স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আর্থসামাজিক উন্নয়নে অদম্য বাংলাদেশ

পাকিস্তানের জন্মই হয়েছিল অদ্ভুত এক ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা নিয়ে। একদিকে পশ্চিম পাকিস্তান, আর একদিকে পূর্ব পাকিস্তান। মাঝখানে এক হাজার মাইল ভারতভূমি। দুটো ফুসফুসের মাঝে এক হাজার মাইল দূরত্ব থাকলে সে মানুষ বাঁচে না। তাই-ই হয়েছিল। প্লুটোক্রেসি ভেঙে জন্ম নিয়েছিল এক নতুন দেশ। বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসে সেই বাংলাদেশ কোথায় দাঁড়িয়ে? বক্ষমাণ নিবন্ধে সে আলোচনাই থাকছে তিনটি ভাগে। প্রথম ভাগে রয়েছে স্বাধীনতার পাঁচ দশকে আর্থসামাজিক বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি। এই অগ্রগতির প্রেক্ষাপট বুঝতে আলোকপাত করা হয়েছে অখ- পাকিস্তানে দুই অঞ্চলের নীতির বৈষম্যের ওপর। দ্বিতীয় ভাগে দেখানো হয়েছে এসব সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের অবস্থান এবং তৃতীয় ভাগে বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশের বৈশ্বিক অবস্থান।

পাঁচ দশকে আর্থসামাজিক অগ্রগতি

দেশভাগের শুরু থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের সম্পদ বরাদ্দ ও অর্থনৈতিক নীতি ছিল পক্ষপাতদুষ্ট। ফল হিসেবে দুই দশকের মধ্যেই পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রকট হয়ে ওঠে। অধ্যাপক রেহমান সোবহান তাঁর ‘বাংলাদেশের অভ্যুদয়: একজন প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য’ গ্রন্থে মোটা দাগে সরকারি নীতির চারটি এলাকাÑবাণিজ্য নীতি, বিনিময়হার নীতি, বৈদেশিক মুদ্রা বরাদ্দের হার নির্ধারণ, ফেডারেল ফিন্যান্স ও বহিঃসম্পদ আহরণ নীতির ক্ষেত্রে আঞ্চলিক পক্ষপাতিত্বের কথা জোর দিয়ে বলেছেন। সরকারি ব্যয় বরাদ্দের নীতি, বৈদেশিক সহায়তা বরাদ্দের নীতি, বৈদেশিক মুদ্রা বরাদ্দের নীতি, বিনিময় হার ও আমদানি-সংক্রান্ত নীতি সর্বদা পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি পক্ষপাত দেখিয়েছে। এর ফলে জিডিপি, মাথাপিছু আয়, জীবনযাত্রার মান সবকিছুতেই পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে পিছিয়ে পড়ে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে সেই বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ বল্গাহীন অশ্ব। ছুটছে দুরন্ত গতিতে। পুঁজির বাজারে বাড়-বাড়ন্ত। নিশ্চিন্তে কৃষি। কম আবাদেই এখন বেশি ফসল। উফশী জাত ও যান্ত্রিকীকরণের ম্যাজিকে। ঘরে উঠছে সাড়ে চার কোটি টন খাদ্যশস্য।

কৃষির সাথে শিল্পের বিকাশও হচ্ছে সমানতালে। সবদিকেই কলকারখানা মাথা তুলছে। এটাই অর্থনীতির সবচেয়ে বড় আয়ুধ। মানুষ কাজ পাচ্ছে। কর্মসংস্থানে যুবমানসে বিষম্নতা কাটছে। পুঁজির বিকাশ দেশের অর্থনৈতিক জমি ক্রমেই উর্বর করছে। প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ পেরিয়ে গেছে। মহামারির কালে চরম বিরুদ্ধ সময়েও তা ৫ শতাংশের নিচে নামেনি। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, লিঙ্গসাম্য, পুষ্টি-মানবোন্নয়নের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সূচকেই বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। দেশজুড়ে চলছে অবকাঠামো উন্নয়নের বিশাল কর্মযজ্ঞ। নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু এখন আর স্বপ্ন নয়। ঢাকায় চলছে মেট্রোরেলের কাজ। শুরু হয়েছে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণও। নগর-গ্রাম সবখানেই বদলের ছোঁয়া। ডিজিটাল বাংলাদেশও আজ বাস্তব।

৮% জিডিপি প্রবৃদ্ধি

ভারতভাগের সময় পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) তেমন একটা তফাত ছিল না। পাকিস্তানের চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার ওপর অর্থনীতিবিদরা যে প্রতিবেদন দিয়েছিলেন, তাতে দেখা যায়, ১৯৪৯-১৯৫০ সাল পর্যন্ত জিডিপিতে বাংলাদেশ তথা পূর্ব পাকিস্তানের হিস্যা ছিল ৪৯ দশমিক ৫ শতাংশ। ১৯৫৯-১৯৬০ সাল নাগাদ এ হিস্যা কমে দাঁড়ায় ৪৭ দশমিক ৫ শতাংশে। ১৯৬৯-৭০ সাল নাগাদ পাকিস্তানের জিডিপিতে এ অঞ্চলের হিস্যা আরও সংকুচিত হয়ে ৪২ দশমিক ৬ শতাংশে দাঁড়ায়।

পঞ্চাশের দশকে পশ্চিম পাকিস্তানে অর্থনীতির দ্রুততর উন্নতি ও কাঠামোগত বৈচিত্র্য সৃষ্টির মাধ্যমে দুই অঞ্চলের মধ্যে অর্থনৈতিক বিকাশের বৈষম্যমূলক একটা পরিবেশ তৈরি করা হয়, ষাটের দশক পর্যন্তও যা জারি থাকে। ফলে পঞ্চাশের দশকে পূর্ব পাকিস্তানে ১ দশমিক ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও পশ্চিম পাকিস্তানে প্রবৃদ্ধির গড় হার ছিল ২ দশমিক ৭ শতাংশ। ষাটের দশকে এ বৈষম্য আরও বেড়ে যায়। পূর্ব পাকিস্তানের ৪ দশমিক ৩ শতাংশের বিপরীতে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রবৃদ্ধির গড় হার দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৪ শতাংশ।

