বিশ্ববাণিজ্যে পটপরিবর্তনকারী চুক্তি আরসিইপি

বৈশ্বিক বাণিজ্যিক পরিম-লে বড় একটি ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকল ২০২২ সালের প্রথম দিনটা। গত ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়েছে রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ (আরসিইপি), যাকে বলা হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বহুপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি।

নতুন এই আঞ্চলিক বাণিজ্যিক জোটে যুক্ত হয়েছে মোট ১৫টি দেশ। এগুলো হলো আসিয়ানভুক্ত ১০টি দেশ-ব্রুনাই, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম এবং তাদের এফটিএ অংশীদার পাঁচটি দেশÑঅস্ট্রেলিয়া, জাপান, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া ও চীন।

আরসিইপির মূল উদ্দেশ্য নিজেদের মধ্যে বাণিজ্যে শুল্ক কমানো, সরবরাহ শৃঙ্খল শক্তিশালী করা ও ই-কমার্সের জন্য নতুন বিধিবিধান চালু করা। জোটটির সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মোট যে পরিমাণ পণ্য বাণিজ্য হয়, তার ৯০ শতাংশের বেশি পণ্য থেকে শুল্ক তুলে নেওয়া হবে এই চুক্তির অধীনে।

২০১২ সালে কম্বোডিয়ায় অনুষ্ঠিত আসিয়ান সম্মেলনে আরসিইপির বিষয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়। আসিয়ানের এফটিএ অংশীদার হিসেবে ভারতও প্রথমে এ আলোচনায় যুক্ত ছিল। তবে ২০১৯ সালে তারা নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়।

লাভবান হবে কারা?

যেকোনো বাণিজ্য জোট বা চুক্তির মূল উদ্দেশ্য হলো, সদস্য দেশগুলোর মধ্যে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য ও প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা। এ ধরনের চুক্তি ছোট-বড় সব অর্থনীতির জন্যই বড় একটি বাজার তৈরি করে। শিল্পোৎপাদনমুখী দেশগুলো এতে যেমন লাভবান হয়, তেমনই উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলোও এর সুবিধাভোগী হয়। বিশেষ করে ব্যাকওয়ার্ড ও ফরোয়ার্ড লিংকেজ শিল্পনির্ভর দেশগুলো এই ধরনের চুক্তির ফলে বেশ উপকৃত হয়।

বিশ্ব বাণিজ্য জোট বা চুক্তি তো আরও রয়েছে। তাহলে আরসিইপি এত বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে কেন? এটি বুঝতে হলে আগে জানতে হবে এই জোট তার সদস্য দেশগুলোর মুক্ত বাণিজ্যে কীভাবে সহায়ক ভূমিকা রাখবে, সেই বিষয়টি। আরসিইপি কার্যকরের পরবর্তী ২০ বছরে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃবাণিজ্যে আমদানি পণ্যে ৯২ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক কমানো হবে। সেবা খাতের কমপক্ষে ৬৫ শতাংশ অন্য সদস্য দেশগুলোর বিনিয়োগকারীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। তথ্যপ্রবাহের জন্য ক্রস-বর্ডার রুলস চালু করে ডিজিটাল বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ কমিয়ে আনা হবে। সদস্য দেশগুলোকে উৎসাহিত করা হবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অপ্রয়োজনীয় প্রতিবন্ধকতা যেমন কোটা বা লাইসেন্সের মাধ্যমে বাণিজ্যে বিধিনিষেধ আরোপ না করার জন্য।

আরসিইপির সদস্য দেশগুলো যখন উল্লিখিত সুবিধাগুলো পাবে, স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে তুলনামূলক কম খরচে কার্যকর ব্যাকওয়ার্ড ও ফরওয়ার্ড সাপ্লাই চেইন গড়ে উঠবে। অনেক কম সময়ে ও কম খরচে কাঁচামাল সংগ্রহ করা সম্ভব হবে। ফলশ্রুতিতে উৎপাদন খরচ কম হবে। উৎপাদন খরচ যখন কমে যাবে, স্বাভাবিকভাবেই পণ্যের বিক্রয় বা রপ্তানি মূল্য কমে যাবে। ফলে আমদানিকারক দেশগুলো আগের তুলনায় কম মূল্যে বেশি পণ্য আমদানি করতে পারবে। প্রতিক্রিয়ায় রপ্তানিকারক দেশের মোট পণ্য রপ্তানির পরিমাণও অনেক বেড়ে যাবে। অর্থাৎ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে সদস্য দেশগুলো অন্য প্রতিযোগীদের তুলনায় কম মূল্যে পণ্য রপ্তানি করে নতুন বাজার দখল করবে এবং অধিক রপ্তানির মাধ্যমে বাড়তি বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনে সক্ষম হবে।

