সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ প্রযুক্তি ও তথ্যপ্রবাহে বৈপ্লবিক রূপান্তর

আধুনিক যুগে শিল্পোৎপাদন থেকে শুরু করে বিপণন-সবকিছুই প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছে। আর তথ্যের অবাধ প্রবাহ সম্পদ ব্যবস্থাপনা সরবরাহ ব্যবস্থাকে করেছে কর্মদক্ষ টেকসই। মৎস্য আহরণ খাতেও তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার হলে জাতীয় অর্থনীতিতে এর অবদান বাড়বে। সমুদ্র অর্থনীতির এই যুগে উপকূলীয় সব দেশের জন্যই বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

প্রাগৈতিহাসিক থেকে এখনকার শিল্পায়ন-পরবর্তী যুগ পর্যন্ত মানবসভ্যতার মৌলিক অনেক বিষয়েই এসেছে পরিবর্তন। তবে একটি বিষয় সবসময়ই মানবজাতির জন্য বড় এক চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। আর সেই বিষয়টি হলো খাদ্যনিরাপত্তা। খাদ্য মানুষের অন্যতম প্রধান মৌলিক চাহিদা। এই চাহিদার বড় একটি অংশ পূরণ করে মৎস্যসম্পদ। ২০৫০ সাল নাগাদ বৈশ্বিক জনসংখ্যা প্রায় ১ হাজার কোটিতে উন্নীত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য মৎস্যসম্পদের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা নিশ্চিতভাবেই বড় একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।

সম্পদ সবসময়ই সীমিত। কার্যকর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা না গেলে এই সীমিত সম্পদ টেকসই উন্নয়নের হাতিয়ার হতে পারে না। খনিজ সম্পদের ক্ষেত্রে যেমন অনেক হিসাব-নিকাশ করে উত্তোলনের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়, মৎস্যসম্পদের ক্ষেত্রেও একই কর্মকৌশল অবলম্বন করা জরুরি। সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি বিষয় হওয়ায় মৎস্য সম্পদের সুরক্ষার দিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি।

যেকোনো টেকসই কর্মপরিকল্পনা সাজানোর জন্য প্রয়োজন বিস্তারিত, সঠিক ও তাৎক্ষণিক তথ্যের অবাধ প্রবাহ। মৎস্য আহরণ খাতেও বিষয়টি সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। কোথায় মাছের প্রাপ্যতা বেশি, কোথায় বিপন্নপ্রায় মৎস্য প্রজাতি টিকে থাকার সংগ্রাম করছে, কী পরিমাণে মাছ ধরলে তা জলজ বাস্তুতন্ত্রের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে না, কোন সময়ে মাছ ধরলে তা প্রজননের জন্য হুমকিস্বরূপ হবে না, কোন বাজারে কোন প্রজাতির মাছের চাহিদা বেশি, কোথায় চাহিদার তুলনায় মাছের সরবরাহ কমÑএসব তথ্য জানা থাকলে টেকসই মৎস্য আহরণ খাত গড়ে তোলা সম্ভব। আর সবার মাঝে এসব তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রয়োজন প্রযুক্তির বিকাশ ও সর্বাত্মক ব্যবহার।

ক্রমবর্ধমান বাজার

সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ ও মৎস্য চাষ সেই আদিকাল থেকে মানুষের জীবিকা ও খাদ্যের বড় উৎস। বর্তমানে এই নির্ভরতা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেড়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ‘দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকোয়াকালচার’ প্রতিবেদন অনুসারে, মৎস্য আহরণ ও মৎস্য চাষের বৈশ্বিক উৎপাদন ২০১৮ সালে ১৮ কোটি টন ছুঁয়েছে। এর অর্ধেকের বেশি (প্রায় ১০ কোটি টন) ছিল সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ।

এফএওর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমুদ্র থেকে আহরণ করা হোক আর চাষ করা হোক, টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা গেলে মৎস্যসম্পদ কর্মসংস্থান ও খাদ্যনিরাপত্তায় বড় ভূমিকা রাখতে পারে। ২০১৮ সালে বৈশ্বিক মাছ রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ১০০ কোটি ডলার, যা প্রতি বছর বাড়ছে। অপর একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০২২ থেকে ২০২৭ পর্যন্ত পাঁচ বছরে মৎস্যসম্পদের বৈশ্বিক বাজার সম্প্রসারিত হবে বার্ষিক চক্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ৮ শতাংশ হারে।

বর্তমানে এই শিল্পের বাজার প্রায় ১৩ হাজার কোটি ডলারের। বিশ্বে ফিশিং ভেসেল রয়েছে প্রায় ৪৬ লাখ। এর বেশির ভাগই ছোট আকারের। অন্তত ২৪ মিটার দৈর্ঘ্যরে ফিশিং ভেসেলের সংখ্যা ৬৫ হাজারের বেশি নয়।

এফএওর হিসাব অনুযায়ী, মৎস্য উৎপাদনে ৩৫ শতাংশ অংশীদারিত্ব নিয়ে বিশ্বে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে চীন। আর চীন বাদে এশিয়ার বাকি দেশগুলোর উৎপাদন ৩৪ শতাংশ। এরপর রয়েছে আমেরিকা (১৪ শতাংশ), ইউরোপ (১০ শতাংশ), আফ্রিকা (৭ শতাংশ) ও ওশানিয়া (১ শতাংশ)।

