সামুদ্রিক উষ্ণপ্রবাহ সামুদ্রিক পরিবেশের বড় নিয়ামক

জলবায়ু পরিবর্তনের যেসব ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব বিশ্ব বাসীকে প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে, তার অন্যতম হলো সামুদ্রিক উষ্ণপ্রবাহ। উপকূলীয় দেশগুলো যে প্রাকৃতিক বিভিন্ন দুর্যোগের আঘাতে বারবার ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে, তার জন্য অনেকাংশেই দায়ী এই উষ্ণপ্রবাহ। এ কথা আর অস্বীকার করার উপায় নেই যে, উষ্ণপ্রবাহ সমুদ্র পরিবহন খাতেও বড় ধরনের প্রভাব রাখতে যাচ্ছে।

মেরিন হিটওয়েভ বা সামুদ্রিক উষ্ণপ্রবাহের সময় সাগরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য সাধারণত এই উচ্চ তাপমাত্রা-সহিষ্ণু হয় না। ফলে উষ্ণপ্রবাহের সময় তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে। চরম প্রতিকূল তাপমাত্রায় উপকূলীয় জলজ প্রাণবৈচিত্র্য যেমন সামুদ্রিক ঘাস ও তৃণভূমি, প্রবাল ও কেলপের (পুষ্টিগুণে ভরপুর বাদামি সামুদ্রিক শৈবাল) কলোনিতে মড়ক লাগতে পারে, এগুলো স্বাভাবিক কার্বন ডাই-অক্সাইড ধারণক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে এবং মৎস্য আহরণ ও পর্যটন ব্যাহত হতে পারে।

সামুদ্রিক উষ্ণপ্রবাহের কারণে জলজ প্রতিবেশের যে ক্ষতি হয়, তার প্রভাব অর্থনীতির ওপরও পড়ে। তবে এই ক্ষতির পরিমাণ কী, সে বিষয়ে খুব বেশি তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায় না। কারণ এই ক্ষতির কিছু হয় প্রত্যক্ষ। সেগুলো হিসাব করা সম্ভব। কিন্তু পরোক্ষ ক্ষতির হিসাব করা খানিকটা কঠিন কাজই বটে।

সম্প্রতি একদল গবেষক ৩৪টি সামুদ্রিক উষ্ণপ্রবাহের ঘটনা বিশ্লেষণ করেছেন এবং এর অর্থনৈতিক প্রভাব পর্যালোচনা করেছেন। তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৬ সালে চিলির দক্ষিণাঞ্চলে উষ্ণপ্রবাহের এক ঘটনায় সামুদ্রিক কৃষিতে (খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণিসম্পদের চাষাবাদ) ৮০ কোটি ডলারের বেশি প্রত্যক্ষ লোকসান হয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিমাঞ্চলের শার্ক বেতে আরেকটি উষ্ণপ্রবাহের ঘটনায় পরোক্ষ প্রভাব হিসেবে তিন বছরে বার্ষিক ৩১০ কোটি ডলার হারাতে হয়েছে দেশটিকে।

প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ যেভাবেই হোক না কেন, একটি বিষয় পরিষ্কার যে সামুদ্রিক উষ্ণপ্রবাহ ব্লু-ইকোনমি বা সমুদ্রনির্ভর অর্থনীতিতে বড় ধরনের ক্ষত তৈরি করতে পারে। এই লোকসান এড়াতে উষ্ণপ্রবাহ ও এর প্রভাব সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা দরকার। তবে সামুদ্রিক উষ্ণপ্রবাহ সম্পর্কে ধারণা লাভের আগে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও পরিবেশের ওপর এর প্রভাব সম্পর্কে জানা দরকার।

বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন যেমনি বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে অতি দ্রুত। অবিরত হিমালয় ও অ্যান্টার্কটিকার বরফের চাঁই গলে নিম্ন এলাকাগুলো ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে ভয়াবহ বন্যা। অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের ফলে ওজোনস্তর পাতলা হয়ে পৃথিবীকে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। যার ফলে প্রবল বেগে বায়ুম-লে ঢুকে পড়ছে সূর্যের অতিবেগুনি তেজস্ক্রিয় রশ্মি। এতে করে বছরান্তে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাপমাত্রা।

শিল্পোৎপাদন একদিকে যেমন মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করেছে, অন্যদিকে পরিবেশের জন্য ডেকে আনছে বিপর্যয়। অতিমাত্রার কার্বন নিঃসরণ ও পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার অন্যতম কারণ এটি। বড় বড় শিল্প-কারখানার ধোঁয়া, জীবাশ্ম জ্বালানির নির্বিচার ব্যবহার, বনভূমি উজাড়, নদী শাসন ইত্যাদির ফলে দারুণভাবে পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে সমগ্র বিশ্বে। গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ, কার্বন ডাই-অক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইড গ্যাসের নির্গমন বেড়ে যাওয়ায় ওজোনস্তর পাতলা হয়ে ভূপৃষ্ঠ তপ্ত হচ্ছে ক্রমান্বয়ে। সূর্যের তীব্র তাপমাত্রাকে ছেঁকে বিশুদ্ধ করে পৃথিবীর উপযোগী করে পাঠাতে ব্যর্থ হচ্ছে ওজোনস্তর। বায়ুম-লের জন্য সুষম তাপমাত্রা এখন আর বিরাজ করছে না। বরং ধীরে ধীরে বরফ যুগের সমাপ্তি ঘটিয়ে পৃথিবী উত্তপ্ত হয়ে উঠছে ক্রমে।

বায়ুম-লে পরিবর্তন: ১৮৮০ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত মিলিতভাবে ভূপৃষ্ঠ ও সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা গড়ে দশমিক ৮৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বেড়েছে। সেই সময়ের পর থেকে বিশ্বজুড়ে শীতল দিনের সংখ্যা প্রতি বছর কমেছে, বেড়েছে গরম দিনের সংখ্যা। এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে উষ্ণপ্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে।

জলম-লে পরিবর্তন: গত পাঁচ দশকে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা (৭৫ মিটার গভীরতা পর্যন্ত) গড়ে দশমিক ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বেড়েছে। সমুদ্রের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায়, উপকূলবর্তী অঞ্চলে তাপমাত্রার বৃদ্ধির হার সব থেকে বেশি। আলোচ্য সময়ে উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে যে শক্তিবৃদ্ধি হয়েছে, তার ৯০ শতাংশই সঞ্চিত হয়েছে সাগরে এবং এর ৭০ শতাংশ সঞ্চিত হয়েছে সাগরের ওপরের অংশে।

সমুদ্রের বেশি লবণাক্ত অংশে অতিরিক্ত বাষ্পীভবনের ফলে সেখানকার পানি আরও লবণাক্ত হয়ে যাচ্ছে এবং অপেক্ষাকৃত কম লবণাক্ত অংশে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে ক্রমে লবণের পরিমাণ কমছে। সমুদ্রের ওপরের বিভিন্ন অংশে ১৯৫০ সালের পর থেকে বৃষ্টিপাত ও বাষ্পীভবনের তারতম্য দেখা যাচ্ছে।

মেরু প্রদেশের পরিবর্তন: ১৯৭১ সালের পর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন হিমবাহ থেকে প্রতি বছর গড়ে ২২৬ গিগাটন বরফ গলেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এই হার আরও বেশি। আলোচ্য সময়ে অ্যান্টার্কটিকায় বরফ গলার হার ছিল গড়ে ৩০ গিগাটন। আর্কটিকে সমুদ্রের বরফ প্রতি দশকে ৩ দশমিক ৫ থেকে ৪ দশমিক ১ শতাংশ হারে কমছে।

বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে পার্মাফ্রস্ট বা ভূপৃষ্ঠের বরফ জমাট অংশের তাপমাত্রা বাড়ছে। যার ফলে উত্তর আলাস্কায় ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি ও রাশিয়ায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে।

