পথচলায় চট্টগ্রাম পৌরসভা

বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব মীর কাশেম-এর সাথে ১৭৬১ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চুক্তি অনুসারে চট্টগ্রাম শহরের শাসনভার বৃটিশদের হাতে ন্যস্ত হয়। তখন মূলত সিভিলিয়ান বা সরকারি কর্মচারীরা শহরের দেখাশুনা করত। এই সময় চট্টগ্রাম ছিল বৃটিশ ভারতের এক ছোট্ট শহর, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এর পরিধি ক্রমশ বাড়তে থাকে। এ কারণে চট্টগ্রাম শহরের উন্নতির লক্ষ্যে ১৮৫৬ সালে এক নগর উন্নয়ন কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির প্রথম কাজ নির্ধারণ করা হয় শহরের নাগরিকদের জীবন যাত্রার উন্নতিকরণ। চট্টগ্রাম শহর মিউনিসিপাল বোর্ড গঠন হওয়ার আগে নগরের উন্নয়নের জন্য এটাই ছিল প্রথম কোনো কমিটি। এই কমিটির একটা নামও প্রদান করা হয়, সরকারি নথিতে এই কমিটির নাম লেখা আছে “চট্টগ্রাম শহরের পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা উন্নয়ন কমিটি”। তবে কমিটি কেবল শহরের ময়লা পরিস্কার নয়, সাথে শহরের চারপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রাকৃতিক খালসমূহের নিস্কাশন এবং রাস্তাঘাট নির্মাণের কাজেও হাত দেয়। সরকারি নথিতে আরো জানা যাচ্ছে এই কমিটির প্রথম আলোচনা সভার দিনটি হচ্ছে ১৮৫৬ সালের ১৪ মে। বিভাগীয় কমিশনার সি. স্টেয়ার ছাড়াও কমিটির বাকী বৃটিশ সদস্যরা হলেন সি চ্যাপম্যান, ডাব্লিউ বিটসন, এইচ জে বেমবার, ডাব্লিউ এইচ হেন্ডারসন এবং জি সি ফ্লেচার। এই কমিটিতে স্থানীয় নাগরিকদের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করে দুজন। এদের নাম  ঠাকুর বক্শ তিওয়ারি এবং হর চন্দ্র রায়। কমিশনার স্টেয়ার সাহেব পদাধিকার বলে এই কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। 

কমিটির প্রথম সভায় আলোচনার বিষয় ছিল শহরের জলনিস্কাশন ব্যবস্থা। এই সময়ে চট্টগ্রাম শহরের চারপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রাকৃতিক খালগুলোতে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এছাড়া শহরের পানীয় জলের সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করে, বিশেষ করে যারা সে সময় শহরের সীমানায় বাস করত, তাদের জন্য। এই খালগুলোর উন্নতির জন্য কমিটি বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

এই খালসমূহের উন্নয়ন কাজ শুরু করার আগে এলাকার ভূমি, খাল ও পুকুর নিয়ে এক জরিপ পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। মেসার্স জার্ভিস এন্ড রাসেল কোম্পানিকে এই কাজের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। কোম্পানি যাতে দ্রুত কাজ সমাপ্ত করতে পারে তার জন্য লেফটেনেন্ট গভর্ণর অগ্রীম ১০০০ টাকা প্রদানের আদেশ দেন।            

একই সভায় এই কমিটি আরেকটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। গাছ কাটার পারিশ্রমিক নির্ধারণ করা। কারণ এই সময়ে শহরের চারপাশ জুড়ে জঙ্গল ছিল। এমনকি দিনের বেলায় এই সকল জঙ্গলে বাঘ দেখা যেত। বাঘের হাতে মানুষের আহত বা নিহত হওয়ার ঘটনা শোনা যেত চারপাশে। যার ফলে জঙ্গল পরিস্কার করতে গিয়ে গাছ কাটার জন্য প্রচুর কাঠুরিয়ার প্রয়োজন হত। তাই সভায় অন্য যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়, সেটি হচ্ছে কীভাবে স্থানীয় কারাবন্দীদের গাছ কাটার কাজে লাগানো যায়। এই কমিটি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অনুরোধ জানায়, যেন কারাগারে অবস্থিত বন্দীদের খাল ও ঝোপঝাড় কাটার কাজে লাগানো হয়। কিন্তু কাজের শুরুতে এই কমিটি আর্থিক সঙ্কটে পড়ে যায়। যার ফলে প্রাদেশিক সরকার প্রধান লেফটেনন্ট গভর্ণর-এর কাছে কমিটির সভাপতি আনুরোধ জানাল যেন এই কাজের জন্য আরো ১০,০০০ টাকা প্রদান করা হয়। 

