মানুষে যোগাযোগ গভীরতর করতে হবে। এশিয়া ও ইউরোপের সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ ও সহযোগিতা বাড়াতে পারলে অর্থনীতিতে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। ভোক্তা ও উৎপাদক, আমদানি ও রপ্তানিকারক-সবাই এর সুফলভোগী হবে।

বিসিআইএম নিয়েও আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয় ২০১৩ সালে। সে বছরের ১৮ ও ১৯ ডিসেম্বর বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত হয় চার দেশের প্রতিনিধি দলের প্রথম বৈঠক। পরের বছরের ১৭ ও ১৮ ডিসেম্বর কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত দুই দিনব্যাপী সম্মেলনে অংশ নেয় বাংলাদেশ, ভারত, চীন ও মিয়ানমার। সেই সম্মেলনে বিসিআইএম বিষয়ে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করে চার দেশ। এতে জ্বালানি সহযোগিতা, জলবায়ু পরিবর্তন, বাণিজ্য সহজীকরণ, শুল্ক কমানো, অ-শুল্ক বাধা দূর, সংস্কৃতি বিনিময় ও জনসাধারণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়, দারিদ্র্য বিমোচন, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিষয় উঠে আসে।

গতিশীল হবে বিনিয়োগ

বিসিআইএম করিডোর নিয়ে চার দেশ অনেক দিন ধরেই কাজ করছে। বিসিআইএম দেশগুলোয় ২৮০ কোটি মানুষের বসবাস, যার অর্থনীতির আকার ১১ লাখ কোটি ডলার। বিসিআইএমের বিষয়টি সমন্বয় করছে চীনের ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট রিফর্মস কমিটি (এনডিআরসি)। সড়ক, রেল ও সমুদ্রপথকে ব্যবহার করে এই এলাকার মানুষের মধ্যে একটি বড় বাজার সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। এর আগে চীনের উদ্যোগে এ অঞ্চলের ২১টি দেশ মিলে ৫ হাজার কোটি ডলারের তহবিল নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি)। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সিল্ক রোড চালুর জন্য ৪ হাজার কোটি ডলারের আর্থিক সহায়তাও ঘোষণা করেছেন। সিল্ক রোড নির্মাণ ও এই অঞ্চলের অবকাঠামোগত উন্নয়নে খরচ করা হবে এই অর্থ। বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমারের মধ্যে অর্থনৈতিক করিডোর চালুর জন্য যোগাযোগ নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠায় প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি ডলার লাগবে বলে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে কক্সবাজার সম্মেলনে প্রাথমিকভাবে জানানো হয়েছিল। বিসিআইএম চালু হলে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়াসহ ভারতের সঙ্গে পাকিস্তান, আফগানিস্তানও যুক্ত হতে পারবে।

২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফরকালে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের নতুন অধ্যায় শুরু হয় এবং প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের উন্নয়নের বিষয়ে সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বিআরআই উদ্যোগের আওতায় এসব উন্নয়ন প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত।

চীনের কুনমিং থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা পর্যন্ত বিস্তৃত বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোরের আওতায় কী কী প্রকল্প গ্রহণ করা যাবে, সেটা নিয়ে যৌথ স্টাডি গ্রুপের সমীক্ষা চলছে। এ ধরনের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে চাই অবকাঠামো খাতে প্রচুর বিনিয়োগ। এআইআইবি গঠনের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে এসব খাতের অর্থের জোগান দেওয়া। এ ব্যাংক স্থাপনে চীনের উদ্যোগ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বাংলাদেশসহ অর্ধশতাধিক দেশ এরই মধ্যে এর সদস্য হয়েছে।

