২০০৭-০৮ সালে ড্রাই বাল্ক পরিবহনে রেকর্ড হয়েছিল, বিশ্ব দেখেছিল সুপার সাইকেল। এক যুগের বেশি সময় পর বাল্ক রেট ও কনটেইনার ফ্রেইট রেটের ঊর্ধ্বগতির কারণে আবার আলোচনায় এসেছে সুপার সাইকেল। কিন্তু একটি সুপার সাইকেলের জন্য পূরণ হতে হবে অত্যাবশকীয় কিছু শর্ত। কী বলছে এবারের বাস্তবতা?

সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে কনটেইনারের চাহিদা আগে থেকেই ঊর্ধ্বমুখী ছিল। বৈশ্বিক বাণিজ্যে মোট পণ্যের বড় একটা অংশ পরিবহন হয় সমুদ্রপথে, তার সিংহভাগ আবার পরিবহন হয় কনটেইনারে। বিশেষ করে নন-বাল্ক কার্গোর প্রায় ৯০ শতাংশ পরিবহন হয় কনটেইনারবাহী জাহাজে। সেই কনটেইনার পরিবহনে ভরা জোয়ার চলছে এখন। সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে কনটেইনার চাহিদায় এমন লাগামছাড়া ঊর্ধ্বগতি এর আগে কখনো দেখা যায়নি। এই চাহিদা এতটাই বেড়েছে যে, দেশে দেশে কনটেইনারের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। কনটেইনারের বুকিং পেতে সরবরাহকারীদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে।

এই বাড়তি চাহিদার কারণে কনটেইনার পরিবহনের ভাড়া বেড়ে গেছে বহুগুণ। আবার ভোক্তাচাহিদা বেড়ে যাওয়ায় পণ্য পরিবহনও হচ্ছে আগের তুলনায় অনেক বেশি। তাহলে কি একে কনটেইনার পরিবহন খাতের সুপার সাইকেল বা চরম শিখর বলা যাবে? এর সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নও চলে আসে- বাল্ক, কনটেইনার বা ট্যাংকার মিলিয়ে সমুদ্র পরিবহন খাতে এমন ভরা জোয়ার কি এবারই প্রথম?

উত্তর হলো, না। শিপিংয়ের ইতিহাসে এই উলম্ব উত্থান এবারই প্রথম নয়। যারা সমুদ্র পরিবহন খাতের দীর্ঘমেয়াদি খতিয়ান রাখেন, তারা নিশ্চয়ই ২০০৭-০৮ সালের ড্রাই বাল্কের সুপার সাইকেলের কথা ভুলে যাননি।

কী এই সুপার সাইকেল?

জাতিসংঘ সুপার সাইকেলের একটি সংজ্ঞা দিয়েছে এভাবে-চাহিদা বৃদ্ধির কারণে যখন বেশিরভাগ পণ্যের ভিত্তিমূল্যে দীর্ঘমেয়াদি ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যায়, তখন তাকে সুপার সাইকেল বলা চলে। আর শিপিং খাতে সুপার সাইকেলের ক্ষেত্রে পণ্যের দামের পাশাপাশি জাহাজ ভাড়া ও সরবরাহের পরিমাণেও স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি চাঙ্গাভাব থাকতে হবে। ২০০৭-০৮ সালে সেটাই হয়েছিল। সে সময় কমোডিটির মূল্য, সরবরাহ, ড্রাই বাল্কের পরিবহন ভাড়া, জাহাজ কোম্পানিগুলোর আয়-সবকিছুই আকাশছোঁয়া ছিল।

সেই জোয়ার আবার দেখা যাচ্ছে এখন। পার্থক্য একটাই, সেবার রেকর্ড ভাঙা ঊর্ধ্বগতি ছিল ড্রাই বাল্ক পরিবহনে। আর এবার কনটেইনার পরিবহনে; সঙ্গে ড্রাই বাল্কেও চাঙ্গাভাব দেখা যাচ্ছে বেশ। তাহলে আরেকবার সুপার সাইকেল দেখতে যাচ্ছি আমরা? আর যদি হয়, তাহলে দুটির মধ্যে কোনটির তীব্রতা বেশি?