গত কয়েক বছরে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মৎস্য উৎপাদন ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। বৈশ্বিক মৎস্য উৎপাদনে এই অঞ্চলের হিস্যা ৪০ শতাংশের বেশি। ২০২১ সালে বাজার অংশীদারিত্বে শীর্ষে ছিল এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল। এশিয়ার অনেক দেশেরই মৎস্য রপ্তানি থেকে প্রতি বছর ৫০ কোটি ডলারের বেশি আয় হয়। আর এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার মোট মৎস্য রপ্তানির অর্ধেকের বেশির গন্তব্য হলো ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা।

তথ্যপ্রযুক্তির প্রবাহে অগ্রগতি

শিল্পায়ন-পরবর্তী যুগে উন্নত বিশ্বের পেশাজীবীরা প্রধানত সেবা ও জ্ঞাননির্ভর খাতে কাজ করে। সেখানে উৎপাদন খাত অনেকটাই যন্ত্রনির্ভর হয়ে পড়েছে। সেন্সর, রোবট, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) মেশিন লার্নিং হয় মানবশ্রমের জায়গা দখল করেছে অথবা উৎপাদন ব্যবস্থাকে করেছে আরও বেশি কর্মদক্ষ। কৃষকরা এখন কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে তাদের ফসলের স্বাস্থ্য তদারকি করতে পারছে। সার ও কীটনাশক প্রয়োগে সাহায্য নিচ্ছে ড্রোনের।

তবে বাণিজ্যিক মৎস্য আহরণ এর ব্যতিক্রম। বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন এই শিল্প খাত এখনো অতিমাত্রায় উৎপাদনমুখী রয়ে গেছে। সেই তুলনায় এই খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার উল্লেখযোগ্য নয়। মাত্রাতিরিক্ত আহরণের ফলে অনেক সময় জলজ বাস্তুতন্ত্র হুমকির মুখে পড়ে যায়। অথচ তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে বাজার চাহিদা ও জোগানের মধ্যে সমন্বয় স্থাপন, ফিশিং ভেসেলগুলোকে ট্র্যাকিং ব্যবস্থার আওতায় এনে তাদের কার্যক্রম তদারকি, স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির মাধ্যমে ভেসেলগুলোর মৎস্য আহরণের পরিমাণ কেন্দ্রীয় তথ্যভাকাণ্ডরে প্রেরণ ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণ করা গেলে এই খাতে নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের নজরদারি আরও জোরালো হবে। এতে করে অনিয়ন্ত্রিত মৎস্য আহরণ কমে গিয়ে মেরিন রিজার্ভের সুরক্ষা নিশ্চিত হবে। একই সঙ্গে নতুন প্রজন্মের প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ফিশিং ভেসেলগুলোর চলাচলকে আরও বেশি নিরাপদ ও ব্যয়সাশ্রয়ী করে তোলা সম্ভব।

গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে মাছ ধরার কাজে ব্যবহৃত একটি ট্রলার

আশার কথা হলো, মৎস্য আহরণ খাতে প্রযুক্তি ও নীতিগত চর্চায় কিছু পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। এ বিষয়ে কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক-

বিশ^জুড়ে মৎস্য আহরণ কার্যক্রম মনিটরিং করে অলাভজনক সংস্থা গ্লোবাল ফিশিং ওয়াচ। পরে এই সংগৃহীত তথ্য দিয়ে ভিজুয়ালাইজেশন তৈরি করে তারা, যা ৭২ ঘণ্টা পর ইন্টারনেটে প্রকাশ করা হয়। এই ভিজুয়ালাইজেশনে প্রবেশাধিকার উন্মুক্ত। অর্থাৎ যে কেউ এই তথ্য ব্যবহার করতে পারে। গ্লোবাল ফিশিং ওয়াচের এই উদ্যোগ অবৈধভাবে মৎস্য আহরণকারী ভেসেলগুলোর মালিক ও ক্যাপ্টেনদের আইনের আওতায় আনার ক্ষেত্রে বেশ সহায়ক ভূমিকা রাখছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভারতের উপকূলীয় ফিশিং জোনে কোনো পরিবর্তন আসে কিনা, সেই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা চালিয়েছে নাম্বারএইট অ্যানালিটিকস প্রাইভেট লিমিটেড। এছাড়া ২০১৮ সালে কেরালার ভয়াবহ বন্যা এবং ২০১৯ সালের সাইক্লোন ফণীর প্রভাবে কেরালা ও ওডিশা রাজ্যের কোস্টাল ভালনারেবিলিটি ইনডেক্সও পর্যালোচনা করেছে তারা। এসব গবেষণা ও পর্যালোচনালব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানটি তৈরি করেছে ওফিশ নামের একটি অ্যাপ, যেটি জেলেদের নিয়মিত আবহওয়ার হালনাগাদ তথ্য দেবে। এছাড়া এটি মৎস্য আহরণের ক্ষেত্রে অনেকটা গুগল ম্যাপের মতো কাজ করবে। একজন জেলে এই অ্যাপ ব্যবহার করে সহজেই তার নিকটবর্তী ফিশিং জোনগুলো সম্পর্কে জানতে পারবে। বর্তমানে ভারতের মহারাষ্ট্র ও কেরালার জেলেদের নিয়ে কাজ করছে নাম্বারএইট। তবে তাদের তৈরি অ্যাপটি ভারতের পাশাপাশি শ্রীলংকার জেলেদেরও উপকারে আসছে। দেশ দুটির সমুদ্রবিষয়ক ও বন্দর কর্তৃপক্ষগুলো যেন অতিরিক্ত ও নিয়ন্ত্রণহীন মৎস্য আহরণ মনিটরিং করতে পারে, সেই বিষয়েও কাজ করছে নাম্বারএইট।