কুনমিং থেকে কলকাতা পর্যন্ত অর্থনৈতিক করিডোর কেবল যোগাযোগের করিডোর হবে না। এর অর্থনৈতিক করিডোরে রূপান্তরের রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। এর আওতায় বিনিয়োগ বাড়বে। অর্থনৈতিক কর্মকা- জোরদার হবে। পরিবহন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যয় কমিয়ে আনার জন্য নেওয়া হবে বিভিন্ন পদক্ষেপ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, চীন হচ্ছে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান আমদানি উৎস। বাংলাদেশ বিশ^বাজার থেকে যত পণ্য আমদানি করে, তার বড় একটি অংশ আসে চীন থেকে। সাম্প্রতিক সময়ে চীন ভারতেরও অন্যতম প্রধান বাণিজ্য অংশীদার হয়ে উঠেছে। দুই দেশের মোট বাণিজ্যের পরিমাণ ৬ হাজার কোটি ডলার। কুনমিং থেকে কলকাতার যোগাযোগ সহজ হলে পরিবহন ব্যয় কমবে এবং দেশ দুটি তা থেকে বিপুলভাবে উপকৃত হবে। এজন্য যে বিনিয়োগ হবে, তাতে বহু মানুষের নতুন কর্মসংস্থান হবে।

বর্তমানে বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমারের মধ্যে বাণিজ্য আশানুরূপ নয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোর এই আঞ্চলিক বাণিজ্যে প্রয়োজনীয় গতি আনতে সক্ষম হবে। ভারতের রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম ফর ডেভেলপিং কান্ট্রিজের একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, এই করিডোর ১ হাজার ৩২০ কোটি ডলারের বাণিজ্যের দুয়ার খুলে দিতে পারে।

২০১৯ সালের জুনে চীনে অনুষ্ঠিত বিসিআইএম আঞ্চলিক সহযোগিতা ফোরামে ১২-দফা যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমারের প্রতিনিধিরা।

রয়েছে চ্যালেঞ্জ

বিসিআইএম বাস্তবায়নে কিছু প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রথমেই বলতে হবে অপ্রতুল বাজার প্রবেশাধিকারের কথা। এছাড়া অ-শুল্ক বিভিন্ন বাধা, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে অনুকূল ব্যাংকিং ও ফিন্যান্সিয়াল মেকানিজমের অনুপস্থিতি সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিসিআইএম থেকে সুবিধা নিশ্চিত করতে হলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। এ বিষয়টিও খুব একটা সহজ হবে না।

চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর (সিপিইসি) ও বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোর দুটোই বিআরআইয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই দুই উদ্যোগের অংশীদার দেশগুলোর মধ্যকার ভূরাজনৈতিক সম্পর্ক যে খুব উষ্ণ, তা বলা যাবে না। ফলে সবদিক সামাল দিয়ে দুটি প্রকল্প নিয়ে এগোনো একটু কঠিন হবে বৈকি।

বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোরকে কেন্দ্র করে এর আগেও এ ধরনের চ্যালেঞ্জ সামনে এসেছিল। এই করিডোরটিকে চীন তাদের উচ্চাভিলাষী বিআরআই প্রকল্পের অংশ হিসেবেই দেখাতে চায়। কিন্তু এই বিআরআইয়েরই আরেকটি অংশ পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে-এই যুক্তিতে ভারত এই উদ্যোগকে না বলে দেয়। কারণ ভারত সমগ্র কাশ্মীরকে নিজেদের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে দাবি করে থাকে এবং সেই ভূখ-ের ওপর অন্য দেশের কোনো আন্তর্জাতিক প্রকল্প মেনে নেওয়াকে নিজেদের সার্বভৌমত্বের সঙ্গে আপস হিসেবেই দেখে তারা।

ভারতের এই বিরোধিতার কারণেই ২০১৯ সালের মে মাস পর্যন্ত বিআরআই-সংশ্লিষ্ট ৩৫টি করিডোর ও প্রকল্পের তালিকায় নাম ছিল না বিসিআইএমের। তবে সে বছরই ১৩তম বিসিআইএম ফোরামে নিজেদের প্রতিনিধি পাঠানোর মাধ্যমে ভারত এই উদ্যোগে আবার প্রাণ ফিরিয়ে দেয়।

বাংলাদেশ অবশ্য বরাবরই আশপাশের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সংযোগ গড়ে তোলার পক্ষে মত দিয়ে আসছে। গত এক দশকে ভারত ও বাংলাদেশ মিলে একশর কাছাকাছি কানেক্টিভিটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। বিসিআইএম কার্যকর হলে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্কও আরও জোরদার হবে।

