দুঃসময় কাটিয়ে সুদিনের প্রত্যাশা

রাতের অন্ধকার শেষ হলে ভোরের আলোর দেখা মেলে-এটাই চিরন্তন সত্য। কিন্তু দিনের শুরুটা যে সবসময়ই আলোকিত হয় তা নয়। মাঝেমধ্যে দুর্যোগের কালো ঘনঘটা প্রকৃতিকে এতটাই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে যে, রৌদ্রোজ্জ্বল আলোকচ্ছটার দেখা মেলা কঠিন হয়ে পড়ে। গত বছর দুয়েক এমনই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে নতুন বছরকে বরণ করতে হচ্ছে বিশ্বকে।

২০২০ সালে নভেল করোনাভাইরাস নামের এক প্রাণঘাতী ভাইরাসের ভয়াল থাবায় টালমাটাল বিশ্ব অর্থনীতি ২০২১ সালে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল নতুন উদ্যমে। কিন্তু নাছোড়বান্দা এই অতিমারির তা-যেন শেষ হয়েও হচ্ছে না, যার ফলে অর্থনৈতিক উত্তরণ নিয়ে একেবারে শঙ্কামুক্ত হওয়া যাচ্ছে না এখন পর্যন্ত। সমুদ্রশিল্পেও করোনা ক্রান্তির প্রভাব প্রকট। সদ্যবিদায়ী বছরের বেশির ভাগ সময়েই আলোচনার কেন্দ্রে ছিল করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট কোভিড-১৯ মহামারি।

অবশ্য গত বছরের পুরোটাই যে নেতিবাচকতার মধ্য দিয়ে গেছে, তা নয়। আশাবাদী হওয়ার মতো বেশকিছু বিষয়ও ছিল। ভালো-মন্দের এমন মিশেলেই ২০২১ সাল কেটেছে সমুদ্রশিল্পের।

টালমাটাল সরবরাহ শৃঙ্খল

বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হলো সমুদ্র পরিবহন। সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের সিংহভাগ আবার হয় কনটেইনারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় কনটেইনারের চাহিদা ঊর্ধ্বমুখী। বিশ্বজুড়ে শিপিং কোম্পানি ও বন্দর কর্তৃপক্ষগুলো এই বাড়তি চাহিদা সামাল দিতে ধীরে ধীরে নিজেদের সক্ষম করে গড়ে তুলছিল। এমনই একসময়ে হানা দিল বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯। রাতারাতি পাল্টে গেল চিত্রপট। স্থবির হয়ে পড়ল বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ড। ধস নামল ভোক্তা চাহিদা ও শিল্পোৎপাদনে। ভেঙে পড়ল সাপ্লাই চেইন।

এরপর দেখা গেল চীনের উৎপাদন তৎপরতা ও মহামারির প্রথম ঢেউ শেষে ভোক্তাচাহিদায় হঠাৎ ঊর্ধ্বগতি। বৈশ্বিক বাণিজ্যের এই দ্রুত পটপরিবর্তনের সঙ্গে ঠিক খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি সমুদ্র পরিবহন খাত। এর সঙ্গে বিভিন্ন প্রভাবক যোগ হওয়ায় দেশে দেশে বন্দরগুলোয় দেখা দেয় কনটেইনার ও জাহাজজট। আবার চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না থাকায় খালি কনটেইনারের যে স্বল্পতা দেখা দিয়েছে, তা-ও বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করছে। এ দুই সংকট গত বছর বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনের জন্য বিশেষ মাথাব্যথার কারণ ছিল।

