বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা ও আত্মনির্ভরশীলতার অবলম্বন

গাঙ্গেয় বদ্বীপের জন্ম, বাণিজ্যিক উত্থান, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনসহ ইতিহাসের বহু গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সাক্ষী বঙ্গোপসাগর। কালের আবর্তে এই জলরাশির ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব বেড়েছে বহুগুণ। সুনীল অর্থনীতির জোয়ার এসেছে বঙ্গোপসাগরেও। সমুদ্র বিজয়ের পর বাংলাদেশের জন্য সেই জোয়ারকে কাজে লাগানোর উপযুক্ত সময় এখনই।

বঙ্গোপসাগর: বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা আত্মনির্ভরশীলতার অবলম্বন

বিশ্বের সবচেয়ে বড় উপসাগর বঙ্গোপসাগর। এই নামটা বাঙালিদের কাছে একটু গর্বের বইকি। বিপুল এই জলরাশির কোলে যে কেবল প্রাচীন বঙ্গ ও এখনকার বাংলাদেশের অবস্থান, তা কিন্তু নয়। বরং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ওডিশা (সাবেক উড়িষ্যা), তেলেঙ্গানা, অন্ধ্র প্রদেশ ও তামিলনাড়– রাজ্য কিংবা মিয়ানমারেরও (প্রাচীন বার্মা) হিস্যা রয়েছে এই উপসাগরের উপকূলীয় সীমানা নির্ধারণে। তা হলেও সাগরের নাম কিন্তু তাদের নামে রাখা হয়নি। হয়েছে বঙ্গ বা বাংলার নামে। আর ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বঙ্গোপসাগর বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অন্যান্য দেশের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে বিশ্ব বাসীকে এই উপসাগরের নাম মাঝেমধ্যেই স্মরণ করতে হয়। আর সেই সঙ্গে অবধারিতভাবেই চলে আসে বঙ্গ বা বাংলা, তথা আধুনিক বাংলাদেশের নাম। কারণ ইংরেজিতে বঙ্গোপসাগরের নাম বে অব বেঙ্গল, যার আভিধানিক অর্থ করলে দাঁড়ায় বাংলার উপসাগর।

তবে বঙ্গোপসাগর ঘিরে বাঙালির আত্মতুষ্টি যে কেবল নামেই, তা কিন্তু নয়। বরং এই জাতির সমৃদ্ধি ও অগ্রযাত্রার আখ্যানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে এই সাগরের নাম। মধ্যযুগে ইউরোপীয় বণিকদের সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশের যে বাণিজ্যিক সংযোগ স্থাপন হয়েছিল, তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল এই জলাধারের। পরবর্তী সময়ে তো এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক বিভিন্ন পটপরিবর্তনে নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন এই ইউরোপীয় বণিক ও তাদের উত্তরসূরিরা।

ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিল বলেছিলেন, ব্রিটেনকে যদি উন্মুক্ত সাগর ও ইউরোপ-এই দুয়ের মধ্যে যেকোনোর একটিকে বেছে নিতে বলা হয়, তাহলে ব্রিটেন অবশ্যই উন্মুক্ত সাগরকেই বেছে নেবে। চার্চিলের এই কথাতেই একটি দেশের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় সমুদ্রের গুরুত্ব ফুটে ওঠে।

বাংলাদেশের জন্যও বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়। সাম্প্রতিক সময়ে সমুদ্র অর্থনীতির জোয়ার ও ভূরাজনৈতিক পটপরিবর্তন এই গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আর অর্থনৈতিক গুরুত্বের কথা চিন্তা করলে দেখা যায়, বঙ্গোপসাগর শুধু ঐশ্বর্যম-িত এক বিশাল লবণাক্ত জলরাশিই শুধু নয়, ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য অন্যতম অবলম্বন হতে পারে এটি।

বঙ্গোপসাগরের নামকরণ

মিয়ানমার, আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলংকা, বাংলাদেশ ও দক্ষিণ ভারতের বিস্তীর্ণ ভূখ-ের মাঝে ২১ লাখ ৭২ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত বঙ্গোপসাগর। সমুদ্রের মাঝখানে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ একটা আড়াল সৃষ্টি না করলে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর পর্যন্ত জলের তালুক হতে পারত বঙ্গোপসাগরের। এখন আন্দামানের পূর্বের জলাধারের নাম আন্দামান সাগর।

প্রাচীন ও মধ্যযুগে বঙ্গোপসাগর কিন্তু এই নামে পরিচিত ছিল না। প্রাচীন সংস্কৃত ভাষায় রচিত সাহিত্যে এর নাম ছিল মহোদধি। জেবিবিডি এনভিল কর্তৃক ১৭৬২ সালে প্রণীত এবং লন্ডন থেকে ১৭৯৪ সালের প্রকাশিত প্রাচীন বিশ্বের মানচিত্রে এর নাম রয়েছে ‘গ্যাঞ্জেটিকা সাইনাস’ বা গঙ্গার সমুদ্র।

বঙ্গোপসাগরের নামকরণের পেছনের সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যায় না। তবুও এই নামকরণের পেছনে তিনটি কারণ অনুমান করেন অনেকেই। প্রথমত, প্রাচীন বঙ্গ অঞ্চলের নামানুসারেই বঙ্গোপসাগর নামকরণ করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ভারতের প্রাচীন গ্রন্থগুলোর কোনো বর্ণনা অনুসারে এ নামকরণ করা হয়েছে। তৃতীয়ত, প্রাচীন বঙ্গ অঞ্চলের মানুষের এমন কোনো বীরত্বগাথা ছিল, যার কারণে তাদের সম্মানার্থে বা প্রভাবে এই জলরাশির নাম বঙ্গোপসাগর রাখা হয়েছে।

সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে বাংলা ছিল একটি সমৃদ্ধিশালী জনপদ। ইতিহাসবেত্তা মাউন্ট স্টুয়ার্ট এলফিনেস্টন বলেন, প্রাচীনকাল থেকে আরব দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্পর্ক ছিল সমুদ্রপথে। তখন চট্টগ্রাম ও সপ্তগ্রাম বা সাতগাঁও নামে বাংলায় দুটি বড় বন্দর ছিল। সপ্তগ্রাম থেকে সরে এসে বন্দরটি প্রথমে হুগলি ও পরে কলকাতায় থিতু হয়। অন্যদিকে চট্টগ্রাম বন্দর সেই একই জায়গায় রয়েছে। প্রাচীন আমল থেকে সমুদ্রগামী জাহাজে দক্ষিণ ভারতের অন্যান্য মানুষের সঙ্গে বাংলার খেটে খাওয়া মানুষও লস্করের কাজ করে এসেছে। এর প্রমাণ মেলে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর জাহাজ ও বাণিজ্যিক জাহাজে হাজার হাজার বাঙালির কাজ করার সাক্ষ্য-প্রমাণ দেখে। বঙ্গোপসাগরের ইংরেজি নাম বে অব বেঙ্গল হওয়ার ক্ষেত্রে ইংরেজদের মননের ওপর তাদের জাহাজে কাজ করা বাঙালি লস্করদের যে প্রভাব ছিল, তা বললে বোধহয় ভুল হবে না। প্রথম দিকে এরাই ছিল ইংরেজের ঘনিষ্ঠজন, ঘরের লোক। ষোড়শ শতাব্দীতে তারা যখন এদেশে ব্যবসা করতে এসে বঙ্গোপসাগরের তীরে বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করত, তখন তাদের জাহাজে কর্মরত এ দেশীয় লস্কররাই তাদের পথঘাট-জনপদ চিনিয়ে দিত।

প্রাচীন বাণিজ্য

বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্যের চল ছিল প্রাচীন যুগ থেকেই। এখানকার প্রাচীন জনপদ পু-্রবর্ধন, রাঢ়, বঙ্গ ও সমতট-হরিকেলে পাওয়া বিভিন্ন নিদর্শন যেমন মুদ্রা ও লিপি থেকে এ সম্পর্কে প্রমাণ মেলে। সে সময় এখানকার প্রধান বাণিজ্য পণ্য ছিল শস্য; বিশেষত ধান ও তিলের মতো দানাদার শস্য। আর এসব পণ্য পরিবহনে একমাত্র মাধ্যম ছিল নদীপথ। গাঙ্গেয় বদ্বীপে অবস্থিত বাংলার জন্য আশীর্বাদ ছিল প্রবাহমান অসংখ্য নদ-নদী। প্রাচীন জনপদগুলোও গড়ে উঠেছিল নদীকেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকের শেষ ভাগে এক গ্রিক নাবিকের লেখা থেকে জানা যায়, গাঙ্গেয় বদ্বীপটির নিম্ন ভাগে উৎপাদিত তেজপাতা ও সুগন্ধি তেলের খুব কদর ছিল রোমের সম্ভ্রান্ত ও বিত্তবান গোষ্ঠীর কাছে।

শিল্পীর তুলিতে আঁকা মুঘল আমলে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা একটি ডাচ জাহাজ

আনুমানিক খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকের মধ্যভাগে লিখিত একটি ঋণসংক্রান্ত চুক্তিপত্রে এই বিবৃতির চমকপ্রদ সমর্থন মিলবে। প্যাপিরাসের ওপর লিখিত এই চুক্তিপত্রে মালাবার উপকূলের বিখ্যাত বন্দর মুজিরিসে (বর্তমান ম্যাঙ্গালোর, কর্ণাটক) অপেক্ষমাণ বিদেশি জাহাজ হার্মোপোলনে প্রচুর পরিমাণে গ্যাঞ্জেটিক নার্ড বা গঙ্গাদেশের সুগন্ধি তেল বোঝাই করার কথা উল্লেখ রয়েছে। ওই সুগন্ধি তেল যে সমুদ্র ও স্থলপথে মিসরের প্রসিদ্ধ বন্দর আলেকজান্দ্রিয়ায় নিয়ে যাওয়া হবে, এই তথ্যটিও ঋণপত্রে উল্লেখ রয়েছে।

অবশ্য ওই গ্রিক লেখক তেজপাতা ও সুগন্ধি তেলকে গঙ্গাদেশের পণ্য বলে চিহ্নিত করলেও এগুলো আসলে নিম্ন গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলে উৎপন্ন পণ্য নয়। এগুলো বাংলার উত্তর-পূর্ব সীমান্তবর্তী অঞ্চলে উৎপাদিত হতো। এই তথ্য থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, উত্তর-পূর্ব ভারতের এই দুই গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী প্রথমে নদীপথে আসত গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকায়, সেখান থেকে উপকূলীয় বাণিজ্যপথে যেত তামিলনাড়– উপকূলে। সেখান থেকে আবার স্থলপথে মালাবারের বিখ্যাত বন্দর মুজিরিসে পণ্যগুলো আনা হতো এবং শেষ পর্যন্ত মুজিরিস থেকে তা পৌঁছত পূর্ব-ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায়। অর্থাৎ প্রাচীন বাংলায় এখনকার মতো ব্যাপক পরিসরে না হলেও মাল্টিমোডাল পরিবহন ও ট্রান্সশিপমেন্ট ব্যবস্থা চালু ছিল।