সমুদ্রপৃষ্ঠের পরিবর্তন: উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হার পূর্ববর্তী শতকগুলোর চেয়ে অনেক বেশি। ১৯০১ সাল আজ পর্যন্ত এই উচ্চতা প্রতি বছর ১ দশমিক ৭ মিলিমিটারের বেশি হারে বাড়ছে। সর্বশেষ তিন দশক হিসাব করলে এই হার দ্বিগুণের কাছাকাছি।

বৈশ্বিক উষ্ণতায় বিপর্যস্ত সামুদ্রিক পরিবেশ

উষ্ণায়নের ফলে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিনই কোনো-না কোনো ধরনের দুর্যোগ সংঘটিত হচ্ছে। এগুলো হলো তাপমাত্রা বৃদ্ধি, খরা, বন্যা, সাইক্লোন, টর্নেডো, ভূমিকম্প ও নদীভাঙন ইত্যাদি। এর মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধিই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলছে ভূম-লকে। প্রকৃতির প্রতিটি দুর্যোগই ভয়াবহ। তবে তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিষয়টি বিশেষভাবে চিন্তার উদ্রেক করে। কারণ এর সঙ্গে অন্যসব দুর্যোগ ওতপ্রোতভাবে জড়িত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এল-নিনোর বিষয়টি তো সবারই জানা। এল-নিনো হলো প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার সমুদ্রপৃষ্ঠের অত্যধিক উষ্ণপ্রবাহ, যা সাধারণত একটানা তিন মৌসুমজুড়ে অব্যাহত থাকে। সাধারণত ২-৭ বছর পরপর এটি সংঘটিত হয়। বায়ুম-লীয় ক্রিয়ার ফলে এল-নিনোর সঙ্গে একটি বিশেষ ক্রিয়ার যোগ ঘটে, যার কারণে ইন্দোনেশিয়া ও পেরু অঞ্চলের কাছে একটি করে দুটি চাপবলয় সৃষ্টি হয়। সেই দুই চাপবলয়ের মধ্যে তীব্রগতিতে তাপপ্রবাহের আদান-প্রদান চলতে থাকে। তাতে ইন্দোনেশিয়া-পেরু পর্যন্ত সমুদ্রভাগে দক্ষিণমুখী উষ্ণতম স্রোতের সৃষ্টি হয়। যার ফলে এই অঞ্চলের বায়ুম-ল ও সমুদ্র উষ্ণতর হয়ে ওঠে।

এই উষ্ণ পানির কারণে মাছ কিংবা ক্ষুদ্র প্রাণিকুল, বিশেষ করে সমুদ্রের এককোষী জীব প্লাংকটনের মৃত্যু ঘটে অস্বাভাবিকভাবে। পরিণামে সমুদ্রের পানিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বাড়তে থাকায় কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। সেক্ষেত্রে সামুদ্রিক প্রাণিকুল অস্তিত্ব সংকটে পড়ে।

সামুদ্রিক তাপপ্রবাহের দ্বারা নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হয় সগ্রাস, কেলপ এবং প্রবালের মতো ভিত্তি প্রজাতি

সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানের বিপর্যয়ের কারণ উষ্ণপ্রবাহ

যখন সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা দীর্ঘ সময় ধরে মাত্রাতিরিক্ত উষ্ণ থাকে, তখন তাকে সামুদ্রিক উষ্ণপ্রবাহ বলা হয়। এর ব্যাপ্তিকাল কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গত চার দশকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধির হার অত্যন্ত বেশি। এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সামুদ্রিক উষ্ণপ্রবাহের ব্যাপ্তিকাল ও ঘটনসংখ্যা বেড়েছে। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভয়াবহ উষ্ণপ্রবাহের যে ১০টি ঘটনার রেকর্ড রাখা সম্ভব হয়েছে, তার আটটিই ঘটেছে গত এক দশকে।

