সড়ক পথে এমন গাড়ির কথা আমরা শুনতে পাচ্ছি, যা চালক ছাড়াই চলে যাবে নিজ গন্তব্যে। সেক্ষেত্রে সামুদ্রিক জাহাজ কেন পিছিয়ে থাকবে! এই প্রেক্ষাপটে জাহাজ মালিকেরা চাইছে এমন এক ধরনের জাহাজ যা নাবিক ছাড়াই তরতর করে এগিয়ে যাবে তার গন্তব্যে। এ ধরনের জাহাজ নির্মাণে হাত দিয়েছে রোলস রয়েস নামের এক কোম্পানি, আশা করা হচ্ছে আগামী দশ থেকে পনের বছরের মধ্যে সমুদ্রে নামতে যাচ্ছে এই জাহাজ। এটি মূলত রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে চলবে। 

সমুদ্রে যে সমস্ত দূর্ঘটনা ঘটে তার কারণ নাবিক কিংবা ক্যাপ্টেনের ভুল সিদ্ধান্ত, যাদের অনেক সময় চাপের মুখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। অনেক সময় একটানা কাজের কারণে নাবিকেরা ক্লান্ত হয়ে পড়ে, যার ফলে তারা ভুল করে বা এই অবস্থায় মানবিক ত্রুটির ঘটনা ঘটে। সমুদ্রে অনেক সময় দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয়, সে সময় অনেক ক্যাপ্টেন কিংবা নাবিক ধীর গতিতে তাদের প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে জাহাজে যন্ত্রপাতি মেরামত কিংবা রক্ষণাবেক্ষণে ত্রুটি দেখা দেয়, ফলে সমুদ্রগামী জাহাজ যে কোন সময় দূর্ঘটনায় পড়তে পারে। জাহাজ বীমা শিল্পের সাথে যুক্ত কোম্পানিগুলোর জন্য এই ধরনের মানবীয় ভুল সবচেয়ে উদ্বেগের কারণ।    

অ্যাালিয়াঞ্জ এস.ই-এর তথ্য অনুসারে শতকরা ৭৫ শতাংশ জাহাজ দূর্ঘটনার কারণ নাবিকেরা, যাদের গ্রহণ করা সিদ্ধান্ত ভুল হওয়ার ফলে জাহাজের দূর্গতি ঘটে।  নরওয়ের ‘সুরক্ষা ও ক্ষতিপূরণ’ ভিত্তিক ক্লাব ‘গার্ড এজ’ সংবাদ প্রদান করছে যে ৭০-৮০ শতাংশ জাহাজ দূর্ঘটনার পেছনে দায়ী মানবীয় ত্রুটি। আগামীতে মনুষ্যবিহীন জাহাজ হতে যাচ্ছে এই ধরনের মানবীয় ত্রুটির এক সমাধান। তবে, এটাই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সমাধান হবে কী না, ভাবনাটা তাই নিয়ে।

কেবল নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছাড়াও মনুষ্যবিহীন জলযান মালিকের খরচ কমিয়ে আনবে। কারণ এর জন্য মালিককে নাবিক নিয়োগ করতে হবে না, এই ধরনের জাহাজে নাবিকদের থাকার জন্য বাড়তি জায়গার প্রয়োজন হবে না। এর ফলে জাহাজ আরো কার্যকর ও দ্রুত গতিতে চলতে সক্ষম হবে।  জাহাজ মালিকেরা এই ধরনের জাহাজের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে, কারণ এই ধরনের জাহাজ রক্ষণাবেক্ষণ ও চলাচলের খরচ কমিয়ে আনতে সক্ষম। রোলস রয়েস-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে মনুষ্যবিহীন জাহাজে জলদস্যুরা হানা দিতে আগ্রহী হবে না। জলদস্যুরা মূলত নাবিকদের বন্দী করে মুক্তিপণ আদায় করে। যদি জাহাজে কোন নাবিক না থাকে তাহলে তারা কাকে বন্দী করে মুক্তিপণ আদায় করবে? তবে এই যুক্তির যারা বিপক্ষে তারা বলছেন, মানুষ ছাড়া যে সমস্ত যান সমুদ্রে চলাচল করবে সেগুলোতে জলদস্যুদের হামলার সম্ভাবনা আরো বেশি, কারণ কেবল সশস্ত্র নিরাপত্তা কর্মীরাই পারে জলদস্যুদের প্রতিহত করতে। তবে ড্রোন-এর মত প্রযুক্তি হয়তো নাবিকবিহীন জাহাজগুলোর চলাচলকে নিরাপদ করতে পারে।

