পানামা খালের খরায় প্রভাবিত হবে মার্কিন মুদ্রাস্ফীতিঃ বিশেষজ্ঞ

সাম্প্রতিক সময়ে চলমান খরার কারণে পানামা খালে জাহাজ চলাচল সীমিতকরণ এবং সারচার্জ ও ড্রাফট লিমিট সংক্রান্ত নতুন নতুন বিধি নিষেধ আরোপ করতে বাধ্য হচ্ছে পানামা ক্যানেল অথরিটি (পিসিএ)। নতুন আরোপিত নিয়ম কানুন ও অতিরিক্ত সারচার্জ মার্কিন মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকে হুমকির মুখে ফেলবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।

আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী পানামা খাল ১৯১৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করে। যাত্রা শুরুর শত বছর পেরিয়ে গেলেও এই রুটে পানামা খালের কোনো বিকল্প তৈরি হয়নি। যার ফলে উচ্চ শুল্ক পরিশোধ করে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৪০টি বাণিজ্যিক জাহাজ এই পথ অতিক্রম করে। ২০২২ অর্থবছরে প্রায় ১৪ হাজার ২০০টি জাহাজ পানামা খাল পাড়ি দিয়েছে। তবে মানবসৃষ্ট এই পথে যাতায়াত করা ততটা সহজ নয়। প্রশান্ত মহাসাগরের পানির স্তর আটলান্টিক মহাসাগরের চেয়ে উঁচু। যার ফলে যান্ত্রিক উপায়ে পানামা খালের পানির স্তর ২৬ মিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি করে এ পথ দিয়ে নৌযান পারাপার করা হয়। পার্শ্ববর্তী গাতুন ও আলাহুয়েলা হ্রদের পানি ব্যবহার করে পানামা খালের পানির স্তর বৃদ্ধি করা হয়।

চলতি বছর অনাবৃষ্টির কারণে সৃষ্ট নজিরবিহীন খরায় হ্রদ দুটির পানির স্তর অনেক কমে গেছে। পিসিএর পরিচালক রিকার্তে ভাসকেজ জানান, ১৯৫০ সালের পর এই প্রথম পানামা খাল এত শুষ্ক মে মাসের দেখা পেয়েছে। সামনের দিনগুলোয় পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। পিএসএর পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী জুলাই মাসে পানামা খালের পানির স্তর ৭৮ দশমিক ২ ফুটে নেমে আসবে, যা ২০১৬ সালের সর্বনিম্ন স্তরের (৭৮ দশমিক ৩ ফুট) রেকর্ডকেও ছাড়িয়ে যাবে। পানির স্তর লাগাতার কমতে থাকায় চলতি বছর খরা মৌসুম (জানুয়ারি-মে) শুরু হওয়ার পর থেকেই জাহাজ চলাচলের ওপর নানাবিধ বিধিনিষেধ আরোপ করে পিসিএ। এই ধারা অব্যাহত থাকলে কর্তৃপক্ষ দৈনিক জাহাজ চলাচলের সংখ্যা ৩৬ থেকে কমিয়ে ২৮ থেকে ৩২টির মধ্যে সীমিত রাখতে বাধ্য হবে বলে জানান ভাসকেজ।

এদিকে আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন, পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে তৈরি হওয়া এল নিনো বছরের শেষ দিকে পুরোদমে তার দাপট দেখাতে শুরু করবে। এল নিনোর প্রভাবে প্রশান্ত মহাসাগরের সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি আরও বিগড়ে যাবে। পানামা খালের পানি বিভাগের প্রধান এরিক করদোবা বলেন, এল নিনোর প্রভাবে পানামা খালের তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং ২০২৪ সালে খরা আরও তীব্রতর হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। স্বাভাবিক কার্যক্রম সচল রেখে খরার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে পিসিএ। পানির স্তর নেমে যাওয়ায় পানামা খালে চলাচলকারী জাহাজগুলোর ড্রাফট লিমিট সাম্প্রতিক সময়ে কয়েক দফা কমানো হয়েছে। বর্তমানে ড্রাফট লিমিট আর্দশমান ৫০ ফুট থেকে কমিয়ে ৪৪ দশমিক ৫ ফুট করা হয়েছে। চলতি মাসেই সেটা আরেক দফা কমিয়ে ৪৪ ফুট করা হবে।

ড্রাফট লিমিটের ওপর জাহাজে কতটুকু কার্গো বহন করা হবে সেই বিষয়টি নির্ভর করে। জাহাজে কার্গো বেশি থাকলে এর ওজন বেশি থাকে এবং বাড়তি ওজন নিয়ে ড্রাফট লিমিট মেনে চলা সম্ভব হয় না। কোনো জাহাজের ড্রাফট লিমিট যদি ৬ ফুট কমানো হয় তবে তার কার্গোর পরিমাণ ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে। যার ফলে পানামা খাল পাড়ি দিতে হলে বড় বড় জাহাজগুলোকে হয় কার্গোর পরিমাণ কমিয়ে দিতে হয়, না হয় পণ্যগুলোকে অন্য জাহাজে বহন করতে হয়। এতে করে পণ্য পরিবহন খরচ অনেক বেড়ে যায়। ফ্লেক্সপোর্ট ইন্টারন্যাশনালের ওশান ফ্রেইটের প্রধান নাথান স্ট্যাং বলেন, ড্রাফট লিমিট কমলে এর প্রভাবে শিল্প ও ভোগ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি কার্গো পরিবহনের পরিমাণ ৪০ শতাংশ কমে যেতে পারে।

নতুন ড্রাফট লিমিটের কারণে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ১ জুন থেকে কনটেইনার প্রতি ফি আরোপ করা শুরু করেছে ক্যারিয়ার কোম্পানিগুলো। জার্মান শিপিং কোম্পানি হ্যাপাগ-লয়েড জানায়, চলতি মাস থেকে এশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলগামী জাহাজে কনটেইনার প্রতি ৫০০ ডলার পিসিসি (পানামা ক্যানেল চার্জ) আরোপ করা হবে। লজিস্টিকস বিশেষজ্ঞদের মতে, এত সব সীমাবদ্ধতার কারণে পানামা খাল দিয়ে জাহাজ চলাচলের খরচ একটা সময় অনেক বেড়ে যাবে। খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পণ্য পরিবহনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো অচিরেই এশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র রুটে বিকল্প পথের খোঁজ করবে।

মুদ্রাস্ফীতি হার ২ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের। জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং আর্ন্তজাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক কর্মকর্তা জনাথন অস্ট্রির মতে, সাম্প্রতিক খরার কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে ফেডের এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রে মুদ্রাস্ফীতির হার ক্রমান্বয়ে কমতে কমতে বর্তমানে ৪ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে এসেছে, তবুও বর্তমান পরিস্থিতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য খুব একটা সুবিধাজনক নয় বলে মনে করছেন তিনি।

এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পিসিএ খরার প্রভাব প্রশমনের জন্য নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও এর ফলে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেবে। বাণিজ্যের জন্য যেসব দেশ পানামা খালের ওপর নির্ভরশীল, তাদের জন্য এই প্রভাব এড়ানো অসম্ভব। এসব দেশের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রও রয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here