আরসিইপি কার্যকরের ফলে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বিনিয়োগ বেড়ে যাবে। ফলে বড় বড় বিনিয়োগকারী দেশ যেমন চীন, জাপান, কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া জোটভুক্ত অন্যান্য দেশ যেমন কম্বোডিয়া, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনামে বেশি বেশি বিনিয়োগ করবে। এতে করে বড় বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ অন্যান্য দেশে কমে যেতে পারে।

বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ বা প্রায় ২৩০ কোটি মানুষ এবং প্রায় ২৮ লাখ ৫০ হাজার কোটি ডলারের অর্থনীতি এই বাণিজ্য চুক্তির আওতায় আসছে। এদের মধ্যে আরসিইপির সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী হবে চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া। এই প্রথমবারের মতো আঞ্চলিক পরাশক্তি তিনটি কোনো মুক্তবাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে পরস্পর যুক্ত হলো। তাদের মধ্যে আবার সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে জাপান। কারণ এই তিন দেশের মধ্যে আন্তঃবাণিজ্যে জাপানের রপ্তানির পরিমাণ (২ হাজার ২ কোটি ডলার) সবচেয়ে বেশি। এরপরের অবস্থানে থাকা চীনের রপ্তানি ১ হাজার ১২০ কোটি ডলার এবং দক্ষিণ কোরিয়ার রপ্তানি ৬৭০ কোটি ডলার।

এক গবেষণা প্রতিবেদনে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সম্মেলন (আঙ্কটাড) উল্লেখ করে, ‘উদীয়মান এই জোটের অর্থনৈতিক বিশালত্ব ও তাদের বাণিজ্যের গতিশীলতাই বলে দিচ্ছে যে, আরসিইপি বিশ্ববাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে যাচ্ছে। করোনা মহামারির এই সময়ে চুক্তিটির বাস্তবায়ন সদস্য দেশগুলোর বাণিজ্যকে সুরক্ষা প্রদানে বিশেষভাবে সহায়ক হবে।’

আঙ্কটাড আরও জানিয়েছে, আরসিইপি কার্যকরের ফলে সদস্য দেশগুলোর মধ্যকার বাণিজ্য ২০১৯ সালের তুলনায় ২ শতাংশ বা প্রায় ৪ হাজার ১৮০ কোটি ডলার বেড়ে যাবে।

টিপিপি বনাম আরসিইপি

যুক্তরাষ্ট্রসহ এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১২টি দেশকে নিয়ে সম্ভাবনাময় একটি বাণিজ্য চুক্তি হতে পারত ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি)। হতে পারত বলা হচ্ছে কারণ ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে চুক্তিটি স্বাক্ষর হলেও এখন পর্যন্ত সেটি কার্যকর হয়নি। বর্তমানে টিপিপি চুক্তির সমর্থনকারী দেশের সংখ্যা ১১। এগুলো হলো অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ব্রুনাই, কানাডা, চিলি, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো, নিউজিল্যান্ড, পেরু, সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনাম।

টিপিপির প্রাথমিক আলোচনায় নাম ছিল ১২টি দেশের। ২০১৬ সালের চুক্তিতে স্বাক্ষরও করেছিল এই ১২টি দেশ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চুক্তিটির সমর্থনকারী দেশের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১টি। এর কারণ যুক্তরাষ্ট্রের পিছু হটা। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী টিপিপি চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেন।

প্রাথমিক চুক্তিতে যে ১২টি দেশ স্বাক্ষর করেছিল, তারা সম্মিলিতভাবে বিশ্ববাণিজ্যের ৪০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে চুক্তিটি কার্যকর হলে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বড় একটি বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হতো যুক্তরাষ্ট্রের।