চীন মনে করে, বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোর বাস্তবায়িত হলে চলমান রোহিঙ্গা সংকট নিরসনের পথ সুগম হবে। ছবিটি বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের উখিয়া ক্যাম্পের

লাভবান হবে বাংলাদেশ

কৌশলগত অবস্থান ও শ্রমশক্তির কারণে সিল্ক রোডের মাধ্যমে এ অঞ্চলের বিশাল বাজারের সুবিধা নিতে পারবে বাংলাদেশ। তৈরি পোশাক শিল্পে বাংলাদেশ যেমন বিশ্ববজারে প্রতিযোগিতা করছে, তেমনি সিল্ক রোড কাজে লাগিয়ে চামড়া, তথ্যপ্রযুক্তি ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পকে আরও বিকশিত করার সুযোগ পাবে। বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমারের মধ্যে পরিবহন নেটওয়ার্ক শক্তিশালী হলে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, বিদ্যুৎ ও পর্যটন যোগাযোগে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি হবে। প্রস্তাবিত বিসিআইএম করিডোরটির আওতায় আসবে চীনের ইউনান প্রদেশ, বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও ভারতের সাড়ে ১৬ লাখ বর্গকিলোমিটারের বিশাল অঞ্চলের ৪৪ কোটি মানুষ; পাশাপাশি থাকবে সড়ক, জল ও আকাশপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা। রুটটি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল দিয়ে হলে চট্টগ্রামকেন্দ্রিক ব্যবসার সুযোগ বাড়িয়ে দেবে। চট্টগ্রাম বন্দরের পণ্য কক্সবাজার, টেকনাফ হয়ে মিয়ানমারের আকিয়াব, মান্দালয় হয়ে কুনমিং পর্যন্ত পৌঁছাবে।

বর্তমানে চীন থেকে বাংলাদেশে পণ্য আনতে খরচ বেশি পড়ছে। এছাড়া রপ্তানিতেও খরচ বেশি পড়ায় চীনের বাজারে সুবিধা করতে পারছে না বাংলাদেশী পণ্য। ভারত যেভাবে তার এক অংশ থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন রাজ্যে পণ্য নিতে বাংলাদেশের কাছে ট্রানজিট চাইছে, তারও অনেকখানি পূরণ করবে এই অর্থনৈতিক করিডোর।

বিসিআইএম নিয়ে করা এশিয়া প্যাসিফিক রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং নেটওয়ার্ক অন ট্রেডের গবেষণায় দেখা গেছে, চারটি দেশের মধ্যকার বাণিজ্যনীতি যদি আংশিক উদারীকরণ করা হয়, তাহলে ন্যূনতম ৩ হাজার ১২০ কোটি টাকার শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা ভোগ করতে পারবে বাংলাদেশ। সর্বোচ্চ সুবিধা পাবে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার। এছাড়া সব মিলিয়ে এই চার দেশের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে সাড়ে ৪৪ হাজার কোটি টাকা।

পাশাপাশি ভৌগোলিক কারণে রপ্তানি সেবায় বড় ধরনের আয় হবে বাংলাদেশের। এই অঞ্চল বিনিয়োগের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হবে, ব্যাপক পরিবর্তন হবে অর্থনীতির।

বিসিআইএম করিডোর বিষয়ে বাংলাদেশেও গবেষণা চালানো হচ্ছে যথেষ্ট। এসব গবেষণায় দেখা গেছে, ঐতিহাসিক সিল্ক রোডের পুনরুত্থানে লিড টাইম কমে যাবে অনেকটা, যা দ্রুত পরিবর্তনশীল এই বিশে^ প্রতিযোগিতা সক্ষমতার ক্ষেত্রে একটা বড় নিয়ামক।

চীনের বাজারে ৫ হাজার ৭০০ পণ্যে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পায় বাংলাদেশ। বিসিআইএম করিডোর কার্যকর হলে এই সুবিধার পরিসর আরও বাড়বে বলে আশা করা যায়। এছাড়া বাংলাদেশের মেশিনারি, হালকা প্রকৌশল ও ইন্টারমিডিয়েট গুডসের মতো শিল্প খাতগুলোয় চীনের বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বিসিআইএম উদ্যোগ এই বিনিয়োগ আসার পথ আরও সুগম করবে। এছাড়া সমুদ্র অর্থনীতির সম্ভাবনাময় খাতগুলো অনুসন্ধানেও চীনকে পাশে পেতে পারে বাংলাদেশ।

