মে মাস এলেই ফিরে আসে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের ইতিহাস। কালে কালে শ্রমজীবী মানুষেরাই গড়ে দিয়েছেন পৃথিবীর ভবিষ্যৎ। চট্টগ্রাম বন্দর আজ যে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আঞ্চলিক শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার, সেই অর্জনেও বন্দরের শ্রমিক-কর্মচারীদের অবদান অনস্বীকার্য। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি সেই সব শ্রমজীবী মানুষদের, যাঁদের অবদানে হাজার বছরের পরিক্রমায় চট্টগ্রাম বন্দর পেয়েছে আজকের অবস্থান। এই করোনাকালীন মহাসংকটে আমাদের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রাম বন্দরকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সচল রেখেছেন বন্দর শ্রমিকেরা। অভিবাদন জানাই বন্দরে কর্মরত সকল শ্রমিক-কর্মচারীদের। তাঁদের অক্লান্ত শ্রম আমাদের একদিন এনে দেবে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট, এই বিশ্বাস।
দেশের অর্থনীতির আকার বৃদ্ধির সাথে সাথে চট্টগ্রাম বন্দরকেন্দ্রিক জাহাজ চলাচলও বেড়েছে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। বর্তমানে বছরে প্রায় চার হাজার জাহাজ হ্যান্ডল করছে চট্টগ্রাম বন্দর। এটি কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিসংখ্যানে পৃথিবীর অনেক স্বনামধন্য বন্দরকে পেছনে ফেলে লয়েডস লিস্টে ৫৮তম স্থানে অবস্থান করছে। কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিসংখ্যান ও প্রবৃদ্ধি সবসময় আলোচিত হলেও চট্টগ্রাম বন্দর কনটেইনারের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ খোলা (বাল্ক ও জেনারেল) পণ্যও হ্যান্ডল করে, যা সামগ্রিক পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের প্রায় অর্ধেক। আর এই খোলা পণ্য বা কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের সিংহভাগ হয় বঙ্গোপসাগরের বিস্তৃত জলরাশিতে, জনমানুষের চোখের আড়ালে। কারণ, কর্ণফুলী নদীর মোহনায় হওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দরকে কিছু প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা অতিক্রম করেই এগিয়ে যেতে হচ্ছে। খর¯্রােতা এবং জোয়ার-ভাটানির্ভর কর্ণফুলী চ্যানেলের গভীরতা তারতম্যের কারণে বেশি ড্রাফটের জাহাজগুলোকে অপেক্ষা করতে হয় বহির্নোঙরে।
কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে বহির্নোঙরের অংশীদারিত্ব প্রায় ৮০ ভাগ। চট্টগ্রাম বন্দরের বিশাল কর্মযজ্ঞের সাথে জড়িয়ে আছে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান। যাদের নিরলস পরিশ্রম অর্থনীতিকে প্রতিনিয়ত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বন্দরের জেটিতে বার্থ ও টার্মিনাল অপারেটরেরা কনটেইনারজাত পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের কাজ করছে, তেমনি বহির্নোঙরে পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের পুরোটাই করছে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরেরা। বহির্নোঙরে পণ্য খালাসের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরের নিয়োজিত ৩০টি শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর কাজ করছেন। এরা পাঁচ বছর মেয়াদের জন্য বন্দর কর্তৃক নিয়োজিত হয়ে থাকেন। বহির্নোঙরের শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরদের নিয়ে থাকছে এবারের বন্দরবার্তার মূল আয়োজন।
বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থার চালিকাশক্তি হলো নৌপরিবহন খাত। কিন্তু বর্তমানে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণজনিত পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ও চলাচলে সীমাবদ্ধতা আরোপের বিষয়টি এখন নৌপথে পণ্য পরিবহনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে অনেক স্থানেই নাবিকেরা জাহাজ থেকে নামতে পারছেন না, নিজ দেশে ফিরতেও পারছেন না। আবার যাঁরা ঘরে আটকা, তাঁরাও জাহাজে আরোহণের জন্য নিকটবর্তী বন্দরে যেতে পারছেন না। প্রয়োজনীয় এন্ট্রি বা এক্সিট ভিসা সংগ্রহ করতে পারছেন না অনেক নাবিক। উপরন্তু উড়োজাহাজের বাণিজ্যিক ফ্লাইট বন্ধ থাকায় এ সমস্যা হয়ে উঠছে জটিলতর। বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিক সমুদ্রযান প্রায় ৯৬ হাজার। এসব জাহাজের নাবিক সংখ্যা প্রায় ১৮ লাখ, যাঁদের এক-পঞ্চমাংশেরও বেশি এখন আটকা পড়ে আছে জাহাজ বা বাড়িতে। অনেক দেশই নাবিক পরিবর্তন নিষিদ্ধ করেছে, পুরো প্রক্রিয়াকে অত্যন্ত কঠোর করে তুলেছে বাদবাকি রাষ্ট্রগুলো। নিয়ম অনুযায়ী, একজন নাবিক সাগরে টানা অবস্থান করতে পারবেন সর্বোচ্চ ১১ মাস। কিন্তু অনেকেই সাগরে অবস্থান করছেন ১৬ মাসেরও বেশি সময় ধরে। তাঁদের অনেকেই এখন বিপজ্জনকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। মাসের পর মাস সমুদ্রযাত্রার ধকল এবং বাড়ি ফিরতে না পারার মানসিক চাপ প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে তাঁদের মধ্যে। শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর মতে, আধুনিক যুগে এসেও মধ্যযুগীয় দাসপ্রথার মতো অমানবিক আচরণের শিকার হচ্ছেন নাবিকেরা। কোভিড-১৯ সংকটে জাহাজে আটকে পড়া বিশ্ব বাণিজ্য পরিচালনের নেপথ্য নায়ক নাবিকদের নিয়ে রয়েছে বিশেষ রচনা।
প্রিয় পাঠক, আমরা চাই এ দেশের মেরিটাইমচর্চাকে একটি সুদৃঢ় ভিত্তিতে দাঁড় করাতে। বৈচিত্র্যময় আঙ্গিকে, সমৃদ্ধ কলেবরে বন্দরবার্তার পথচলা বাংলাদেশের মেরিটাইম খাতের বিকাশে আরও সহায়ক হবে-সেই প্রত্যাশা। সবাইকে শুভেচ্ছা।