মধ্যযুগে বাংলার মূল রপ্তানি পণ্য ছিল বস্ত্র ও চাল। ষোড়শ শতকের শেষদিকে চট্টগ্রাম ও সাতগাঁও থেকে সমুদ্রপথে বিভিন্ন অঞ্চলে চাল রপ্তানি হতো। সেই শতকের আশির দশকে বিখ্যাত ব্রিটিশ বণিক রালফ ফিচ বাংলাকে বিশাল এক বস্ত্রভান্ডার বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, বাংলা থেকে প্রচুর পরিমাণে কাপড় ও চাল সমগ্র ভারতবর্ষ, শ্রীলংকা, বার্মা, মালাক্কা, সুমাত্রা ও অন্যান্য স্থানে রপ্তানি হতো। এ সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন ফরাসি পরিব্রাজক পিরার্ড ডি লাভাল। ১৬০৭ খ্রিষ্টাব্দের দিকে চট্টগ্রাম সফর করে তিনি লেখেন, ‘দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পর চট্টগ্রাম প্রচুর পরিমাণে চাল গোয়া, মালাবারসহ সমগ্র ভারতবর্ষ, সুমাত্রা, মালাক্কা ও সুন্দা দ্বীপে রপ্তানির অপেক্ষায় জমা (স্তূপীকৃত) রয়েছে।’ মুগল শাসনামলেও এই উদ্বৃত্ত চাল রপ্তানি অব্যাহত থাকে এবং এর পরিমাণ বেড়ে যায়। ১৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগিজ মিশনারি ও পর্যটক ফ্রে সেবাস্তিয়ান ম্যানরিক লিখেছেন, প্রতি বছর শত শত বড় নৌকাভর্তি চাল ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য বাংলার বন্দর থেকে বিদেশে রপ্তানি হয়। কিন্তু সপ্তদশ শতকের সত্তরের দশকের দিকে বাংলা থেকে প্রাচ্যে চাল রপ্তানি কমে আসে।

মুগল আমলে এই বদ্বীপে অর্থকরী পণ্য বিশেষত কাপড় ও সিল্ক উৎপাদন বহুলাংশে বেড়ে যায়। ১৫৮৬ খ্রিষ্টাব্দে রালফ ফিচ মন্তব্য করেন, সোনারগাঁয়ে তুলা থেকে যে মসৃণ ও উন্নত মানের কাপড় উৎপাদিত হতো, তা ছিল সমগ্র ভারতবর্ষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। মুগল শাসনামলে রাজদরবারের বিলাসবহুল দ্রব্যসামগ্রী সরবরাহের জন্য বাংলা আকর্ষণীয় স্থান ছিল। বাংলার কৃষি ও কৃষিজ উৎপাদনের ব্যাপক সমৃদ্ধি যুগপৎভাবে এ অঞ্চলে মুগল শাসনকে সুসংহত করে এবং সমুদ্র ও বহির্বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির সঙ্গে বাংলার সম্পৃক্তি ঘটায়।

মুগলদের হাতে দিল্লির সুলতানি যুগের পতনের প্রথম পর্বে পর্তুগিজ বণিকরা বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী অঞ্চলে চলে আসে এবং ষোড়শ শতকের ত্রিশের দশকে বাংলার চট্টগ্রাম ও সাতগাঁওয়ে বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে তোলে। সেই শতকের শেষ দুই দশকে গাঙ্গেয় বদ্বীপের গভীর অভ্যন্তরে মুগলদের আগমন পর্যন্ত পর্তুগিজরা হুগলিতে বন্দর গড়ে তোলে ও চট্টগ্রামে তাদের সামাজিক প্রতিষ্ঠা ঘটায়। তবে তাদের চলাচল কেবল চট্টগ্রাম পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকেনি। বরং তারা নদীপথে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলেও সওদার জন্য যেত। ঢাকা ও পাশর্^বর্তী এলাকায় তাদের বাণিজ্য-বসতি স্থাপন সেটাই প্রমাণ করে।

বাংলায় পর্তুগিজ বাণিজ্যের বিস্তৃত বিবরণ ও নির্দেশনা পাওয়া যায় মানরিকের বিবরণে। পর্তুগিজ বণিকরা যেমন দক্ষিণ ভারত এমনকি চীন, সুমাত্রা, বোর্নিও, মালাক্কা প্রভৃতি অঞ্চল থেকে বাংলায় বিভিন্ন ধরনের পণ্য নিয়ে আসত, তেমনি তারা এখান থেকে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করত। ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল পর্তুগিজদের রপ্তানি করা চালের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল ছিল। পিরার্ড ডি লাভাল এ বলেন, যখন চালভর্তি জাহাজগুলোর পথে বিলম্ব হতো কিংবা কোনো জাহাজ ডুবে যেত তখন সুমাত্রা, মালাক্কা প্রভৃতি অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ দেখা দিত।

পর্তুগিজ বণিকরা বাংলায় কী পরিমাণ বাণিজ্য করত, তা তাদের দেওয়া বাণিজ্য শুল্কের পরিমাণ থেকেই আন্দাজ করা যায়। আমদানি-রপ্তানির ওপর ২ দশমিক ৫ শতাংশ হারে পর্তুগিজরা মুগল রাজশক্তিকে বছরে প্রায় এক লাখ টাকা শুল্ক প্রদান করত। অর্থাৎ তাদের বার্ষিক বাণিজ্যের আকার ছিল ৪০ লাখ টাকার মতো। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, পর্তুগিজরা বাংলায় খুবই লাভজনক বাণিজ্য পরিচালনা করত এবং বাংলার সমুদ্র ও বহির্বাণিজ্যে তাদের একচেটিয়া প্রাধান্য ছিল।

সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে হুগলিতে কারখানা স্থাপন করে ব্রিটিশ ও ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় বাণিজ্য শুরু করে। ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পরে গঠিত হয়। সেই শতকেরই আশির দশকে তারা এই অঞ্চলে বাণিজ্য শুরু করে। প্রথমদিকে ইউরোপীয় বণিকদের মনোযোগ ছিল মসলা বাণিজ্যের দিকে। ইংরেজ ও ডাচরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দ্বীপপুঞ্জ থেকে মসলা সংগ্রহ করত। বিনিময়ে তারা সেখানে মোটা সুতিবস্ত্র সরবরাহ করত। কিন্তু পরবর্তী সময়ে যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রভৃতি কারণে সেখানে ইউরোপীয় বাণিজ্যে ভাটা পড়লে তারা বাংলার দিকে নজর দেয়। কোম্পানিগুলোর বাণিজ্য পরিচালনার জন্য বাংলা ছিল অধিকতর সুবিধাজনক এলাকা। এখানে অপেক্ষাকৃত কম খরচে উন্নত মানের মোটা সুতি কাপড় উৎপাদন হতো। বাংলার রেশমও ছিল তাদের কাছে লাভজনক পণ্য। উন্নত মান ও তুলনামূলকভাবে সস্তা হওয়ার কারণে সে সময়ে ইতালীয় ও পারস্যের সিল্কের পরিবর্তে ইউরোপে বাংলার সিল্কের চাহিদা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছিল।

ইউরোপ ও ভারতের মধ্যে প্রাচীন বাণিজ্যপথ (১০০০-১৪৯৭ খ্রিষ্টাব্দ)

এশীয় বাণিজ্যে বাংলার গুরুত্ব কোম্পানিগুলোর আনুপাতিক বাণিজ্যের হার লক্ষ করলেই বোঝা যায়। আঠারো শতকের শুরুতে এশিয়া থেকে নেদারল্যান্ডসে রপ্তানি করা মোট পণ্যসামগ্রীর ৪০ শতাংশই ছিল বাংলার। একই সঙ্গে এশিয়া থেকে সেখানে কাপড় রপ্তানিতে ৫০ শতাংশ হিস্যা ছিল বাংলার। ডাচ কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি একই ছিল।

প্রাচীন ও মধ্যযুগে ইউরোপ ও ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে বাণিজ্যিক পণ্য পরিবহনে কয়েকটি রুট ব্যবহার করা হতো। এর একটি হলো ইতালির ভেনিস থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে মিসরের আলেকজান্দ্রিয়া এবং পরবর্তীতে সেখান থেকে লোহিত সাগর হয়ে ভারতের পশ্চিম উপকূলের বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) পর্যন্ত। উল্লেখ্য, সে সময় সুয়েজ খাল না থাকায় এ পথে সরাসরি জাহাজ চলাচল করতে পারত না।

আরেকটি পথ ছিল ইতালির জেনোয়া বন্দর থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে কনস্ট্যান্টিনোপল (বর্তমান ইস্তাম্বুল) এবং সেখান থেকে কৃষ্ণসাগর, টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস (দজলা-ফোরাত) নদী ও পারস্য উপসাগর হয়ে ভারতীয় উপকূল পর্যন্ত। কনস্ট্যান্টিনোপল থেকে আরেকটি পথে ভারতে আসা যেত। সেটি হলো কৃষ্ণসাগর-কাস্পিয়ান সাগর-আমু দরিয়া নদী-সিন্ধু নদী রুট।

১৪৫৩ সালে তুর্কিরা কনস্ট্যান্টিনোপল ও পূর্ব-ভূমধ্যসাগর উপকূল দখল করে নিলে প্রাচীন বাণিজ্যপথগুলো অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। তখন ইউরোপের সঙ্গে ভারতীয় মহাদেশের সংযোগ ধরে রাখার জন্য বিকল্প পথ অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, যার ফল হলো ভাস্কো দা গামার আবিষ্কৃত পথ। পর্তুগালের লিসবন বন্দর থেকে এই পথটি আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে দক্ষিণ ভারতের কালিকট বন্দরে এসে ঠেকেছে। কিন্তু এই রুটে আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগরের বিস্তীর্ণ জলপথ পাড়ি দিতে হতো জাহাজগুলোকে। পরে এই ঘুরাপথের সমাধান এনে দেয় আজ থেকে দেড়শ বছর আগে খননকৃত সুয়েজ খাল।

এবার আসা যাক বঙ্গোপসাগরে জাহাজ চলাচল প্রসঙ্গে। বিশ শতকের শুরুতে যন্ত্রচালিত জাহাজের আবির্ভাবের আগে এ পথে পালতোলা জাহাজে সমুদ্র পাড়ি দেওয়া হতো। বঙ্গোপসাগরে চলাচলের ক্ষেত্রে দুটি মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের ওপর নির্ভর করে বাণিজ্যিক জাহাজগুলো চলত। উত্তর-পূর্বমুখী মৌসুমি বায়ুনির্ভর জাহাজগুলো পশ্চিম বা দক্ষিণ থেকে দক্ষিণ-এশিয়া বা পূর্ব-এশিয়ায় আসত। আর ফিরতি পথে দক্ষিণ-পশ্চিমমুখী মৌসুমি বায়ুপ্রবাহ ব্যবহার করত তারা। পালতোলা জাহাজ দিয়েই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারত ও ইংল্যান্ডের মধ্যে যোগাযোগ ও বাণিজ্য সচল রেখেছিল।

বঙ্গোপসাগরের নদ-নদী

বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক বড় নদী পশ্চিম থেকে পূর্বে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। এর মধ্যে গঙ্গা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র, মহানদী, গোদাবরী, কৃষ্ণা, ইরাবতী ও কাবেরী নদী উল্লেখযোগ্য। বিশ্বের ২৮তম দীর্ঘ নদী ব্রহ্মপুত্র নেপাল, চীন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ২ হাজার ৯৪৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে যমুনা, পদ্মা ও মেঘনার জল স্রোতের সঙ্গে মিশে বঙ্গোপসাগরে  পড়েছে। আবার অনেক ছোট নদীও সরাসরি বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। ৬৪ কিলোমিটার দীর্ঘ (৪০ মাইল) কৌম এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ছোট নদী।