ভোগ্যপণ্যের বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনের পাওয়ার হাউস হয়ে উঠেছে চীন। চীনা সমুদ্রবন্দরগুলোর কার্যক্রমে যেকোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি হলে বৈশি^ক আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। গত বছর চীনের গুরুত্বপূর্ণ দুটি বন্দরে করোনাজনিত স্থবিরতা সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। গত মে মাসে শেনঝেনের ইয়ানতিয়ান পোর্টের কার্যক্রম বন্ধের কারণে সাংহাই ও হংকং বন্দরে জট লেগে যায়। এছাড়া জুনের বেশির ভাগ সময়েই চীনের গুরুত্বপূর্ণ এই এক্সপোর্ট হাবের মোট সক্ষমতার মাত্র ৩০ শতাংশ কার্যক্রম চালু ছিল। পরবর্তী সময়ে সেই জট ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই নতুন করে চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় বিশ্বের তৃতীয় ব্যস্ততম কনটেইনার পোর্ট নিংবোর সংকট। আগস্টে বন্দরটির কার্যক্রম আংশিক বন্ধ রাখায় এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়, যা চীনের অন্য বড় বন্দরগুলোর ওপর চাপ তৈরি করে।

যুক্তরাষ্ট্রের সমুদ্র বাণিজ্যের প্রধান দুটি গেটওয়ে হলো পোর্ট অব লস অ্যাঞ্জেলেস ও পোর্ট অব লং বিচ। কোভিড-১৯ মহামারির শুরুর দিকে অর্থাৎ ২০২০ সালের শুরুতে এই দুই বন্দরে বার্থিং স্পেসের জন্য স্যান পেড্রো বে-তে অপেক্ষারত জাহাজের সংখ্যা রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছায়। মাঝে কিছুটা উন্নতি হলেও ২০২১ সালের দ্বিতীয়ার্ধে পরিস্থিতি আবার সেদিকেই এগোতে থাকে।

করোনার কারণে কেবল চীন বা যুক্তরাষ্ট্রই নয়, বরং বন্দর কার্যক্রমে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে বিশে^র প্রায় সব প্রান্তেই। গত মার্চে সিঙ্গাপুর বন্দরে ১৮ হাজার টিইইউএস অথবা এর চেয়ে বেশি ধারণক্ষমতার আল্ট্রা-লার্জ কনটেইনার জাহাজের অপেক্ষমাণ থাকার সময় দাঁড়ায় পাঁচ থেকে সাত দিন, যেখানে বন্দরটিতে জাহাজের স্বাভাবিক টার্ন-অ্যারাউন্ড সময় হলো দুদিন। মেরিন ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস ইইসির তথ্য অনুযায়ী, জুলাইয়ে হংকং বন্দরে জাহাজের ওয়েটিং রেশিও ছিল ৬৭ শতাংশ। ওকল্যান্ড, স্যাভানাহ, সিয়াটল ও ভ্যাঙ্কুভার বন্দরেও ওয়েটিং রেশিও ছিল ৬৫ শতাংশের ওপরে।

ভোক্তা চাহিদা হঠাৎ বেড়ে যাওয়া, কনটেইনার ও যন্ত্রপাতির সংকট, মহামারির অন্যান্য প্রভাবÑএগুলোর কারণেই মূলত বন্দরে জাহাজগুলোর বার্থিংয়ে বিলম্ব হয়েছে গত বছর। ২০২১ সালে কনটেইনার জাহাজগুলোকে বার্থিংয়ের জন্য গড়ে অপেক্ষা করতে হয়েছে করোনা-পূর্ব বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি সময়।

সমুদ্র পরিবহনে অতিজোয়ার

২০২১ সালে সমুদ্র পরিবহনে কনটেইনার চাহিদায় যে লাগামছাড়া ঊর্ধ্বগতি দেখা গেছে, তা আগে কখনো দেখেনি বিশ্ব। এই চাহিদা এতটাই বেড়েছে যে, দেশে দেশে কনটেইনারের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। কনটেইনারের বুকিং পেতে সরবরাহকারীদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এই বাড়তি চাহিদার কারণে কনটেইনার পরিবহনের ভাড়া বেড়ে গেছে বহুগুণ।

কেবল যে কনটেইনারের ভাড়াই আকাশচুম্বী, তা নয়। বরং বাল্ক রেটও ঊর্ধ্বমুখী ছিল গত বছরের বেশির ভাগ সময়। সেপ্টেম্বরে ড্রাই বাল্ক রেট এক দশকের বেশি মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হয়। বাল্টিক এক্সচেঞ্জের প্রধান ড্রাই বাল্ক সি ফ্রেইট ইনডেক্সও ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরের পর সর্বোচ্চ অবস্থানে উঠে যায়।