যুদ্ধের বছরে অর্থাৎ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ঋণাত্বক হয়ে যায়। ওই বছর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হয় ঋণাত্মক ৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ। সেইপ্রবৃদ্ধিতেই এখন উড়ন্ত গতি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রথমবারের মতো ৮ শতাংশের গণ্ডি পেরিয়ে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশে পৌঁছেছে। মহামারিকালেও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫ শতাংশের নিচে নামেনি বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ২০২০ পঞ্জিকাবর্ষের যে হিসাব দিয়েছে, তাতে ২০২০ সালে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ। বছরটিতে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি পেয়েছে কেবল গায়ানা ও দক্ষিণ সুদান।

তবে এই প্রবৃদ্ধি কোনো ম্যাজিক নয়, কোনো জাদুদণ্ডের ছোঁয়ায়ও আসেনি। অনেক সিঁড়ি ভেঙে প্রবৃদ্ধির শিখরে উঠতে হয়েছে। সাফল্যের এই কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেওয়া হলেও তাঁর বক্তব্য, এটা দেশের সব মানুষের পরিশ্রমের ফসল।

১২০ ডলারের মাথাপিছু আয় এখন ২০৬৪ ডলার

পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানে অর্থনীতির দ্রুত উন্নতি ও বহুমুখীকরণের অনিবার্য পরিণতি হিসেবে দুই অঞ্চলের মধ্যে মাথাপিছু আয়ে বড় ধরনের বৈষম্য তৈরি হয়। ১৯৪৯-৫০ সালে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে মাথাপিছু আয়বৈষম্য ছিল ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ। ১৯৬৯-৭০ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ৬১ শতাংশে।

মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে দুই অঞ্চলের মধ্যে এ বৈষম্যের সাথে সমানতালে বাড়তে থাকে বিভিন্ন পণ্যদ্রব্য, সেবা ও সুযোগ-সুবিধাভোগের বৈষম্যও। মাথাপিছু কৃষিজাত দ্রব্যাদি ভোগের ক্ষেত্রে অতটা বৈষম্য না ঘটলেও স্থূলবৈষম্য সৃষ্টি হয় শিল্পদ্রব্যাদি যেমন কাগজ, কাপড় ও বিদ্যুৎশক্তির ব্যবহারে। বৈষম্যের এই পথপরিক্রমায় উত্তরাধিকার সূত্রে মাথাপিছু মাত্র ১২০ ডলার আয় নিয়ে স্বাধীন দেশ হিসেবে যাত্রা করে বাংলাদেশ। এরপর শুধুই এগিয়ে যাওয়া। ২০২০ সালেই বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় পৌঁছে গেছে ২ হাজার ৬৪ ডলারে।

১০ শতাংশের ঘরে অতিদারিদ্র্য

তীব্র আঞ্চলিক অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর বিরাট একটা অংশ দারিদ্র্যরেখার নিচে নেমে আসে। ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশের বেশি ছিল দারিদ্র্যসীমার নিচে। অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা কৌশলের পাশাপাশি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির কারণে সে অবস্থা থেকে ধীরে বেরিয়ে এসেছে স্বাধীন বাংলাদেশ। ব্যাপকভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ওপর ভর করে চরম দারিদ্র্য থেকে দরিদ্রদের বড় অংশ উঠে এসেছে। ২০১৯ সালে দেশে দারিদ্র্যের হার নেমে এসেছে ২০ শতাংশে। অতিদরিদ্রের হারও নেমে এসেছে ১০ শতাংশে।

৬৩ কোটি থেকে বেড়ে রপ্তানি হাজার কোটি ডলার

জিডিপির আকারই প্রাথমিকভাবে স্থানীয় বাজারের আকার নির্ধারণ করে। সেই হিসাবে, ১৯৪৯-৫০ সালের দিকে ১ হাজার ২৩৭ কোটি ৪০ লাখ টাকার জিডিপি নিয়ে এই অঞ্চলের বাজারের আকার বেশি হওয়ারই কথা। কারণ, পশ্চিম পাকিস্তানের জিডিপি তখনো ১ হাজার ২০৯ কোটি ১০ লাখ টাকা। তবে বাজারের সাথে কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থান, তার নিরাপত্তা ও অসামরিক খাতে ব্যয়, চাকরি প্রভৃতি যুক্ত করলে পশ্চিম পাকিস্তানের বাজার সম্ভাবনা কিছু পরিমাণে হলেও বেশি ছিল। বাজার সম্ভাবনা বেশি হলেও রপ্তানি সম্ভাবনা পূর্ব পাকিস্তানেই থেকে যায়। ১৯৪৮-৪৯ ও ১৯৫৪-৫৫ সালের মধ্যে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার ৫১ দশমিক ৫ শতাংশের জোগান আসত পূর্ব পাকিস্তান থেকে।

বিশ্বব্যাংকের উপাত্ত থেকে জানা যায়, ১৯৬০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের রপ্তানির আর্থিক মূল্য ছিল ৬৫ কোটি ৬৬ লাখ ৫১ হাজার ৫৭২ ডলার। মুক্তিযুদ্ধের আগের বছর ১৯৭০ সালে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৮৭ কোটি ৭৫ লাখ ৬৪ হাজার ৮২৭ ডলারে। তবে যুদ্ধের বছর ১৯৭১ সালে পণ্য রপ্তানি থেকে মাত্র ৬৩ কোটি ৫১ লাখ ৯৮ হাজার ৮৭ ডলার আয় করতে পেরেছিল বাংলাদেশ। পোশাক শিল্পের হাত ধরে আশির দশক থেকে রপ্তানি আয় বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধানতম স্তম্ভ হয়ে দাঁড়াতে শুরু করে। পরবর্তী এক দশকে রপ্তানি আয় ৮০ শতাংশ বেড়ে যায়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ৪০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে ৪০ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। প্রতিকূল বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে ২০১৯-২০ অর্থবছরে রপ্তানি বেশ খানিকটা কমলেও ৩৩ বিলিয়ন ডলারের (৩ হাজার ৩৭৬ কোটি) ওপরেই আছে। পোশাকপণ্যের বাইরেও রপ্তানির নতুন নতুন খাত হিসেবে ওষুধ, স্টিল, সিমেন্ট এবং সিরামিকও তাদের অবস্থান জানান দিচ্ছে।