যে অঞ্চল নিয়ে আজকের এই বাংলাদেশ, তার ভূমিরূপ গঠনেও গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনার সম্মিলিত স্রোতপ্রবাহ ও বঙ্গোপসাগরের অবদান অবিসংবাদিত। বিশ্বের সবচেয়ে বড় লোনাপানির বনাঞ্চল সুন্দরবনও এই গাঙ্গেয় পললভূমিরই একটি অংশ। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনার মিলিত স্রোতধারা প্রতি বছর প্রায় ১০০ কোটি টন পলিমাটি সমুদ্রে নিয়ে ফেলে। এই পলিমাটিতে জন্ম বিশ্বের বৃহত্তম বদ্বীপ বাংলাদেশের।

আগেই বলা হয়েছে, বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্যে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত নদীগুলোর বড় অবদান রয়েছে। এ অঞ্চলে এক সময়কার প্রধান দুই বন্দর চট্টগ্রাম ও সাতগাঁওয়ের অবস্থান নদীর তীরে। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামের প্রাণভোমরা কর্ণফুলী নদী। আর এক সময়কার ব্যস্ত কিন্তু বর্তমানে বিলুপ্ত সাতগাঁও বন্দরের অবস্থান ছিল সরস্বতী নদীর ধারে। সেই সরস্বতী নদী প্রবাহ হারানোর সঙ্গে সঙ্গে সাতগাঁও তার জৌলুস হারাতে শুরু করে।

সাতগাঁও থেকে বন্দর সরে এসে বর্তমানে কলকাতার যে জায়গায় থিতু হয়েছে, সেটিও হুগলি নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত। এই বন্দরটি বঙ্গোপসাগর থেকে ২০৩ কিলোমিটার অভ্যন্তরে অবস্থিত। এটি ভারতের একমাত্র নদীকেন্দ্রিক বড় বন্দর। কলকাতা বন্দরের দুটি পৃথক ডক সিস্টেম রয়েছে। এর একটি কলকাতায়, আরেকটি হলদিয়ায়, যেটি আবার হুগলি নদীর মোহনার কাছে অবস্থিত।

মধ্যযুগে বাংলার বিভিন্ন জনপদ থেকে পণ্য প্রথমে নৌপথে উপকূলীয় বন্দরে আনা হতো এবং সেখান থেকে জাহাজে করে ইউরোপে পাঠানো হতো। মুগল আমলে যেমন বাংলার নৌপথ ছিল চলাচলের প্রধান মাধ্যম, তেমনি কোম্পানি যুগেও এদেশের নৌবন্দরগুলো যথেষ্ট সমৃদ্ধি অর্জন করেছিল। বর্তমানেও বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দরগুলোর মাধ্যমে যে পণ্য আমদানি করা হয়, সেগুলো দেশের অভ্যন্তরে পৌঁছানোর ক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা রয়েছে নদীর। ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে রয়েছে দেশের প্রথম অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল, যেখান থেকে ঢাকা ও তার পাশর্^বর্তী এলাকায় কনটেইনার পরিবহন করা হয়।

বঙ্গোপসাগরের দুঃখ

বছরের পর বছর ধরে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ে ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমারসহ এ অঞ্চল প্রভাবিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আসছে। একের পর এক ভয়ংকর সব ঘূর্ণিঝড়ের কারণেই একটি সাধারণ প্রশ্ন এসে যায়-বঙ্গোপসাগরের ঘূর্ণিঝড়গুলো কি অন্য অঞ্চলের চেয়ে বেশি মারাত্মক?

আবহাওয়াবিদরা জানাচ্ছেন, বিশ্বের ইতিহাসে যে ১০টি ঘূর্ণিঝড় সবচেয়ে বেশি প্রাণঘাতী, তার আটটিরই উৎপত্তি বঙ্গোপসাগরে। যে ৩৬টি মারাত্মক ট্রপিক্যাল সাইক্লোনের রেকর্ড রাখা সম্ভব হয়েছে, তার ২৬টিও এই অঞ্চলেরই। গত দুই শতাব্দীতে বিশ্বের ট্রপিক্যাল সাইক্লোন সম্পর্কিত যত মৃত্যু ঘটেছে, তার ৪২ শতাংশ হয়েছে কেবল বাংলাদেশেই। সংখ্যায় এর পরিমাণ প্রায় ২০ লাখ। বিশ্বের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ যে সাইক্লোন, সেটিও বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলেই আঘাত হেনেছিল। ১৯৭০ সালের ভোলা সাইক্লোন নামে পরিচিত সেই ঘূর্ণিঝড়ে তিন থেকে পাঁচ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়।

১৯৭০ সালে ভোলা সাইক্লোন নামে পরিচিত ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত উপকূলীয় ঘরবাড়ি। প্রলয়ঙ্করী সেই ঝড়ে
তিন থেকে পাঁচ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল

খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের মোট ১৪টি উপকূলীয় জেলায় বাংলাদেশের ২৫ শতাংশ মানুষের বাস। জাতীয় অর্থনীতিতে তাদের অবদান প্রায় এক-চতুর্থাংশ। অথচ অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এই অঞ্চল, এর অবকাঠামো ও বসবাসকারী জনগণের অর্থনৈতিক জীবন নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান মতে, চলতি বছরের ২৬ মে প্রবাহিত ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে দেশের বিভিন্ন জেলার ১৫ লাখ মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় বাঁধ ও ঘরবাড়ি ভেঙে যায়। আসলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাঁধ ভেঙে উপকূলীয় ফসলের ক্ষেতে লোনা পানি প্রবেশ করা ও মানুষের পানিবন্দি জীবন যেন নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে খুলনা ও সাতক্ষীরার বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে এই দুর্ভোগ প্রতি বছরই পোহাতে হয়। এর মধ্যে কিছু দুর্যোগের প্রভাব হয় দীর্ঘস্থায়ী।

উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের অর্থনৈতিক প্রভাব সুদূরপ্রসারী। বাঁধ ভেঙে সাগরের লোনাপানি প্রবেশ করায় সেখানকার বিস্তীর্ণ জমিতে ফসল আবাদ করা সম্ভব হয় না। আবার এই অঞ্চলের অন্যতম অর্থকরী চিংড়ি চাষও ক্ষতিগ্রস্ত হয় এর কারণে। জলোচ্ছ্বাস ও জোয়ারের পানিতে ঘের তলিয়ে গেলে লাখ লাখ টাকার লোকসান হয় চিংড়িচাষিদের।

উপকূলীয় জনজীবন ও অর্থনীতির স্বার্থ রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই পরিকল্পনা এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারও এই প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে শত বছরের মহাপরিকল্পনা ডেল্টা প্ল্যান বা বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০-তে উপকূলীয় অঞ্চলকে অন্যতম হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং সেখানকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি ব্যবস্থাপনাকে অগ্রাধিকারমূলক বিষয়ের তালিকায় রেখেছে।

কৌশলগত গুরুত্ব

বঙ্গোপসাগর দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত। আর এই অঞ্চলে রয়েছে দুটি বিশাল অর্থনৈতিক জোট সার্ক ও আসিয়ান। স্বাভাবিকভাবেই এই দুই জোটের কৌশলগত পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ জুড়ে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। চীনের দক্ষিণাঞ্চলীয় এবং ভারত ও বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দরগুলোর ওপর এই সাগরের প্রভাব অপরিসীম। কলকাতা, চেন্নাই, বিশাখাপতম্ন, তুতিকোরিন, চট্টগ্রাম, মোংলা প্রভৃতি বন্দর এই সাগরের মাধ্যমে যুক্ত হয়েছে। আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও ভূরাজনীতিরও একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে রয়েছে বঙ্গোপসাগর।

চীন সম্প্রতি শ্রীলংকা, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রও বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা চালাচ্ছে।

বঙ্গোপসাগরের সুবিধাভোগী উপকূলবর্তী দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ওডিশা (উড়িষ্যা), অন্ধ্র প্রদেশ ও তামিলনাড়– রাজ্য, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলংকা ও থাইল্যান্ড। আর স্থলবেষ্টিত দেশ ও অঞ্চলগুলোর মধ্যে রয়েছে ভুটান, নেপাল ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল।

বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী দেশগুলোর সম্মিলিত জিডিপি প্রায় সাড়ে ৭ লাখ কোটি ডলার। আর সুবিধাভোগী দেশগুলো জিডিপিতে যোগ করেছে ৮১ হাজার কোটি ডলারের বেশি। এই অঞ্চলের সার্কভুক্ত দেশগুলোর আন্তঃবাণিজ্য তাদের মোট আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের তুলনায় নগণ্য হলেও (মাত্র ৫ শতাংশ) আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর বাণিজ্য সেই তুলনায় অনেক ভালো অবস্থায় রয়েছে (২৫ শতাংশ)।

বাংলাদেশের বাণিজ্য বঙ্গোপসাগর

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বঙ্গোপসাগরের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। বঙ্গোপসাগর ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের একটি প্রধান অংশ। পাশাপাশি এটি ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের সংযোগকারী হওয়ায় আঞ্চলিক ও কৌশলগতভাবে এর গুরুত্ব অনেক। মালদ্বীপ, শ্রীলংকা, ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া এমনকি স্থলবেষ্টিত ভুটান ও নেপালও বাণিজ্যিকভাবে এই জলরাশির সুবিধাভোগী। বঙ্গোপসাগর শুধু একটি সাগর নয়; বরং এটি বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক ও করপোরেট স্বার্থের প্রাণভোমরাস্বরূপ।

আগেই বলা হয়েছে, প্রাচীন গাঙ্গেয় বদ্বীপের বৈদেশিক বাণিজ্য প্রায় পুরোপুরি নির্ভর করত বঙ্গোপসাগরের ওপর। এখনো সেই নির্ভরতা এতটুকু কমেনি। দেশের মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের ৮০ শতাংশের বেশি সম্পন্ন হয় সমুদ্রপথে। বছরখানেক আগে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দর ট্রান্সশিপমেন্ট ও ট্রানজিটের যুগে প্রবেশ করায় নেপাল, ভারত ও ভুটানে পণ্য পরিবহনে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানগত গুরুত্ব বেড়েছে। আর বঙ্গোপসাগর ছাড়া এই সম্ভাবনা কাজে লাগানো সম্ভব নয়।

সমুদ্র বাণিজ্যের এই ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব দেশের সরকার বেশ ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পারছে। এ কারণেই চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের পাশাপাশি নির্মাণ করা হয়েছে দেশের তৃতীয় সমুদ্রবন্দর পায়রা। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে নির্মাণ করা হচ্ছে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর।

সম্ভাবনাময় সমুদ্র অর্থনীতি বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট

ব্লু-ইকোনমি বা সমুদ্র অর্থনীতি থেকে বিপুল আয়ের অপার সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের। এ কথা ঠিক যে, এখন পর্যন্ত এই সম্ভাবনার পুরোটা কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি। তবে সমুদ্রসম্পদের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার কীভাবে করা যায়, সেই বিষয়ে কর্মপরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে। সমুদ্র অর্থনীতির উন্নয়নে ২০১৭ সালে যাত্রা হয় বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের। তার আগে ২০১৫ সালে এ-সংক্রান্ত একটি আইন পাস হয়।

মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির পর থেকে বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগর থেকে বছরে ৯৬০ কোটি ডলারের সম্পদ আহরণ করছে। যদিও সম্ভাবনা রয়েছে আরও বেশি সুফল ভোগের। কোনো কোনো পরিসংখ্যানে বছরে আড়াই লাখ কোটি ডলারের সম্পদ আহরণ সম্ভব বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

বঙ্গোপসাগরে এমনই ছোটবড় ৫০-৬০ হাজার ছোট নৌকা ও ট্রলারে করে মাছ ধরেন জেলেরা। বড় আকারের মাছ ধরার জাহাজ ব্যবহার
করতে পারলে উৎপাদনশীলতা নিশ্চিতভাবেই বেড়ে যাবে। এজন্য এই খাতে আরও বিনিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে

কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে এই ঘাটতিটা থেকে যাচ্ছে। এর মধ্যে বড় একটি সীমাবদ্ধতা হলো সমুদ্র খাতে সীমিত বিনিয়োগ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কীভাবে আরও বেশি বিনিয়োগ আসবে, সেই উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। এ বিষয়ে আরও বেশি অনুকূল নীতিকাঠামো প্রণয়ন করা দরকার। বিশেষ করে কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মহামারির কারণে মন্দার মুখে পড়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে সামুদ্রিক সম্পদ আহরণের প্রতি জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ধনী দেশগুলোর ৯০ শতাংশই ২০২২ সাল নাগাদ মহামারি-পূর্ব অর্থনৈতিক অবস্থায় ফিরে যাবে। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর উত্তরণের গতি অনেক ধীর। ফলে মহামারি-পরবর্তী বিশ্ব ধনী ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বৈষম্য অনেক বেড়ে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য সমুদ্রসম্পদ আহরণের পরিমাণ বৃদ্ধি করাটা মহামারির ক্ষতি কাটিয়ে ওঠায় সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, তৈরি পোশাক রপ্তানির মাধ্যমে বছরে ৪০ হাজার কোটি টাকার মতো আয় হয় বাংলাদেশের। আর সামুদ্রিক সম্পদের মধ্যে কেবল মাছ রপ্তানি থেকেই ১০-১২ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। অন্যান্য সম্পদ এর সঙ্গে যোগ হলে সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।

বঙ্গোপসাগর জৈববৈচিত্র্যেপূর্ণ একটি বিশাল জলাধার। প্রবাল, মৎস্য প্রজনন অঞ্চল ও ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল এই বৈচিত্র্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বঙ্গোপসাগর বিশে^র ৬৪টি বৃহৎ সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানের অন্যতম। বঙ্গোপসাগর বিভিন্ন প্রজাতির কচ্ছপ, তিমি, ডলফিন, ব্যারাকুডা, স্কিপজ্যাক টুনা, ইয়েলোফিন টুনা, ইত্যাদির আবাসস্থল। বাংলাদেশের লোনাপানির মৎস্যসম্পদের চাহিদা রয়েছে পুরো বিশে^ই। বিশেষ করে এদেশের চিংড়ির কদর সর্বত্র। বাংলাদেশে মোট ৫৬টি প্রজাতির চিংড়ি শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৭টিই লোনাপানির। এছাড়া ১২টি কম লবণাক্ত পানি ও সাতটি প্রজাতি স্বাদুপানির বাসিন্দা।

বিশে^র অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর দেশগুলো আগেই সমুদ্র শিল্পের উন্নয়নে নজর দিয়েছে, যার ফল তারা এরই মধ্যে পেতে শুরু করেছে। বর্তমান সময়ে অস্ট্রেলিয়ার জিডিপিতে (মোট দেশজ উৎপাদন) সমুদ্র অর্থনীতির অবদান সাড়ে ৪ হাজার কোটি ডলার বা ৩ শতাংশের বেশি। দেশটি এরই মধ্যে ২০১৫-২৫ মেয়াদের জন্য ব্লু-০ইকোনমির দশক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৫ সাল নাগাদ অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতিতে সমুদ্র অর্থনীতির অবদান ১০ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

সমুদ্র শিল্পে জোর দিয়েছে আধুনিক বিশে^ অর্থনৈতিক উন্নয়নে চমক দেখানো চীনও। দেশটির অর্থনীতিতে সমুদ্র শিল্পের অবদান ১ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলার, যা জিডিপির প্রায় ১০ শতাংশ। গত পাঁচ বছরে এ শিল্পে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে তারা। নিশ্চিতভাবেই সামনের বছরগুলোয় এই গতি আরও বাড়বে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩৫ সাল নাগাদ জিডিপিতে সমুদ্র খাতের অবদান ১৫ শতাংশে উন্নীত হবে।

বিশে^র শীর্ষ অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৩ সালে ব্লু-ইকোনমির অবদান ছিল ৩৫ হাজার ৯০০ কোটি ডলার, যা জিডিপির ২ শতাংশ। দেশটির জাতীয় অর্থনীতিতে সমুদ্র শিল্পের এই হিস্যা দিন দিন বাড়ছে। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অর্থনীতিতে বার্ষিক জিভিএ (গ্রস ভ্যালু অ্যাডেড) হিসেবে ৫০ হাজার কোটি ইউরো যোগ করছে এই শিল্প।

বাংলাদেশের জন্য সমুদ্র অর্থনীতির সম্ভাবনাময় বিভিন্ন খাত রয়েছে। এগুলো হলো মৎস্য আহরণ, জাহাজ চলাচল ও জাহাজ ব্যবস্থাপনা, বন্দর ও সামুদ্রিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সহায়ক পরিষেবা, সামুদ্রিক জৈবপ্রযুক্তি, খনিজ পদার্থ, সামুদ্রিক নবায়নযোগ্য শক্তি, সামুদ্রিক পণ্য, সামুদ্রিক পর্যটন ও অবকাশ, সামুদ্রিক স্থাপনা নির্মাণ, সামুদ্রিক বাণিজ্য, সামুদ্রিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং শিক্ষা ও গবেষণা। এসব খাতের টেকসই উন্নয়নে সরকারকে উদ্যোগী তো হতে হবেই, পাশাপাশি সব স্টেকহোল্ডারকেই সহযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

