সমুদ্র পরিবহনে এক নবযুগের সূচনা হয়েছে বাংলাদেশে। ৯৫২ একক কনটেইনার তৈরি পোশাক নিয়ে সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সরাসরি ইতালি গেছে জাহাজ এমভি সোঙ্গা চিতা। এর মাধ্যমে সমুদ্র বাণিজ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পথে একধাপ এগিয়ে গেল দেশের শিপিং খাত। বাংলাদেশ থেকে পণ্য নিতে হলে প্রথমে চট্টগ্রাম থেকে সিঙ্গাপুর বা কলম্বো বন্দরে নিতে হয়। চট্টগ্রাম থেকে সিঙ্গাপুর বা শ্রীলংকার বন্দর ঘুরে ইতালিতে যেতে স্বাভাবিকভাবে সময় লাগে ২৪ থেকে ২৮ দিন। সিঙ্গাপুর বা শ্রীলংকায় বড় জাহাজে বুকিং পেতে দেরি হওয়ার কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই সময় লাগে ৩০ থেকে ৩৫ দিনের বেশি। তবে চট্টগ্রাম-ইতালি সরাসরি জাহাজসেবা বাংলাদেশ থেকে ইতালিতে পণ্য রপ্তানির এই সময় কমিয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই সার্ভিস চালু হওয়ার ফলে ইতালিতে পণ্য পাঠাতে ভিয়েতনামের চেয়ে অন্তত এক-দুই সপ্তাহ কম সময় লাগবে। খরচও কমে প্রায় ৩০ শতাংশ।
অল্প সংখ্যক পণ্য নিয়ে অপেক্ষাকৃত ছোট জাহাজে করে বেশি দূরত্বের পথ পাড়ি দেওয়ার চেয়ে ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে পণ্য পাঠানোই বেশি লাভজনক। এ কারণে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে রপ্তানি পণ্য সিঙ্গাপুর বা শ্রীলংকা হয়ে পরিবহন করা হয়। তবে সম্প্রতি জাহাজ-সংকট, ভাড়া অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়া ও ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরগুলোর পণ্যজটের কারণে এখন অপেক্ষাকৃত ছোট জাহাজে সরাসরি ইতালিতে কনটেইনার পণ্য পরিবহনকে লাভজনক বিবেচনা করা হচ্ছে। সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন ভাড়া কমে আগের মতো কনটেইনারপ্রতি (৪০ ফুট) আড়াই থেকে তিন হাজার ডলারে নেমে এলে পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে। তবে সমুদ্রপথের ভাড়া সহসাই স্বাভাবিক হচ্ছে না, সে সম্পর্কে আভাস দিয়েছে বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এসব প্রেক্ষাপটে বলা যায়, ইউরোপে সরাসরি কনটেইনার পাঠানোর ঘটনা বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ইতিহাসের পাতায় বিশেষ এক অধ্যায় যোগ করল। আপাতত শুরু হলো একটি দেশ দিয়েই। শিগগির এই সেবা ইউরোপের অন্যান্য দেশ, এমনকি ইউরোপের গ-ি ছাড়িয়ে অন্য বাজারগুলোতেও ছড়িয়ে পড়বে-এমন আশা করাই যায়। বাংলাদেশী পণ্যের সরাসরি ইউরোপ যাত্রার আদ্যোপান্ত থাকছে এবারের প্রধান রচনায়।
বৈশ্বিক বাণিজ্যিক পরিম-লে বড় একটি ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকল ২০২২ সালের প্রথম দিনটা। গত ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়েছে রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ (আরসিইপি), যাকে বলা হচ্ছে বিশ্বের বদেব সবচেয়ে বড় বহুপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি। আরসিইপির মূল উদ্দেশ্য নিজেদের মধ্যে বাণিজ্যে শুল্ক কমানো, সরবরাহ শৃঙ্খল শক্তিশালী করা ও ই-কমার্সের জন্য নতুন বিধিবিধান চালু করা। জোটটির সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মোট যে পরিমাণ পণ্য বাণিজ্য হয়, তার ৯০ শতাংশের বেশি পণ্য থেকে শুল্ক তুলে নেওয়া হবে এই চুক্তির অধীনে।
নতুন এই আঞ্চলিক বাণিজ্যিক জোটে যুক্ত হয়েছে মোট ১৫টি দেশ। এগুলো হলো আসিয়ানভুক্ত ১০টি দেশ-ব্রুনাই, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম এবং তাদের এফটিএ অংশীদার পাঁচটি দেশ-অস্ট্রেলিয়া, জাপান, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া ও চীন। আরসিইপির সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী হবে চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া। এই প্রথমবারের মতো আঞ্চলিক পরাশক্তি তিনটি কোনো মুক্তবাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে পরস্পর যুক্ত হলো। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ বা প্রায় ২৩০ কোটি মানুষ এবং প্রায় ২৮ লাখ ৫০ হাজার কোটি ডলারের অর্থনীতি এই বাণিজ্য চুক্তির আওতায় আসছে। আর এর প্রত্যক্ষ সুবিধাভোগী হবে সমুদ্র পরিবহন খাত। আরসিইপির বিস্তারিত নিয়ে থাকছে বিশেষ প্রতিবেদন।
প্রিয় পাঠক, আমরা চাই এ দেশের মেরিটাইম চর্চাকে একটি সুদৃঢ় ভিত্তিতে দাঁড় করাতে। বৈচিত্র্যময় আঙ্গিকে, সমৃদ্ধ কলেবরে বন্দরবার্তার পথচলা বাংলাদেশের মেরিটাইম খাতের বিকাশে আরও সহায়ক হবে-সেই প্রত্যাশা। সবাইকে শুভেচ্ছা।