সমুদ্র পরিবহনে ভাড়া বাড়লেও জাহাজের চাহিদা কিংবা পণ্য পরিবহনের পরিমাণ যে কমেছে, তা কিন্তু নয়। বরং ভোক্তা চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় পণ্য পরিবহন হয়েছে আগের তুলনায় বেশি।

২০২১ সালের প্রথম সাত মাসে সব ধরনের ড্রাই বাল্ক ক্যারিয়ার দিনপ্রতি গড়ে ২০ হাজার ডলারের বেশি আয় করেছে। অক্টোবরে ড্রাই বাল্ক শিপিং রেট দিনপ্রতি ৮০ হাজার ডলারে উঠে যায়। বাল্টিক ড্রাই ইনডেক্স বেড়েছে নভেম্বরজুড়েই। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেও তা ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও বছর শেষের সপ্তাহগুলোয় এই সূচক কিছুটা কমেছে।

এভার গিভেন নাটকীয়তা

গত বছর চায়ের কাপে ঝড় তুলেছিল যেসব বিষয় তার মধ্যে অন্যতম ছিল দানবীয় কনটেইনারবাহী জাহাজ এভার গিভেনের সুয়েজ খালে আটকা পড়া। খালি চোখে দেখলে অনেকের কাছেই এটি সাধারণ একটি ঘটনা মনে হতে পারে। কিন্তু বৈশ্বিক সমুদ্র পরিবহন খাতকে অনেক চড়া মূল্য দিতে হয়েছে এই অচলাবস্থার।

গত বছরের ২৩ মার্চ সুয়েজ খালে আটকা পড়ে এভার গিভেন। লোহিত সাগর থেকে ভূমধ্যসাগরে যাওয়ার সময় দুই লাখ টনের এই জাহাজ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খালটিতে আড়াআড়িভাবে আটকে যায়। নিয়ন্ত্রণ হারানোর আগে জাহাজটি প্রবল বাতাস ও ধূলিঝড়ের কবলে পড়েছিল। ফলে বন্ধ হয়ে যায় বিশে^র অন্যতম ব্যস্ততম এই বাণিজ্যিক রুট। সুয়েজ খালের দুই প্রান্তের প্রবেশমুখে জাহাজজট তৈরি হয়, যেখানে আটকে পড়ে সাড়ে তিনশর বেশি জাহাজ। ২৪ মার্চ উদ্ধারকাজ শুরু হয়। ছয়দিন আটকে থাকার পর অবশেষে মুক্ত হয় এভার গিভেন।

খালে আটকা পড়া থেকে মুক্ত হলেও এভার গিভেন নাটক চলেছিল আরও মাসতিনেক। সুয়েজ কর্তৃপক্ষের দাবি, জাহাজটি আটকে যাওয়ায় দৈনিক এক থেকে দেড় কোটি ডলার রাজস্ব হারাতে হয়েছে তাদের। এ ঘটনায় জাহাজটির মালিকপক্ষের কাছে মোটা অংকের ক্ষতিপূরণ দাবি করে মিশর সরকার। প্রায় তিন মাস এ নিয়ে মালিকপক্ষ, বিমা কোম্পানি ও খাল কর্তৃপক্ষের মধ্যে দরকষাকষি হয়। অবশেষ একটি চুক্তি সম্পাদিত হলে ৭ জুলাই মিশর থেকে ছাড়া পায় এভার গিভেন।

চুক্তির শর্তাবলি প্রকাশ করা হয়নি। তবে মিশর জাহাজের মালিকপক্ষের কাছে ৫৫ কোটি ডলার দাবি করেছে বলে জানা যায়।

২০১৮ সালে তৈরি জাহাজটির দৈর্ঘ্য ৪০০ মিটার। ওজন প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার টন। জাহাজটি ২০ হাজার কনটেইনার পরিবহন করতে সক্ষম। সুয়েজ খাল অতিক্রমের সময় জাহাজটিতে ১৮ হাজার ৩০০ কনটেইনার ছিল। সুয়েজ খাল থেকে উদ্ধার হওয়ার পর জাহাজটিকে মিশরের গ্রেট বিটার লেকে রাখা হয়েছিল।