প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগে গতিসঞ্চার

স্বাধীনতার বছর থেকেই বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আসতে শুরু করে। পরের বছর ১৯৭২ সালে ৯০ হাজার ডলার প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ পায় বাংলাদেশ। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত এর পরিমাণ ছিল খুবই নগণ্য। এর পরেও যে খুব বেশি বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে তা নয়। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির বিশ্লেষণ অনুযায়ী, প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ ৩০ কোটি ৮ লাখ ডলার থেকে ৩৫ কোটি ৬০ লাখ ডলারে পৌঁছাতে সময় লাগে দীর্ঘ ১৫ বছর (১৯৮০ থেকে ১৯৯৫)। আরও বেশি প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে বড় ধরনের সংস্কার কর্মসূচি হাতে নেয় সরকার। নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু হওয়া এই সংস্কার কর্মসূচির আওতায় কয়েক বছর পর্যন্ত বিনিয়োগের ওপর কর মওকুফ, শুল্কমুক্ত সুবিধায় মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি, কোম্পানিতে শতভাগ বিদেশি মালিকানা, মুনাফার পুনর্বিনিয়োগ, মাল্টিপল ভিসা, বিদেশি নির্বাহীদের ওয়ার্ক পারমিট ও রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) সুবিধা দেওয়া হয়। পাশাপাশি ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়নে বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে সরকার। ফলস্বরূপ ২০১৮ সালে ৩৬১ কোটি ডলার প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সক্ষম হয় বাংলাদেশ। তবে ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপীই প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস পেয়েছে। বছরটিতে বৈশ্বিক প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ ৪২ শতাংশ কমেছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। আঙ্কটাডের হিসাবে ২০১৯ সালে বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ১৬০ কোটি ডলার।

জিডিপিতে উৎপাদন খাতের হিস্যা বেড়েছে

স্বাধীনতা-পরবর্তী অনেকটা সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি ছিল আমদানিনির্ভর। জিডিপিতে উৎপাদন (ম্যানুফ্যাকচারিং) খাতের হিস্যা ছিল সামান্য। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে স্বাধীনতার পরের বছর ১৯৭২ সালে জিডিপিতে উৎপাদন খাতের হিস্যা ছিল মাত্র ৪ শতাংশ। পরবর্তীতে নবজাত শিল্প সুরক্ষায় আমদানি-বিকল্প শিল্পায়নের কৌশল হাতে নেয় সরকার। আশি ও নব্বইয়ের দশকে শিল্প খাতের এ সংস্কার জিডিপিতে শিল্পের হিস্যা বাড়াতে ভূমিকা রাখে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের জিডিপিতে শিল্পের হিস্যা দাঁড়িয়েছে ১৮ শতাংশ। একইভাবে জিডিপিতে অনুৎপাদনশীল খাতের হিস্যাও ১৯৭২ সালের ২ শতাংশ বেড়ে ২০১৯ সালে ১১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। শিল্পায়নকে আরও গতিশীল করতে সারা দেশে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছে সরকার।

অবকাঠামো উন্নয়নে উড়ন্ত গতি

১৯৪৭-৪৮ সালে পূর্ব বাংলায় রাস্তা, রেলপথ ও সংখ্যার হিসাবে মোটরগাড়ি-সবকিছুই তুলনামূলকভাবে অনেক কম ছিল। পরবর্তী বছরগুলোতে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুলই ছিল। পাকিস্তান ইকোনমিক সার্ভে ১৯৬৯-৭০ অনুযায়ী, ১৯৫১-৫২ সালের তুলনায় ১৯৬৭-৬৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানের রাস্তা ৬ গুণ বেড়ে ২ হাজার ৫৮৮ মাইলে উন্নীত হলেও পশ্চিম পাকিস্তানের ২২ হাজার ৫০৮ মাইলের তুলনায় যাকে সামান্যই বলতে হবে। একইভাবে ১৯৬৭-৬৮ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে ৫ হাজার ৩৩৪ মাইল রেলপথের বিপরীতে পূর্ব পাকিস্তানে রেলপথ ছিল ১ হাজার ৭১২ মাইল।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সেই যোগাযোগ অবকাঠামোও কার্যত ধ্বংস করে দিয়ে যায়। স্বাধীনতার পর যোগাযোগ অবকাঠামোয় বিনিয়োগ শুরু করে নতুন সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় রেল ও সড়কপথের দৈর্ঘ্য বেড়েছে। সারা দেশে বর্তমানে পাকা সড়ক রয়েছে ৫৫ হাজার কিলোমিটার। এর মধ্যে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অধীনে মহাসড়কের দৈর্ঘ্য ২২ হাজার ৯৬ কিলোমিটার। সারা দেশে যে ৯৯টি জাতীয় মহাসড়ক রয়েছে, তার দৈর্ঘ্য ৩ হাজার ৯০৬ কিলোমিটার। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, মিটারগেজ, ব্রডগেজ ও ডুয়ালগেজ মিলিয়ে বাংলাদেশে রেলপথ উন্নীত হয়েছে ২ হাজার ৮৮৫ কিলোমিটারে। এর মধ্যে চালু রয়েছে ২ হাজার ৬৫৬ কিলোমিটার। তবে পরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হওয়ার পরও স্বাধীনতা-পরবর্তী পাঁচ দশকে হ্রাস পেয়েছে অভ্যন্তরীণ নৌপথের পরিমাণ। সারা বছর নাব্য থাকে এমন নৌপথের দৈর্ঘ্য এখন ৩ হাজার ৮০০ কিলোমিটার, বর্ষা মৌসুমে যা ৬ হাজার কিলোমিটারে উন্নীত হয়। তবে নৌপথের দৈর্ঘ্য ১০ হাজার কিলোমিটারে উন্নীত করার কাজ চলছে।