নিজেদের প্রত্যাহারের মাধ্যমে আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের যে সুযোগ হাতে ঠেলে দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, আরসিইপির মাধ্যমে সেই সুযোগটাই কাজে লাগাচ্ছে চীন। বৈশি^ক জিডিপিতে সম্মিলিতভাবে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অবদান রাখা দেশগুলোর মধ্যে একটি বৃহত্তর অর্থনৈতিক ঐক্য গড়ে তুলতে অনেক দিন ধরেই চেষ্টা চালিয়ে আসছিল বেইজিং। আরসিইপির মাধ্যমে প্রচেষ্টা চূড়ান্ত ফল পেতে যাচ্ছে।

আরসিইপির ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বাইরের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো সেখানে ব্যবসা করতে গিয়ে কিছু প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে পারে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের টিপিপি থেকে সরে যাওয়া ও আরসিইপি চুক্তি কার্যকর হওয়ার ফলে মার্কিন কোম্পানিগুলোর এ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করাটা কঠিন হয়ে পড়বে।

টিপিপি ও আরসিইপির মধ্যে কিছু কৌশলগত পার্থক্য রয়েছে। টিপিপির লক্ষ্য ছিল অর্থনীতিতে কিছু মৌলিক পরিবর্তন আনা। অন্যদিকে আরসিইপি হলো অনেকটা বাণিজ্যের দুয়ার উন্মুক্ত করে দেওয়ার মতো। আরসিইপিকে অনেকে চীনকেন্দ্রিক চুক্তি বলছেন। তবে বাস্তবতা হলো, টিপিপি যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক ছিল, আরসিইপি সেভাবে বেইজিংয়ের ওপর নির্ভরশীল থাকবে না। মোটকথা, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের চুক্তি হলেও আরসিইপির প্রভাব কেবল অঞ্চলটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না।

বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশের বাজার আসবে আরসিইপির আওতায়

বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট

স্বল্পোন্নত (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণের পর পর্যায়ক্রমে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্যিক সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। এমন একসময়ে আরসিইপি চুক্তি বাংলাদেশকে কঠিন এক বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে পারে। তাই এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রাক্কালে বাংলাদেশের জন্য আরসিইপির গুরুত্বকে বিশেষভাবে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। বিশেষ করে এমন একসময়ে, যখন বাংলাদেশ এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততার দিকে বিশেষ নজর দিচ্ছে।

আরসিইপি নিয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া রয়েছে। কেউ কেউ এই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কেউ আবার এই চুক্তির কারণে কোনো ঝুঁকি দেখছেন না। আরসিইপির ফলে বাংলাদেশকে কোনো ধরনের বিরূপ বাণিজ্যিক পরিবেশে পড়তে হবে কিনা, তা সময়ই বলে দেবে। তবে তার আগে সম্ভাব্য পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা যাক।

আরসিইপির ফলে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলো চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ায় অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্যসুবিধা পাবে। বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, লাওসের মতো দেশগুলো রপ্তানিতে বাড়তি সুবিধা পাবে। স্বল্পমূল্যে কাঁচামালের সহজলভ্যতার ফলে এসব দেশ বাংলাদেশের তুলনায় স্বল্পদামে পণ্য রপ্তানি করতে পারবে।

আরেকটি বিষয়, প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে বাংলাদেশকে ভিয়েতনাম, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলোর সঙ্গে টেক্কা দিতে হবে। কারণ নতুন এই জোটের সদস্যরা বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে।

আরসিইপি সদস্যদের মধ্যে দুটি দেশ লাওস ও মিয়ানমারও বাংলাদেশের মতো এলডিসি থেকে উত্তরণের পথে রয়েছে। শর্তসাপেক্ষে অগ্রাধিকারমূলক সুযোগের ভিত্তিতে আরসিইপি এই দেশগুলোকে একটি বৃহৎ বাজারে প্রবেশাধিকার দিচ্ছে। বাংলাদেশ কিন্তু এই বাজারে অগ্রাধিকারমূলক প্রবেশাধিকারের জন্য বিবেচিত হবে না।

তৈরি পোশাক বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস। সাম্প্রতিক সময়ে ভিয়েতনাম এই খাতে বেশ ভালো করছে। নতুন এই জোটের কারণে ভিয়েতনাম এই বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে আরও বেশি অগ্রাধিকার পাবে। সেই সঙ্গে কাঁচামাল সংগ্রহের ক্ষেত্রেও বড় ধরনের সুযোগ পাবে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠা দেশটি।