ফিশিং খাতে তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা আরেকটি প্রতিষ্ঠান হলো গ্লোবাল ডায়ালগ অন সিফুড ট্রেসেবিলিটি। আন্তর্জাতিক বি-টু-বি প্রতিষ্ঠানটির কাজ হলো সিফুড ট্রেসেবিলিটি নিয়ে একটি ভলান্টারি ইন্ডাস্ট্রি স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করা। সাপ্লাই চেইনে সিফুডের সরবরাহ ট্র্যাক করে যেসব অটোমেটেড সিস্টেম, সেগুলোর মধ্যে সমন্বয় স্থাপনের ক্ষেত্রে কার্যকর একটি প্লাটফর্ম হিসেবে কাজ করে এই স্ট্যান্ডার্ড। সিস্টেমগুলো এই প্লাটফর্ম থেকে অভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে বিধায় সব সিস্টেমেই একই তথ্য পাওয়া যাবে। ফলে ক্রেতারা কোনো রকম বিভ্রান্তি ছাড়াই জানতে পারবে যে তাদের সিফুডগুলো কোথা থেকে আসছে এবং সেগুলো কতটা টেকসই উপায়ে আহরণ করা হয়েছে।

আহরণের পরিমাণের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ফিশিং পোর্ট হলো ম্যাসাচুসেটসের নিউ বেডফোর্ড। এই বন্দরকেন্দ্রিক যেসব ফিশিং বোট সাগরে মাছ ধরতে যায়, সেগুলোয় কিছু সেন্সর লাগানো থাকে। এসব সেন্সরের মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্য দিয়ে একটি মেরিন ডেটা ব্যাংক তৈরি করা হয়, যেখানে সাগরের তাপমাত্রা, পানির লবণাক্ততা ও অক্সিজেনের মাত্রা ইত্যাদি তথ্য জমা করা হয়। জেলেরা এই তথ্য ব্যবহার করে ধারণা লাভ করতে পারে যে, সাগরের কোন অঞ্চলে মাছের প্রাপ্যতা কেমন অথবা কোন অঞ্চলে কোন প্রজাতির মাছ বেশি পাওয়া যায়। এতে করে যে সুবিধা হবে সেটি হলো, নির্দিষ্ট প্রজাতির মৎস্য আহরণকারীরা সহজেই তাদের অঞ্চল বাছাই করতে পারবে এবং অনৈচ্ছিকভাবে অন্য প্রজাতির মাছ আহরণ (বাইক্যাচ) এড়িয়ে চলতে পারবে।

ভারতের মেরিন প্রডাক্টস এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (এমপিইপিএ) এরই মধ্যে রপ্তানিমুখী অ্যাকোয়াকালচার ফার্মগুলোকে নিয়ে একটি জিপিএস-ভিত্তিক তথ্যভা-ার গড়ে তোলার একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যার মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে তথ্য ও সেগুলোর মান নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।

কেন এই পরিবর্তন?

● বর্তমানে বিশ্বে যতগুলো ফিশিং ভেসেল রয়েছে, তার খুবই নগণ্য অংশ উন্নত তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে। বেশির ভাগ ভেসেলই এই বিষয়টি মনিটর করে না যে তারা কী ধরছে।

● যারা মনিটরিং ডেটা সংগ্রহ করে, তাদের অধিকাংশই আবার পেপারওয়ার্ক বেশি করে। অর্থাৎ পর্যবেক্ষণের তথ্যগুলো ম্যানুয়ালি নথিভুক্ত করা হয়। পরে এই তথ্য স্প্রেডশিটে লিপিবদ্ধ করা হয় এবং তা বিশ্লেষণের জন্য প্রস্তুত করা হয়। এই কাজে কয়েক মাস পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে। আবার এতে ভুল হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে অনেক বেশি।

● স্যাটেলাইট ও সেলুলার নেটওয়ার্কভিত্তিক তথ্যপ্রবাহকে কাজে লাগিয়ে এই ধরনের সমস্যা দূর করা সম্ভব।

সমুদ্র অর্থনীতির এই যুগে মৎস্য আহরণ গুরুত্বপূর্ণ একটি অর্থনৈতিক কার্যক্রমে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে বৈশ্বিক জনসংখ্যার অন্তত ১০ শতাংশ মানুষ সিফুডের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছে। এই খাতে যে অব্যবস্থাপনাগুলো রয়েছে, সেগুলো দূর করতে পারলে কর্মসংস্থান যেমন বাড়বে, তেমনই বিশ^ অর্থনীতিতে যোগ হবে ৮ হাজার কোটি ডলারের বেশি। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর ফিশিং ভেসেল এই অব্যবস্থাপনা দূর করতে পারে। সেটি কীভাবে, তা এক নজরে দেখে নেওয়া যাকÑ

মৎস্য আহরণে শীর্ষে রয়েছে চীন। দীর্ঘদিন ধরে দেশটি ফিশিং ভেসেলগুলোর জন্য জ¦ালানি ভর্তুকি দিয়ে আসছে। তবে মাত্রাতিরিক্ত আহরণ বন্ধে সম্প্রতি চীনের দুটি প্রদেশ এই ভর্তুকি বন্ধ করে দিয়েছে