যোগাযোগ সহজ করতে যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু আগেই নির্মিত হয়েছে। পদ্মা সেতুও এখন বাস্তব। কর্ণফুলীর তলদেশে চলছে টানেল নির্মাণের কাজ। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি নির্মিত হচ্ছে পায়রা ও মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে মহাকাশ যোগাযোগেও সামিল হয়েছে বাংলাদেশ।

বন্দরে পণ্য হ্যান্ডলিং ১৭ গুণ বৃদ্ধি

স্বাধীনতার অব্যাবহিত পরের বছরগুলোতে সমুদ্রবন্দরগুলো দিয়ে আমদানিই হতো বেশি। পাটের বাইরে রপ্তানিপণ্য সেভাবে না থাকায় রপ্তানির পরিমাণও ছিল সামান্য। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে চট্টগ্রাম ও চালনা (বর্তমানে মোংলা) বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানিপণ্য পরিবহনের পরিমাণ ছিল ৫৭ লাখ ৮০ হাজার টন।

এর মধ্যে ৩৫ লাখ ৮৭ হাজার টন পরিবাহিত হয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। স্বাধীনতার পাঁচ দশকে এসে সমুদ্রবন্দরগুলো দিয়ে কার্গো পরিবহন প্রায় ১০ কোটি টনে উন্নীত হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সমুদ্রবন্দরগুলো দিয়ে কার্গো পরিবহন হয়েছে ৯ কোটি ৮২ লাখ ৪০ হাজার টন। একই সময়ে কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ২৯ লাখ টিইইউজ।

খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে ৩৫৪%

ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। তবে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই কৃষি অর্থনীতিও চরম বিপর্যয়ে পড়ে। কৃষি খাত পুরোপুরি ভেঙে পড়ে এবং খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদন হয় মাত্র ৯৯ লাখ মেট্রিক টন। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে অর্থাৎ ২০২০ সালে এসে খাদ্যশস্যের উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৫৪ লাখ মেট্রিক টন। কৃষির অন্যান্য খাত যেমন মাছ, পোলট্রি ও মাংস উৎপাদনেও এখন স্বয়ম্ভরতায় বাংলাদেশ। এটা সম্ভব হয়েছে কৃষির যান্ত্রিকীকরণ, ফসলের নতুন জাত উদ্ভাবন ও শস্য নিবিড়তা বাড়ানোর মধ্য দিয়ে।

বিদ্যুতের আওতায় ৯৯%

অর্থনৈতিক উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি জরুরি বিদ্যুৎ-জ¦ালানির সহপ্রাপ্যতা। স্বাধীনতার পর একটা লম্বা সময় পর্যন্ত অর্থনীতির প্রয়োজনে বিদ্যুতের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হলেও জোগানে ছিল যারপরনাই স্বল্পতা। বিদ্যুৎ খাতে যথেষ্ট জোর না দেওয়ার কারণে দেশের জনগণের বৃহদাংশ বিদ্যুৎসুবিধার বাইরেই থেকে যায়। ১৯৯১ সালেও বিদ্যুৎসুবিধার আওতায় ছিল মাত্র ১৪ শতাংশ মানুষ। ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৯ শতাংশে। এটা সম্ভব হয়েছে বিদ্যুৎ খাত ঘিরে বর্তমান সরকারের মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন ও সে অনুযায়ী বাস্তবায়নের সুবাদে। ২০০৯ সালেও দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ২৭টি। ২০২০ সালে এ সংখ্যা ১৪৭টিতে উন্নীত হয়েছে। ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য উৎসসহ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার ১৭১ মেগাওয়াটে। ২০০৯ সালে যেখানে উৎপাদন সক্ষমতা ছিল মাত্র ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। সক্ষমতার বিপরীতে সর্বোচ্চ উৎপাদন পৌঁছেছে ১৩ হাজার ৩৭৭ মেগাওয়াটে। বিদ্যুতের গ্রাহকসংখ্যা ২০০৯ সালের ১ কোটি ৮ লাখ থেকে বেড়ে হয়েছে ৩ কোটি ৯৮ লাখ।

পদ্মা সেতুর স্প্যান বসানো গত ডিসেম্বরেই শেষ হয়েছে। চলছে রোডওয়ে ও রেলওয়ে স্ল্যাব বসানোর কাজ। সবকিছু ঠিকমতো চললে ২০২১ সালের জুনেই যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হবে সেতুটি

শিক্ষার হার বেড়ে প্রায় তিন গুণ

গত পাঁচ দশকে মানবোন্নয়নের প্রায় সব সূচকেই আশাতীত সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ। শিক্ষা এর মধ্যে প্রধানতম। স্বাধীনতার তিন বছর পর ১৯৭৪ সালেও বাংলাদেশে শিক্ষার হার ছিল মাত্র ২৬ দশমিক ৮ শতাংশ। শিক্ষার হার ৫০ শতাংশের কাছাকাছি নিয়ে যেতে ২০১১ সাল পর্যন্ত লেগে যায়। সুচিন্তিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সুচারুভাবে তা বাস্তবায়নের ফলে এরপর থেকে দ্রুত বাড়তে থাকে শিক্ষার হার। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে শিক্ষার হার পৌঁছে যায় ৭৪ দশমিক ৭ শতাংশে। এই সময়ে প্রাথমিকে শিক্ষার্থী ভর্তি প্রায় শতভাগে উন্নীত হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার নেমে দাঁড়িয়েছে ১৮ শতাংশে। শিক্ষার হার বাড়াতে যা নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে।