রয়েছে সম্ভাবনাও

বাণিজ্যিক প্রেক্ষাপটে আরসিইপি বাংলাদেশের জন্য যে কেবল ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে, তা নয়। বরং এর ফলে বাংলাদেশের সামনে কিছু সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে।

এলডিসিতে থাকা বাংলাদেশ আরসিইপি সদস্যভুক্ত কয়েকটি দেশের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের সুবিধা পেয়ে আসছে আগে থেকেই। এই ব্লকে বাংলাদেশের বড় অংকের রপ্তানি বাণিজ্য রয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট ৩ হাজার ৩৭০ কোটি ডলার রপ্তানি আয়ের ১০ দশমিক ৪ শতাংশই এসেছে আরসিইপি দেশগুলো থেকে। বাণিজ্যের সরল তত্ত্ব এটাই বলে যে, বিনিয়োগ সাধারণত সাশ্রয়ী শ্রম এলাকাগুলোয় স্থানান্তর হয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। সঠিক কূটনৈতিক তৎপরতা ও অনুকূল ব্যবসায়িক পরিবেশ নিশ্চিত করা গেলে এলডিসি থেকে উত্তরণের পরও বাংলাদেশ শ্রমঘন শিল্পে বিনিয়োগ টানতে পারবে বলে আশা করা যায়।

পরোক্ষভাবেও এই চুক্তি বাংলাদেশের উৎপাৎদনশীলতায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। চুক্তির ফলে বাংলাদেশের ওপর ভ্যালু অ্যাডিশনের চাপ তৈরি হবে। ফলে দেশীয় উৎপাদকরা আরও প্রতিযোগী ও উদ্ভাবনী হয়ে উঠবে, যা কার্যত বাংলাদেশের শিল্প খাতকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে।

আরেকটি বিষয় বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মতো আরসিইপি একটি সম্মিলিত জোট হয়ে উঠলে বাংলাদেশ সেখানে অর্থনৈতিক চুক্তি করার ক্ষেত্রে অঞ্চলভিত্তিক সুবিধা পাবে। অর্থাৎ তখন বাণিজ্যিক চুক্তিগুলো দেশভিত্তিক না হয়ে অঞ্চলভিত্তিক হবে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার বিষয়টি এড়িয়ে যেতে পারবে, যা কখনো কখনো অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে।

২০১৩ সালের ৯-১৩ মে ব্রুনাইতে আরসিইপির ট্রেড নেগোসিয়েশন কমিটির প্রথম বৈঠকে বাণিজ্য সংহতির ডাক দেওয়া হয়

বাংলাদেশের করণীয়

আরসিইপির ফলে বাংলাদেশের বাণিজ্য খাতে যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, তা মোকাবিলায় কয়েকটি পদক্ষেপ বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।

প্রথমত, এই বিষয়টি মেনে নিতে হবে যে, আমরা চাইলেও এই চুক্তিতে যেতে পারতাম না। কারণ এটি আসিয়ানভুক্ত ও আসিয়ানের সঙ্গে যাদের মুক্তবাণিজ্য চুক্তি রয়েছে, তাদের চুক্তি। বাংলাদেশ আসিয়ানভুক্ত নয়। তাদের সঙ্গে কোনো মুক্তবাণিজ্য চুক্তিও নেই। ফলে আরসিইপি ইস্যুতে বাংলাদেশের করার কিছু ছিল না।

তবে বাংলাদেশ এখন যে কাজটি করতে পারে সেটি হলো, জোটভুক্ত যেসব দেশের সঙ্গে বর্তমানে আমাদের বাণিজ্য চুক্তি রয়েছে, সেগুলো সঠিকভাবে কাজে লাগানো। যেমন চীন আমাদের ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা দিয়েছে। এটি কাজে লাগাতে পারলে রপ্তানি বেড়ে যাবে বাংলাদেশের। এর পাশাপাশি সরকার আরসিইপি জোটের সঙ্গে বাণিজ্যিক সুবিধার বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে পারে।

দ্বিতীয়ত যে বিষয়ে বাংলাদেশকে উদ্যোগ নিতে হবে, সেটি একান্তই আমাদের নিজস্ব বিষয়। পরিবর্তিত প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে সাফল্য অর্জনের জন্য আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যে-বৈচিত্র্য আনতে হবে। এছাড়া উৎপাদন ব্যয় কমানো, শক্তিশালী মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করার মতো উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশকে কপিরাইট, ই-বাণিজ্যসহ অন্যান্য বিষয়ের দিকে আরও বেশি নজর দিতে হবে।