সাগরে জলদস্যুতা: কিছুটা স্বস্তির আশা

সমুদ্র বাণিজ্যে বড় একটা উদ্বেগের বিষয় হলো জলদস্যুতা। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় গিনি উপসাগর বাণিজ্যিক জাহাজগুলোর কাছে আতঙ্কের প্রতিনাম হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২০ সালে বিশ^জুড়ে মোট ১৩৫ জন ক্রু জাহাজ থেকে অপহৃত হয়েছেন। এই অপহরণের ৯৫ শতাংশই ঘটেছে গিনি উপসাগরে। তা-ও আবার নির্দিষ্ট একটি অংশেই বারবার এসব ঘটনা ঘটছে। আন্তর্জাতিক জলসীমায় মোট সাগরের ২০ শতাংশেরও কম আয়তনের এলাকাজুড়ে অপতৎপরতা চালাচ্ছে জলদস্যুরা।

তবে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর তৎপরতায় গত বছর গিনি উপসাগরে জলদস্যুতা অনেকটাই কমে এসেছে। জলদস্যুতা প্রতিরোধ সক্ষমতা বাড়াতে নাইজেরিয়ার বিভিন্ন কর্মসূচি ও অন্তত দুটি আন্তর্জাতিক মেরিটাইম ফোর্সের যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে।

সমুদ্র নিরাপত্তায় বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ করেছে নাইজেরিয়া। গত জুনে নাইজেরিয়ার সমুদ্র নিরাপত্তা সংস্থা নিমাসার অধীনে যাত্রা হয়েছে ডিপ ব্লু প্রজেক্টের। এই প্রকল্পের অধীনে দুটি স্পেশাল মিশন প্যাট্রল বোট, তিনটি স্পেশাল মিশন হেলিকপ্টার, দুটি লাইট মেরিটাইম প্যাট্রল এয়ারক্রাফট ও চারটি আনম্যানড এয়ার ভেসেল যুক্ত হয়েছে সমুদ্র নজরদারিতে।

গিনি উপসাগরে জলদস্যুতা প্রতিরোধের লক্ষ্যে গত বছরের মে মাসে বাল্টিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম কাউন্সিলের (বিমকো) উদ্যোগে গ্রহণ করা হয় গালফ অব গিনি ডিক্লারেশন অন সাপ্রেশন অব পাইরেসি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরকারী অংশীজনের সংখ্যা বাড়ছে।

ভারত মহাসাগরে কয়েক বছর আগেও বড় মাথাব্যথার কারণ ছিল সোমালীয় জলদস্যুদের উৎপাত। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তাদের ত্রাস কিছুটা কমেছে। এই উন্নতির ফলস্বরূপ ভারত মহাসাগরে জলসদ্যুতার ‘উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা (এইচআরএ)’-এর ভৌগোলিক সীমানা সংকুচিত করেছে সমুদ্র পরিবহন খাতের বিভিন্ন শীর্ষ সংস্থা। বৈশ্বিক শিপিং ও জ¦ালানি তেল খাতের প্রতিনিধি হিসেবে এই পরিবর্তনে সম্মতি জানিয়েছে বাল্টিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম কাউন্সিল (বিমকো), ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব শিপিং (আইসিএস), ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব ড্রাই কার্গো শিপওনার্স (ইন্টারকার্গো), ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব ইনডিপেনডেন্ট ট্যাংকার ওনার্স (ইন্টারট্যাংকো) ও অয়েল কোম্পানিজ ইন্টারন্যাশনাল মেরিন ফোরাম (ওসিআইএমএফ)।

ভৌগোলিক সীমানায় এই পরিবর্তনের ফলে এখন থেকে ভারত মহাসাগরের ইয়েমেনি ও সোমালীয় টেরিটোরিয়াল সি এবং এর পূর্ব ও দক্ষিণ পাশের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকে (ইইজেড) জলদস্যুতার ক্ষেত্রে এইচআরএ হিসেবে দেখা হবে। গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর থেকে এই পরিবর্তন কার্যকর হয়েছে।