তথ্য ও প্রযুক্তির উপযোগিতা

সক্ষমতা ও কার্যদক্ষতা বৃদ্ধি: গবেষকরা দেখেছেন, গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস), ফিশফাইন্ডার, ইকোসাউন্ডার, অ্যাকুইস্টিক ক্যামেরার মতো আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে ফিশিং ভেসেলগুলোর মাছ ধরার সক্ষমতা প্রতি বছর গড়ে অন্তত ২ শতাংশ বেড়ে যায়।

বিশ^ব্যাপী সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের ক্ষেত্রে বড় দুটি চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হয়। এর মধ্যে একটি হলো জলবায়ু পরিবর্তন। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, সামুদ্রিক দূষণ ইত্যাদি কারণে সাগরের পানির গুণগত মান ও পরিবেশে পরিবর্তন আসে। সামুদ্রিক প্রতিটি প্রজাতির টিকে থাকা ও বংশবৃদ্ধির জন্য নির্দিষ্ট জলজ পরিবেশ থাকা বাঞ্ছনীয়। এই পরিবেশের কোনোরূপ পরিবর্তন ঘটলে প্রজাতিগুলো সেই জায়গা থেকে অন্যত্র সরে যায়। ফলে যে অঞ্চলে বছরখানেক আগেও জেলেরা প্রচুর পরিমাণে মাছ পেত, এখন তা না-ও পেতে পারে। ইলেকট্রনিক মনিটরিং সিস্টেম, কম্পিউটার ভিশন টেকনোলজি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদির প্রয়োগ ঘটিয়ে জলজ পরিবেশের যেকোনো পরিবর্তন সম্পর্কে জানা এবং সেই অনুযায়ী মৎস্য আহরণের কার্যকর পরিকল্পনা সাজানো সম্ভব।

মৎস্যজীবীদের আরেকটি বড় যে সমস্যার সঙ্গে লড়াই করতে হয়, সেটি হলো সঠিক বাজার ধরতে না পারা। প্রযুক্তি যে কেবল তাদের মাছের প্রাচুর্যতা সম্পর্কেই তথ্য দেয়, তা নয়। বরং কোন প্রজাতির মাছের চাহিদা কোথায় বেশি, সেই সম্পর্কে জানতেও সহায়তা করে। এই গুরুত্ব উপলব্ধি করে অনেক দেশেই মৎস্য আহরণের দৈনিক পরিমাণ ও বাজারদর নিয়ে কেন্দ্রীয় তথ্যভা-ার গড়ে তোলা হয়েছে।

মৎস্যজীবীদের সুরক্ষা: আগেই বলা হয়েছে, সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেদের সুরক্ষার বিষয়টি এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত করা যায়নি। বিভিন্ন কারণে প্রতি বছর হাজার হাজার জেলেকে প্রাণ হারাতে হয় সাগরে গিয়ে। কখনো উত্তাল সাগর, কখনো জলদস্যু তাদের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সেসব অঞ্চলে এই ধরনের বিপদের ঝুঁকি বেশি, যেখানকার ফিশিং ভেসেলগুলোয় উন্নত তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের চর্চা নেই।

একটা সময় ছিল যখন মানুষ প্রকৃতির কাছে পুরোপুরি অসহায় ছিল। তবে প্রযুক্তির কল্যাণে এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে। প্রকৃতির বিরূপ আচরণ সম্পূর্ণরূপে প্রতিহত করার সক্ষমতা এখনো অর্জন করা সম্ভব হয়নি। তবে আমরা এখন যেটা করতে পারি সেটি হলোÑপ্রাকৃতিক বিভিন্ন দুর্যোগের বিষয়ে আগে থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করা। প্রযুক্তির কল্যাণে সামুদ্রিক নিম্ন চাপ, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি বিষয়ে পূর্বসতর্কতা প্রদান করা সম্ভব হয়। আর ফিশিং ভেসেলগুলোও সেই অনুযায়ী অগ্রিম নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। কোনো ভেসেল সমুদ্রযাত্রার অপেক্ষায় থাকলে সেটি কয়েক দিনের জন্য যাত্রা বাতিল করতে পারে। আর কোনো ভেসেল আগে থেকেই সাগরে অবস্থান করলে সেটি উন্নত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা বাহিনীর সাহায্য নিতে পারে।

সাগরজীবীদের কাছে সবসময়ই আতঙ্কের এক নাম হলো জলদস্যুতা। বাণিজ্যিক জাহাজের পাশাপাশি ফিশিং ভেসেলগুলোকেও মাঝেমধ্যে জলদস্যুদের কবলে পড়তে হয়। এমন পরিস্থিতিতে জেলেদের অপহরণ অথবা প্রাণ হারানোর ঝুঁকি কমাতে পারে উন্নত তথ্যপ্রযুক্তি। এর মাধ্যমে জেলেরা দ্রুত কোস্ট গার্ড অথবা নৌবাহিনীর কাছে সাহায্যবার্তা পাঠাতে পারে। এছাড়া ভেসেলগুলো অটোমেটিক আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম (এআইএস) ব্যবহার করলে জরুরি পরিস্থিতিতে তাদের অবস্থান শনাক্ত করা বাহিনীগুলোর জন্য সহজ হয়।

মৎস্যজীবীদের সুরক্ষার বিষয়ে গত কয়েক বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (আইএমও)। সংস্থাটি যেসব আন্তর্জাতিক বিধিবিধান প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে, সেগুলো সাগরে ‘ইলিগ্যাল, আনরিপোর্টেড অ্যান্ড আনরেগুলেটেড (আইইউইউ)’ অর্থাৎ অবৈধ, অনবগত ও অনিয়ন্ত্রিত মৎস্য আহরণ বন্ধেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