২০০৭-০৮ সালের সুপার সাইকেল আবার ফিরে আসবে কিনা, সে বিষয়ে চূড়ান্ত উপসংহারে পৌঁছানোর সময় এখনো আসেনি। তবে বিশ্লেষকদের অনেকে এরই মধ্যে বলে দিয়েছেন, তেমনটি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। যা-ই হোক, সুপার সাইকেলের বিষয়টি নিশ্চিত হতে গেলে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে এই দুই সময়ে বাজারধারার তুলনামূলক চিত্র এখনই টানা যায়। এতে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনুমান করাটা সহজ হবে।

ড্রাই বাল্কে সুপার সাইকেল ফিরে আসছে না

চলতি বছর এরই মধ্যে ড্রাই বাল্ক রেট গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছেছে। বাল্টিক এক্সচেঞ্জের প্রধান ড্রাই বাল্ক সি ফ্রেইট ইনডেক্স অন্তত এক যুগের বেশি সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ পয়েন্টে উন্নীত হয়েছে। গত ২৬ সেপ্টেম্বর এই সূচকের অবস্থান ছিল ৪ হাজার ৯৬২ পয়েন্টে, যা ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরের পর সর্বোচ্চ। প্রতি সপ্তাহেই ড্রাই বাল্ক পরিবহনে ভাড়া বাড়ছে। এই ট্রেন্ড দেখে অনেকেই আশাবাদী হয়ে উঠেছেন, তাহলে হয়তো ড্রাই বাল্ক পরিবহনে আবার ২০০৭-০৮ ফিরে আসছে। এ নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় কম বইছে না।

তবে বাস্তবতা হলো, এবার ড্রাই বাল্কে সুপার সাইকেল দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। অথচ চলতি বছরের প্রথমার্ধে ফ্রেইট রেটের পাশাপাশি বিশ^জুড়ে কমোডিটির দামও কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। তাহলে সুপার সাইকেল আসতে বাধা কোথায়?

এখানে একটা সূক্ষ্ম বিষয় রয়েছে। একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে যে, পণ্যের দাম বৃদ্ধি অথবা পরিবহনে ভাড়া বেড়ে যাওয়ার অর্থ শিপিংয়ে সুপার সাইকেল নয়। ড্রাই বাল্ক বা কনটেইনার-উভয় ক্ষেত্রেই এ কথা প্রযোজ্য। অর্থাৎ ড্রাই বাল্কে সুপার সাইকেল এসেছে কিনা, কেবল কমোডিটির দাম ও বাল্ক রেটের ওপর ভিত্তি করে তা বিচার করলে চলবে না। এর সঙ্গে কী পরিমাণ পণ্য পরিবহন হচ্ছে, সে বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে। পরিমাণের হিসাব ব্যতিরেকে সুপার সাইকেল নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।

বিশ্লেষকরা বলছেন, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে কমোডিটির দাম ও জাহাজভাড়ার পাশাপাশি ড্রাই বাল্ক পরিবহনের পরিমাণও বেড়েছে। তবে তা এমন পর্যায়ে যায়নি যে, একে সুপার সাইকেল বলা যাবে।

আবার সুপার সাইকেল তখনই দেখা যায়, যখন পণ্যের চাহিদা ও সরবরাহ লাগামহীনভাবে বেড়ে যায়। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে আকরিক লোহা পরিবহন আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ দশমিক ২ শতাংশ বেড়ে ৭৭ কোটি ১০ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। যেকোনো বছরের প্রথমার্ধের হিসাবে পণ্যটি পরিবহনে এটাই সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি। এর আগের রেকর্ড ছিল ২০১৮ সালে, শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ। তবে এর অর্থ এই নয় যে, সরবরাহ লাগামছাড়াভাবে বেড়েছে। বরং আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে, উচ্চমূল্য আকরিক লোহার চাহিদার রাশ টেনে ধরেছে। ফলে সরবরাহ যে উচ্চতায় উঠে যাওয়ার কথা ছিল, সেই পর্যায়ে যেতে পারছে না।

২০০৭-০৮ সালে আকরিক লোহার চাহিদা ঠিকই লাগামহীন ছিল। এই দুই বছরে চীনের আকরিক লোহা আমদানি যথাক্রমে ১৮ ও ১৬ শতাংশ বেড়েছিল।

একইভাবে বছরের প্রথম ছয় মাসে কয়লা পরিবহন ৩ দশমিক ৬ শতাংশ বাড়লেও তা ২০১৯ সালের একই সময়ের তুলনায় কম রয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ফ্রেইট রেট কিংবা পণ্যের দাম বাড়লেও সরবরাহের পরিমাণ এখনো চূড়ায় পৌঁছাতে পারেনি। আর সুপার সাইকেল ঘোষণা দিতে গেলে পরিমাণ বৃদ্ধির বিষয়টি অপরিহার্য।