প্রত্যাশা বাড়িয়েছে সমুদ্র বিজয়

আন্তর্জাতিক আদালতে রায়ের মাধ্যমে ২০১২ সালে মিয়ানমার ও ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা চিহ্নিত হওয়ার ফলে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি টেরিটোরিয়াল সমুদ্র এলাকা, ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইইজেড) এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপপ্রাণিজ সম্পদের ওপর বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বঙ্গোপসাগরে মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ ১৭টি ব্লকের মধ্যে ১২টির আইনগত অধিকার পেয়েছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে ভারতের কাছ থেকে দাবিকৃত ১০টি ব্লকের সবগুলোই পাওয়া গেছে। সমুদ্রসীমা নির্ধারণের ফলে এই ব্লকগুলোয় গ্যাস অনুসন্ধানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

বঙ্গোপসাগর বিশে^র ৬৪টি বৃহৎ সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানের অন্যতম। বিভিন্ন প্রজাতির তিমি, ডলফিন, টুনা ইত্যাদির আবাসস্থল এই বিশাল জলরাশি

দুই বছরের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল প্রদত্ত এ রায় দুটিকে বাংলাদেশের জন্য ‘সমুদ্র বিজয়’ হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। এই রায়ে বাংলাদেশের স্থলভাগের বাইরে জলসীমাতেও আরেক বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। আর এই বিজয় সুনীল অর্থনীতিতে আরও এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করেছে।

বাংলাদেশের বার্ষিক বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা আড়াই হাজারের মতো বাণিজ্যিক জাহাজের সাহায্যে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছে। বিদেশী জাহাজগুলোকে প্রায় ৬০০ কোটি ডলার ভাড়া পরিশোধ করতে হচ্ছে। সমুদ্রগামী দেশীয় বাণিজ্যিক জাহাজের সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে এ ব্যয় কমানো সম্ভব।

বাংলাদেশের মিঠাপানিতে যেখানে ২৫০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়, সেখানে বঙ্গোপসাগরে রয়েছে প্রায় ৪৭৫ প্রজাতির মাছ। এর মধ্যে ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি রয়েছে। সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভর করছে উপকূলীয় প্রায় ৩০ লাখ মানুষের জীবিকা। জেলেরা বঙ্গোপসাগরে ৫০ থেকে ৬০ হাজার ছোট নৌকা ও ট্রলার ব্যবহার করে মাছ ধরছেন। এ খাতে আরও বিনিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে। বড় আকারের মাছ ধরার জাহাজ ব্যবহার করতে পারলে উৎপাদনশীলতা নিশ্চিতভাবেই বেড়ে যাবে।

বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী অঞ্চল থেকে প্রচুর লবণ উৎপাদন সম্ভব। বঙ্গোপসাগরে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে গ্যাস হাইড্রেট, যা থেকে মিথেন গ্যাস উৎপাদন করা যায় । আরও রয়েছে পলিমেটালিক ম্যাঙ্গানিজ নডিউলস, যা থেকে কপার, ম্যাগনেশিয়াম, নিকেল, কোবাল্টসহ মূল্যবান ধাতু আহরণ করা যেতে পারে। এই গ্যাস হাইড্রেট, পলিমেটালিক ম্যাঙ্গানিজ নডিউলস ছাড়াও পলিমেটালিক সালফায়েড ও কোবাল্টসমৃদ্ধ ফেরোম্যাঙ্গানিজ ক্রাস্ট বাংলাদেশের ইইজেড ও মহীসোপানে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা, তা যাচাই-বাছাইয়ের লক্ষ্যে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের সময় এসেছে। দেশের সমুদ্রসৈকতে জিরকন, ইলমেনাইট, ম্যাগনেটাইট, রুটাইলসহ বিভিন্ন মূল্যবান খনিজ সম্পদ পাওয়া গেছে। এসব খনিজ সম্পদের উত্তোলন ও ব্যবহার প্রয়োজন।

আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তির পর বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা

উপসংহার

আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে সমুদ্রসীমায় নিরঙ্কুশ ও সার্বভৌম অধিকার তো মিলেছে। কিন্তু কেবল এই অর্জনে সন্তুষ্ট হয়ে বসে থাকলে চলবে না। এই অধিকার প্রাপ্তির সঙ্গে কিছু দায়বদ্ধতাও চলে আসে। বাংলাদেশকে এখন সামুদ্রিক মানচিত্র প্রণয়নের পাশাপাশি সমুদ্র জরিপ, মৎস্য ও খনিজ সম্পদ আহরণ, পর্যটন এবং নৌ-চলাচল ও সমুদ্র এলাকার নিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ শুরু করার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সামুদ্রিক সম্পদ আহরণ ও সংরক্ষণে অগ্রাধিকার দিয়ে ‘ব্লু-ইকোনমি’ বা সমুদ্র অর্থনীতিকে পরিপূরক মডেল হিসেবে নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। এর মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণসহ দেশে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনেতিক উন্নয়ন সম্ভব হবে।

শুধু স্থলভাগ নয়, বরং এর সঙ্গে সমুদ্রসম্পদের অধিকতর ব্যবহারকে একুশ শতকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের বড় হাতিয়ার হিসেবে দেখা হচ্ছে। সমুদ্র ও সামুদ্রিক সম্পদের সদ্ব্যবহার বাংলাদেশের উন্নয়নেও যুগান্তকারী ভূমিকা রাখতে সক্ষম। এ বিষয়ে এখনই সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে সমুদ্র বিজয়ের প্রকৃত সুফল থেকে বঞ্চিত হতে পারে বাংলাদেশ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here