জরিপ কাজের দায়িত্ব প্রাপ্ত জার্ভিস এন্ড রাসেল সে বছরই চট্টগ্রামে এসে উপস্থিত হয় এবং দ্রুত কাজ শুরু করে। এই কাজের জন্য প্রতিষ্ঠানটি মুনু নামের একজন সার্ভেয়ারকে নিযুক্ত করে। এই কাজের জন্য সার্ভেয়ারের পারিশ্রমিক ধরা হয় ৩০০ টাকা।

বন্দরের গতিশীলতা ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে। বেশি সংখ্যক জাহাজ ভেড়ার ফলে প্রয়োজন হয়ে পড়ে বাড়তি কুলির। অনেকে বিভিন্ন স্থান থেকে কাজের সন্ধানে চট্টগ্রামে এসে কুলিতে পরিণত হয়। এদের অনেকে বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ে। প্রশাসনের কাছে এরা ‘ডেনজার কুলি’ বা ‘বিপজ্জনক কুলি’ হিসেবে অভিহিত হয়। অজ্ঞাতনামা এইসব কুলিদের দ্বারা সংঘঠিত অপরাধের পরিমাণ বাড়তে শুরু করলে বৃটিশ প্রশাসন চিন্তিত হয়ে পড়ে। ১৫ জুলাই, ১৮৫৬ সালে কমিটি দ্বিতীয়বারের মত আলোচনায় বসে, আলোচনার বিষয়বস্তু হিসাবে নির্ধারণ করা হয় কীভাবে ডেনজার কুলিদের নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় বন্দরে বাড়তে থাকা অপরাধ নিয়ন্ত্রণে এই সমস্ত কুলিদের উপর নজর রাখা হবে। শহরের সার্ভেয়ার বা জরিপের দায়িত্বে নিয়োজিত মি. রিভেট- এর পক্ষে সকল কুলিদের উপর নজর রাখা সম্ভব ছিল না। ফলে মি. এভেরিকে এই কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করতে বলা হয়।

উন্নয়ন কমিটির একার পক্ষে ক্রমবর্ধমান সকল কাজ সামলানো মুশকিল হয়ে পড়ে। সরকার শহরের দায়িত্ব শহরের নিজস্ব প্রশাসনের হাতে প্রদান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, আর এই সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়ে জন্ম নেয় ‘চিটাগং মিউনিসিপালিটি’ বা ‘চট্টগ্রাম পৌরসভা’।  

২২ জুন, ১৮৬৩ সালে চট্টগ্রাম শহর আনুষ্ঠানিক ভাবে পৌরসভায় পরিণত হল। সদ্য গঠিত পৌরসভাকে পাঁচটি ওয়ার্ডে ভাগ করা হয়, যাদের অভিহিত করা হত এ, বি, সি, ডি এবং ই ওয়ার্ড নামে। পৌরসভার প্রথম প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন মি. জে ডি ওয়ার্ড।

আজকের এই বিশাল বাণিজ্যিক মহানগরী চট্টগ্রামকে দেখে কল্পনা করা মুশিকল যে সদ্য গঠিত পৌরসভাটি ছিল অতি ক্ষুদ্র এক নগরী। তখনকার চট্টগ্রামের আয়তন ছিল মাত্র ছয় বর্গ মাইল। নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে সেই চট্টগ্রাম আজ বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here