চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থা

চট্টগ্রাম বন্দর দেশের সমৃদ্ধির স্বর্ণদ্বার। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড আবর্তিত হচ্ছে এই বন্দরকে কেন্দ্র করে। কেবল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, কল্যাণমুখী কার্যক্রম ও শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে চট্টগ্রাম বন্দর। ষাটের দশকে যখন চট্টগ্রাম অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না, তখন থেকেই এ অঞ্চলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে বন্দরে কর্মরতদের পোষ্য এবং আশপাশের এলাকার ছেলেমেয়েদের শিক্ষা বিকাশে ভূমিকা রেখে আসছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। ষাটের দশকের একেবারে শেষদিকে ১৯৫৯ সালে ‘পোর্ট ট্রাস্ট হাই স্কুল’ নামে ছেলেদের জন্য একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে কর্তৃপক্ষ, যা এখন বন্দর কর্তৃপক্ষ উচ্চ বিদ্যালয় নামে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। নারীশিক্ষার ক্ষেত্রেও বন্দর কর্তৃপক্ষের ভূমিকা প্রশংসনীয়। পোর্ট ট্রাস্ট হাই স্কুল প্রতিষ্ঠার ৬ বছর পরেই ১৯৬৫ সালে মেয়েদের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। যেটি এখন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। এই অঞ্চলে নারী শিক্ষা প্রসারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে চলেছে প্রতিষ্ঠানটি।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে ছেলেমেয়েদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার পাশাপাশি নানামুখী সহশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে প্রতিষ্ঠান দু’টি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল এবং অন্যান্য শিক্ষামূলক কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে এ অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি অর্জন করেছে বিদ্যালয় দু’টি।

বন্দর কর্তৃপক্ষ উচ্চ বিদ্যালয়

‘পোর্ট ট্রাস্ট হাই স্কুল’ নামে বিদ্যালয়টি যাত্রা শুরু করে ১৯৫৯ সালে। শুরুর দিকে লাল ইটের ছোট দালানে চলতো স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম। বন্দরে কর্মরতদের সন্তান ও আশেপাশের এলাকায় বসবাসরতদের সন্তানদের প্রায় বিনামূল্যে পাঠদান করা হতো। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত স্কুলটিতে সহশিক্ষা কার্যক্রম চালু ছিল। পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালে ‘বন্দর কর্তৃপক্ষ উচ্চ বিদ্যালয়’ নামে ছেলেদের জন্য পৃথক কার্যক্রম শুরু করে। ২০১৩ সালে বিদ্যালয়ের সাথে কলেজের কার্যক্রম শুরু হলেও ২০১৫ সালে তা আবার মাধ্যমিক বিদ্যালয় হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমানে আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্বলিত চার তলা বিশিষ্ট ভবনে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম চলছে। রয়েছে সুপ্রশস্ত খেলার মাঠ, মাঠের পাশে রয়েছে শহীদ মিনার, ক্যান্টিন ও অত্যাধুনিক অডিটোরিয়াম। এছাড়াও পর্যাপ্ত বই নিয়ে রয়েছে লাইব্রেরি, সুসজ্জিত মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম এবং ৪০টি কম্পিউটার সমৃদ্ধ আধুনিক কম্পিউটার ল্যাব। ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় ৮০০ ছাত্রকে পাঠদানের জন্য আছেন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ২৪ জন অভিজ্ঞ শিক্ষক-শিক্ষিকা। জাতীয় দিবসসমূহ উদযাপন, বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা এবং বিতর্ক প্রতিযোগিতার মতো সৃজনশীল আয়োজন ছাড়াও বিদ্যালয়ে রয়েছে রেড ক্রিসেন্ট, বয়স্কাউট ও নৌস্কাউট কার্যক্রম।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে ধারাবাহিক ভালো ফলাফলের মাধ্যমে এ অঞ্চলে শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মুকুট ধরে রেখেছে বিদ্যালয়টি। ২০১৩ সালে থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত গত ৫ বছরে বিদ্যালয়ের ফলাফল ঈর্ষণীয়। জেএসসি পরীক্ষায় ২০১৬ সালে ১০০ ভাগ এবং সর্বশেষ ২০১৭ সালে ৯৯ দশমিক ৩২ ভাগ। এসএসসির ফলাফলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জিপিএ-৫ সহ পাশের হার এ অঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সর্বোচ্চ। ব্যবসায়, বিজ্ঞান ও মানবিক তিন শাখার সম্মিলিত ফলাফলে ২০১৬ ও ২০১৭ সালের পাশের হার যথাক্রমে ৯৭ দশমিক ১৬ ও ৮৮ দশমিক ৩৪ ভাগ। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে জুনিয়র বৃত্তির ক্ষেত্রেও বন্দর কর্তৃপক্ষ উচ্চ বিদ্যালয়ের সাফল্য রয়েছে। ২০১৫ সালে সরকারি পর্যায়ে ৭ জন ও বেসরকারি পর্যায়ে ১৪ জন এবং ২০১৬ সালে সরকারি পর্যায়ে ৪ জন ও বেসরকারি পর্যায়ে ১৬ জন ছাত্র বৃত্তি পেয়েছে।

জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ-২০১৮ তে বন্দর ও বায়েজিদ থানায় শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সম্মান অর্জন করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়

সত্তরের দশকে নারী শিক্ষার জন্য চট্টগ্রামে হাতেগোনা কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল। এসময় নারী শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করে বন্দর কর্তৃপক্ষ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। ১৯৬৫ সাল থেকে প্রতিষ্ঠার ৫৩ বছরে শিক্ষার আলো ছড়িয়েছে বন্দরে কর্মরতদের পোষ্য ও আশেপাশের এলাকায় বসবাসরত মেয়েদের মাঝে। যাদের কেউ কেউ এখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে কর্মরত রয়েছেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়েও। মহান মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা নারী মুক্তিযোদ্ধা নূরজাহান বারীও এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

বিদ্যালয়ে মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদানের জন্য রয়েছে সুপরিসর চারতলা বিল্ডিং। এছাড়া লাইব্রেরি, বিজ্ঞানাগার ও মাল্টিমিডিয়া ক্লাস রুম দিচ্ছে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার সকল সুবিধা। চালুর অপেক্ষায় আছে আধুনিক কম্পিউটার ল্যাব। বিদ্যালয়ে যাতায়াতে শিক্ষক ও ছাত্রীদের জন্য রয়েছে নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা। বন্দরে কর্মরতদের পোষ্য ও বহিরাগতসহ প্রায় ৯০০ ছাত্রীর পাঠদানের জন্য রয়েছেন ১৮ জন অভিজ্ঞ শিক্ষক। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে বন্দর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা জাতীয় পর্যায়ে নিয়মিত অংশগ্রহণ করে প্রতিষ্ঠানের জন্য বয়ে আনছে সম্মান। জাতীয় দিবস সমূহ উদযাপন ছাড়াও বিদ্যালয়ে সারা বছর ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক ও বিতর্ক প্রতিযোগিতাসহ ছাত্রীদের নিয়ে আয়োজন করা হয় সৃজনশীল বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও প্রতিযোগিতার।

ফলাফল, লেখাপড়ার মান ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের জন্য ২০১৬ ও ২০১৭ সালে থানা ভিত্তিক শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সম্মান অর্জন করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা রফিয়া খাতুন ২০১৬ সাল থেকে টানা তিনবার থানা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক হওয়ার সম্মান অর্জন করেছেন। এছাড়াও ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৯ জন ছাত্রী থানা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থী নির্বাচিত হয়েছেন এবং ১ জন জাতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছেন। আঞ্চলিক পর্যায়ে আয়োজিত বিতর্ক প্রতিযোগিতা ও বিজ্ঞান মেলায় অংশ নিয়ে ১ম স্থানসহ একাধিক পুরস্কার অর্জন করেছে বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ছাত্রীরা।

গত ৫ বছরের জেএসসি পরীক্ষার ফলাফলে গড়ে প্রতি বছর শতকরা ৯৮ ভাগ শিক্ষার্থী ও এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে প্রতিবছর গড়ে শতকরা ৯৩ ভাগ শিক্ষার্থী কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়েছে। ২০১৬ সালে জেএসসি পরীক্ষায় শতকরা ১০০ ভাগ এবং ২০১৭ সালে ৯৯ দশমিক ৩৫ ভাগ শিক্ষার্থী পাশ করেছে। এসএসসির ফলাফলে ২০১৬ সালে ৯৩ দশমিক ১৭ ভাগ ও ২০১৭ সালে ৯৫ দশমিক ০৪ ভাগ ছাত্রী পাস করেছে। জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় গত ৪ বছরে ৯৪ জন ছাত্রী বৃত্তি পেয়েছে। এর মধ্যে ২০১৫ সালে সরকারি পর্যায়ে ৮ জন ও বেসরকারি পর্যায়ে ২০ জন এবং ২০১৬ সালে সরকারি পর্যায়ে ৩ জন ও বেসরকারি পর্যায়ে ২২ জন ছাত্রী বৃত্তি পেয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here