দুঃসময় কাটিয়ে উঠছে জাহাজ ভাঙা শিল্প

গত বছরটা উপমহাদেশের জাহাজ ভাঙা শিল্পের জন্য সময়টা বেশ ভালোই গেছে। কোভিড-১৯ মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে এ শিল্প বেশ ভালোভাবেই প্রত্যাবর্তন করেছে। টানা তৃতীয়বারের মতো এ শিল্পে শীর্ষস্থানে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। ২০২০ সালে বিশে^ যত জাহাজ ভাঙা হয়েছে, তার ৩৮ দশমিক ৫ শতাংশে হিস্যা রয়েছে বাংলাদেশের। দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ভারত ও পাকিস্তান। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন-বিষয়ক সংস্থা ‘আঙ্কটাড’ প্রকাশিত ‘রিভিউ অব মেরিটাইম ট্রান্সপোর্ট-২০২১’ প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

২০২১ সালে শিপ রিসাইক্লিং প্রাইস দ্বিগুণের বেশিতে উন্নীত হয়েছে। করোনার কারণে ২০২০ সালে বৈশ্বিক বাণিজ্য ও পণ্য পরিবহন প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছিল। সে সময় রিসাইক্লিংয়ের জন্য জাহাজের প্রাপ্যতা সহজ হওয়ায় রিসাইক্লিং প্রাইস এলডিটিপ্রতি (লাইট ডিসপ্লেসমেন্ট টনেজ) ২০০ ডলারের আশপাশে ছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে। রিসাইক্লিংযোগ্য জাহাজের সরবরাহ কিছুটা কম থাকায় দামও বেড়েছে।

কেবল জাহাজের দাম নয়, বরং ডিমোলিশনের জন্য শিপইয়ার্ডে পাঠানো জাহাজের সংখ্যাতেও চাঙ্গাভাব দেখা গেছে ২০২১ সালে। বছরের প্রথম চার মাসে বিশ^জুড়ে যে পরিমাণ অয়েল ট্যাংকার ভাঙার জন্য ইয়ার্ডগুলোয় পাঠানো হয়েছিল, তাতেই ২০১৯ ও ২০২০ সালের পুরো বছরের সংখ্যা ছাড়িয়ে যায়। বছর শেষে জাহাজ ভাঙার সংখ্যা ১১ বছরের রেকর্ড ভেঙে যাওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছিল বাল্টিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম কাউন্সিল (বিমকো)।

মহামারিতে নি¤œমুখী নাবিকদের প্রসন্নতার সূচক

ক্রু পরিবর্তন ও শোর লিভকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া অনিশ্চয়তার কারণে গত বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে নাবিকদের প্রসন্নতার সূচক উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। মিশন টু সিফেরারের একটি জরিপ প্রতিবেদনে এমন চিত্র তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদন অনুযায়ী, দ্বিতীয় প্রান্তিকে সিফেরার হ্যাপিনেস ইনডেক্স করোনা মহামারি শুরুর পর সর্বনিম্নে অবস্থান করছিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনার কারণে ক্রুদের ভ্রমণ-সংক্রান্ত জটিলতা, জাহাজ ত্যাগ নিয়ে অনিশ্চয়তা এবং শোর লিভের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা নাবিকদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। মহামারির কারণে জাহাজে জীবনযাত্রার প্রায় সব ক্ষেত্রেই নেতিবাচক পরিস্থিতি বাড়ছে। শিগগির গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে পরিবর্তন আনতে না পারলে নাবিকদের মানসিক অবসাদ দূর করা কঠিন হয়ে পড়বে বলে প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়।

সাধারণ প্রসন্নতা, কাজের চাপ, প্রশিক্ষণ, সামাজিক জীবন, শোর লিভ, মজুরি, খাদ্য, স্বাস্থ্য, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ, ওয়েলফেয়ার ফ্যাসিলিটি ইত্যাদি ক্যাটাগরিতে নাবিকদের প্রতিক্রিয়া নিয়ে জরিপ প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। আর প্রতিটি ক্যাটাগরিতেই উত্তরদাতারা নেতিবাচক পরিস্থিতির কথা বলেছেন।