একটা জাহাজ নিজে নিজে চলছে, আর নাবিকদের বদলে জাহাজ চালাচ্ছে সেফ মেশিন- এমন চিন্তা নতুন কিছু নয়। যেমন, আধুনিক জাহাজগুলো কাগজের চার্টের বদলে সূক্ষ্ম ইলেক্টনিক চার্ট এবং অটোমেটিক রাডার প্লটিং এইড (এআরপিএ) পদ্ধতির উপর নির্ভরশীল, এছাড়াও আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসারে অনেক জাহাজে এখন আনম্যান্ড মেশিনারি স্পেস বা ইউএমএস নামক যন্ত্র বসানো হয়েছে। এই যন্ত্রটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে মেশিন রুমের তাপমাত্রা বাড়ার বিষয়টি বুঝতে সক্ষম, এছাড়াও মেশিন রুমে আগুন লাগলে কিংবা পানি ঢুকে গেলে এই যন্ত্র সাথে সাথে সঙ্কেত প্রদান করতে থাকে। এতে নাবিকদের পক্ষে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জাহাজে ইউএমএস প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। জাহাজের নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এটি এক গুরুত্বপুর্ণ যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। স্বয়ংক্রিয় নৌযান কী পরিমাণ নাবিক কমিয়ে আনবে, তার এক ধারণা দিচ্ছে বিশাল আকারের কনটেইনার পরিবাহী জাহাজগুলো। যেমন,  ১,৮০,০০০ হাজার টন পর্যন্ত কনটেইনার বহন করতে পারা মারেস্ক ট্রিপল-ই শ্রেণীর জাহাজ চলানোর জন্য মাত্র ১৩ জন নাবিকের প্রয়োজন।              

বর্তমানে প্রযুক্তি যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে এটা নিশ্চিত যে আগামীতে এমন সব জাহাজ নির্মাণ করা হবে যেগুলো মাটি থেকে রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে চালানো সম্ভব।

এ ধরনের জাহাজ কী কী ধরনের সুবিধা প্রদান করতে যাচ্ছে সে বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। জাহাজ নির্মাতা কোম্পানিগুলোর প্রযুক্তিগত দক্ষতা এখন এমন এক পর্যায়ে চলে এসেছে যে কোম্পানিগুলো এই ধরনের জাহাজ নির্মাণের খুব কাছে চলে এসেছে। কিন্তু তারপরেও এই ধরণের জাহাজ নির্মাণে বেশ কিছু বাধা রয়েছে। মূলত জাহাজ মালিক, জাহাজ বীমাকারী প্রতিষ্ঠান ও শিপিং কোম্পানিগুলোকে এই সকল বাধা পার হতে হবে। মনুষ্যবিহিন জাহাজ নির্মাণের প্রথম বাঁধা হচ্ছে এই সংক্রান্ত আইন, কারণ এখন পর্যন্ত এই বিষয়ে কোন আন্তর্জাতিক আইন নেই। বাণিজ্যিক কার্যক্রমের উদ্দেশ্যে এই ধরনের জাহাজ পরিচালনার জন্য প্রয়োজন হবে আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদনের। যেমন, কীভাবে এই সকল জাহাজ চলাচলের সময় নির্ধারণ করা হবে এবং এই সমস্ত জাহাজের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বীমার ধরণ কেমন হবে সেগুলো নির্ধারণ করতে হবে। তবে আন্তর্জাতিক নিয়ম সংশোধন না করলেও, এই ধরণের মনুষ্যবিহীন জাহাজকে সমুদ্রে জীবনের নিরাপত্তা বিষয়ক সম্মেলন (সোলাস) এর নীতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা নীতি (আইএসএম) মেনে চলতে হবে ।

