নৌবাণিজ্য, বন্দর এবং এর পরিচালন কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে পুরো মেরিটাইম খাত। মেরিটাইম সংশ্লিষ্ট চাকরি বৃদ্ধি, কর্মরতদের জীবনমানে উন্নয়ন এবং স্থিতি এনে দিতে এই খাত সমুদ্র পথে বাণিজ্য প্রসারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। সমুদ্র এবং ভূমি উভয় ক্ষেত্রে টেকসই ব্লু ইকোনমির বিস্তারে বন্দর এবং মেরিটাইম খাতকে সম্পদ তৈরির মাধ্যম হিসাবে নিজেদের মান বাড়াতে হবে। এটিই প্রধান বার্তা হিসেবে আজ ছড়িয়ে পড়ছে সারা বিশ্বে। 

‘একসুত্রে জাহাজ, বন্দর এবং জনগণ’ এই স্লোগানকে প্রতিপাদ্য করে গত ২৮ সেপ্টেম্বর ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (আইএমও) এবং বৈশ্বিক নৌবাণিজ্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো কনফারেন্স, সেমিনার, কর্মশালাসহ নানাবিধ কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে পালন করলো বিশ্ব মেরিটাইম দিবস। আইএমও এর সদস্যসমূহ নৌ যোগাযোগ, অবকাঠামোগত সুবিধা  এবং অন্যান্য সমস্যা মোকাবেলায় যেন একসাথে কাজ করতে পারে, সেটির উপরে জোর দেয়া দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য। জাতিসংঘের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসংগঠন হিসেবে আইএমও মেরিটাইম খাতে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বদ্ধপরিকর।

বিশ্ব মেরিটাইম দিবস জাতিসংঘের স্বীকৃত একটি দিন –  নৌবাণিজ্যখাত, আইএমও এর নানাদিক এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট নৌবাণিজ্যিক কর্মকান্ড স¤পর্কে বিশ্ববাসীকে একটি স্বচ্ছ ধারণা দিতে প্রতিবছর দিনটি পালিত হয়ে থাকে। বিশ্ব মেরিটাইম দিবস ২০১৭ এর মূল বক্তব্য অনুযায়ী, বন্দর এবং জাহাজসমূহের মধ্যবর্তী দ্বিপাক্ষিক স¤পর্ক উন্নয়নে যেমন জোর দেয়া হবে, একই সাথে নিরাপদ, নিশ্চিত এবং কার্যকর নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সামনের দিনগুলোতে আইএমও রাখতে চলেছে আরও ফলপ্রসূ ভূমিকা। প্রথাগতভাবে, এদিন আইএমওর প্রধান কার্যালয়ে মেরিটাইম শিক্ষার্থী এবং তরুণ পেশাজীবীদের নিয়ে একটি ডিপ্লোমেটিক রিসিপশন এর আয়োজন করা হয়ে থাকে। নৌবাণিজ্য নির্বিঘœ রাখতে আইএমও’র নেয়া নিরাপত্তা, প্রকৌশলগত ও জনকল্যানমুখী নানা পদক্ষেপের সাথে তাঁরা পরিচিত হন। এরপর আইএমও সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বন্দর, সমুদ্রযাত্রা বিষয়ক অভিজ্ঞতার বিনিময় এবং অপারেশনাল কর্মকান্ডকে অধিকতর গতিশীল করে তোলার উদ্দেশ্যে এক প্রাণবন্ত আলোচনা সভার আয়োজন ছিল। এছাড়া দিবসটি উপলক্ষে আইএমও সদস্য রাষ্ট্রসমূহ কর্তৃক মনোনীত মেরিটাইম প্রতিনিধিদের সভাও অনুষ্ঠিত হয়।    

অনলাইন মিডিয়া এবং বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এবারের বিশ্ব মেরিটাইম দিবস এর কার্যক্রম বেশ জোরেশোরে দেখা গেছে। এমনকি, নিউইয়র্কের হেড কোয়ার্টার থেকে জাতিসংঘের ওয়েবসাইটের মূলপাতায় এসডিজি অর্জনে আইএমও এবং শিপিং সেক্টরের ভূমিকার গুরুত্ব তুলে ধরে বিস্তারিত রিপোর্ট করা হয়েছে।