পাঁচ দশকে গড় আয়ু বেড়েছে ২৬ বছর

মানুষের গড় আয়ু নির্ভর করে বেশকিছু চলকের ওপর। জীবনযাত্রার মান, স্বাস্থ্যসেবাপ্রাপ্তি, পুষ্টি ও অর্থনৈতিক অবস্থা এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। স্বাধীনতা-পরবর্তী বছরে এগুলোর কোনোটিই সহজপ্রাপ্য ছিল না। ১৯৭২ সালেও বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল মাত্র ৪৬ দশমিক ৬ বছর। জনগণের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবাপ্রাপ্তির সহজগম্যতায় ২০২০ সালে এসে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু দাঁড়িয়েছে ৭২ দশমিক ৬ বছরে।

মাতৃ শিশুমৃত্যু হ্রাসে অভাবনীয় সাফল্য

পাকিস্তান সৃষ্টির পর এই অঞ্চলের জনসংখ্যা বেশি হওয়া সত্ত্বেও স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় অনেক কম ছিল। এই বৈষম্য দূরীকরণেও বছরের পর বছর ধরে কার্যত কিছু করা হয়নি। পাকিস্তান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইয়ারবুকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৬৬ সালেও পশ্চিম পাকিস্তানের হাসপাতালগুলোয় শয্যা ছিল ২৬ হাজার ২০০টি। অথচ পূর্ব পাকিস্তানে ছিল মোটে ৬ হাজার ৯৮৪টি। প্রকট বৈষম্য ছিল চিকিৎসকের সংখ্যায়ও। ১৯৬৯ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে ১ লাখ ৩১ হাজার চিকিৎসকের বিপরীতে পূর্ব পাকিস্তানে ছিলেন মাত্র ৮৮ হাজার ১০০ চিকিৎসক। স্বাভাবিকভাবেই স্বাস্থ্যসেবার প্রাপ্যতা কাক্সিক্ষত পর্যায়ে ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই সন্তান জন্মের সিংহভাগই হতো অপ্রাতিষ্ঠানিক। সেই সাথে পুষ্টির অভাবে মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার ছিল উচ্চ। বিশ^ব্যাংকের উপাত্ত অনুযায়ী, ১৯৭৫ সালেও প্রতি ১ লাখ জীবিত সন্তান জন্মদানের সময় মৃত্যু হতো ৬০০ প্রসূতির। ১৯৯০ সালে তা ৫৭৪ জনে নেমে আসে। একই কারণে ১৯৭৩ সালেও এক হাজার শিশুর মধ্যে মারা যেত ১৬৭ জন। তবে স্বাস্থ্যসেবা বিশেষ করে মাতৃ ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা এবং পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতিতে মাতৃমৃত্যু হার পাঁচ দশকে ৭০ শতাংশের বেশি হ্রাস পেয়েছে। ২০১৭ সালে এসে প্রতি ১ লাখে প্রসূতি মৃত্যু দাঁড়িয়েছে ১৭৩ জনে। ২০২০ সালে শিশুমৃত্যুও প্রতি হাজারে ২১ জনে নেমে এসেছে।

লিঙ্গ সমতায় ঈর্ষণীয় অর্জন

সামাজিক-অর্থনৈতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের ব্যাপকভিত্তিক অংশগ্রহণের ফলে লিঙ্গ সমতায় আশাতীত সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ। ২০২০ সালের লিঙ্গ সমতা সূচকে টানা দ্বিতীয় বছরের মতো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থান অর্জন করেছে বাংলাদেশ। গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্স ২০২০ অনুযায়ী, সার্বিকভাবে বাংলাদেশ লিঙ্গবৈষম্য কমিয়ে এনেছে ৭৩ শতাংশ। ১৯৯৬ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মোট শ্রমশক্তিকে নারীদের অংশগ্রহণ ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬ শতাংশের বেশি। দক্ষিণ এশিয়ার গড় যেখানে ৩৫ শতাংশ।

আর্থসামাজিক সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান

স্বাধীন বাংলাদেশ ও তৎপরবর্তী সাফল্যের গল্পটা একেবারে অন্য রকম। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে আর্থসামাজিক অনেক সূচকেই পাকিস্তানকে ছাপিয়ে গেছে বাংলাদেশ। কোনো কোনো সূচকে ভারতকেও অতিক্রম করে গেছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক অনেক সূচকেই দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন অন্য উচ্চতায়।

মাথাপিছু জিডিপিতে ভারত-পাকিস্তানকে অতিক্রম

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের অর্থনীতি ছিল বিধ্বস্ত। ১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন দেশের মাথাপিছু জিডিপি ছিল মাত্র ৯৪ দশমিক ৩৮ ডলার (চলতি মূল্যে)। তখনো পাকিস্তানের মাথাপিছু জিডিপি ১৫৩ ডলারের ওপরে ছিল। দেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে নতুন উদ্যমের কারণে ১৯৭৫ সালেই বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ২৫৭ দশমিক ৫৭ ডলারে পৌঁছে যায়। কিন্তু পাকিস্তানের মাথাপিছু জিডিপি নেমে আসে ১৬৮ ডলারে। বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার থমকে গেলেও নব্বইয়ের দশকে বেসরকারি খাতের জন্য অর্থনীতিকে উন্মুক্ত করে দেওয়ার পর জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে হাওয়া লাগে। ২০১৯ সালে বর্তমান মূল্যে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ১ হাজার ৮৫৫ দশমিক ৭৪ ডলারে উন্নীত হয়। একই সময়ে পাকিস্তানের মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২৮৪ দশমিক ৭ ডলার। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এক প্রতিবেদনে ২০২০ সালে বাংলাদেশে ১ হাজার ৮৮৮ ডলার মাথাপিছু জিডিপির পূর্বাভাস দেয়। আর ভারতের মাথাপিছু জিডিপির পূর্বাভাস দেয় ১ হাজার ৮৭৭ ডলার। অর্থাৎ মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বিশ^ব্যাংকের হিসাবে, ২০১৯ সালে চলতি মূল্যে নেপালের মাথাপিছু জিডিপি ছিল ১ হাজার ৭১ ও আফগানিস্তানের ৫০৭ ডলার। তবে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি মাথাপিছু জডিপি ছিল শ্রীলংকার ৩ হাজার ৮৫৩, মালদ্বীপের ১০ হাজার ৬২৫ ও ভুটানের ৩ হাজার ৩১৬।

