বৈশ্বিক উষ্ণায়ণের প্রভাবে বিগত কয়েক দশক ধরে উত্তপ্ত হচ্ছে সমুদ্রের উপরিভাগ। সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাওয়ায় হুমকির মুখে পড়েছে অগুনতি জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে আবাসস্থল বদলেছে অনেক জলজ জীব। যার ফলে বিস্তীর্ণ সাগরের বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছে মৎস্যসম্পদের ঘাটতি। আর্থিক সংকট কাটাতে সেসব স্থানের জেলেরা বিকল্প কর্মসংস্থানের দিকে ঝুঁকছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই জলদস্যুতার মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আবহাওয়া-সংক্রান্ত জার্নাল ওয়েদার, ক্লাইমেট অ্যান্ড সোসাইটিতে (ডব্লিউসিএএস) প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলদস্যুতার মধ্যকার যোগসূত্র তুলে ধরেন ম্যাকাউ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সহকারি অধ্যাপক বোজিয়াং ও মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড ক্রিমিনাল জাস্টিসের অধ্যাপক গ্যারি লাফ্রি।
সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বা সি সারফেস টেম্পারেচারের (এসএসটি) হেরফের শীতল রক্তবিশিষ্ট জলজ প্রাণী, উদ্ভিদ ও প্রবালকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রার সামান্যতম পরিবর্তনও মাছ সবার আগে টের পায়। পানির তাপমাত্রা পরিবর্তনের সাথে সাথে মাছ উষ্ণ অথবা শীতল কোনো স্থানে স্থানান্তরিত হয়। যার ফলে সেই অঞ্চলের বাস্তুসংস্থানে আমূল পরিবর্তন দেখা দেয়। বাস্তুসংস্থানের এই পরিবর্তন মাছের মজুদের ওপর অতিদ্রুত তীব্রতর প্রভাব বিস্তার করে। মাছের মজুদ হ্রাস-বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জলদস্যু হামলার তীব্রতা ওঠা-নামা করে কিনা, সেটা খতিয়ে দেখতেই গবেষণাটি পরিচালনা করেন জিয়াং ও লাফ্রি।
পূর্ব আফ্রিকার উপকূলীয় অঞ্চল ও দক্ষিণ চীন সাগর বিশ্বের অন্যতম জলদস্যুপ্রবণ এলাকা। অঞ্চল দুটির ওপর বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বিপরিতমুখী প্রভাব বিস্তার করেছে। বিগত বিশ বছরের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে পূর্ব আফ্রিকা মৎস্য শূন্য হলেও দক্ষিণ চীন সাগরে মাছের পরিমাণ আগের চেয়ে বেড়েছে। প্রাকৃতিক এই পট পরিবর্তনে বদলে গেছে সেখানকার জেলেদের জীবিকার ধরণ।
গবেষণার জন্য অঞ্চল দুটির বিগত দুই দশকের ২ হাজারের বেশি জলদস্যু হামলার ঘটনা যাচাই-বাছাই করেন গবেষকরা। সে সঙ্গে সেসব অঞ্চলের স্থানীয় অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রভাব পর্যালোচনা করেন তারা। গবেষণা শেষে প্রতীয়মান হয় যে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণায়নের সাথে জলদস্যু হামলার হ্রাস-বৃদ্ধির সম্পর্ক রয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় পূর্ব আফ্রিকার মাছের মজুদ দিনদিন হ্রাস পাচ্ছে। যে কারণে এসব অঞ্চলে জলদস্যু হামলার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে দক্ষিণ চীন সাগরে উষ্ণতার কারণে মাছের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় এই অঞ্চলে জলদস্যু হামলার ঘটনা কমে গেছে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ পণ্য সমুদ্রপথে পরিবহন হওয়ায় পণ্যবাহী জাহাজগুলো জলদস্যু হামলার ঝুঁকিতে থাকে। বিশেষ করে সংকীর্ণ প্রণালী, ব্যস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ জলপথে (যেমন সোমালিয়া ও কেনিয়ার মতো আফ্রিকার পূর্বাঞ্চলীয় দেশগুলোর উপকূল) এ ধরনের হামলার ঘটনা বেশি ঘটে। প্রতিবছর জলদস্যু হামলার কারণে শিপিং খাতকে প্রায় ৯০০ কোটি ডলার ক্ষতির মুখে পড়তে হয়।
লাফ্রি বলেন, জলদস্যু বলতেই আমাদের মানসপটে যে চিত্র ভেসে ওঠে, বাস্তব পরিস্থিতি তার চেয়ে একেবারেই ভিন্ন। এখনকার জলদস্যুরা অনেক বেশি আধুনিক ও অনেক বেশি প্রযুক্তিনির্ভর। বাহ্যিক বেশভুষা দেখে জলদস্যুদের চিহ্নিত করার দিন পেরিয়ে গেছে। বর্তমানে জলদস্যুরা জিপিএসের সহায়তায় সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। তবে মুখ দেখে জলদস্যু চেনার কোনো উপায় না থাকলেও কোন পরিস্থিতিতে একজন সাধারণ জেলে জলদস্যুতার সাথে জড়িয়ে পড়ে, জিয়াং ও লাফ্রির গবেষণায় সেই চিত্র উঠে এসেছে।
প্রাচীনকাল থেকেই জেলেরা বিশ্বের দরিদ্র সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে অন্যতম। সমুদ্রযাত্রার দক্ষতা ও বৈরি আবহাওয়া মোকবিলার নৈপুণ্য থাকায় জলদস্যুতার সাথে জড়িত অপরাধীচক্র দরিদ্র জেলেদের নিজেদের দলে ভেড়ায়। সিঙ্গাপুরে বেড়ে ওঠা জিয়াং বলেন, সিঙ্গাপুরের উপকূলবর্তী এলাকার অনেক জেলে ‘স্ট্যান্ডবাই পাইরেটস’ বা খন্ডকালীন জলদস্যু হিসেবে পরিচিত। মোটা দাগে তাদের সবাইকে অপরাধীর কাতারে ফেলা যায় না। কারণ খন্ডকালীন জলদস্যুদের অনেকেই আশানুরূপ মাছ শিকার করতে ব্যর্থ হয়ে জলদস্যুতার পথ বেছে নেয়। যার ফলে কোনো স্থানে মাছ ধরার পরিমাণ কমতে থাকলে সেসব স্থানে জলদস্যু হামলার ঘটনা ক্রমশ বেড়ে যায়।
সামনের দিনগুলোয় গোটা বিশ্ব তথা সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জিয়াং ও লাফ্রি। তাদের মতে, অদূর ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তন আরও তীব্র আকার ধারণ করলে এর প্রভাবে সংঘটিত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডও জটিল ও গুরুতর হয়ে উঠবে, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করবে। যার ফলে পূর্ব আফ্রিকার উপকূলীয় অঞ্চলে জলদস্যু হামলার ঝুঁকি আরও বাড়বে। সোমালিয়া, কেনিয়া বা অন্য কোনো দেশের পক্ষে এককভাবে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। গবেষকদের মতে, জলদস্যু হামলা কোনো দেশের একক সমস্যা নয়। তাই আন্তর্জাতিক এই সমস্যার সমাধানে সব দেশকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন তারা।