কেবল যে উষ্ণম-লীয় অঞ্চলেই মেরিন হিটওয়েভ দেখা যায়, তা নয়। বরং এই দুর্যোগ যেকোনো অঞ্চলেই হানা দিতে পারে। কারণ সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা দুটি উপায়ে বেড়ে যেতে পারে। প্রথমত, বায়ুম-ল থেকে তাপ শোষণের মাধ্যমে। দ্বিতীয়ত, সামুদ্রিক স্রোতের মাধ্যমে উষ্ণ পানি এক জায়গা থেকে অন্যত্র প্রবাহের মাধ্যমে। যখন এ দুটি ঘটনা যুগপৎ ঘটে, তখন চরম মাত্রার উষ্ণপ্রবাহ তৈরি হয়।

একটি দেশের অর্থনীতির ওপর উষ্ণপ্রবাহ মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ এটি সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানের স্বাভাবিকতা নষ্ট করে দেয়। আর একটি সুস্থ সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থান অর্থনীতিতে কতটা অবদান রাখতে পারে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশেষ করে ব্লু-ইকোনমি বা সমুদ্র অর্থনীতির যুগে বাস্তুসংস্থানের স্বাভাবিকতা ধরে রাখার গুরুত্ব আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মৎস্য আহরণ, সামুদ্রিক কৃষি, সামুদ্রিক ও উপকূলীয় পর্যটনের মতো অর্থনৈতিক কার্যক্রমের প্রসারের জন্য প্রবাল, কেলপ ও সামুদ্রিক তৃণভূমির সুরক্ষা জরুরি। কারণ এগুলো অন্যান্য জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন।

সামুদ্রিক উষ্ণপ্রবাহ যখন এই ধরনের ‘মৌলিক’ প্রজাতির ক্ষতি সাধন করে, তখন পুরো বাস্তুসংস্থানই অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে এর ওপর নির্ভরশীল আর্থ-সামাজিক প্রতিবেশও বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়ে। সাম্প্রতিক সময়ে অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট ব্যারিয়ার রিফে কয়েক দফায় কোরাল ব্লিচিংয়ের পর তেমনটাই হয়েছে।

উষ্ণপ্রবাহ অর্থনৈতিক প্রভাব

ভাগ্যক্রমে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে চরম মাত্রায় উষ্ণপ্রবাহের ঘটনা বিরল। ফলে এসব ক্ষেত্রে অর্থনীতির কতটা ক্ষতি হতে পারে, সে বিষয়ে সম্যক ধারণা লাভ করা কঠিন। তবে গত ২৫ বছরে বিশে^র প্রধান ওশান বেসিনগুলোয় ৩৪টি উষ্ণপ্রবাহের ঘটনা পর্যালোচনা করে অর্থনৈতিক ক্ষতির একটি প্রাথমিক হিসাব দিয়েছেন গবেষকরা। তারা বলছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উষ্ণপ্রবাহের কারণে মৎস্য আহরণের পরিমাণ কমে গেছে, কেলপ ও সামুদ্রিক ঘাসের তৃণভূমি ধ্বংস হয়ে গেছে এবং কিছু ক্ষেত্রে সামুদ্রিক প্রাণবৈচিত্র্যের গণমৃত্যু হয়েছে।

এসব ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে যে উষ্ণপ্রবাহ বিরাজ করেছে, সেটির নামকরণ করা হয়েছে ‘দ্য ব্লব’। উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে ২০১৫-২০১৬ সালে প্রায় বছরখানেক অব্যাহত ছিল এই উষ্ণপ্রবাহ। এর কারণে যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূল পর্যন্ত বিস্তীর্ণ সমুদ্র অঞ্চলের পানির তাপমাত্রা ২ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গিয়েছিল। সেই ঘটনায় মাছের পরিমাণ কমে গিয়েছিল। হাজার হাজার সামুদ্রিক পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রাণী মারা গিয়েছিল। দ্য ব্লবের কারণে মৎস্য আহরণ খাতে সাড়ে ৯ লাখ ডলারের বেশি আর্থিক ক্ষতি হয়েছিল বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়।