ভালো অবস্থানে জিডিপিতে বাণিজ্যের অবদান

পক্ষপাতমূলক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নীতির কারণে স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত এই অঞ্চলের বাণিজ্য সেভাবে বিকাশ লাভ করতে পারেনি। বিশ্বব্যাংকের উপাত্ত অনুযায়ী, ১৯৬০ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত জিডিপিতে বাণিজ্যের অবদান ২০ শতাংশের ওপরে থাকলেও ১৯৭১ সালে তা ১৭ শতাংশে নেমে আসে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর ১৯৭২ সালে জিডিপিতে বাণিজ্যের হিস্যা কিছুটা বেড়ে ১৯ দশমিক ৪ শতাংশে দাঁড়ায়। তবে বাণিজ্যে নতুন গতি আনে নব্বইয়ের দশকে অর্থনৈতিক উদারীকরণ নীতি। ১৯৯৫ সালেই তা ২৮ দশমিক ২ শতাংশে পৌঁছে যায়। ব্যবসা-বাণিজ্যকেন্দ্রিক সংস্কারমূলক নানা কর্মসূচি ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর ভর করে ২০১২ সালে জিডিপিতে বাণিজ্যের অবদান ৪৮ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত হয়। পরের কয়েক বছর এটা ধরে না রাখা গেলেও ২০১৯ সালেও জিডিপিতে বাণিজ্যের অবদান ৩৬ শতাংশের (৩৬ দশমিক ৭৬) ওপরেই ছিল।

পক্ষান্তরে গত ৫০ বছরে পাকিস্তানের জিডিপিতে বাণিজ্যের অবদান একবারই ৪০ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছে। ১৯৯৩ সালে দেশটির জিডিপিতে বাণিজ্যের হিস্যা ৩৮ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল এবং সেটাই এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। বিশ্বব্যাংকের উপাত্ত অনুযায়ী, সর্বশেষ ২০১৯ সালে পাকিস্তানের জিডিপিতে বাণিজ্যের অবদান ছিল বাংলাদেশের চেয়ে ঢের কম ৩০ দশমিক ৪৪ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মধ্যে ২০১৯ সালে ভারতের জিডিপিতে বাণিজ্যের অংশ ছিল ৪০, নেপালের ৫৫, শ্রীলংকার ৫২ ও ভুটানের ৮৪ শতাংশ।

পোশাক শিল্পই বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান স্তম্ভ। মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশই আসছে এই শিল্প থেকে

এফডিআই আকর্ষণে দ্বিতীয়

উচ্চপ্রবৃদ্ধির সুবাদে অনেকদিন ধরেই সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। সরকারি ঋণও সন্তোষজনক স্তরে রয়েছে। তবে বহুমুখী এই উন্মুক্ত অর্থনীতির সবচেয়ে বড় শক্তি সাশ্রয়ী শ্রমের পর্যাপ্ততা। ভৌগোলিক বিচারেও বাংলাদেশ রয়েছে সন্তোষজনক অবস্থানে। সেই সাথে ব্যবসায়িক নানা সংস্কারের ফলে বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। ফল হিসেবে গত দশকেই প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগে (এফডিআই) পাকিস্তানকে অতিক্রম করে যায় বাংলাদেশ। ২০১৮ সালেও পাকিস্তানের চেয়ে বেশি  বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সক্ষম হয় বাংলাদেশ। ওই বছরে পাকিস্তানে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের আন্তপ্রবাহ ১৭৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার হলেও বাংলাদেশে এর পরিমাণ ছিল ৩৬১ কোটি ৩০ লাখ ডলার। পরের বছর অবশ্য পাকিস্তান কিছুটা এগিয়ে গেছে। আঙ্কটাডের বৈশ্বিক বিনিয়োগ প্রতিবেদন ২০২০ অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ১৬০ কোটি ডলারের প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ এলেও পাকিস্তানে এর পরিমাণ ছিল ২২১ কোটি ডলার। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ২০১৯ সালে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের আন্তঃপ্রবাহ ছিল ২৮৭ কোটি ডলার। বছরটিতে ভারতে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের আন্তপ্রবাহ ছিল ৫ হাজার ৫৫ কোটি ডলার। দক্ষিণ এশিয়ার বাকি সব দেশেই বিদেশি বিনিয়োগের আন্তপ্রবাহ ছিল বাংলাদেশের চেয়ে কম। ২০১৯ সালে শ্রীলংকায় এফডিআই এসেছিল ৭৫ কোটি ৮০ লাখ, নেপালে সাড়ে ১৮ কোটি, মালদ্বীপে সাড়ে ৫৬ কোটি ও আফগানিস্তানে ৪ কোটি ডলারের মতো।

প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে থাকলেও সম্ভাবনার চেয়ে পরিমাণটা এখনো অনেক কম। এ থেকে বেরিয়ে আসতে প্রয়োজন নীতিসহায়তা ও ব্যবসার পরিবেশে উন্নতি সাধন। নানা সংস্কারের মাধ্যমে সেই চেষ্টাই চলছে।

