দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের প্রায় ৯২ ভাগ পরিবাহিত হয় চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে। সরাসরি অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট এ বিশাল কর্মযজ্ঞে চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে জড়িয়ে রয়েছে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান। যাদের নিরলস পরিশ্রম চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে সাথে অর্থনীতির প্রাণসঞ্চার করতে প্রতিনিয়ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। শুধুমাত্র পণ্য খালাস ও জাহাজীকরণকে চট্টগ্রাম বন্দরের মূল কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হলে এ প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে রয়েছে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর। চট্টগ্রাম বন্দরের হ্যান্ডলিং কার্যক্রমের অর্ধেকের বেশি হয়ে থাকে বহির্নোঙরে আর বাকিটুকু হয় বন্দরের নিজস্ব জেটিতে। বহির্নোঙরে হ্যান্ডলিংয়ের কাজটি করে থাকে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর। শতাংশের হিসেবে মোট কনটেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের প্রায় ৪৫ ভাগ হ্যান্ডলিং করে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর। এককভাবে যদি খোলা পণ্য বা বাল্ক হ্যান্ডলিং হিসেব করা হয় তবে এ অংশীদারিত্ব প্রায় ৭৫ ভাগ।

কর্ণফুলী নদীকে কেন্দ্র করে কয়েকশ বছর আগে গড়ে উঠেছে এ বন্দর। চলন, বলন আর জোয়ার ভাটার কারণে কর্ণফুলীর মনমর্জি বুঝেই চলাচল করতে হয় পণ্যবাহী জাহাজকে। আর নির্দিষ্ট গভীরতার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বেশি ড্রাফটের বড় বড় জাহাজকে (মাদার ভেসেল) অবস্থান করতে হয় বর্হিনোঙ্গরে। ফলে এসব জাহাজকে বন্দরের মূল জেটিতে আনতে কর্ণফুলীর চ্যানেলের নির্দিষ্ট গভীরতায় চলাচল উপযোগী করতে আংশিক পণ্য খালাস কিংবা বহির্নোঙরে পুরো পণ্য খালাসে প্রয়োজন হয় শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরদের। এখান থেকে খালাসকৃত পণ্য লাইটার জাহাজের মাধ্যমে পৌঁছে যায় আমদানিকারকের দুয়ারে। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর ছাড়াও বঙ্গোপসাগরের বিশাল জলরাশির কুতুবদিয়া ও মাতারবাড়ি পর্যন্ত চলে এ কার্যক্রম। বন্দরের মত শীত, গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষায় ২৪ ঘন্টা হ্যান্ডলিং কার্যক্রম চলে এখানে।

শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটররা চট্টগ্রাম বন্দরের নিবন্ধিত অপারেটর। দরপত্রের মাধ্যমে ৫ বছরের জন্য নিয়োজিত হয়ে থাকে প্রতিষ্ঠানগুলো। বর্তমানে ৩০টি প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পণ্য খালাসের কাজ করছে। অর্থনীতি ও দেশের চলমান উন্নয়ন কর্মকান্ডের সাথে তাল মিলিয়ে গত কয়েক বছরে চট্টগ্রাম বন্দরে বেড়েছে আমদানির পরিমাণ। এ বিশাল পরিমাণ পণ্য হ্যান্ডলিংয়ে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরকে। বিশেষ করে অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য আমদানিকৃত নির্মাণ সামগ্রী যেমন পাথর ও অন্যান্য ভারী যন্ত্রপাতি আমদানির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। এ বিশাল পরিমাণ বাড়তি পণ্য হ্যান্ডলিংয়ে চট্টগ্রাম বন্দরকে আরো বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। বন্দরের পাশাপাশি উন্নয়ন প্রকল্পের এ বাড়তি হ্যান্ডলিংয়ের কাজটি করছে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটররা। বাল্ক বা খোলা পণ্যের প্রায় তিন চতুর্থাংশই হ্যান্ডলিং হচ্ছে বহির্নোঙরে। শুধুমাত্র উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য আনা সামগ্রীই নয়, নিয়মিতভাবে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটররা গম, ভুট্টাসহ অন্যান্য ফুড গ্রেইন, রেফশিট, চিনি, সিমেন্ট ক্লিংকার, স্ক্র্যাপ স্টিল, কয়লা ও ভারী যন্ত্রপাতি হ্যান্ডলিং করে আসছে। পদ্মা সেতু, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য আনা ভারি যন্ত্রপাতি হ্যান্ডলিং করে নির্দিষ্ট সময় ও গন্তব্যে পৌঁছে দিতে ভূমিকা রাখে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটররা।

