ক্রমবর্ধমান মুল্যস্ফীতিতে চাপের মুখে পড়বে নৌ বীমা শিল্প: আইইউএমআই

নৌ বীমা শিল্পের চলমান ইতিবাচক ধারায় আমূল পরিবর্তনের আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব মেরিন ইন্স্যুরেন্স (আইইউএমআই)। সংস্থাটির মতে, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির কারণে অদূর ভবিষ্যতে লোকসানের মুখে পড়বে বৈশ্বিক নৌ বীমা শিল্প।

করোনা মহামারির পর বিশ্বজুড়ে সমুদ্র পরিবহন শিল্পে চাঙ্গাভাব ফিরে আসে। পণ্য পরিবহনের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় জাহাজের মূল্য বৃদ্ধি পেলেও কমে যায় বাজার সক্ষমতা। এমন অবস্থায় ২০২২ সালে জাহাজের কাঠামোর বৈশ্বিক বীমার প্রিমিয়াম ৫ দশমিক ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। সেই সঙ্গে গত বছর নৌপথে দুর্ঘটনার পরিমাণ কমে যাওয়ায় ক্ষতিপূরণ প্রদানের পরিমাণও কম ছিল, যা নৌ বীমাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকসানের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

বিগত বছরটি লাভজনকভাবে শেষ করলেও চলতি বছর মূল্যস্ফীতির প্রকোপে পড়েছে নৌ বীমা শিল্প। মূল্যস্ফীতির দরুণ জাহাজের সরঞ্জাম, শিপইয়ার্ড ও শ্রমিক খরচ বাড়লেও বীমা প্রিমিয়ামের পরিমাণ আগের মতোই আছে। এর ফলে আগামী বছর দুয়েকের মধ্যে ক্ষতিপূরণ প্রদান কঠিন হয়ে পড়বে বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য। আইইউএমআই জানায়, ব্যয় বাড়লেও তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়বে না মুনাফা।

আইইউএমআইয়ের ওশান হাল কমিটির চেয়ার ইলিয়াস সাকিরিসি বলেন, কোভিড-পরবর্তী সময়ে বৈশ্বিক শিপিং পুনরায় সচল হয়ে ওঠায় ইস্পাতসহ আরও অনেক প্রয়োজনীয় উপকরণের ঘাটতি দেখা দেয়। মূল্যস্ফীতির কারণে সমুদ্র পরিবহনসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় এই সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে।

এদিকে মূল্যস্ফীতি কেবল জাহাজ মেরামত ব্যয় ও ক্ষতিপূরণের পরিমাণকেই প্রভাবিত করছে না, এর কারণে বীমাকারী প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি সত্ত্বেও বীমা প্রিমিয়ামের হার বৃদ্ধি না করায় সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বীমাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সামগ্রিক মুনাফা হ্রাস পাবে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেন সাকিরিস। তার মতে, সামনের দিনগুলোয় মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব জ্বালানি, বৈদ্যুতিক যানবাহন ও ডার্ক ফ্লিট নৌ বীমা শিল্পের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

পরিবেশবান্ধব জ্বালানি

২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্র পরিবহন খাতকে কার্বনমুক্ত করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগুচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (আইএমও)। বৈশ্বিক শিপিং খাত তাই পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ও প্রযুক্তি দিকে ঝুঁকছে। জাহাজ চালনার প্রচলিত পদ্ধতিগুলোর পরিবর্তে নিঃসরণমুক্ত নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে গেলে জাহাজের নির্মাণ খরচ বেড়ে যায়। অত্যাধুনিক জাহাজ বহরের ক্ষতিপূরণ আগের চেয়ে ব্যয়বহুল হবে বলে জানান সাকিরিস। এছাড়া অত্যাধুনিক প্রযুক্তির দ্রুত বাস্তবায়ন এবং বর্তমানে প্রচলিত ইঞ্জিনে পরিবেশবান্ধব জ্বালানির ব্যবহার দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেবে বলে মনে করেন তিনি।

বৈদ্যুতিক গাড়ি ও লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি অগ্নিদুর্ঘটনাপ্রবণ হওয়ায় এসব গাড়িবাহী জাহাজও মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকে। বিষয়টি বীমার প্রিমিয়াম বৃদ্ধিতে প্রভাবক হতে পারে

বৈদ্যুতিক গাড়ি লিথিয়ামআয়ন ব্যাটারি

লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি ও বৈদ্যুতিক গাড়ি অত্যন্ত দাহ্যতার ঝুঁকিপূর্ণ। এই ধরনের যানবাহন বহনকারী কনটেইনার জাহাজও অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঝুঁকিতে থাকে। লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি ও বৈদ্যুতিক গাড়ি বহনের উচ্চঝুঁকির কথা উল্লেখ করে আইইউএমআই জানায়, কার্গো প্রোটোকল অনুসরণের পাশাপাশি এসব জাহাজে অবশ্যই আর্লি ফায়ার ডিটেকশন সিস্টেম, ড্রেঞ্চার ও কার্বন ডাইঅক্সাইডযুক্ত অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। এসব পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া দুর্ঘটনা মোকাবিলা করা বেশ কষ্টসাধ্য হবে।

ডার্ক ফ্লিট

ইউক্রেন যুদ্ধের পর রাশিয়ার ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। আইএমওর তথ্যমতে, বিশ্বজুড়ে ৩০০ থেকে ৬০০টি ট্যাংকার আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রুশ তেল পরিবহন করছে। এসব জাহাজের বহর ‘ডার্ক ফ্লিট’ বা ‘শ্যাডো ফ্লিট’ নামে পরিচিত। পুরনো, ত্রুটিপূর্ণ ও মেয়াদবিহীন এসব জাহাজ অটোমেটিক আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম (এআইএস), মালিকানার বৈধ কাগজপত্র ও বীমা কাভারেজ ছাড়াই কার্যক্রম পরিচালনা করে। সাকিরিস জানান, গোপনে কার্যক্রম পরিচালনা করায় এসব জাহাজ নিজে যেমন দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে থাকে, তেমনি ব্যস্ত প্রণালী বা বন্দরে অন্যান্য জাহাজের চলাচলকেও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। বর্তমান পরিস্থিতি চলমান থাকলে সামনের দিনগুলোয় ডার্ক ফ্লিট বীমাকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here