প্রতিবছর আইএমও এই দিনটির ‘প্যারালাল ইভেন্ট’ পালনের উদ্দেশ্যে একটি দেশকে নির্বাচিত করে। ২০১৭ সালের জন্য দেশটি ছিল পানামা। অক্টোবরের ১ থেকে ৩ তারিখে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে আমেরিকান দেশ পানামা পালন করেছে বিশ্ব মেরিটাইম দিবসের প্যারালাল ইভেন্ট। এবারের থিম, ‘একসূত্রে জাহাজ, বন্দর এবং জনগণ’, কথাটি আইএমও’র এ ক্যাটাগরির সদস্য রাষ্ট্র পানামার ক্ষেত্রে খুবই প্রযোজ্য। লাতিন বন্দরগুলোর মূল কেন্দ্র হিসেবে পানামা খাল এবং সবচেয়ে বেশি বাণিজ্যতরী পানামার পতাকাবাহী হওয়ায় বিশ্ববাণিজ্যে দেশটির অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কাকতালীয়ভাবে, বিশ্ব মেরিটাইম দিবস এর উদযাপনের সাথে একই বিন্দুতে মিলে গেছে পানামার আন্তর্জাতিক জাহাজ রেজিস্ট্রির শততম বছরের আনন্দ উৎসব। জাহাজ পরিবর্তন বা স্থলপথে পরিবহন, যেকোনো প্রয়োজন নিয়ে কোনো জাহাজ যখনই বন্দরে আসে, তাকে স্বাগত জানাচ্ছে পানামা। মূল উদ্দেশ্য সেই একটিই, সাধারণ জনগনের কাছে দ্রুততম সময়ে পণ্য পৌঁছে দেয়া।  

অপরদিকে, পরিবেশে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনতে যে উচ্চাকাক্সক্ষী পরিকল্পনা আইএমও এর হাতে আছে, তা বাস্তবায়নের জন্য আন্তর্জাতিক প্রত্যাশার চাপ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সকলের আশাবাদ, প্যারিস জলবায়ু চুক্তির সরাসরি সমর্থনকারী প্রাথমিক কৌশলপত্রটি পরবর্তী বছরের মধ্যেই সর্বত্র গৃহীত হবে। অথচ এসবই করতে হবে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিশ্ববাণিজ্যে যে বিপুল পরিমাণ পণ্য স্থানান্তর হচ্ছে বা হতে চলেছে, তাতে এতটুকু ব্যাঘাত না ঘটিয়ে, যদিও আন্তর্জাতিক সরবরাহ ব্যবস্থার ৯০ শতাংশই হয় সমুদ্রপথে। আসলে, বৈশ্বিক শিপিং খাতে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন কমিয়ে আনার জন্য সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে আইএমও। এ কারণে সমুদ্র-বাণিজ্যের বিভিন্ন খাতে জলবায়ু বিষয়ক যে সকল অগ্রগতি হয়েছে তা ধরে রাখতে এবং এগিয়ে নিতে আইএমও এর এই নিয়ন্ত্রণ জরুরিও বটে। বিমকো, ইন্টারকার্গো এবং ইন্টারট্যাঙ্কো এর মতো শিপিং জোটগুলোর সাথে মিলে আইসিএস (ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অফ শিপিং) গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনতে সম্ভাব্য পদক্ষেপসমূহ উল্লেখ করে বিস্তারিত একটি প্রস্তাবনা সম্প্রতি আইএমওর কাছে উপস্থাপন করেছে। সংগঠনগুলোর মতে, বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা যেন অবশ্যই বিপদসীমার নিচে থাকে, সে উদ্দেশ্যে আইএমও এর সকল সদস্যদের একমত হওয়া উচিত। অবশ্য ২০৫০ সালের মধ্যে ২০০৮ এর তুলনায় কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কতখানি নিচে নামিয়ে আনা প্রয়োজন, এ নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজটি করতে হবে আইএমও’কেই, মাথায় রাখতে হবে উন্নয়নশীল দেশসমূহের বাণিজ্যিক ও শিল্প উন্নয়নের ন্যায়সঙ্গত প্রভাবও। আন্তর্জাতিক নৌবাণিজ্য শিল্প সংশ্লিষ্টরাও ওয়াকিবহাল যে, আইএমও যত দ্রুত সম্ভব কার্বন কমিয়ে আনতে কাজ করে চলেছে। নিজেদের কর্মপরিকল্পনা এবং সদিচ্ছা নিয়ে এখন বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোর এগিয়ে আসার পালা।

বিশ্ব মেরিটাইম দিবসের বিভিন কার্যক্রম থেকে নিশ্চিত আভাস পাওয়া যায় যে, মেরিটাইম খাতের সকল অংশে  সমন্বিত ও সার্বিক উন্নয়নের গুরুত্ব তুলে ধরতে সামনের দিনগুলোতে আইএমও আরো জোরালো ভূমিকা রাখবে।

– বন্দরবার্তা প্রতিবেদন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here