বন্দরের জেটিতে জাহাজ ভিড়িয়ে পণ্য খালাস করতে যেমন নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়, তেমনি বহির্নোঙরে পণ্য খালাস করতেও অনুসরণ করতে হয় নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া। শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটররা মূলত আমদানিকৃত খোলা পণ্য খালাস করে থাকে। রপ্তানি পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ একেবারেই নগণ্য। আমদানিকারক পণ্য আমদানির জন্য প্রথমে এলসি খোলেন। শিপিং এজেন্ট আমদানিকারকের পক্ষে জাহাজে করে পণ্য আমদানির ঘোষণা দেন। এরপর শিপিং এজেন্টের মনোনীত শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর পণ্য খালাসের প্রক্রিয়া শুরু করেন। শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটররা মাদার ভেসেল থেকে লাইটার জাহাজে পণ্য খালাস করে থাকে। আমদানিকারক শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরকে লাইটার জাহাজ সরবরাহ করে। এজন্য অবশ্য আমদানিকারককে লাইটার জাহাজ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের মাধ্যমে লাইটার বরাদ্দ নিতে হয়। আমদানিকারকের লাইটার জাহাজে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটররা পণ্য খালাসে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, শ্রমিক ও কর্মচারী নিয়ে বহির্নোঙরে যায়। যন্ত্রপাতির মধ্যে রয়েছে গ্রেভ, স্ক্যাভেটর, পে-লোডার ইত্যাদি। মাদার ভেসেলে পৌঁছে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরের সুপারভাইজার জাহাজের সুপারভাইজার ও ক্যাপ্টেনের সাথে যোগাযোগ করে খালাস প্রক্রিয়া শুরু করেন। এ পর্যায়ে সরকারি কাস্টম ডিউটি ও বন্দরের পাওনা চার্জসমূহ আদায় হয়েছে কিনা যাচাই বাছাই করা হয়। এরপর আমদানিকারক ও জাহাজের সার্ভেয়ার পণ্যের সার্ভে কাজ শেষ করেন। সার্ভে কাজ শেষ হওয়ার পর মাদার ভেসেলের ক্রেন ও শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরদের যন্ত্রপাতির সমন্বয়ে পণ্য খালাস শুরু হয়।

চট্টগ্রাম বন্দরের নিবন্ধিত শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরদের প্রতিদিন ১০-১২ হাজার টন পণ্য খালাসের সক্ষমতা রয়েছে। বর্তমানে লাইটার জাহাজ সংকটের কারণে সক্ষমতার পুরোটা কাজে লাগানো যাচ্ছেনা। একটি মাদার ভেসেল থেকে পণ্য খালাসে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরদের ১৮-২০ দিন সময় লাগছে। যা লাইটার জাহাজ প্রাপ্তির উপর নির্ভর করে আরো হ্রাস পায়। তবে বহির্নোঙরে পণ্য খালাসের সুবিধার কারণে তা নৌপথে দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে যাচ্ছে সহজেই। চট্টগ্রাম বন্দরের বর্হিনোঙ্গরে খালাসকৃত পণ্য লাইটারে করে নারায়ণগঞ্জ, নওয়াপাড়া, খুলনা, বরিশাল ও বগুড়াসহ দেশের নানান প্রান্তে নৌবন্দরগুলোতে তথা আমদানিকারকের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে। এতে একদিকে যেমন অর্থের সাশ্রয় হচ্ছে তেমনি দ্রুততম সময়ের মধ্যে তা পৌঁছে যাচ্ছে নির্দিষ্ট গন্তব্যে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here