জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধি আর জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি অর্থনীতিতে বেশি প্রভাব ফেলেছে

২০২০ সালে মহামারি শুরু হওয়ার পর অর্থনীতিবিদেরা ভেবেছিলেন, ২০২১ সাল হবে পুনরুদ্ধারের বছর। এ বছর প্রায় সব দেশ ক্ষতি কাটিয়ে উঠেছে। সবাই আবার একভাবে তা পারেনি। কিছু কিছু কারণে পুনরুদ্ধারের গতি কমেছে।

চলতি বছর বিশ্ব অর্থনীতির সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি। ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে সারা বিশ্ব যখন লকডাউনে স্থবির, তখন জ্বালানির তেলের দাম কমে দাঁড়ায় মাইনাস ৩৭ ডলার। কিন্তু এরপর থেকে ওপকে ও তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো ধারাবাহিকভাবে তেল সরবরাহ কমাতে শুরু করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের শুরু থেকেই তেলের দাম বাড়তে শুরু করে। অক্টোবর মাসে তা ব্যারেলপ্রতি ৮৩ ডলারে উঠে যায়। এতে সব দেশই জ্বালানির দাম বাড়াতে বাধ্য হয়। অথচ এমন একসময়ে এই মূল্যবৃদ্ধি হলো, যখন অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পালে হাওয়া লাগতে শুরু করেছে। জ্বালানির এই মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব অর্থনীতির সব খাতেই অনুভূত হয়। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে মূল্যস্ফীতি। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারতসহ বড় দেশগুলো জ্বালানির দাম কমাতে মজুত থেকে বাজারে তেল ছাড়তে শুরু করে।

মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির আরেকটি কারণ হচ্ছে, জাহাজসহ সব ধরনের পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি। কয়েক দফা লকডাউনের পর এ বছরের গ্রীষ্মে অর্থনীতি চাঙা হতে শুরু করে। হঠাৎ করেই বেড়ে যায় চাহিদা। ফলে বিদ্যমান অবকাঠামো নিয়ে বৈশ্বিক এই চাহিদা পূরণ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। বন্দরে বন্দরে বাড়তে শুরু করে জাহাজের জট। আবার চীনসহ অনেক দেশেই স্থানীয় পর্যায়ে সময় সময় লকডাউন ছিল। এতে পণ্য ছাড় করতে সময় বেশি লেগে যায়। ফলে সামগ্রিকভাবে জাহাজের ভাড়া যেমন বেড়ে যায়, তেমনি পণ্য পরিবহনে সময় বেশি লাগে। এ কারণেও জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। শুরু হয় মূল্যস্ফীতি নিয়ে উদ্বেগ। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দিশেহারা হয়ে পড়েছে।

এদিকে দারিদ্র্য বিমোচনে বিশ্ব অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ২০২০ সালে মহামারির ধাক্কায় গত ২০ বছরের মধ্যে এই প্রথম বিপুলসংখ্যক মানুষ আবারও দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়। বিশ্বব্যাংকের হিসাব বলছে, ২০২০ সালে প্রায় ১০ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের ভাষায়, এই দরিদ্র মানুষেরা একরকম নাক ভাসিয়ে টিকে আছে। অর্থাৎ পানিতে ডুবন্ত মানুষ যেমন পানির ওপরে নাক ভাসিয়ে নিশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করে, ঠিক সে রকম। এরা কখনো দারিদ্র্যসীমার ওপরে ওঠে, আবার কখনো নেমে যায়।

বলা হচ্ছে, মহামারি শেষ করার সবচেয়ে কার্যকর ও দ্রুত মাধ্যম হচ্ছে টিকাদান। কিন্তু সেই টিকাদানে দেশে দেশে যোজন যোজন ব্যবধান। উন্নত বিশ্বের ৭৫ শতাংশ মানুষ যেখানে টিকার আওতায় এসেছে, সেখানে নিম্ন আয়ের দেশের মাত্র ৭ শতাংশ মানুষ টিকা পেয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়াবে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। গত ৮০ বছরে মন্দার পরবর্তী বছর এত দ্রুত হারে প্রবৃদ্ধি আর হয়নি। কিন্তু সেই প্রবৃদ্ধির চরিত্র সমতামুখী নয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here