আইএমওর এমনই একটি উদ্যোগ হলো কেপটাউন এগ্রিমেন্ট। ২০১২ সালে গৃহীত কেপটাউন এগ্রিমেন্টের মূল উদ্দেশ্য হলো ফিশিং বোটগুলোর ওপর ফ্ল্যাগ স্টেট, বন্দর ও উপকূলীয় দেশগুলোর নিয়ন্ত্রণ আরও সুসংহত করা। এই চুক্তিতে যেসব শর্ত রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ফিশিং বোটগুলোকে সাগরে চলাচলের উপযোগী হওয়া, সহায়ক মেশিনারি ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম স্থাপন করা এবং জীবন বাঁচানো, যোগাযোগ ও অগ্নিনির্বাপণের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা।

অবশ্য এই চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য কিছু পূর্বশর্ত রয়েছে। অন্তত ২২টি রাষ্ট্র এবং ৩ হাজার ৬০০ ফিশিং ভেসেল (অন্তত ২৪ মিটার দৈর্ঘ্যরে) সমর্থন দেওয়ার ১২ মাস পর চুক্তিটি কার্যকর হবে। কেপটাউন চুক্তি যেন দ্রুত কার্যকর হয়, সেই লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে আইএমও।

মেরিন রিজার্ভের সুরক্ষা: মানুষের প্রোটিন চাহিদার বড় একটি অংশ পূরণ হয় সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ দিয়ে। স্বাভাবিকভাবেই বৈশি^ক জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে এই সম্পদের ওপর চাপ বাড়বে। এছাড়া সিফুডে থাকে বিভিন্ন খনিজ পুষ্টিগুণ। এ কারণে বিশ^জুড়ে সিফুডের চাহিদা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে পর্যটনপ্রবণ অঞ্চলগুলোতে এর চাহিদা অত্যধিক।

এই বাড়তি চাহিদা উপকূলীয় অর্থনীতিকে গতিশীল করে বটে, তবে এর একটি নেতিবাচক প্রভাবও রয়েছে। মাত্রাতিরিক্ত আহরণের ফলে অনেক অঞ্চলেই সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের রিজার্ভ হুমকির মুখে পড়েছে।

বাজার চাহিদা বেশি থাকায় অনেক সময় জেলেরা নিয়ন্ত্রণহীন মাত্রায় মৎস্য আহরণ করে। আবার মাছ ধরা নিষিদ্ধ এমন অঞ্চলেও লুকিয়ে লুকিয়ে কার্যক্রম চালাতে দেখা যায় তাদের। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এ দুটি প্রবণতাই প্রতিরোধ করা সম্ভব। ভেসেলগুলোর আহরিত মৎস্যের পরিমাণ নিয়ে একটি স্বয়ংক্রিয় তথ্যভা-ার গড়ে তুলতে পারলে অনিয়ন্ত্রিত আহরণের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ আরও জোরালো হবে। এছাড়া সব ভেসেলে এআইএস নিশ্চিত করতে পারলে সেগুলো আর নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি এড়িয়ে সংরক্ষিত অঞ্চলে মাছ ধরতে পারবে না।

আরেকটি উদ্বেগজনক বিষয় হলো বাইক্যাচ। অনেক সময় জেলেদের জালে এমন প্রজাতির মাছ ও সামুদ্রিক জীব ধরা পড়ে, যেগুলো হয় জেলেরা ধরতে চায় না, অথবা সেগুলো ধরার অনুমতি নেই। ফলে সেগুলো আবার ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় তারা। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জালে আটকা পড়া সামুদ্রিক জীবগুলো আঘাতপ্রাপ্ত হয় অথবা সেগুলো মারা যায়। এতে করে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়।

একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। হয়তো চিংড়ি আহরণকারীরা এমন জায়গায় জাল ফেলল, যেখানে চিংড়ির বিচরণ কম কিন্তু অন্যান্য প্রজাতির মাছের প্রাচুর্য বেশি। সেক্ষেত্রে অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও তাদের জালে অন্যান্য প্রজাতির মাছ বেশি ধরা পড়বে।

মাছের প্রজাতির আচরণগত তথ্য অর্থাৎ কোন প্রজাতির মাছ ও সামুদ্রিক জীব কোন অঞ্চলে বেশি বিচরণ করে, জলজ পরিবেশভেদে সেগুলোর প্রাপ্যতা কোথায় কেমন, সেই বিষয়গুলো জানা থাকলে এই বাইক্যাচ বা অনিচ্ছাকৃত মৎস্য আহরণ প্রতিরোধ করা সম্ভব। সমৃদ্ধ মেরিন ডেটা এক্ষেত্রে কতটা সহায়ক হতে পারে, সেই বিষয়টি বলাই বাহুল্য।

বাজারের গতিশীলতার সুরক্ষা: বিশ্বায়নের এই যুগে কোনো পণ্যের বাজার আর একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলকেন্দ্রিক নেই। বরং এক অঞ্চলে উৎপাদিত পণ্য চলে যাচ্ছে অন্যত্র। মৎস্যসম্পদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আহরিত মাছ চলে যাচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকার গ্রাহকদের খাবারের প্লেটে। আবার সেখানকার প্রক্রিয়াজাত মাছ পাওয়া যাচ্ছে এশিয়া-আফ্রিকার বাজারে।

