বন্দরের অবকাঠামোগত উন্নয়ন পরিকল্পনায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে অধিকতর গুরুত্বের মধ্যে আনতে হবে

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সর্বব্যাপী। প্রতিনিয়ত বাড়ছে দুর্যোগের ঘটনা। সর্বশেষ দুই দশকে প্রতিবছর ৩৫০ থেকে ৫০০টি মধ্যম থেকে ভয়াবহ মাত্রার দুর্যোগের শিকার হয়েছে বিশ্ববাসী, যা আগের তিন দশকের গড় ঘটনার তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি। ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বজুড়ে এমন দুর্যোগের সংখ্যা দাঁড়াতে পারে বছরে ৫৬০টি। বন্দরশিল্পকেও এসব দুর্যোগ মোকাবিলা করে টিকে থাকতে হচ্ছে। উন্মুক্ত উপকূলীয় এলাকা অথবা প্লাবনপ্রবণ মোহনায় অবস্থানের কারণে বিশ্বের সমুদ্রবন্দরগুলোকে প্রায়ই সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি, সামুদ্রিক ঝড়, উত্তাল ঢেউ, ঝোড়ো বাতাস, বন্যা, টেকটোনিক বিভিন্ন ঘটনা যেমন সুনামির মতো সামুদ্রিক ভূমিকম্পসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কাছে অসহায় হয়ে পড়তে দেখা যায়।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগে যে শুধু বন্দরের অবকাঠামোগত ক্ষতিই হয়, তা নয়। সামগ্রিক বাণিজ্যেও এর প্রভাব গুরুতর। নেদারল্যান্ডসের রটারডাম বন্দরকে মডেল ধরে এক গবেষণায় দেখা যায়, বন্যার কারণে বন্দর অবকাঠামোর ক্ষতির পাশাপাশি সামগ্রিক বাণিজ্যিক কার্যক্রমের খরচ ৬৪ থেকে ৮৬ শতাংশ বেড়ে যায়। তাই বন্দরের অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে। এসব উন্নয়ন হতে হবে জলবায়ুসহিষ্ণু। জাতিসংঘের ২০৩০ এজেন্ডা ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্টের গোল ৯, ১৩ ও ১৪ এবং টার্গেট ১ দশমিক ৫ পূরণে মূল ভূমিকা রাখবে সমুদ্রবন্দর ও গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য পরিবহন অবকাঠামোর জলবায়ুসহিষ্ণু সক্ষমতা অর্জন। তবে বন্দরের সুরক্ষায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা ও সহনশীলতার সক্ষমতা অর্জনের জন্য কোনো একটি নির্দিষ্ট পদক্ষেপ পর্যাপ্ত নয়। নীতিনির্ধারক, খাতসংশ্লিষ্ট অংশীজন, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও উন্নয়ন সহযোগীদের বহুমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। আর এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সমন্বিত পদক্ষেপ একান্ত জরুরি।

জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুকিপ্রবণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ওপরের দিকেই রয়েছে। ‘দক্ষিণ এশিয়ার জলবায়ু উপদ্রুত এলাকা (হটস্পট), জীবনমানের ওপরে তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের ১৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ হবে ১৪ লাখ ১৯ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। প্রতিবেদনটিতে বেশি হুমকির মুখে রয়েছে এমন শীর্ষ ১০টি জেলার মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম বন্দর, তেল শোধনাগারসহ অনেক বড় বড় অবকাঠামো এই শহরে গড়ে উঠেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের অনেক কাছাকাছি হওয়ায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে এখানকার আর্থিক ক্ষতি অনেক বেশি হবে। এছাড়া কয়েক বছর ধরে চট্টগ্রাম শহরে জলাবদ্ধতার পরিমাণও বাড়ছে। এসবের সামগ্রিক প্রভাব পড়বে চট্টগ্রাম বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রমে।

অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে এসব দুর্যোগ মোকাবিলায় বদ্ধপরিকর চট্টগ্রাম বন্দর। ১৯৯১ সালের প্রলঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পর দুর্যোগ প্রতিরোধে ১৯৯২ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য প্রণয়ন করা হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা এবং দুর্যোগ-পরবর্তী পুনর্বাসন পরিকল্পনা। পরিকল্পনাটির মূল লক্ষ্য হলো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় বন্দর এলাকার প্রাণ ও সম্পদের সুরক্ষা প্রদান, যতটা সম্ভব ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম রাখা এবং যত দ্রুত সম্ভব বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম পুনরায় চালু করা। সাম্প্রতিক সময়ে দুর্যোগ মোকাবিলায় বেশ দক্ষতা দেখিয়েছে  চট্টগ্রাম বন্দর। বর্তমানে এটি অবকাঠামো নির্মাণে জলবায়ুসহিষ্ণুতার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। এক্ষেত্রে বে টার্মিনাল ও মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দরের কথা প্রণিধানযোগ্য। দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষম ব্রেক-ওয়াটারসহ নির্মাণ করা হচ্ছে এদের অবকাঠামোসমূহ। বন্দরের টেকসই ভবিষ্যৎ গড়তে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমনের বিস্তারিত নিয়ে রয়েছে এবারের মূল আয়োজন।

প্রিয় পাঠক, আমরা চাই এ দেশের মেরিটাইম চর্চাকে একটি সুদৃঢ় ভিত্তিতে দাঁড় করাতে। বৈচিত্র্যময় আঙ্গিকে, সমৃদ্ধ কলেবরে বন্দরবার্তার পথচলা বাংলাদেশের মেরিটাইম খাতের বিকাশে আরও সহায়ক হবে-সেই প্রত্যাশা। সবাইকে শুভেচ্ছা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here