বৈদেশিক মুদ্রার মজুদে দ্বিতীয়

গতিশীল বিনিয়োগ, শক্তিশালী রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের ওপর ভর করে বৈদিশিক মুদ্রার মজবুত মজুদ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। ছয় মাসের আমদানি দায় মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ ডলার কয়েক বছর ধরেই মজুদ রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, ২০১৯ সাল শেষে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ দাঁড়ায় ৩২ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। পরিমাণটা পাকিস্তানের প্রায় দ্বিগুণ। ২০১৯ সাল শেষে পাকিস্তানে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ছিল মাত্র ১৬ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালের জুনে পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ একেবারে তলানিতে নেমে আসে এবং ১০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের সুবাদে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ কিছুটা শক্তিশালী হলেও ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে ১৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করতে পারেনি। অথচ একই সময়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ দাঁড়ায় ৪৩ বিলিয়ন ডলার, যা দিয়ে ১০ মাসের আমদানি দায় পরিশোধ সম্ভব।

দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের চেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ রয়েছে কেবল ভারতের। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে জুনে দেশটিতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ছিল ৫৮৯ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার। ওই বছরে (আগস্ট) নেপালের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের পরিমাণ দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন, শ্রীলংকার ৫ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন, ভুটানের ১ দশমিক ৪৯ ও মালদ্বীপের দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার।

মাথাপিছু জাতীয় আয়ে পাকিস্তানকে অতিক্রম

জীবনযাত্রার মান কেমন হবে তাতে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে মাথাপিছু জাতীয় আয়। বিশ্ব ব্যাংকের হিসাবে, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় ছিল মাত্র ১২০ ডলার। এরপর ধারাবাহিকভাবে তা বাড়তে থাকলেও নতুন শতক থেকে এটি নতুন গতি পায়। উচ্চপ্রবৃদ্ধির পাশাপাশি মাথাপিছু জাতীয় আয় বেড়ে ২০১৯ সালে ১ হাজার ৯৪০ ডলারে দাঁড়ায়, পাকিস্তানের তুলনায় যা ২৭ শতাংশ বেশি। ২০১৯ সালে পাকিস্তানের মাথাপিছু জাতীয় আয় ছিল ১ হাজার ৪১০ ডলার। এছাড়া মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার জন্য মাথাপিছু ১ হাজার ৩৬ ডলার আয়ের যে শর্ত আছে, ২০১৫ সালেই তা স্পর্শ করেছে বাংলাদেশ। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় পৌঁছে যায় ২ হাজার ৬৪ ডলারে।

বিশ্বব্যাংকের উপাত্ত অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মধ্যে ২০১৯ সালে ভারতের মাথাপিছু জাতীয় আয় ছিল ২ হাজার ১২০, ভুটানের ৩ হাজার ১৪০, মালদ্বীপের ৯ হাজার ৬৮০, নেপালের ১ হাজার ৯০, শ্রীলংকার ৪ হাজার ২০ ও আফগানিস্তানের ৫৩০ ডলার।

অন্যান্য সূচকের অবস্থানও ওপরের দিকে

স্বাধীনতার ৫০ বছরের পথচলায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখেছে তরুণ শ্রমশক্তি। সেই সাথে শ্রমশক্তিতে লক্ষণীয় হারে নারীর অংশগ্রহণ, বিশেষ করে রপ্তানিনির্ভর পোশাক শিল্পে। বিশ্বব্যাংকের উপাত্ত অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১৫ ও তার বেশি বয়সী নারীদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার ৩৬ শতাংশের বেশি। পাকিস্তানে যেখানে এই বয়সী নারীদের মাত্র ২২ শতাংশের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ভারতে এ হার ২১ দশমিক ৫ শতাংশ। অর্থাৎ ১৫ বছরের বেশি বয়সী নারীদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হারে পাকিস্তান এমনকি ভারতের চেয়েও এগিয়ে আছে বাংলাদেশ।

২০২০ সালের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার যে সূচক, সেখানেও পাকিস্তানের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। এই সূচকে পাকিস্তান ১৫২তম অবস্থানে থাকলেও বাংলাদেশ রয়েছে ১২০তম স্থানে। এমনকি ভারতের চেয়েও সূচকটিতে এগিয়ে বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সূচকে ভারত রয়েছে বাংলাদেশের একধাপ পেছনে ১২১তম অবস্থানে।

বিজনেস টু কনজিউমার ই-কমার্স র‌্যাংকিংয়েও পাকিস্তানের চেয়ে একধাপ এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। আঙ্কটাডের বিটুসি ই-কমার্স ইনডেক্স ২০২০ এ বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১৫তম। যদিও ২০১৯ সালের সূচকে আরও ভালো অবস্থানে অর্থাৎ ১০৩তম স্থানে ছিল বাংলাদেশ। এই সূচকে ২০২০ সালে পাকিস্তানের স্থান ১১৬তম।

মাতৃ ও শিশুমৃত্যু হার হ্রাসের সাফল্যে ভারত-পাকিস্তান উভয়কেই ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। বিশ^ব্যাংকের ২০১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে শিশুমৃত্যু হার (জন্ম নেওয়ার পর দুই মাস বয়স পর্যন্ত প্রতি এক হাজার শিশুর মধ্যে) ২৫ দশমিক ৬ হলেও পাকিস্তানে এ হার ৫৫ দশমিক ৭। আর ভারতে প্রতি এক হাজার শিশুর মধ্যে ২৮ দশমিক ৩ জন জন্ম নেওয়ার পর দুই মাসের মধ্যে মারা যায়।