এবার আসা যাক ড্রাই বাল্ক পরিবহনের ব্যয় প্রসঙ্গে। বাল্টিক ড্রাই ইনডেক্স ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পয়েন্টে উঠে গেলেও তা সর্বকালের সর্বোচ্চ অবস্থান থেকে ঢের দূরে রয়েছে। ২০০৮ সালের ২০ মে এই সূচকের মান ছিল ১১ হাজার ৭৯৩ পয়েন্ট। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাল্টিক ড্রাই ইনডেক্স আবার ১০ হাজার পয়েন্টের ঘরে চলে যাবে, সেই সম্ভাবনা নেই। ঠিক একইভাবে এই সূচক ২ হাজারের নিচে নেমে আসবে, সেই আশঙ্কাও নেই। এটি মাঝামাঝি পর্যায়ে থাকার সম্ভাবনাই বেশি।

বাল্টিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম কাউন্সিলের (বিমকো) চিফ শিপিং অ্যানালিস্ট পিটার স্যান্ডের মতে, ভোগ্যপণ্যের দাম আবার বাড়তে শুরু করেছে এবং তা ২০০৭ ও ২০০৮ সালের সময়কার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। এ কারণে সবাই কমোডিটি সুপার সাইকেলের কথা বলছে। তবে বাস্তবতা হলো, ড্রাই বাল্ক পরিবহনে জাহাজভাড়া যতই গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে থাকুক না কেন, ২০০৭-০৮ সালের দিকে শিপিং কোম্পানিগুলোর যে আয় ছিল, তার চেয়ে ঢের পিছিয়ে রয়েছে। আর তা সেই পর্যায়ে যাবে, সে সম্ভাবনাও ক্ষীণ।

চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে সব ধরনের ড্রাই বাল্ক ক্যারিয়ার দিনপ্রতি গড়ে ২০ হাজার ডলারের বেশি আয় করেছে। এর মধ্যে কেপসাইজ ক্যারিয়ারগুলোর প্রতিদিনের গড় ভাড়া ছিল ২৪ হাজার ৯৭০ ডলার। তবে তা ২০০৮ সালের ধারেকাছেও যেতে পারেনি। সে বছরের প্রথম সাত মাসে কেপসাইজ ক্যারিয়ারের গড় ভাড়া ছিল ১ লাখ ৪৭ হাজার ৪৭৫ ডলার। অন্যান্য সাইজের ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রেও গড় আয় ২০০৮ সালের তুলনায় বেশ কম রয়েছে এখন।

সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে ড্রাই বাল্ক, কনটেইনার অথবা ট্যাংকারের ভাড়া একটি অভিন্ন নিয়ম মেনে চলে। তা হলো, এই ভাড়া চরম মাত্রায় স্থিতিস্থাপক। অর্থাৎ পরিস্থিতি অনুযায়ী তা একেবারে পড়ে যেতে পারে, আবার সময় বুঝে চড়েও যেতে পারে। এখানে নির্দিষ্ট কোনো ভাড়ার বালাই নেই। যদি চাহিদার তুলনায় জাহাজের সংখ্যা কম থাকে, তখন সরবরাহকারীদের প্রফিট মার্জিন যতক্ষণ না একেবারে শূন্যের কোটায় নেমে আসছে, ততক্ষণ পর্যন্ত ভাড়া বাড়তেই থাকে। এ যেন গ্রিক প্রবাদেরই বাস্তব প্রতিফলন-‘৯৮টি জাহাজ ও ১০১টি কার্গো, ভাড়া আকাশছোঁয়া। ৯৮টি কার্গো ও ১০১টি জাহাজ ভাড়া তলানিতে।’

আজকের ড্রাই বাল্কের বাজার আর চলতি সহস্রব্দের প্রথম দশকের বাজারের ধরন এক নয়। সেই সময়ে বিশ্বের উদীয়মান এক বাজার ছিল চীন। আর তাদের কমোডিটি আমদানির পরিমাণও ছিল অভূতপূর্বভাবে বেশি। সুতরাং এখনকার চাহিদা বৃদ্ধিকে কোনোভাবেই সেই সময়ের সঙ্গে মেলানো সম্ভব নয়।

