বৈদেশিক বাণিজ্য সামাল দিতে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোই শেষ কথা নয়

দেশের আমদানি-রপ্তানির প্রধান গেটওয়ে চট্টগ্রাম বন্দর। ছবি: বন্দর বার্তা

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বাংলাদেশের চলতি অর্থবছরের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ৫১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে পণ্য রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ৪৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার, আর সেবা খাতের লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। পণ্য রপ্তানির তালিকায় শীর্ষে রয়েছে তৈরি পোশাক। আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি পণ্যের প্রায় পুরোটাই পরিবাহিত হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। ফলে ধারাবাহিকভাবে পণ্য রপ্তানি বৃদ্ধির বিষয়টি সামনে আসলে, উঠে আসে বন্দরের সক্ষমতার বিষয়টি।

তৈরি পোশাক খাতের সংগঠন বিজিএমইএ ও অন্যান্য বাণিজ্য সংগঠনগুলো রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের আলোচনায় সবসময় বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে। কারণ, ধারাবাহিক সক্ষমতা বৃদ্ধি একটি দেশের প্রধান বন্দরের জন্য অপরিহার্য বিষয়। কিন্তু শুধুমাত্র চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথকে সহজ করবে কিনা, এ বিষয়ে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।

একটি পরিসংখ্যানে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। গত বছর (২০২১) চট্টগ্রাম বন্দর ৩২ লাখ টিইইউস (প্রতিটি বিশ ফুট দৈর্ঘ্যের কনটেইনার) কনটেইনার পরিবহন করেছে। এ সংখ্যার অর্ধেক আমদানি পণ্যবাহী কনটেইনার দেশে এসেছে এবং সমপরিমাণ রপ্তানি পণ্যবাহী ও খালি কনটেইনার চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে বিশ্বের অন্যান্য বন্দরে পরিবাহিত হয়েছে। অর্থ্যাৎ যে পরিমাণ কনটেইনার দেশে এসেছে, একই পরিমাণ কনটেইনার দেশ থেকে বর্হিবিশ্বের বন্দরে পরিবাহিত হয়েছে। এখানে যে বিষয়টি উল্লেখযোগ্য সেটি হলো, দেশ থেকে চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে পরিবাহিত হওয়া কনটেইনারের অর্ধেক পণ্য বোঝাই করে জাহাজীকরণ হয়েছে, বাকী অর্ধেক কোনো পণ্য না নিয়েই অর্থ্যাৎ খালি জাহাজীকরণ হয়েছে। কারণ এসব কনটেইনারে বোঝাইয়ের জন্য রপ্তানি পণ্য আমাদের ছিলোনা। ফলে বিদ্যমান সক্ষমতায় রপ্তানি পণ্য পরিবহনের সুযোগ রয়েছে। যা, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ দীর্ঘদিন বলে আসছে। 

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পণ্য পরিবহনে চট্টগ্রাম বন্দর রেগুলেটরি অথরিটি হিসেবে কাজ করে বলে সবসময় চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতার বৃদ্ধির বিষয়টি সামনে আসে। এ সাপ্লাই চেইনে বন্দরের সাথে জড়িয়ে আছে অনেকগুলো সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান। কাস্টমস, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট, শিপিং এজেন্ট, কোয়ারেন্টাইন কর্তৃপক্ষ, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার ও বেসরকারি আইসিডিসহ অনেকগুলো সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান এ সাপ্লাই চেইনের অংশ। এ ছাড়া হিন্টারল্যান্ড কানেকটিভিটি ও লজিস্টিক্স সক্ষমতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

দেশে এখন ১৯টি বেসরকারি আইসিডি রয়েছে। যেগুলো রপ্তানি পণ্যের প্রায় শতভাগ ও ৩৭টি আমদানি পণ্য হ্যান্ডলিং করে থাকে। ফলে ঠিক সময়ে পণ্য জাহাজীকরণে এসব আইসিডিগুলোর সক্ষমতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গত বছরের ২৬ এপ্রিল পোশাক খাতের সংগঠন বিকেএমইএ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর কাছে পাঠানো এক চিঠিতে বেসরকারি আইসিডিগুলোর সক্ষমতা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে। সংগঠনটি বলেছিল, বেসরকারি আইসিডিতে পর্যাপ্ত জায়গা ও যন্ত্রপাতির অভাবে পণ্য খালাস কার্যক্রম ব্যাহত হয়। বন্দর থেকে দুই দিনের মধ্যে পণ্য খালাস করা গেলেও আইসিডি থেকে ছয় থেকে সাতদিন সময় লাগে।

উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে বন্দর থেকে পণ্য খালাসের প্রথা চালু নেই। এসব দেশে বন্দর থেকে পণ্যবাহী কনটেইনার ওয়্যারহাউজ বা আমদানিকারকের ইয়ার্ডে সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয়। শুল্কায়ন ও অন্যান্য দাপ্তরিক কাজ সেখানেই সম্পাদন করা হয়। ফলে বন্দরের অভ্যন্তরে কনটেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিংকে সমস্যার মুখে পড়তে হয়না। প্রায় ৭০ ভাগ আমদানি পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ড থেকেই খালাস হয়ে থাকে। এলসিএল কনটেইনারের পণ্য আনস্টাফিং (কনটেইনার থেকে নামিয়ে শেডে সংরক্ষণ) খালাস প্রক্রিয়াকে দীর্ঘায়িত করে। পণ্যের শুল্কায়ন ও কায়িক পরীক্ষাও পণ্য খালাস কার্যক্রমের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এজন্য বন্দরের কার্যক্রম গতিশীল করতে পণ্য খালাসের কার্যক্রম বন্দরের বাইরে নিয়ে যাওয়া ও বেসরকারি আইসিডির সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়টিও আলোচিত হচ্ছে দীর্ঘদিন।

চট্টগ্রাম বন্দরে হ্যান্ডলিংকৃত পণ্যের বেশিরভাগ পণ্যই ঢাকামুখী। লজিস্টিকস সক্ষমতা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা পণ্য পরিবহনকে প্রভাবিত করে। এ ছাড়া আইসিডিগুলো থেকে পণ্য পরিবহনও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গত বছরের নভেম্বরের প্রথম ১৫দিন সংবাদমাধ্যমগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ শিরোনাম ছিল পরিবহন ধর্মঘটে রপ্তানি পণ্য পরিবহন স্থবির হয়ে যাওয়ার বিষয়টি। নভেম্বরের ১০ তারিখ ডেইলি স্টার অনলাইনের বাংলা সংস্করণের একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘পরিবহন ধর্মঘট: ১৯টি ডিপোতে ৯ হাজার ৫০০ পণ্যবাহী কনটেইনারের স্তুপ’। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে ডাকা এ ধর্মঘটের কারণে পণ্য পরিবহন ব্যাহত হয়েছে মারাত্মকভাবে। এ সময় আইসিডি থেকে পণ্যবাহী কনটেইনার বন্দরে না আসায়, রপ্তানি পণ্য না নিয়েই জাহাজ বন্দর জেটি ত্যাগ করার উদাহরণ তৈরি হয়েছে। ডেইলি স্টারের সংবাদেও এটি উঠে এসেছে।  এ ছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন দাবিতে ডাকা পরিবহন ধর্মঘটের কারণে পণ্য পরিবহন ব্যাহত হওয়ার বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে বেশ গুরুত্বের সাথে। ধর্মঘট আমদানি-রপ্তানি পরিবহনকে যেমন দীর্ঘায়িত করেছে, তেমনি ধর্মঘটের ধাক্কা সামলে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে বন্দর কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে।

গত মাসে উদযাপিত হয়েছে পবিত্র ঈদ-উল ফিতর। এ সময় পত্রিকার পাতায় আবারও কনটেইনার স্তুপের বিষয়টি সংবাদের বিষয় হয়ে উঠে। ঈদের ছুটির কারণে বন্দর থেকে পণ্য খালাস অস্বাভাবিক হারে কমতে থাকে। স্বাভাবিক সময়ে পণ্যবাহী কনটেইনারের এ সংখ্যা তিন থেকে চার হাজারের মধ্যে থাকলেও, ঈদের ছুটির সময় এ সংখ্যা এক হাজারের নিচে নেমে আসে। বন্দরের ইয়ার্ডে কনটেইনারের সংখ্যা বাড়তে থাকে, দীর্ঘায়িত হতে থাকে বর্হিনোঙরে অপেক্ষমান জাহাজের সারি। অথচ পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে এমন আশঙ্কায় বন্দর কর্তৃপক্ষ ঈদের ছুটির সময় পুরোদমে বন্দরের কার্যক্রম চালু থাকবে বলে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানালেও এর ফলাফল খুব সুখকর হয়নি। পণ্য খালাস ও জাহাজীকরণের সাথে সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম কার্যত বন্ধ থাকায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। যার ধাক্কা সামলাতে হয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষকে।

তাই বলা যায়, ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির চাপ তথা আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের পণ্য পরিবহন সামাল দিতে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি স্টেকহোল্ডারদের সক্ষমতা, গতিশীলতা ও নিরবচ্ছিন্ন সেবাদানও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সাপ্লাই চেইনের একটি অংশও যদি সমান তালে কাজ করতে না পারে, তবে তা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অংশগুলোর কার্যক্রমকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে কোনো পক্ষই এর সুফল ভোগ করতে পারেনা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here