১৩ খাতে শীর্ষ দশে

চাষের জমি বাড়েনি। শিল্প-নগরায়ণের চাপে খানিক কমেছে। চাষিরাও বদলাননি। বদলেছে চিন্তা। চাষ করছেন পরিণত ও সচেতন মন নিয়ে, নির্ভুল অংক কষে। কোন জমিতে কোন বীজ, কী সার, কোন কীটনাশক সবই তাদের নখদর্পণে। পাশে কৃষিবান্ধব, সহৃদয় সরকার। যা দরকার জোগান আসছে নিমেষে। কৃষি গবেষণায় মিলছে নতুন জাত, নতুন বীজ। সার প্রয়োগে বাড়তি খরচের প্রশ্ন নেই। গভীর নলকূপ, সৌরবিদ্যুতের শক্তিতে সেচের আওতায় অধিকাংশ জমি। অক্লান্ত শ্রম দিয়েও প্রকৃতির অকৃপায় আক্ষেপের দিন এখন অতীত। আগের বিবর্ণতা ঘুচিয়ে মাঠজুড়ে ফসলের বর্ণময় সম্ভার। ধানে ধন্য দেশ। অন্নচিন্তামুক্ত কৃষক। ধানের ফলনই এখন সোয়া ৫ কোটি টন। এর বেশি ফলন মাত্র তিনটি দেশের।

ধানের সাথে গম, ভুট্টা, আলু, সবজি, পাটও ফলছে পাল্লা দিয়ে। বছরে দেড় কোটি টনের বেশি সবজি ফলিয়ে বাংলাদেশ এখন তৃতীয় অবস্থানে। আলুর

উৎপাদনও এক কোটি টনের বেশি। এর বেশি আলু উৎপাদনের কৃতিত্ব মাত্র পাঁচটি দেশের। বাংলাদেশের চেয়ে বেশি কাঁঠাল পাচ্ছে কেবল বৃহৎ ভূমি ভারত। আমের ফলনেও আমাদের অবস্থান প্রথম দশেই। আর পেয়ারায় অষ্টম। প্রত্যাবর্তনরত সোনালি আঁশের সোনালি গৌরব। পাটের উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয় হলেও পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে শীর্ষে বাংলাদেশই।

পদ্মা-মেঘনার স্রোতের ভাঁজে ভাঁজে এখন রুপালি ইলিশ। সারা বিশে^ আহরিত মোট ইলিশের ৮৬ শতাংশই হয় বাংলাদেশে। মিঠাপানির মাছ উৎপাদনেও আছে তৃতীয় অবস্থানে।

ভূমির উৎপাদনই ছিল স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি। বৃহদায়তন ও ভারী শিল্পের বিকাশ তখনো হয়নি। কিন্তু জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের তাগিদটা তীব্র। এই তাগিদ থেকেই স্বাধীনতার পর শুরু হয় বিদেশমুখিতা। আশির দশকে পায় ভিন্ন মাত্রা। বিশে^র বিভিন্ন প্রান্তে এখন এক কোটির বেশি বাংলাদেশির কর্মযোগ। তাঁদের হাত ধরে আসছে প্রায় ২ হাজার কোটি ডলার প্রবাসী আয়।

ভূমির শক্তিতে চিরকালের যে কৃষিজ বাংলাদেশ, সেখানে আজ শিল্পেরও বাড়বাড়ন্ত। দীর্ঘ অধ্যবসায় আর শ্রমে ধীরে ধীরে মাথা তুলেছে পোশাকশিল্প। ধীরে গরিমায় আকাশ ছুঁয়েছে। এই শিল্পে বাংলাদেশ এখন বৈশ্বিক সুপারপাওয়ার। চীনের পরই সবচেয়ে বেশি পোশাক রপ্তানি হয় এখান থেকেই।

উন্নত জাত ও কৃষির যান্ত্রীকরণের ছোঁয়ায় কম আবাদেও আসছে বেশি ফলন। শুধু ধান উৎপাদনই হচ্ছে বছরে সোয়া ৫ কোটি টন

মাইলফলক স্বীকৃতি

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে অভিগমনে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্টের কাছ থেকে স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশ। স্বল্পোন্নত দেশে উত্তরণের তিনটি শর্তই পূরণ করায় ২০১৮ সালের পর ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশের পক্ষে সুপারিশ করেছে জাতিসংঘ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহৎ ও গৌরবোজ্জ্বল এই অর্জনের কৃতিত্ব দিয়েছেন দেশের জনগণকে। বলেছেন, ‘সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা এই মাইলফলক অর্জন করতে পেরেছি।’

এর আগে ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংকের মাথাপিছু আয়ের নিরিখে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয় বাংলাদেশ। মাথাপিছু আয়ের বিচারে ২০২১ সাল শেষে বাংলাদেশ উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পথে রয়েছে। এছাড়া সহশ্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনে অন্যতম রোলমডেলের স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশ। দারিদ্র্য দূরীকরণ, খাদ্যনিরাপত্তা, প্রাথমিক শিক্ষা, মৃত্যুহার হ্রাস, টিকাকরণ ও সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে বাংলাদেশ লক্ষণীয় সাফল্য দেখিয়েছে। এসডিজি অর্জনেও বিশেষ পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ ও প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০৪১ এ সরকার বিষয়টি অন্তর্ভুক্তও করেছে।

আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদদের চোখে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি বিস্ময়কর। ‘বাস্কেট কেস’র তত্ত্ব ভুল প্রমাণ করে অবিভক্ত পাকিস্তানের দরিদ্রতম অঞ্চলটিই এখন উদীয়মান অর্থনীতি। ব্র্রিটেনের সেন্টার ফর ইকোনমিক্স অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চের পূর্বাভাসে ২০৩৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতি। বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর বয়ানে, বাংলাদেশ এখন এশিয়ার সাফল্যের গল্প। দুই দশক আগেও যা ছিল কল্পনার অতীত। তবে সব অর্থনীতির মতোই দুর্নীতি, আয়বৈষম্যের মতো কিছু ঝুঁকিও আছে। এসব ঝুঁকি মোকাবেলা করে বাংলাদেশ কি পারবে তার অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে টেকসই রূপ দিতে? তবে এসব ঝুঁকি মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রীর যে অঙ্গীকার, তাতে আশাবাদের যথেষ্ট কারণ খুঁজে পাচ্ছেন কৌশিক বসু। আশাবাদী আর সব অর্থনীতিবিদও। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথায়, ‘এক যুগ আগের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক নয়। আজকের বাংলাদেশ এক বদলে যাওয়া বাংলাদেশ।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here