উষ্ণপ্রবাহের কারণে কার্বন শোষণের সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বনভূমি যেমন বায়ুম-ল থেকে কার্বন শোষণ করে, পানিতে তেমনই সামুদ্রিক ঘাস, কেলপ, প্রবাল ইত্যাদি কার্বন শোষণ করে নেয় এবং কার্বন স্টোরেজ হিসেবে কাজ করে। যখন এগুলো মারা যায়, তখন কার্বন শোষণও কমে যায়।

অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিমাঞ্চলের শার্ক বে-তে রয়েছে বিশে^র বৃহত্তম সামুদ্রিক তৃণভূমি। ১ হাজার ২০০ বর্গনটিক্যাল মাইলজুড়ে এর ব্যাপ্তি। ২০১১ সালে উষ্ণপ্রবাহের কারণে সেখানে ৩৪ শতাংশ সামুদ্রিক ঘাস মারা গিয়েছিল, যার ফলে পরবর্তী তিন বছরে ২০০ থেকে ৯০০ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুম-লে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই ঘটনায় পরোক্ষভাবে অর্থনৈতিক লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল প্রতি বছর প্রায় ৩১০ কোটি ডলার। এই হিসাব করা হয়েছে সামুদ্রিক ঘাসের কার্বন ধারণের সক্ষমতা ও এর ইকোসিস্টেম সার্ভিস ভ্যালুর ওপর ভিত্তি করে।

এই উষ্ণপ্রবাহের কারণে অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূলের ৬০ মাইল পর্যন্ত জায়গাজুড়ে কেলপের বাসস্থান ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। বিভিন্ন প্রজাতির কাঁকড়া আহরণ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আর যেসব মাছের প্রজাতি বেঁচে থাকার জন্য কেলপের ওপর নির্ভরশীল, সেগুলোর পরিমাণ কমে গিয়েছিল। ফলে মৎস্যসম্পদ আহরণের ওপর নির্ভরশীল স্থানীয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়েছিল।

মেরিন হিটওয়েভের সিংহভাগ প্রভাবই নেতিবাচক। তবে স্বল্পমেয়াদি কিছু ইতিবাচক প্রভাবও দেখা যায়। জলজ প্রাণীর কিছু প্রজাতি রয়েছে, যারা তুলনামূলক উষ্ণ পানির প্রবাহকে অনুসরণ করে। ফলে যে অঞ্চলে সামুদ্রিক উষ্ণপ্রবাহ তৈরি হয়, সে অঞ্চলে এসব প্রজাতির জলজ প্রাণীর বিচরণ বেড়ে যায়। ফলে সেখানে নির্দিষ্ট প্রজাতির মৎস্য আহরণ বেড়ে যায়।

তবে এই আহরণ বেড়ে যাওয়াও মাঝেমধ্যে আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের গালফ অব মেইনের মেরিন হিটওয়েভের কথা। সেই সময়ে সেখানে লবস্টারের অপ্রত্যাশিত ঢল নামে। ফলে আহরণও স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেড়ে যায়। এতে লবস্টারের দাম এতটাই পড়ে গিয়েছিল যে, এই খাতে ব্যবসায়ীদের আনুমানিক ৩ কোটি ৮০ লাখ ডলার লোকসান হয়েছিল।

একই অঞ্চলে একাধিকবার মেরিন হিটওয়েভ হানা দেওয়ারও কিছু মন্দের ভালো বিষয় রয়েছে। কারণ এতে আগের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রস্তুতি গ্রহণের সুযোগ থাকে। যেমনটি দেখা গিয়েছিল ২০১৬ সালে গালফ অব মেইনে দ্বিতীয় দফায় সামুদ্রিক উষ্ণপ্রবাহের সময়। এ দফায় লবস্টার আহরণ থেকে ১০ কোটি ৩০ লাখ ডলারের মুনাফা হয়েছিল ব্যবসায়ীদের। আর এটি সম্ভব হয়েছিল কারণ লবস্টার আহরণ বেড়ে গেলে কী পদক্ষেপ নিতে হবে, সে বিষয়ে প্রথম দফার ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল।