সিফুডের বৈশ্বিক বাজারে সাপ্লাই চেইনের কার্যদক্ষতা নিশ্চিত করতে বড় অবদান রাখবে তথ্যপ্রবাহ। কখন-কোথায়-কোন মাছের উৎপাদন বেশি হচ্ছে, সেই তথ্য সময়মতো পেয়ে গেলে বাজার সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি গ্রহণ করতে সক্ষম হবে। ফলে নিয়মিত উৎসে কোনো কারণে মাছের সরবরাহ কমে গেলে বিকল্প উৎস সন্ধানে পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যাবে।

ক্রেতাদের পাশাপাশি মৎস্য উৎপাদনকারীরাও এই তথ্যপ্রবাহের উপকারভোগী হবে। এমন অনেক পরিস্থিতি তৈরি হয় যখন একটি অঞ্চলে মাছের সরবরাহ এত বেড়ে যায় যে, সেখানে দাম অনেকটা পড়ে যায়। আবার অন্য কোনো অঞ্চলে সরবরাহ কম থাকায় মাছের মূল্য থাকে অনেক চড়া। এমন পরিস্থিতিতে উৎপাদনকারীরা বাজার পরিবর্তনের মাধ্যমে সরবরাহ ও মূল্যের ভারসাম্য রক্ষায় সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।

বিশ্বে ফিশিং ভেসেল রয়েছে প্রায় ৪৬ লাখ। এর বেশির ভাগই ছোট আকারের

তথ্যের বাইরে থাকবে না কেউই

অটোমেটিক ইনফরমেশন সিস্টেমের (এআইএস) মাধ্যমে ফিশিং ভেসেলের অবস্থানগত তথ্য সহজেই জানা সম্ভব। কিন্তু যেসব ভেসেল এআইএস ব্যবহার করে না, সেগুলো কি নজরদারির বাইরে থেকে যাবে? এমনটি হলে তো অবৈধ মৎস্য আহরণ নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।

গ্লোবাল ফিশিং ওয়াচ জানিয়েছে, তারা এমন একটি ম্যাপ তৈরি করেছে, যেখানে এআইএসের বাইরে থাকা ভেসেলগুলোর অবস্থানও স্পষ্টভাবে ফুটে উঠবে। এই ধরনের ভেসেলগুলোকে তারা বলছে ‘আনডিটেক্টেড ডার্ক ফ্লিটস’। এই ম্যাপ সবাই ব্যবহার করতে পারবে।

এই ম্যাপ তৈরির ক্ষেত্রে গ্লোবাল ফিশিং ওয়াচ ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির স্যাটেলাইট সেন্টিনেল-ওয়ান থেকে প্রাপ্ত সিনথেটিক অ্যাপারচার রাডার (এসএআর) ডেটা ব্যবহার করেছে। মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদমের মাধ্যমে এই তথ্য বিশ্লেষণ করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফিশিং ভেসেলগুলোর অবস্থান ট্র্যাক করা যায়।

সেন্টিনেল-ওয়ান রাডার থেকে প্রাপ্ত ইমেজের আর্কাইভ পর্যালোচনা করে গ্লোবাল ফিশিং ওয়াচ ২ কোটি ডেটা পয়েন্টকে আলাদাভাবে শনাক্ত করেছে, যেগুলো ৩০ ফুটের বেশি দীর্ঘ সমুদ্রগামী ভেসেলগুলোর চলাচল নির্দেশ করে। এর পাশাপাশি সংস্থাটি এআইএস ব্যবহার করা ভেসেলগুলো থেকে পাঠানো ১০ হাজার কোটি জিপিএস পজিশন ডেটা পয়েন্টের তথ্যও বিশ্লেষণ করেছে। এই দুই তথ্য পর্যালোচনা করে গ্লোবাল ফিশিং ওয়াচ সেই সব জাহাজকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে, যেগুলো এআইএস ট্র্যাকিংয়ের বাইরে গিয়ে নিজেদের আড়াল করার চেষ্টা চালিয়েছে।

অবৈধ মৎস্য আহরণ প্রতিরোধ

অবৈধ ও মাত্রাতিরিক্ত মৎস্য আহরণ এখন বেশির ভাগ দেশের জন্যই মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সমস্যা নিরসনে দেশগুলো এরই মধ্যে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু করেছে।

ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানকে নিয়ে গঠিত কোয়াড্রিল্যাটারাল সিকিউরিটি এজেন্সি (কোয়াড) সম্প্রতি একটি যৌথ স্যাটেলাইট-ভিত্তিক ট্র্যাকিং সিস্টেম চালুর পরিকল্পনার কথা ঘোষণা দিয়েছে, যেটি অবৈধ মৎস্য আহরণ বন্ধে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।

এদিকে বিশ্বের শীর্ষ মৎস্য উৎপাদনকারী দেশ চীনের মেরিন রিজার্ভের সুরক্ষা নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে। এ কারণে দেশটির দুটি প্রদেশ সম্প্রতি অতিরিক্ত আহরণ বন্ধে নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এই দুটি প্রদেশ হলো শ্যানডং ও ফুজিয়ান। তারা ফিশিং ভেসেলগুলোকে জ্বালানি ভর্তুকি প্রদানের পরিবর্তে ‘ফিশারি স্টুয়ার্ডশিপ’ ভর্তুকি প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে।

