কার্বন শুল্ক তহবিল শিপিং খাতের বৃহত্তর কল্যাণে সহায়ক হবে: বিশ্বব্যাংক

আন্তর্জাতিক সমুদ্র পরিবহন খাতে কার্বন নিঃসরণ কমানোর প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে কার্বন শুল্ক আরোপের পক্ষে জনমত জোরালো হচ্ছে ক্রমশ। এর সঙ্গে আরও একটি বিষয় আলোচনার খোরাক হয়ে দাঁড়িয়েছে-এই কর আদায়ের মাধ্যমে যে তহবিল গড়ে উঠবে, সেটি কীভাবে কাজে লাগালে সমুদ্র পরিবহন খাত সর্বোচ্চ মাত্রায় উপকৃত হবে।

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৫০ সাল নাগাদ কার্বন শুল্ক আরোপের মাধ্যমে ১ লাখ কোটি থেকে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি ডলার জমা হতে পারে। বিভিন্ন পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে প্রতি বছর ৪ হাজার ১০০ কোটি ডলার থেকে ১০ হাজার ৫০০ কোটি ডলার পর্যন্ত কার্বন শুল্ক আদায়ের প্রাক্কলন করছে বিশ্বব্যাংক। এই অর্থ সমুদ্র পরিবহন খাতকে নিঃসরণমুক্ত করা, এই খাতের অবকাঠামো ও সক্ষমতার উন্নয়ন, বৃহত্তর জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, জাহাজের বহর আধুনিকীকরণ ও নবায়ন, কার্বনমুক্ত ইঞ্জিন ও প্রপালশন সিস্টেম স্থাপন, জাহাজের জ্বালানি কার্যদক্ষতা বৃদ্ধির জন্য উপযোগী প্রযুক্তির প্রয়োগ ইত্যাদি কাজে লাগানো যেতে পারে বলে মনে করছে প্রতিষ্ঠানটি।

প্রায়োগিক খাত দেখিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি কার্বন তহবিল থেকে যেন সবাই ন্যায্য ভাগ পায়, সেই বিষয়টির ওপরও জোর দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বিশেষ করে ভূমিবেষ্টিত, ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো (যারা নগণ্য পরিমাণে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করলেও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অন্যদের সমান বা কখনো কখনো বেশি ভুগতে হচ্ছে) যেন এই তহবিল থেকে ন্যায়সঙ্গত হিস্যা পায়, সেই বিষয়টি নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক।

শিপিং খাতে কার্বন শুল্ক আরোপ নিয়ে দীর্ঘ ১০ বছর আলোচনার পর গত বছর ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের (আইএমও) ইন্টারসেশনাল ওয়ার্কিং গ্রুপের (আইএসডবিøউজি) বৈঠকে সমুদ্র পরিবহন খাতে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের বিপরীতে শুল্ক আরোপের বিষয়ে একমত হয় দেশগুলো। অবশ্য এখন পর্যন্ত এর নির্দিষ্ট কোনো হার নির্ধারিত হয়নি। বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা বিভিন্ন হারে কার্বন শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করেছে।

আইএমওর কাছে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় অংকের শুল্ক আরোপের প্রস্তাব এসেছে জাপানের পক্ষ থেকে। দেশটি ২০২৫ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে শিপিং খাতে প্রতি টন কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণের বিপরীতে ৫৬ ডলার, ২০৩০ সাল থেকে টনপ্রতি ১৩৫ ডলার, ২০৩৫ সাল থেকে ৩২৪ ডলার ও ২০৪০ সাল থেকে ৬৭৩ ডলার হারে শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করেছে। যেহেতু প্রতি টন বাংকার ফুয়েল প্রায় তিন টন কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ করে, সেহেতু প্রতি টন বাংকার ফুয়েলের ক্ষেত্রে শুল্কের পরিমাণ উল্লিখিত অংকের তিনগুণ হবে।

এছাড়া প্রতি টন কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণের বিপরীতে ২০০ ডলার করে শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করেছে গেটিং টু জিরো কোয়ালিশন। প্রতি টন বাংকার ফুয়েলের ওপর ৪৫০ ডলার অথবা প্রতিটন কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণে ১৫০ ডলার শুল্কের প্রস্তাব করেছে কনটেইনার শিপিং জায়ান্ট মায়েরস্ক। মার্শাল আইল্যান্ডস ও সলোমন আইল্যান্ডসের প্রস্তাব টনপ্রতি ১০০ ডলার শুল্কের। এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বলেছে, প্যারিস জলবায়ু চুক্তির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে গেলে ২০৩০ সাল নাগাদ বৈশ্বিক গড় কার্বন শুল্কের পরিমাণ টনপ্রতি অন্তত ৭৮ ডলারে উন্নীত করতে হবে। বর্তমানে এই হার মাত্র ২ শতাংশ।

কার্বন শুল্কের সমর্থনে যে যুক্তি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে, সেটি হলো-এই শুল্ক আদায়বাবদ যে তহবিল তৈরি হবে, তা থেকে পরিচ্ছন্ন বা সবুজ জ্বালানিতে ভর্তুকি দেওয়া যেতে পারে। এই শল্ক আরোপের ফলে একদিকে জীবাষ্ম জ্বালানির দাম বেড়ে যাবে, অন্যদিকে পরিবেশবান্ধব জ্বালানির খরচ কমে যাবে। এতে জাহাজগুলো সবুজ জ্বালানি ব্যবহারে আরও বেশি উৎসাহিত হবে।

এছাড়া নিঃসরণমুক্ত প্রপালশন প্রযুক্তি ও পরিবেশবান্ধব জ্বালানির প্রচলন ঘটানোর জন্য ব্যাপক পরিসরে গবেষণা ও উন্নয়নের প্রয়োজন রয়েছে। এসব প্রযুক্তি ও জ্বালানি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যবহারের আগে পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাটাও জরুরি। এসব প্রক্রিয়া বেশ ব্যয়বহুল। কার্বন শুল্ক তহবিল থেকে এই ব্যয় নির্বাহ করা হলে দেশগুলো গবেষণা, উদ্ভাবন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষায় আরও বেশি আগ্রহী হবে।

বৈশ্বিকভাবে মোট যে পরিমাণে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করা হয়, তার প্রায় তিন শতাংশ আসে সমুদ্র পরিবহন খাত থেকে। একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিচ্ছন্ন জ্বালানি ও উদ্ভাবনী প্রযুক্তির ব্যবহারে এখনই উদ্যোগ না নিলে ২০৫০ সাল নাগাদ কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ ২০০৮ সালের তুলনায় ৯০-১৩০ শতাংশ বেড়ে যাবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here