ভৌগলিক, অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত ইত্যাদি কারণে বিশ্বের কোনো দেশই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল ও অন্যান্য অনেক পণ্যের চাহিদা পূরণেই একটি দেশকে নির্ভর করতে হয় অন্য দেশের উপর। আবার কখনো কোনো পণ্য চাহিদার অতিরিক্ত উৎপাদনের ফলে উদ্বৃত্ত রয়ে যায়। চাহিদা ও যোগানের এ বিপরীতমুখী আচরণের কারণে সৃষ্টি হয়েছে বৈদেশিক বাণিজ্যের।

সময়ের সাথে সাথে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে স্থানীয় বাজারে ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে, উন্নয়ন কর্মকান্ডের জন্য নানাবিধ সামগ্রীর চাহিদা বেড়েছে। বাংলাদেশ যেমন সস্তা ও দক্ষ শ্রমিকের কারণে তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন শিল্পে উন্নতি লাভ করেছে। তেমনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ অনুকূল সুযোগ সুবিধার কারণে ভিন্ন ভিন্ন শিল্পখাতে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। ফলে বেড়েছে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ব্যাপ্তি। সড়ক, রেল, বিমান কিংবা সমুদ্র যে পথেই পণ্য আমদানি-রপ্তানি হোক না কেনো, তাকে নির্দিষ্ট কিছু আইন-কানুন মেনে গন্তব্যে পৌঁছাতে হয়। আমদানি ও রপ্তানি প্রক্রিয়াতে আপাত দৃষ্টিতে শুধু আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকের ভূমিকা দৃশ্যমান হলেও এর পেছনে রয়েছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। আমদানি কিংবা রপ্তানির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বৃত্তাকারে যদি রূপরেখা আঁকা হয় তবে দেখা যাবে এর উল্লেখযোগ্য অংশে রয়েছে সিএন্ডএফ এজেন্ট। আমদানি পণ্য সমুদ্র বন্দর, স্থল বন্দর কিংবা নৌবন্দর থেকে আমদানিকারকের দৌরগোড়া পর্যন্ত পৌঁছানো এবং রপ্তানি পণ্য কারখানা থেকে বিদেশে পাঠানোর জন্য জাহাজে ওঠানে কিংবা অন্য কোনো বাহনে বোঝাই করা পর্যন্ত আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকের পক্ষে যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে সিএন্ডএফ এজেন্ট। এক কথায় বৈদেশিক বাণিজ্যে ব্যবসায়ী, বন্দর ও কাস্টম কর্তৃপক্ষের সাথে সেতুবন্ধনের কাজ করে সিএন্ডএফ এজেন্ট।