এদিকে বিমকোর সিফেরার ওয়ার্কফোর্স রিপোর্টে সতর্ক করে বলা হয়, ২০২৬ সাল নাগাদ শিপিং খাতে অফিসারের মারাত্মক সংকট দেখা দিতে পারে। আর এই সংকট এড়াতে হলে শিল্পখাতটিতে এখনই প্রশিক্ষণ ও নিয়োগের মাত্রা বাড়াতে হবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, শিপিং খাতে এসটিসিডব্লিউ সার্টিফায়েড অফিসারের চাহিদা বাড়ছে। বৈশি^ক বাণিজ্যিক জাহাজের বহর পরিচালনার জন্য ২০২৬ সাল নাগাদ অতিরিক্ত প্রায় ৯০ হাজার অফিসার প্রয়োজন হবে।

সাইবার হামলার ঝুঁকিতে সমুদ্রশিল্প

বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো সমুদ্র পরিবহন। এ কারণে সাইবার অপরাধ ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হামলার বড় ঝুঁকিতে রয়েছে এ খাত। গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের কলোনিয়াল অয়েল পাইপলাইন সিস্টেমে চালানো সাইবার হামলা সে আশঙ্কার কথাই জানান দিচ্ছে।

অ্যালিয়াঞ্জ গ্লোবাল করপোরেট অ্যান্ড স্পেশাল্টির সর্বশেষ ‘সেফটি অ্যান্ড শিপিং রিভিউ ২০২১’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৯ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ কলোনিয়াল পাইপলাইনের মাধ্যমে প্রায় ৩০টি তেল পরিশোধনাগার ও ৩০০টির মতো জ্বালানি সরবরাহকারী টার্মিনাল সংযুক্ত রয়েছে। সাম্প্রতিক সাইবার হামলার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলজুড়ে পেট্রোলের তীব্র সংকট দেখা দেয়। সিস্টেম অনলাইনে ফিরিয়ে দেয়ার বিনিময়ে হ্যাকাররা পাইপলাইন পরিচালনাকারী কোম্পানির কাছ থেকে ৪৪ লাখ ডলার হাতিয়ে নেয়। বোঝাই যাচ্ছে, এই হামলা চালিয়ে বেশ সফল ছিল হ্যাকাররা। এই সাফল্য অন্যান্য হ্যাকারকেও এই ধরনের অপকর্মে জড়িয়ে পড়তে উৎসাহিত করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সাগরে কনটেইনার হারানোয় উদ্বেগ

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বৈশ্বিক বাণিজ্যের কলেবর বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে সমুদ্র পরিবহনের চাহিদা। এ কারণে শিপিং কোম্পানিগুলো এখন দৈত্যাকার জাহাজ তৈরির দিকে নজর দিয়েছে, যেগুলো একের পর এক কনটেইনার সাজিয়ে বিশাল সমুদ্র পাড়ি দেয়। উত্তাল সাগর পাড়ি দেওয়ার সময় বিরূপ পরিবেশে কিংবা অনাকাক্সিক্ষত সংঘর্ষের সময় জাহাজ থেকে কিছু কনটেইনার পড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। উদ্বেগের বিষয় হলো, সাগরে কনটেইনার হারানোর হার সাম্প্রতিক সময়ে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। আর কোটি কোটি ডলারের পণ্যবাহী এসব কনটেইনার সাগরে পড়ে যাওয়ায় কেবল যে গ্রাহকরাই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তা নয়। সমুদ্র নিরাপত্তার বিষয়টিও হুমকির মুখে পড়ে যাচ্ছে।

একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি বছর গড়ে ১ হাজার ৪০০ কনটেইনার সাগরে হারিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে এ সংখ্যা রেকর্ড উচ্চতায় উঠে গেছে। ২০২০ সালে ৩ হাজার কনটেইনার সাগরে হারিয়ে গেছে। ২০২১ সালেও এ সংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী ছিল। এই দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে পণ্য পরিবহনের ক্রমবর্ধমান চাপকেই দায়ী করা হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, শিপিং খাতে এখন পণ্যের সুরক্ষার চেয়ে দ্রুততর সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানোকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ কারণে জাহাজগুলোয় পাহাড়সম কনটেইনার বোঝাই করা হয়। এসব জাহাজ উত্তাল সাগরে পড়লে কনটেইনার পড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।