প্রভাব পড়ছে সমুদ্র পরিবহনেও

সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা বেড়ে গেলে সামুদ্রিক বায়ুপ্রবাহ ও বায়ুর চাপেও বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। এর ফলে তৈরি হয় ঘূর্ণিঝড়। এই সামুদ্রিক ঝড় সমুদ্র পরিবহন খাতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অনেক সময় জাহাজগুলো ঝড় এড়াতে নিয়মিত রুট ছেড়ে বিকল্প পথে চলাচল করতে বাধ্য হয়। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সময় লেগে যেতে পারে। আবার কিছু ক্ষেত্রে ঝড়ের কবলে পড়ে কনটেইনার সাগরে পড়ে যাওয়া ও জাহাজের ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার খবরও পাওয়া যায়। এই বিলম্ব, পণ্য হারানো অথবা জাহাজের ক্ষয়ক্ষতি সমুদ্র পরিবহন খাতের জন্য বড় একটি মাথাব্যথার কারণ।

সামুদ্রিক ঝড়ের কারণে বন্দরগুলোরও বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বন্দরের অবকাঠামোগত ক্ষতি হতে পারে। আর ঝড়ের শক্তি কিছুটা কম থাকলেও তা বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটানোর জন্য যথেষ্ট। এতে কার্গো লোডিং-আনলোডিংয়ে বিলম্ব হয়, যার কারণে আমদানি-রপ্তানিকারক, জাহাজের মালিক, বন্দর কর্তৃপক্ষ, গ্রাহক-সবাই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

প্রবাল একটি ভিত্তি প্রজাতি। প্রবাল হারানোর মানে পুরো ইকোসিস্টেম হুমকির মুখে পড়ে যাওয়া

প্রয়োজন আগাম সতর্কতা

এখন পর্যন্ত সামুদ্রিক উষ্ণপ্রবাহের অর্থনৈতিক প্রভাবের যতটুকু ধারণা গবেষকরা দিতে সক্ষম হয়েছেন, তা ন্যূনতম হিসাব-নিকাশ। প্রকৃত লোকসান আরও বেশি হতে পারে। কারণ আর্থ-সামাজিক অনেক বিষয় থাকে, যেগুলো অগোচরেই থেকে যায়। যেসব অঞ্চলে বৈজ্ঞানিক গবেষণার সুযোগ-সুবিধাদি কম, সেসব অঞ্চলের ক্ষেত্রে এই কথা আরও বেশি প্রযোজ্য। এছাড়া ভারত মহাসাগরের মতো কিছু সামুদ্রিক অঞ্চলে মেরিন হিটওয়েভ নিয়ে খুব বেশি গবেষণা হয়নি। সেসব অঞ্চলেও ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত হিসাব বের করা কঠিন।

সামুদ্রিক উষ্ণপ্রবাহের বিষয়ে অগ্রিম সতর্কবার্তা পাওয়াটা খুব জরুরি। তা হলে জেলেরা সেই জায়গা থেকে সরে যাওয়ার অথবা নতুন প্রজাতির মৎস্যসম্পদ আহরণের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় পাবেন। অথবা তারা অগ্রিম আহরণের মাধ্যমে উষ্ণপ্রবাহের সময়ের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার সুযোগ পাবেন। এছাড়া এতে করে সামুদ্রিক জৈবসম্পদের সুরক্ষায় সম্ভাব্য পদক্ষেপগুলো গ্রহণেরও সুযোগ থাকবে।