গত দেড় দশক ধরে চীনের উপকূলীয় মৎস্য আহরণকারীরা জ্বালানিতে ভর্তুকি সুবিধা পেয়ে আসছেন। এই ভর্তুকিকে চীনের মৎস্য আহরণ খাতের জন্য প্রাণ সঞ্চারকারী উদ্যোগ দেখা হচ্ছিল। কিন্তু এর কিছু অসুবিধাও রয়েছে। যেহেতু এই ভর্তুকি মৎস্য আহরণকারী সব নৌযানের জন্যই প্রযোজ্য, সেহেতু অতিরিক্ত আহরণকারীরাও সুবিধাটি পেয়ে আসছে। এর ফলে মৎস্যসম্পদের সুরক্ষা হুমকির মুখে পড়ে যাচ্ছে।

ফিশারি স্টুয়ার্ডশিপ ভর্তুকি দুটি ক্ষেত্রে সমানভাবে দেওয়া হবে। প্রথমত, যারা মৎস্য আহরণে নিষেধাজ্ঞার সময়ে আইন মেনে চলবে, তারা এই ভর্তুকি পাবে। দ্বিতীয়ত, মৎস্য আহরণের ক্ষেত্রে যেসব দায়িত্ব ও কর্তব্যবিধি রয়েছে, সেগুলো প্রতিপালন করলে ভেসেলগুলো এই ভর্তুকির জন্য বিবেচিত হবে।

বাংলাদেশে এখনো সনাতন পদ্ধতিনির্ভর অনেক ছোট নৌযান ঝুঁকি নিয়ে সাগরে মাছ ধরতে যায়। এসব নৌযানের নিরাপত্তা বাড়াতে আধুনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটানো দরকার

এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ

বাংলাদেশের দক্ষিণে অবস্থিত বঙ্গোপসাগর জৈববৈচিত্র্যে পূর্ণ একটি বিশাল জলাধার। প্রবাল, মৎস্য প্রজনন অঞ্চল ও ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল এই বৈচিত্র্য আরও বাড়িয়েছে। বঙ্গোপসাগর বিশ্বের ৬৪টি বৃহৎ সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানের অন্যতম। বিভিন্ন প্রজাতির কচ্ছপ, তিমি, ডলফিন, ব্যারাকুডা, স্কিপজ্যাক টুনা, ইয়েলোফিন টুনা ইত্যাদির আবাসস্থল এটি। বঙ্গোপসাগরে পাওয়া যায় প্রায় ৪৫৭ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ।

বাংলাদেশের লোনাপানির মৎস্যসম্পদের চাহিদা রয়েছে পুরো বিশ্বেই। বিশেষ করে এ দেশের চিংড়ির কদর রয়েছে সর্বত্র। বাংলাদেশে মোট ৫৬টি প্রজাতির চিংড়ি শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৭টি প্রজাতিই লোনাপানির। এছাড়া ১২টি কম লবণাক্ত পানি ও সাতটি প্রজাতি স্বাদুপানির বাসিন্দা।

অসামরিক বিভিন্ন সরকারি সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে দেশের সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের সুরক্ষায় অতন্দ্র প্রহরীর মতো কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড। এই দুই বাহিনীর নিয়মিত ও কার্যকর অপারেশনের কারণে বাংলাদেশের জাতীয় সম্পদ ইলিশসহ অন্যান্য মাছ বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে, যা দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।

গত এক দশকে দেশে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে ৮০ শতাংশের বেশি। বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ইলিশ আহরিত হচ্ছে, যা দেশের জিডিপিতে প্রায় ১ শতাংশ অবদান রাখছে। ২০০১ সাল থেকে মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান ও অপারেশন জাটকার মতো বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে আসছে নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ড।

বর্তমানে বাংলাদেশের ৩ দশমিক ৮ শতাংশ সমুদ্র অঞ্চল মেরিন প্রটেকটেড এরিয়া (এমপিএ) ঘোষিত। এই এলাকায় নিরবচ্ছিন্ন প্যাট্রোলিংয়ের মাধ্যমে সমুদ্রসম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে কাজ করে যাচ্ছে বাহিনীগুলো। মেরিন রিজার্ভের সুরক্ষায় বাংলাদেশের গৃহীত পদক্ষেপ এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসিত হয়েছে ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

বাংলাদেশের বিশাল সমুদ্রসীমায় মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা, আহরণের নীতিমালা বাস্তবায়ন, সামুদ্রিক পরিবেশ সংরক্ষণ, বাণিজ্যিক মৎস্য আহরণকারী ট্রলার ও অন্যান্য যান্ত্রিক নৌযান নিয়ন্ত্রণ, মৎস্যজীবীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি কার্যক্রম বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে মৎস্য অধিদপ্তরের অধীনস্থ সামুদ্রিক মৎস্য দপ্তর চট্টগ্রাম।

বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ট্রলার ক্যাটাগরির একটি আধুনিক মৎস্য আহরণকারী জাহাজ। পারটেক্স গ্রুপের মালিকানাধীন জাহাজটি থাইল্যান্ডে তৈরি। এতে রয়েছে অত্যাধুনিক সোনার সিস্টেম

যেসব মাছ ধরার নৌযান সাগর থেকে মাছ ধরে ফিরে আসে, তাদের আহরণের পরিমাণগত তথ্য এই দপ্তরের কাছে জমা দিতে হয়। এই তথ্য সংকলন ও বিশ্লেষণ করে সামুদ্রিক মৎস্য দপ্তর বাণিজ্যিক ট্রলার কর্তৃক বার্ষিক মৎস্য আহরণের পরিমাণ নিরূপণ করে থাকে। সংস্থাটির দেওয়া তথ্য অনুসারে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বঙ্গোপসাগর থেকে মৎস্য আহরণ করা হয়েছে মোট ৬ লাখ ৩৭ হাজার ৪৭৬ টন। পাঁচ বছরের ব্যবধানে ২০২০-২১ অর্থবছরে এই পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৫ হাজার ৮৭১ টন।