তৃতীয়ত, প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলায়, বিশেষ করে আরসিইপিতে রপ্তানি বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য বাংলাদেশ বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন (বিমসটেক) ও এশিয়া-প্যাসিফিক ট্রেড এগ্রিমেন্টের (এপিটিএ) মতো চ্যানেলগুলো ব্যবহার করতে পারে।

সমুদ্র পরিবহন খাতে আরসিইপির প্রভাব

আরসিইপি এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের শিপিং খাতে শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির নিয়ামক হয়ে দাঁড়াবে বলে খাত-সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। তারা বলছেন, এই চুক্তির ফলে সদস্য দেশগুলোর মধ্যকার আন্তঃবাণিজ্যের যে প্রসার ঘটবে, তার সুবিধা ভোগ করবে সমুদ্র পরিবহন খাত।

চীনের আমদানি-রপ্তানি পণ্যের ৯০ শতাংশের বেশি পরিবহন হয় সমুদ্রপথে। জোটের অন্য দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য বেড়ে যাওয়ার ফলে চীনের জাহাজ নির্মাণ ও সমুদ্র পরিবহন খাতে নতুন প্রাণের সঞ্চার হবে। যেসব বন্দরের মূল কার্যক্রম আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবহন করা, সেসব চীনা বন্দর এই চুক্তির কারণে বিশেষভাবে লাভবান হবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, আরসিইপি চুক্তির ফলে পণ্য বাণিজ্য অনেকখানি বেড়ে যাবে। আর এর প্রত্যক্ষ সুবিধাভোগী হবে সমুদ্র পরিবহন খাত। তাদের মতে, আরসিইপি এশিয়ার সাপ্লাই চেইনে পারস্পরিক সংযোগ আরও বৃদ্ধি করবে। এটি বাণিজ্যের মুক্ত প্রবাহের জন্য ইতিবাচক হবে। আর সাপ্লাই চেইন যত সম্প্রসারিত হবে এবং বাণিজ্যের প্রবাহ যত মসৃণ হবে, সমুদ্র পরিবহন খাত তত বেশি সুফল পাবে।

আরসিইপির ফলে কেবল যে বাণিজ্যের পরিমাণই বাড়বে, তা নয়। বরং পর্যটন খাতকেও পুনরুজ্জীবিত করবে এটি। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে সবার আগে যে খাতের ওপর আঘাত এসেছিল, সেটি হলো ভ্রমণ খাত। চলাচলের নিষেধাজ্ঞায় নৌ-পর্যটন খাতকে বড় ধরনের লোকসানের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। এই খাতকে পুনরায় চাঙ্গা করার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে আরসিইপি।

উপসংহার

বিশ্বের বড় একটি বাজারের সৃষ্টি হলো আরসিইপির মাধ্যমে। সেটি যেমন জোটের সদস্য দেশগুলোর নিজেদের জন্য, তেমনই বাইরের দেশগুলোর জন্যও। ইইউ যেমন সদস্য রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থ সুরক্ষার পাশাপাশি উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর অগ্রযাত্রায় বড় ভূমিকা রেখে যাচ্ছে, আরসিইপি জোটটিও একইভাবে আশীর্বাদ হয়ে উঠতে পারে আমাদের জন্য। এই সম্ভাবনা কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজন কিছু দূরদর্শী উদ্যোগ।

যেকোনো চ্যালেঞ্জই নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়। আরসিইপি কার্যকরের ফলে বাংলাদেশের সামনে যেসব চ্যালেঞ্জের উদ্ভব হবে, ইতিবাচক মানসিকতায় মোকাবিলা করতে পারলে সেগুলোই আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার প্রভাবক হয়ে উঠতে পারে। সুতরাং আরসিইপিকে আপদ বিবেচনা করে বসে না থেকে আমাদের ভবিষ্যতের জন্য কর্মপরিকল্পনা সাজাতে হবে। আর তা হলে এই আঞ্চলিক জোটের সদস্য না হয়েও এটি থেকে লাভবান হবে বাংলাদেশ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here