বিষয়টি ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশনকেও (আইএমও) ভাবাচ্ছে। কনটেইনার হারানো প্রতিরোধে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, গত বছরের মে মাসে আইএমওর মেরিটাইম সেফটি কমিটির বৈঠকে সেই বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

ইন্দোনেশিয়ার সাবমেরিন ডুবি

২০২১ সালে মেরিটাইম খাতের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক একটি ঘটনা ছিল ইন্দোনেশিয়ার সাবমেরিন ডুবি ও এর সব নাবিকের করুণ মৃত্যু।

গত বছরের ২১ এপ্রিল ৫৩ জন নাবিকসহ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় কেআরআই নাংগালা ৪০২ সাবমেরিন। ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপের নিকটবর্তী সমুদ্রে একটি মহড়ায় অংশ নিয়েছিল সেটি। নিখোঁজ হওয়ার তিনদিন পর ইন্দোনেশীয় কর্তৃপক্ষ জানায়, সাবমেরিনটি ডুবে গেছে।

এরপর শুরু হয় উদ্ধার তৎপরতা। উদ্ধারকাজে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও ভারত সহায়তা করে। হারিয়ে যাওয়ার সময় সাবমেরিনটিতে কেবল তিনদিনের উপযোগী অক্সিজেন মজুদ ছিল। তাই তিনদিন পেরিয়ে যাওয়ার পর ইন্দোনেশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, নাবিকদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

৪৪ বছরের পুরনো সাবমেরিনের খোঁজে যুদ্ধজাহাজ পাঠানো হয়েছিল। আকাশ থেকেও চালানো হয় অনুসন্ধান। তাতে সাবমেরিনটি পানিতে ডুব দেওয়ার জায়গার আশপাশে তেল ছড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।

স্ক্যান করে সাগরের প্রায় ৮৫০ মিটার গভীরে সাবমেরিনটির উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছিল। এই গভীরতা ছিল সাবমেরিনটির স্বাভাবিক সীমার অনেক নিচে। সাবমেরিনটি তিন টুকরো অবস্থায় সমুদ্রের তলদেশে পাওয়া যায়। এতে থাকা ৫৩ নাবিকের সবাইকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

নাংগালা তৈরি হয়েছিল জার্মানিতে। ইন্দোনেশিয়ার পাঁচটি সাবমেরিনের একটি ছিল এটি। নাংগালা ডুবে যাওয়ার কারণ পরিষ্কার জানা না গেলেও ইন্দোনেশিয়ার নৌ কর্মকর্তারা বলছেন, মানুষের ত্রুটি নয়, বরং প্রাকৃতিক বা পরিবেশগত কোনো কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।

সেন্ট্রাল আর্কটিকে মৎস্য আহরণ নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক চুক্তি কার্যকর

সেন্ট্রাল আর্কটিক ওশানের হাই সিজ অঞ্চলে অনিয়ন্ত্রিত মৎস্য আহরণ প্রতিরোধের লক্ষ্যে যে আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল, তা গত ২৫ জুন কার্যকর হয়েছে। এই চুক্তির মাধ্যমে আগামী ১৬ বছর এ অঞ্চলে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো কর্তৃক বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মৎস্য আহরণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

উত্তর মহাসাগরের হাই সিজ অঞ্চলে বরফের আস্তরণ বর্তমানে সংকোচনের পর্যায়ে রয়েছে, যা বাণিজ্যিক মৎস্য আহরণের সম্ভাবনা তৈরি করেছে। কিন্তু এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে জানতে হলে এটি নিয়ন্ত্রণে আনা দরকার। সেই লক্ষ্যেই চুক্তিটি কার্যকর করা হয়েছে।

Facebook Notice for EU! You need to login to view and post FB Comments!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here