কনটেইনারে চাঙ্গাভাব, তবে…

পণ্য পরিবহনের ভাড়া কেবল চাহিদার ওপর নির্ভর করে না। এর সঙ্গে জোগানের বিষয়টিও চলে আসে। বর্তমানে কনটেইনার ভাড়ায় যে ঊর্ধ্বগতি, তা-ও কেবল চাহিদা বৃদ্ধির জন্য নয়। হ্যাঁ, যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে কনটেইনারের চাহিদা আকাশছোঁয়া। কিন্তু বৈশি^ক প্রেক্ষাপটে তা স্বাভাবিক গড়ের চেয়ে সামান্যই বেশি। কনটেইনার পরিবহনে এই অভূতপূর্ব ভাড়া বৃদ্ধির নেপথ্যে রয়েছে চাহিদার বিপরীতে কনটেইনার সরবরাহে ঘাটতি। এরই ফলশ্রুতিতে তৈরি হয়েছে কনটেইনার ও জাহাজজট। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে জাহাজগুলোকে একটি পোর্টকলে বেশি সময় ব্যয় করতে হচ্ছে। এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতেই শিপিং কোম্পানিগুলো কনটেইনার পরিবহনে বাড়তি ভাড়া আদায় করছে।

সমুদ্রপথে নন-বাল্ক কার্গোর প্রায় ৯০ শতাংশ পরিবহন হয় কনটেইনারবাহী জাহাজে। নিরাপদ ও সুবিধাজনক মাধ্যম হওয়ায় বিশ্বের বড় বড় শিপিং কোম্পানিগুলো এখন ভোগ্যপণ্য পরিবহনে কনটেইনারকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। ফলে বিশ্বজুড়ে কনটেইনারের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। আর এই বাড়তি চাহিদা সামাল দিতে শিপিং কোম্পানি ও বন্দর কর্তৃপক্ষগুলো ধীরে ধীরে নিজেদের সক্ষম করে গড়ে তুলছিল। আর এমনই একসময়ে হানা দিল বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯। রাতারাতি পাল্টে গেল চিত্রপট। স্থবির হয়ে পড়ল বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কর্মকা-। ধস নামল ভোক্তাচাহিদা ও শিল্পোৎপাদনে। ভেঙে পড়ল সাপ্লাই চেইন। এরপর হঠাৎই দৃশ্যপটে পরিবর্তন। গত বছরই প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে চীনের উৎপাদন তৎপরতা দেখা গেল। এছাড়া মহামারির প্রথম ঢেউ শেষে বিশ্ববাজারে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে ভোক্তাচাহিদায় হঠাৎ ঊর্ধ্বগতিও দৃশ্যমান হয়। বৈশ্বিক বাণিজ্যের এই দ্রুত পটপরিবর্তনের সঙ্গে ঠিক খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি সমুদ্র পরিবহন খাত। এর সঙ্গে বিভিন্ন প্রভাবক যোগ হওয়ায় দেশে দেশে বন্দরগুলোয় দেখা দেয় কনটেইনার ও জাহাজজট। আবার চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না থাকায় খালি কনটেইনারের যে স্বল্পতা দেখা দিয়েছে, তা-ও বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করছে। এ দুই সংকট বৈশি^ক সাপ্লাই চেইনের জন্য বিশেষ মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাপ্লাই চেইন স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে শিপিং কোম্পানিগুলো অতিরিক্ত কনটেইনার ও জাহাজ সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছে। আর তাদের এই বিনিয়োগের প্রভাব পড়ছে কনটেইনার ভাড়ায়।

করোনার প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে বিশ্বের যেসব ভোক্তাবাজার পুনরায় চাঙ্গা হতে শুরু করেছে, যুক্তরাষ্ট্র তার অন্যতম। সামনে এ ব্যয় আরও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সরবরাহ বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তাও দেখা দিয়েছে। এর ফলে দেশটিতে চীনা পণ্য আমদানিতে হঠাৎ করেই জোয়ার তৈরি হয়েছে।

একদিকে বাড়তি চাহিদা, অন্যদিকে কনটেইনার সংকট-এই দুয়ের প্রভাবে চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ৪০ ফুটের একেকটি কনটেইনার পরিবহন ব্যয় ২০ হাজার ডলার ছাড়িয়েছে। গত বছরের তুলনায় তা ৫০০ শতাংশ বেশি। রয়টার্সের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে কেনাকাটার মৌসুমের আগে খুচরা বিক্রেতাদের ক্রমবর্ধমান ক্রয়াদেশের কারণে এমনিতেই বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনে চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এখন আবার যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে সংক্রমণ বাড়ার কারণে খালাস কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এতে কনটেইনারজট আরও প্রকট হচ্ছে। এসব কারণে কনটেইনার পরিবহন ব্যয় অত্যধিক বেড়ে গেছে।