আমরা যদি আমদানিকারকের পক্ষে সিএন্ডএফ এজেন্টের ভূমিকার কথা ধরি তাহলে পণ্য পৃথিবীর অন্য প্রান্ত থেকে বন্দরে কিংবা বন্দরের আওতায় আসার পর থেকে কাজ শুরু হয় সিএন্ডএফ এজেন্টদের। এসময় আমদানিকারক সিএন্ডএফ এজেন্টের কাছে আমদানি পণ্য খালাসে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে এলসি, প্যাকিং লিস্ট, আইজিএম (ইমপোর্ট জেনারেল ম্যানুফেস্ট), কনটেইনারের বিবরণ, চালান ইত্যাদি প্রয়োজনীয় দলিলাদি। বিল অব ইমপোর্টে প্রয়োজনীয় তথ্যবলী পূরণ করে কাস্টমসে দাখিল করে সিএন্ডএফ এজেন্ট। এরপর কাস্টমসের এসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে তথ্যাবলি ইনপুট দিলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি রেজিস্ট্রেশন নম্বর প্রদান করে। যার মাধ্যমে পণ্য আমদানির ঘোষণা দেওয়া হয়। এ পর্যায় পর্যন্ত কাজ সিএন্ডএফ এজেন্ট তার অফিসে বসেই করতে পারে। এরপর বিল অব এন্ট্রিতে বা ইমপোর্টে দেয়া তথ্যের সমর্থনে প্রয়োজনীয় দলিলাদি উপস্থাপন করতে হয় কাস্টম হাউজে। এর ভিত্তিতে কাস্টম হাউজ পণ্যের এসেসমেন্ট করে। তবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কোনো কনটেইনার যদি রেড মার্কড হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে কনটেইনারের পণ্য কায়িক পরীক্ষার পর এসেসমেন্ট করা হয়। সিএন্ডএফ এজেন্ট আমদানিকারকের পক্ষে কায়িক পরীক্ষাকালে উপস্থিত থাকেন। কাস্টম কর্তৃপক্ষ কায়িক পরীক্ষায় সন্তুষ্ট হলে অর্থ্যাৎ বিবরণ অনুযায়ী পণ্য পেলে ছাড়পত্র দিয়ে থাকেন। কায়িক পরীক্ষা শেষে এসেসমেন্ট সেকশনে পণ্যের এইচএস (হারমোনাইজড সিস্টেম) কোড দেওয়ার পর পণ্যের শুল্ক স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্ধারিত হয়ে থাকে। সঠিক এইচএস কোড দেওয়া হয়েছে কিনা তা এ পর্যায়ে পরীক্ষা করে কাস্টম কর্তৃপক্ষ। কাস্টমের ট্রেজারি সেকশনে (সোনালী ব্যাংকে) শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। শুল্ক পরিশোধের পর ট্রেজারি সেকশন থেকে রিলিজ অর্ডার দেওয়া হয়। যা কাস্টম কর্তৃক পণ্য খালাসের ছাড়পত্র। এ পর্যায়ে বন্দর থেকে পণ্য খালাসের জন্য শিপিং এজেন্টের কাছ থেকে ডিও (ডেলিভারি অর্ডার) গ্রহণ করে সিএন্ডএফ এজেন্ট। তবে একই কনটেইনারে যদি একাধিক আমদানিকারকের পণ্য এসে থাকে সেক্ষেত্রে পণ্য খালাসে ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারের কাছ থেকে এনওসি  (নো অবজেকশন সার্টিফিকেট) নিতে হয়। এরপর সিএন্ডএফ এজেন্টকে যেতে হয় বন্দরের ওয়ান স্টপ সার্ভিসে। এখানে এ পর্যন্ত নেয়া সকল ছাড়পত্র যাচাই বাছাই করে কনটেইনার সার্টিফাইড করা হয়। এরপর বন্দরের ইয়ার্ড থেকে কনটেইনার নামানোর জন্য ইনডেন্ট দেয় সিএন্ডএফ এজেন্ট। কনটেইনার কিপডাউন হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে কনটেইনার খোলা হয় পণ্য আনস্টাফিং করার জন্য। তবে এর আগে প্রয়োজনীয় সংখ্যক লেবার বুকিং দেয়া হয়। এরপর ট্রাকে বা কাভার্ড ভ্যানে পণ্য বোঝাই করা হয়। বোঝাইকৃত পণ্য চূড়ান্তভাবে বন্দর থেকে নিয়ে যেতে বন্দরের নিরাপত্তা বিভাগ থেকে ছাড়পত্র নিতে হয়। বন্দরের গেটে এই ছাড়পত্র প্রদর্শন করে পণ্য খালাস করে আমদানিকারকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে ৩৭টি বিশেষায়িত পণ্য প্রাইভেট আইসিডি থেকে খালাস করা হয়। সেক্ষেত্রেও একই ধরনের প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমদানিকারক কনটেইনার অন চেসিস (সরাসরি জাহাজ থেকে ডেলিভারি) ডেলিভারি নিয়ে নিজস্ব ইয়ার্ডে পণ্য আনস্টাফিং করার সুযোগ পায়। এক্ষেত্রে কাস্টম হাউজ থেকে সিএন্ডএফ রিস্ক বন্ড নেয় আমদানিকারকের পক্ষে। বিশেষ করে শিল্পপণ্যের ক্ষেত্রে এমন হয়ে থাকে।

রপ্তানির ক্ষেত্রেও পণ্য কারখানা থেকে বের হওয়ার পর থেকে জাহাজে ওঠানো পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াটি সিএন্ডএফ এজেন্ট সম্পন্ন করে। রপ্তানির প্রায় শতভাগ বেসরকারি আইসিডির মাধ্যমে হ্যান্ডলিং হয়ে থাকে। পণ্য রপ্তানির জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেওয়ার পর সিএন্ডএফ এজেন্ট ডাটা-শিট তৈরি করে এসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে  দেয়। এরপর বেসরকারি আইসিডিতে থাকা কাস্টম হাউজের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা পণ্যের এসেসমেন্ট করে থাকেন। পণ্যের নির্ধারিত শুল্ক পরিশোধ শেষে কাস্টম থেকে পণ্যের শিপমেন্ট করার অনুমতি নেওয়া হয় এবং কাস্টম কর্মকর্তার উপস্থিতিতে পণ্য কনটেইনারে বোঝাই করা হয়। শিপমেন্টের অনুমতি পাওয়ার পর তা বেসরকারি আইসিডির কাছে তুলে দেওয়া হয় শিপমেন্টের জন্য। এখান থেকে আইসিডিগুলো রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার বন্দরে নিয়ে রপ্তানি কনটেইনারের জন্য নির্ধারিত ইয়ার্ডে নিয়ে যায়, যেখান থেকে শিডিউল অনুযায়ী তা জাহাজে তোলা হয়। আর এভাবেই হাজার মাইল দূরে আমদানিকারকের দুয়ারে পৌঁছে যাচ্ছে দেশে উৎপাদিত পণ্য কিংবা বিদেশ থেকে পণ্য এসে মেটাচ্ছে দেশের চাহিদা। এতে বেগবান হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাকা। এই পুরো প্রক্রিয়ার নেতৃত্বে থাকে সিএন্ডএফ এজেন্ট।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here