বিসিআইএম উদ্যোগ বাস্তব রূপ নিলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, পরিবহন অবকাঠামো, শিপিং, পর্যটন, ব্যবসা ও বিনিয়োগ খাত নিশ্চিতভাবেই গতিশীল হবে। তবে এই উদ্যোগ থেকে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ কতটা সুবিধা আদায় করে নিতে পারবে, সে বিষয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের প্রত্যাশা

বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোর বাস্তবায়নের মধ্যে চলমান রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান অন্তর্নিহিত বলে বিশ্বাস করে চীন। ২০১৯ সালের মে মাসে এক সম্মেলনে এমন কথা জানিয়েছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত চীনের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত ঝ্যাং জু। সে সময় তিনি বলেছিলেন, চীন রোহিঙ্গা ইস্যু গভীরভাবে লক্ষ করছে। বেইজিং আশা করে, বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোর বাস্তবায়নে সমস্যাটির উপযুক্ত সমাধান আসবে। বাংলাদেশ বিআরআই উদ্যোগের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারের মর্যাদা পাচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন ঝ্যাং জু।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মিয়ানমারের রাজনৈতিক পটভূমিতে পরিবর্তন এসেছে। বিসিএমআই অর্থনৈতিক করিডোরও এখনো প্রস্তাবনার পর্যায়েই রয়েছে। তাই পরিবর্তিন প্রেক্ষাপটে এই উদ্যোগ রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়, তা দেখতে হলে আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।

উপসংহার

ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের সুযোগ রয়েছে আঞ্চলিক অর্থনীতির কেন্দ্রে পরিণত হওয়া। এ উদ্দেশ্য সামনে রেখেই মূলত চীনের বিআরআই ও বিসিআইএম উদ্যোগে যোগ দিয়েছে বাংলাদেশ। আসলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার বরাবরই আঞ্চলিক সুসম্পর্ক ও অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততার প্রতি জোর দিয়ে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী মনে করেন, গোটা বিশ্ব আজ গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে। এ কারণে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কানেক্টিভিটি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। চীনের বিআরআই কিংবা বিসিআইএম উদ্যোগের ফলে এই যোগাযোগ ব্যবস্থা বা কানেক্টিভিটির উন্নতি হবে, যার অর্থনৈতিক সুফল পাবে সংশ্লিষ্ট সব দেশ। বাংলাদেশ যেন কোনোভাবেই এই সুফল থেকে বঞ্চিত না হয়, সেই লক্ষ্য সামনে রেখেই কূটনৈতিক অবস্থান নিয়েছে সরকার। এক্ষেত্রে কোনো দেশের সঙ্গে দ্বন্দ্বে না জড়ানোর বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।

যেকোনো আঞ্চলিক উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে গেলে বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি আসবে। কৌশলগত অবস্থান, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন প্রভাবক, নীতিগত মতপার্থক্যের কারণে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। কূটনৈতিক আলোচনা ও তৎপরতার মাধ্যমে এসব বাধা দূর করা সম্ভব। অতীতেও এমনটি দেখা গেছে। বিসিআইএমের ক্ষেত্রেও এ কথা সমানভাবে প্রযোজ্য। উদ্যোগটি বাস্তবায়নের পথে যদি নতুন করে কোনো চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়, তবে পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে তা মোকাবেলা করা সম্ভব হবে বলে বাংলাদেশ বিশ্বাস করে।

বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোরটি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উত্তরণের গতি আরও ত্বরান্বিত হবে। দেশের মানুষও এতে লাভবান হবে। কারণ এই যোগাযোগ নেটওয়ার্ক তৈরির ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে, যার ফলে বিপুল কর্মসংস্থান তৈরি হবে। অর্থাৎ দেশের জিডিপিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বিসিআইএম। এ কারণে সম্ভাব্য সব চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে উদ্যোগটির সফল বাস্তবায়ন হবে, এটাই এখন প্রত্যাশা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here