পণ্য পরিবহন ট্র্যাকিং ফার্ম ফ্রেইটোস জানিয়েছে, বিশ্বের ব্যস্ততম পণ্য পরিবহন রুট চীন-যুক্তরাষ্ট্র। এ রুটে কনটেইনার পরিবহনের ভাড়া অনেকটা বেড়েছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলে প্রতিটি কনটেইনার পরিবহনে ব্যয় হচ্ছে ২০ হাজার ডলারের বেশি। অথচ গত ২৭ জুলাই এ হার ১১ হাজার ডলারের কম ছিল। চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলে কনটেইনার পরিবহন ব্যয়ও ২০ হাজার ডলারের কাছাকাছি পৌঁছেছে। এছাড়া চীন-ইউরোপ রুটে এ ব্যয় প্রায় ১৪ হাজার ডলার।

কনটেইনার পরিবহনের এই ব্যয় বৃদ্ধির বোঝা গিয়ে পড়ছে সরবরাহকারী ও ক্রেতাদের ওপর। অন্যদিকে তা শিপিং কোম্পানিগুলোর জন্য আশীর্বাদ হয়েই এসেছে। পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় তাদের পকেট ভারী হচ্ছে। ফরাসি শিপিং কোম্পানি সিএমএ সিজিএম কেবল চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) ২০০ কোটি ডলারের বেশি নিট মুনাফার কথা জানিয়েছে। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় তা ৪০ গুণ বেশি। এর চেয়েও বেশি মুনাফা করেছে এপি মোলার-মায়েরস্ক। বছরের প্রথম তিন মাসে ২৭০ কোটি ডলার নিট মুনাফা অর্জন করেছে তারা, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৩ গুণ বেশি।

কনটেইনার সংকট, জট ও ফ্রেইট রেট বেড়ে যাওয়ার কারণে বৈশ্বিক শিপিং খাতের হালচালই পাল্টে গেছে। শিপিং কোম্পানিগুলো এখন কম লাভজনক রুট বাদ দিয়ে বেশি লাভজনক রুটে পণ্য পরিবহন করছে। কিছু কোম্পানি ট্রান্স-আটলান্টিক ও এশিয়ার মতো কম লাভজনক পথে জাহাজ কমিয়ে দিচ্ছে।

ড্রাই বাল্কের ক্ষেত্রে যে কথা বলা হয়েছিল, কনটেইনারের ক্ষেত্রেও সেই একই পূর্বাভাস দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা। যদিও কনটেইনারের চাহিদা এরই মধ্যে রেকর্ড পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে এবং ভাড়াও আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে, তবুও এখনই সুপার সাইকেল দেখা যাবে না বলেই মনে করছেন তারা। এখানেও সেই পরিমাণের ইস্যুটি উঠে আসছে।

কনটেইনার পরিবহনের জট কাটাতে শিপিং কোম্পানিগুলো তাদের বহরে নতুন নতুন জাহাজ যোগ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। বর্তমানে জাহাজ নির্মাতাদের রেকর্ড বুকে ৬১৯টি কনটেইনারবাহী জাহাজ রয়েছে। এর মধ্যে ৩৮১টি কেবল চলতি বছরের প্রথম আট মাসেই কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। ধারণক্ষমতার বিচারে তা ৩৪ লাখ ৪০ হাজার টিইইউ। এত কম সময়ের মধ্যে এত বেশি সংখ্যক ও ধারণক্ষমতার জাহাজের কার্যাদেশ এর আগে কখনো দেখা যায়নি। এদিক থেকে কনটেইনার পরিবহনের বাজারকে বেশ চাঙ্গাই বলতে হয়। তবে এখানে একটি কিন্তু রয়েছে। মোট অর্ডার বুকের হিসাবে চলতি বছরটা এখনো পিছিয়ে রয়েছে। ২০০৮ সালের জুলাইয়ে মোট ৬৮ লাখ টিইইউ ধারণক্ষমতার কনটেইনার জাহাজ সরবরাহের অপেক্ষায় ছিল। এ বছরের আগস্ট পর্যন্ত তা ছিল ৫৩ লাখ টিইইউ। অর্থাৎ সক্ষমতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ২০২১ সাল এখনো ২০০৮ সালের চেয়েও পিছিয়ে রয়েছে। এখানে একটা কথা উল্লেখ করা দরকার, ২০০৮ সালে কিন্তু কনটেইনার শিপিংয়ে সুপার সাইকেল ছিল না।

