চট্টগ্রাম বন্দরে স্বাস্থ্যসেবা

সময়কাল ষাটের দশকের একেবারে শেষভাগ। রেল-পোর্ট ট্রাস্ট পৃথক হয়ে রেলওয়ে ও পোর্ট দু’টি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পৃথক হওয়ার সাথে সাথে পর্যায়ক্রমে একীভূত সকল সেবা কার্যক্রমও পৃথক হতে থাকে। একসময় রেলওয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সদরঘাটে পোর্ট কমিশনার অফিসে ছোট পরিসরে চালু করা হয় ডিসপেন্সারি। এখানেই আউটডোরে সেবা প্রদানের মাধ্যমে বন্দরের চিকিৎসাসেবার সূচনা হয়। এরপর আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম। ১৯৬২ সালে বন্দর স্টেডিয়াম সংলগ্ন স্থানে (বর্তমানে পুলিশ লাইন) চালু হয় ইনডোর সুবিধাসহ ১২ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল। এরপর ১৯৬৫ সালে ৩০ শয্যা ও ১৯৬৭ সালে ৭০ শয্যায় উন্নীত করা হয় হাসপাতালটিকে। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় দেশের সকল উন্নয়ন কাজ বন্ধ হয়ে গেলে হাসপাতাল উন্নয়নের কাজও বন্ধ হয়ে যায়। পরে অবশ্য কাজ পুনরায় শুরু হয়। এসময় হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন বন্দরের তৎকালীন প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. কামাল এ খান। ১৯৬৮ সালে বন্দর ভবনের পশ্চিম পার্শ্বে ৫ একর জায়গার উপর নির্মাণ করা হয় এইচ আকৃতির ভবন যা ১৯৮৪ সালে দ্বিতল করার মাধ্যমে ১৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে বৃদ্ধি পেতে থাকে বন্দরের চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম। শুধুমাত্র কর্মকর্তা-কর্মচারী নয় শ্রমিকদের জন্যও ছিল পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধা। ১৯৮০ সালে ডক শ্রমিক ব্যবস্থাপনা বোর্ড গঠিত হওয়ার সাথে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় ডক শ্রমিক ব্যবস্থাপনা হাসপাতাল। ২০০৮ সালে ডক শ্রমিক ব্যবস্থাপনা বোর্ড বিলুপ্তি হলে হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ২০১১ সালের জুলাইয়ে বন্দরের ৩ নং জেটি গেটে নতুন করে চালু হয় বন্দর শ্রমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র।

বন্দরের উৎপাদনশীলতার সাথে বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বাস্থ্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মক্ষম রাখতে ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে বন্দর কর্তৃপক্ষের রয়েছে আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা। একসময় ১২ শয্যা নিয়ে শুরু করা হাসপাতাল এখন ১৫০ শয্যার হাসপাতাল। নির্মাণাধীন রয়েছে চারতলা বিশিষ্ট ৫ ব্লকের আধুনিক হাসপাতাল, যা পুরোদমে চালু হলে আরো একধাপ এগিয়ে যাবে বন্দরের স্বাস্থ্যসেবা।

হাসপাতালে রয়েছে সকল স্বাস্থ্যসেবা

চট্টগ্রাম বন্দর হাসপাতালে কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাদের পোষ্যদের আউটডোর এবং ইনডোরে চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হয়। এছাড়া বহিরাগত রোগীদের দেয়া হয় প্রাথমিক চিকিৎসা। এখানে রয়েছে মেডিসিন বিভাগ, সার্জারি বিভাগ, দন্ত বিভাগ, চক্ষু বিভাগ, গাইনী বিভাগ এবং নাক-কান-গলা বিভাগ। প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তার অধীনে বর্তমানে ২৭ জন অভিজ্ঞ চিকিৎসক কর্মরত রয়েছেন চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে। হাসপাতালের আউটডোর ও ইনডোরে নাক-কান-গলা, চক্ষু, অর্থোপেডিক্স, জেনারেল, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, শিশু, গাইনী ও ডায়াবেটিসের চিকিৎসা দেয়া হয়। এছাড়াও আউটডোরে রয়েছে নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞের চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ। ইনডোরে পুরুষদের জন্য মেডিকেল ওয়ার্ড, সার্জিক্যাল ওয়ার্ড এবং মহিলাদের জন্য মহিলা ওয়ার্ড ও গাইনী ওয়ার্ড ও কেবিন।

থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য বন্দর হাসপাতালে সরকার কর্তৃক অনুমোদিত নিরাপদ রক্তপরিসঞ্চালন কেন্দ্র রয়েছে। যেখানে থ্যালাসেমিয়া রোগীরা ছাড়াও রক্তশূণ্যতা এবং ক্যান্সারসহ অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীরা রক্তপরিসঞ্চালন সেবা পান।  ফিজিওথেরাপি ইউনিটে পক্ষাঘাতগ্রস্থ ও ব্যথাজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীদের জন্য রয়েছে নিয়মিত ফিজিওথেরাপি নেয়ার সুযোগ। যক্ষা রোগীদের জন্য রয়েছে ব্র্যাক কর্তৃক পরিচালিত যক্ষারোগ নির্ণয়, চিকিৎসা ওষুধ বিতরণ কেন্দ্র। কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং তাদের পোষ্যরা ছাড়াও বন্দর এলাকার মানুষ এখানে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ পেয়ে থাকেন। হেপাটাইটিস বি ও জরায়ুর ক্যান্সারের টীকা দেয়া হয় বন্দর হাসপাতালের টীকা কেন্দ্রে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শিশু ও বন্দর এলাকার শিশুদের জন্য সিটি করপোরেশন কর্তৃক সরবরাকৃত টীকা দেওয়ার জন্য একটি ইপিআই সেন্টার রয়েছে। সিটি করপোরেশনের একজন টীকাদানকারী এই কার্যক্রম পরিচালনা করেন।

রোগীদের যে কোন সাধারণ ও জটিল অপারেশনের জন্য রয়েছে অত্যাধুনিক অপারেশন থিয়েটার। এনেসথেশিয়া বিশেষজ্ঞসহ অভিজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন অপারেশন করার জন্য। প্রয়োজনে অন্য হাসপাতাল থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এনে অপারেশনের ব্যবস্থাও রয়েছে। রোগ নিরূপণের জন্য হাসপাতালে রয়েছে আধুনিক প্যাথলজি ও এক্সরে ইউনিট। স্বল্প পরিসরে হৃদরোগীদের জন্য চালু আছে সিসিইউ ইউনিট।

এছাড়া কিডনি হেমো ডায়ালাইসিস ইউনিট, ক্যান্সার রোগীদের সার্বিক সেবা ও পরিবার পরিকল্পনা ইউনিট রয়েছে এখানে।

যেভাবে সেবা দেয়া হয়

চট্টগ্রাম বন্দর হাসপাতালের আউটডোরে রয়েছে টিকেট কাউন্টার। টিকেট কাউন্টারে টিকেট সহকারী রোগীর নাম এন্ট্রি করার পর রোগীর সমস্যা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের কাছে প্রেরণ করেন। টিকেটের ক্রমানুযায়ী রোগীরা চিকিৎসা নেন। জরুরি বিভাগে একজন মেডিকেল অফিসার সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করেন। প্রাথমিক চিকিৎসায় রোগীর উন্নতি না হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ইনডোর চিকিৎসকের কাছে রেফার করেন। তখন ইনডোর চিকিৎসক রোগীর শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করেন। হাসপাতালের আউটডোরে প্রতিদিন গড়ে ৬০০-৭০০ রোগী চিকিৎসা নেন এবং ইনডোরে ভর্তি থাকেন গড়ে ১০০-১৫০ জন রোগী।

সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সকল চিকিৎসাসেবা ওষুধ

বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বন্দর হাসপাতালের ইনডোর ও আউটডোরসহ সকল চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ বিনামূল্যে পেয়ে থাকেন। রোগ নিরূপণী কেন্দ্রের সকল সেবাও বিনামূল্যে দেয়া হয়। ভর্তি রোগীর ক্ষেত্রে চিকিৎসকের দেয়া কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা যদি বন্দর হাসপাতালে না থেকে থাকে সেক্ষেত্রে অন্য  কোনো রোগ নিরূপণী কেন্দ্র হতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সকল অর্থ বন্দর কর্তৃপক্ষ বহন করে। চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী বন্দর হাসপাতাল থেকে দেয়া হয় প্রয়োজনীয় সকল ওষুধ।