তবে দুঃখের বিষয় হলো, বিজ্ঞানীরা কিন্তু এখন পর্যন্ত সামুদ্রিক উষ্ণপ্রবাহ সম্পর্কে খুব বেশি আগে থেকে সতর্কবার্তা দেওয়ার প্রযুক্তি বা পদ্ধতি আবিষ্কার করতে পারেননি। বর্তমানে বড়জোর সপ্তাহখানেক আগে এ বিষয়ে ধারণা পাওয়া যায়।

এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে কি মেরিন হিটওয়েভ ও এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে বাঁচার কোনো উপায়ই নেই? উত্তর হলো, পুরোপুরি এড়ানো সম্ভব না হলেও লোকসানের পরিমাণ কমানো যায়। প্রথম কথা হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি প্রশমন করতে হবে। এক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হলো গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানো এবং প্যারিস জলবায়ু চুক্তির শর্তগুলো পূরণে আপসহীন অবস্থান নেওয়া।

১৯২৫ সালের তুলনায় এরই মধ্যে সামুদ্রিক উষ্ণপ্রবাহের ব্যাপ্তি ৫০ শতাংশ বেড়েছে। সামনের দিনগুলোয় এটি আরও বাড়বে বলেই সাধারণভাবে ধরে নেওয়া যায়। এমনকি বৈশি^ক উষ্ণায়নের গড় মান ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখতে সক্ষম হলেও এর কোনো ব্যত্যয় হবে না বলে মনে করছেন গবেষকরা।

সুতরাং আমাদের আরও নিয়মিত ও বেশি মাত্রার সামুদ্রিক উষ্ণপ্রবাহের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। যেন এর অর্থনৈতিক অভিঘাত কার্যকরভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব হয়। বৈশ্বিক নীতিনির্ধারকরা সম্ভবত বিষয়টি ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পারছেন। এ কারণে বর্তমানে যত প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে, সব পরিকল্পনার মূলে রয়েছে চরম প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা।

আপাতত আমাদের সামুদ্রিক উষ্ণপ্রবাহকে অনিবার্য ধরে নিয়েই প্রস্তুত থাকতে হবে। আর এক্ষেত্রে অতীত ঘটনাগুলো থেকে শিক্ষা নেওয়া খুব জরুরি। আমাদের আরেকটি সম্ভাব্য পরিস্থিতির জন্যও প্রস্তুত থাকতে হবে। যদি জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধ প্রচেষ্টার গতি শ্লথ হয় এবং বৈশি^ক উষ্ণতা বৃদ্ধি যদি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখা সম্ভব না হয়, তবে সেক্ষেত্রে সতর্কতামূলক পদক্ষেপই হবে অর্থনৈতিক লোকসান কমানোর প্রধান উপায়।

উপসংহার

সমুদ্র অর্থনীতির জোয়ারে সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানের সুরক্ষার বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ এর ব্যত্যয় ঘটলে সমুদ্রসম্পদ থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা আহরণ করা সম্ভব নয়। মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে বৈশ্বিক তাপমাত্রা যে বেড়ে যাচ্ছে, তা যে কেবল বায়ুম-লেরই ক্ষতি করছে, তা নয়। এর কারণে সামুদ্রিক পরিবেশের ভারসাম্যও নষ্ট হচ্ছে।

মেরিন হিটওয়েভ বা সামুদ্রিক উষ্ণপ্রবাহ একটি প্রাকৃতিক প্রবণতা। শিল্পায়নের আগেও এর অস্তিত্ব ছিল। তবে সাম্প্রতিক দশকগুলোয় বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সামুদ্রিক উষ্ণপ্রবাহের প্রকটতা বেড়েছে। যেহেতু বিষয়টি পুরোপুরি প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়, সেহেতু এর প্রকটতা ও নেতিবাচক প্রভাব প্রশমনই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আর এর জন্য প্রয়োজন প্রযুক্তির উন্নয়ন। পাশাপাশি জলবায়ু চুক্তি মেনে তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তা না হলে সমুদ্রনির্ভর অর্থনীতিতে ধস নামাতে পারে সামুদ্রিক উষ্ণপ্রবাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here