বিভিন্ন আকারের ড্রাই বাল্ক ক্যারিয়ারের ভাড়ার তুলনামূলক চিত্র

চলতি বছর এখন পর্যন্ত ভবিষ্যতে সরবরাহের চুক্তিতে কনটেইনার জাহাজ নির্মাণের কার্যাদেশের চিত্রটি এমন-২০২৩ ও ২০২৪ প্রত্যেক বছরের জন্য ১৫ লাখ টিইইউ করে। আগের ও চলতি বছরের কার্যাদেশ মিলিয়ে ২০২৪ সালে মোট ২১ লাখ ৫০ হাজার টিইইউ ধারণক্ষমতার জাহাজ সরবরাহের কথা রয়েছে। এমনটি হলে ২০২৪ সালে কনটেইনার জাহাজ সরবরাহে রেকর্ড হবে। এর আগে ২০১৫ সালে সর্বোচ্চ ১৬ লাখ ৬০ হাজার টিইইউ ধারণক্ষমতার জাহাজ সরবরাহ করেছিল জাহাজ নির্মাতারা।

ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে এই বাড়তি সক্ষমতা সহায়ক হবে অবশ্যই। কিন্তু শঙ্কার একটি জায়গা থেকেই যাচ্ছে। কারণ ইতিহাস বলছে, এর আগে কখনই নির্দিষ্ট সময়সূচি অনুযায়ী জাহাজ সরবরাহ করতে পারেনি নির্মাতারা। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে।

বিমকোর চিফ শিপিং অ্যানালিস্ট পিটার স্যান্ড বলেন, ‘আমরা সবসময়ই দেখে এসেছি, জাহাজ সরবরাহের ক্ষেত্রে পূর্বনির্ধারিত সময়ের চেয়ে বিলম্ব হচ্ছে। এ কারণে আমরা ধারণা করছি ২০১৫ সালের সরবরাহের রেকর্ড সহসাই ভাঙছে না। শিপিং কোম্পানিগুলোও হয়তো সেটি বুঝে গেছে। এ কারণে তারা কনটেইনারবাহী জাহাজের কার্যাদেশ দিয়েই নিশ্চিত বসে থাকতে পারছে না। কিছু কোম্পানি স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদের জন্য এয়ার কার্গো সক্ষমতা বাড়ানোর দিকেও নজর দিয়েছে। আমার কাছে এটি একটি ইতিবাচক অগ্রগতি মনে হচ্ছে। এর মাধ্যমে প্রমাণ হয় যে, কোম্পানিগুলো যেকোনো উপায়ে রপ্তানিকারকদের পণ্য ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’

উপসংহার

২০০৭-০৮ সালের ড্রাই বাল্ক সুপার সাইকেলের মতো হোক আর না-ই হোক, ২০২১ সালটা যে কনটেইনার শিপের হতে যাচ্ছে, তা অনেকটাই পরিষ্কার। পুরো বছর শেষ হতে এখনো কয়েক মাস সময় বাকি। এরই মধ্যে রেকর্ড ফ্রেইট রেট, রেকর্ড পরিমাণ কার্গো পরিবহন এবং রেকর্ড সংখ্যক নতুন কনটেইনারের কার্যাদেশ-এসব ঘটনাপ্রবাহ তারই প্রমাণ দিচ্ছে।

২০০৭-০৮ সালের ড্রাই বাল্ক রেট ও এখনকার কনটেইনার রেটের এই ঊর্ধ্বগতির মধ্যে একটি জায়গায় মিল রয়েছে। সেটি হলো অননুমেয়তা। কোভিডকালীন সময়ে কনটেইনারের চাহিদা যে এতটা বেড়ে যাবে, তা খাতসংশ্লিষ্টদের কেউই ধারণা করতে পারেননি। ঠিক একইভাবে ২০০৭-০৮ সালের ভয়াবহ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার সময়েও ড্রাই বাল্ক পরিবহনে এতটা চাঙ্গাভাব থাকবে, তার পক্ষে বাজি ধরার জন্যও খুব বেশি কেউ ছিলেন না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here