সার্বক্ষণিক অ্যাম্বুলেন্স সেবা

দুর্ঘটনাক্রান্ত ও মুমূর্ষু রোগীদের দ্রুততম সময়ে হাসপাতালে নিয়ে আসতে এবং অন্য হাসপাতালে স্থানান্তর করতে রয়েছে সার্বক্ষণিক অ্যাম্বুলেন্স সেবা। ২টি আধুনিক অ্যাম্বুলেন্সসহ রয়েছে একটি অত্যাধুনিক আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স। আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স পরিচালনায় একটি নীতিমালা তৈরির কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়া বন্দরের চ্যানেলে কিংবা বহির্নোঙরে দুুর্ঘটনাক্রান্ত ও অসুস্থ নাবিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজনে রয়েছে অ্যাম্বুলেন্স শিপ। অত্যাধুনিক ও দ্রুত গতিসম্পন্ন এ শিপে রয়েছে প্রাথমিক চিকিৎসার প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা।

উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থা

চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন স্থাপনা, দপ্তর, আবাসিক ও অনাবাসিক এলাকাসমূহ নিয়মিত পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য রয়েছে স্যানিটেশন বিভাগ। বন্দর হাসপাতালের অধীনে পরিচালিত হয় এ বিভাগ। বন্দরের সকল এলাকা নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার পাশাপাশি এন্টিম্যালেরিয়া অভিযান পরিচালনা করে স্যানিটেশন বিভাগ। এ বিভাগে কর্মরত রয়েছে প্রায় ২০০ জন।

বন্দর শ্রমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র

ডক শ্রমিক ম্যানেজমেন্ট বোর্ড বিলুপ্ত হওয়ার পর বন্দরের ইয়ার্ড, জেটি এবং মুরিংয়ে বার্থ ও টার্মিনাল অপারেটরদের নিয়োগকৃত শ্রমিকরাই কাজ করেন। বন্দরের কাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ শ্রমিক। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও দুর্ঘটনায় প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানে বন্দর শ্রমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে রয়েছে প্রয়োজনীয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা। বন্দরের ৩ নম্বর জেটি গেটে অবস্থিত স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রটি বন্দরের প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তার অধীনে পরিচালিত হয়। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে শুধুমাত্র আউটডোরে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা ও প্রয়োজনীয় ওষুধ দেয়া হয়। চারজন চিকিৎসক শিফ্ট অনুযায়ী সার্বক্ষণিক চিকিৎসাসেবা দেন। বন্দর হাসপাতালের মতো এখানেও রয়েছে সার্বক্ষণিক অ্যাম্বুলেন্স সেবা। ‘শ্রমিক স্বাস্থ্যসেবা তহবিল’ থেকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সকল ব্যয় নির্বাহ করা হয়ে থাকে। সম্প্রতি বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান একটি অ্যাম্বুলেন্স প্রদান করেছেন স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে। বর্তমানে এখানে ২টি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

চট্টগ্রাম বন্দরের স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম মূলত বন্দর হাসপাতালকে ঘিরে। বন্দরের পরিধি বৃদ্ধির সাথে বাড়ছে কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা। এ বৃহৎ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বাড়ানো হচ্ছে হাসপাতালের কলেবর। চারতলা বিশিষ্ট আধুনিক হাসপাতাল ভবন নির্মাণের কাজ একেবারে শেষ পর্যায়ে। কাজ শেষ হলে এখানে নিয়মিত সেবাগুলোর পাশাপাশি চালু করা হবে সিসিইউ ও আইসিইউ। এছাড়া ১৫০ শয্যা থেকে ২০০ শয্যায় উন্নীত করার পরিকল্পনাও রয়েছে কর্তৃপক্ষের।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here