যেকোনো সম্পদের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন এই সম্পদের প্রাপ্যতা ও আচরণগত বিষয়ে সঠিক তথ্য জানা। মৎস্য সম্পদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। দেশের সমুদ্রসীমার কোন অংশে কোন প্রজাতির মাছের বিচরণ বেশি, নিয়মিত আহরণের ফলে কোনো নির্দিষ্ট প্রজাতির মাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে কিনা, প্রজাতিগুলোর প্রজনন মৌসুম কখন, কতটা গভীর পানিতে সেগুলো ডিম ছাড়ে, ডিম থেকে পোনা উৎপাদনে পানির উষ্ণতাসহ অন্যান্য পরিবেশ কেমন থাকা প্রয়োজন ইত্যাদি বিষয় জানা দরকার। এই তথ্য যেমন মৎস্য আহরণকে সর্বোচ্চ কার্যদক্ষ ও টেকসই করে তোলে, তেমনই মেরিন রিজার্ভের সুরক্ষাতেও কার্যকর ভূমিকা রাখে।

বাংলাদেশ এই বিষয়টিকে মাথায় রেখে সমুদ্র গবেষণার ওপর জোর দিয়েছে। এই লক্ষ্যে সংগ্রহ করা হয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মেরিন সার্ভে ভেসেল। এই ভেসেলে রয়েছে মৎস্য ও সমুদ্র-সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে গবেষণা ও জরিপকার্য পরিচালনার জন্য হাই-টেক সব সরঞ্জাম। দেশের ৫ লাখের বেশি উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জীবিকা প্রত্যক্ষভাবে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের ওপর নির্ভরশীল। এই সম্পদের বিষয়ে সঠিক তথ্য তুলে ধরার মাধ্যমে সার্ভে ভেসেল মৎস্য সুরক্ষায় সুব্যবস্থাপনা, টেকসই আহরণ ও কার্যদক্ষতা বৃদ্ধিতে তথা উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে অসামান্য ভূমিকা রাখবে।

তবে বাংলাদেশকে একটি জায়গায় এখনো উন্নতি করতে হবে। গভীর সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া ট্রলারগুলোয় অত্যাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সরঞ্জাম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এর ফলে যেকোনো বিপদের সময় ট্রলারগুলো দ্রুত উদ্ধারকারী বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে। এছাড়া প্রতিটি ট্রলারে কিছু মেরিন ডেটা সংগ্রহের ব্যবস্থা করা গেলে সেগুলো নিয়ে একটি কার্যকর তথ্যভা-ার গড়ে তোলা সম্ভব। এই তথ্য নিয়মিত হালনাগাদ হওয়ার ফলে কখন সাগরের পরিস্থিতি কেমন, সেই বিষয়ে অন্যান্য ভেসেলগুলোও তাৎক্ষণিক তথ্য জানার সুযোগ পাবে।

আমাদের প্রতিবেশী ভারত, শ্রীলংকাসহ এশিয়ার অনেক দেশেই এখন সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের ক্ষেত্রে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন ফিশিং ভেসেল ব্যবহার করা হচ্ছে। বাজার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে গেলে আমাদেরও এই খাতের উন্নয়ন করতে হবে। আশার কথা হলো, বাংলাদেশের সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ খাতে এরই মধ্যে কিছু অত্যাধুনিক নৌযান যুক্ত হয়েছে, যেগুলোয় উন্নত যোগাযোগ ও নেভিগেশন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে।

উনিশ শতকে সাগরে মাছ ধরায় ব্যস্ত একটি পালতোলা ব্রিটিশ ট্রলার। উইলিয়াম এ. নেলের আঁকা ছবি

উপসংহার

খাদ্যনিরাপত্তার জন্য মৎস্যসম্পদের সুরক্ষা অত্যন্ত জরুরি। যেহেতু বিশ্বে মাছের জোগানের বড় একটি অংশ আসে সামুদ্রিক উৎস থেকে, সেহেতু এর টেকসই ভবিষ্যতের কথা আমাদেরই ভাবতে হবে। এছাড়া বিশ্বের সব প্রান্তের মানুষ যেন আমিষের অন্যতম প্রধান এই উৎস থেকে বঞ্চিত না হয়, সেই বিষয়টির দিকেও নজর দিতে হবে।

ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে যেন অতিরিক্ত মাত্রায় মৎস্য আহরণ না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। সংরক্ষিত অঞ্চলে এবং নিষেধাজ্ঞার সময়ে মাছ ধরা বন্ধ করতে নিয়মিত তদারকি কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। বাজার চাহিদা অনুযায়ী মাছের সরবরাহ যেন সুষম হয়, সেই দিকে খেয়াল রাখতে হবে। আর এসব কাজে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে যে বিষয়টি, সেটি হলো সমৃদ্ধ তথ্যের অবাধ প্রবাহ।

বর্তমান যুগে প্রায় সব শিল্প খাতই প্রযুক্তির উৎকর্ষে ভর করে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় মৎস্য আহরণ খাত পিছিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না। তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রযাত্রার সহযাত্রী হয়ে এই শিল্পকেও উজ্জ্বল ও টেকসই ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যেতে হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here