সোলাস, সমুদ্রে নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা নিয়ে ব্যাপকভাবে কাজ করে থাকে, যার মধ্যে রয়েছে নৌযান পরিচালনা ও জাহাজের নিরাপত্তা, যা নাবিকদের নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। মনুষ্যবিহীন জাহাজ হয়তো এই সকল আইন মেনে চলতে সক্ষম হবে না, কারণ বর্তমান আইনে জাহাজ পরিচালনার জন্য জাহাজে অন্তত কয়েকজন নাবিকের উপস্থিতি প্রয়োজন। ফলে সমুদ্রে এই ধরণের জাহাজ চলাচল হবে অবৈধ এবং সমুদ্র আইন বিরোধী। তবে ‘উপকূল ধরে চলা জাহাজ’ কিংবা ‘ক্রু-অপারেশন সেন্টার’ যেভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করে, সেক্ষেত্রে এই ধরণের আইন প্রয়োজ্য নয়, যার ফলে এই ধরনের নিয়মের আওতায় মনুষ্যবিহীন জাহাজ পরিচালনা করা সম্ভব হবে। আগামী  সোলাস সম্মেলনে এই ধরণের জাহাজ চলাচলে নিরাপত্তার সংজ্ঞা সংশোধন করা হবে কি না, বা এই বিষয়ে আইন তৈরি করা হবে কি না, সেটাই এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। তবে একটা বিষয় পরিষ্কার, মনুষ্যবিহীন জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এবং সোলাস একই লক্ষ্যে কাজ করছে, আর সেটা হচ্ছে সমুদ্রে জাহাজের নিরাপত্তা।

বীমার ক্ষেত্রে কী ধরনের ঝুঁকি আসতে পারে  তার হিসেব করা হয় সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে। নির্মাতারা কী কী উপাদান দিয়ে মনুষ্যবিহীন জাহাজ তৈরি করছে, এই তথ্য ছাড়া এই জাহাজ কী ধরণের ঝুঁকিতে পড়তে পারে সে বিষয়ে কোন গ্রহণযোগ্য তথ্য নেই। কীভাবে এই রিমোট কন্ট্রোল জাহাজ পরিচালনার করা হবে, তার উপর ভিত্তি করে এর বীমার ধরণ নির্ধারণ করা হবে। এই ধরণের জাহাজে নিরাপত্তা ঝুঁকি কম থাকবে, সেটা পরিষ্কার, তবে এই ধরণের জাহাজে নতুন ঝুঁকি দেখা দিতে পারে, যেমন ইন্টারনেট বা সাইবার হামলার মত ঝুঁকি। এই ধরণের জাহাজে যে সমস্ত সিস্টেম ও সফটওয়্যার ব্যবহার করা হবে সেগুলোতে যে হামলা হবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? এগুলোর সিস্টেমের মাঝে ভাইরাস বা ম্যালওয়ার প্রবেশ করতে পারে, এমন কী এর সিস্টেম কেউ হয়তো হ্যাকও করে নিতে পারে।

প্রযুক্তির উন্নয়নের একটা বড় কারণ হচ্ছে সমুদ্রে চলাচল করা জাহাজের নিরাপত্তার উন্নতি ঘটানো। তবে প্রযুক্তি নিজে সব কিছু করতে পারে না, প্রযুক্তিকে পরিচালনার জন্য প্রয়োজন মানুষের। এই সকল জাহাজ পরিচালনার আইনগত ভিত্তি ও নীতি নির্ধারণে মানুষের ভাবনা অনিবার্য, যে সকল আইনের মধ্যে দিয়ে এই সমস্ত জাহাজ তার বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করবে। এই আইনের ভিত্তি যথাযথ না হলে মনুষ্যবিহীন জাহাজ চলাচলের চিন্তা কেবল কাগজে কলমে থেকে যাবে। এখন এই বিষয়ে আইন ও নীতি তৈরির করার জন্য চাপ ক্রমশ বাড়ছে, আশা করা হচ্ছে ‘সোলাস ২০২৪’ সম্মেলনে মনুষ্যবিহীন জাহাজ চলাচল সংক্রান্ত আইন প্রস্তুত করা হবে, যা হবে ইউএমএস অনুরূপ এক আইন, যে আইন ইতোমধ্যে বিদ্যমান।

যে বিষয়টি এখন পরিষ্কার সেটি হচ্ছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলতে সক্ষম হবে এমন জাহাজ নির্মাণের দিকে পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে, যা হবে নিরাপদ জাহাজ চলাচলের এক পরবর্তী যৌক্তিক পদক্ষেপ। এই শিল্পের সাথে জড়িত ব্যক্তিরা এখন জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সাথে মিলে ভবিষ্যতের জাহাজ নির্মাণের আইনগত ও বাণিজ্যিক পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে কাজ শুরু করতে যাচ্ছে।

সূত্র:

ঝযরঢ়ং, চড়ৎঃং ম্যাগাজিনের ২০ মার্চ ২০১৭ সংস্করণ থেকে

অনুলিখন: বিজয় মজুমদার     

Facebook Notice for EU! You need to login to view and post FB Comments!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here