১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অবস্থানের বিষয়টি যুদ্ধে লিপ্ত সব পক্ষের সমর বিশারদদের যুদ্ধ পরিকল্পনা ও রণনীতি নির্ধারণে অন্যতম বিবেচ্য ছিল। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী চেয়েছিল যে কোন মূল্যে কর্ণফুলী নদীর নাব্যতা ও চট্টগ্রাম বন্দর সচল রেখে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে তাদের সরবরাহ ব্যবস্থা অক্ষুণœ ও নিরাপদ রাখতে। অপরদিকে মুক্তিবাহিনী এবং তাদের সহায়তাকারী বন্ধুদেশ ভারতের লক্ষ্য ছিল প্রতিপক্ষকে হীনবল করতে তাদের প্র্রধান পশ্চাদসুবিধা চট্টগ্র্রাম বন্দর অচল করে দেয়া। এ প্রেক্ষাপটেই কর্ণফুলী নদীতে অবস্থানরত বিদেশী জাহাজ বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে ডুবিয়ে দিয়ে বন্দরকে অচল করা এবং একই সাথে বিশ্ববাসীকে মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপকতা সম্পর্কে জানান দেয়া। এই অভিযান পরিকল্পনারই নাম ‘অপারেশন জ্যাকপট’। এটা ছিল ১৯৭১ এর ১৫ আগস্ট চট্টগ্রাম বন্দরে ৩৯ জন নৌকমান্ডোর এক মৃত্যুঞ্জয়ী দুঃসাহসী অভিযান। ঐ রাতে কর্ণফুলী নদীতে ৯টি জাহাজ লিমপেট মাইন দিয়ে বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে ডুবিয়ে দেয় নৌকমান্ডোরা। একই দিন মংলা সমুদ্রবন্দর, নারায়ণগঞ্জ ও চাঁদপুর নদীবন্দরেও আলাদা আলাদা দলে নৌকমান্ডোদের যুগপৎ অভিযান চলে। পৃথিবীর নৌযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এ এক অনবদ্য কীর্তি। সামান্যতম ক্ষয়ক্ষতির শিকার না হয়ে এ ছিল শতভাগ সফল এক অভিযান এবং বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়া এই সমর কুশলতা আজ যুদ্ধবিদ্যা ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) এই বীরত্বপূর্ণ ও গৌরবময় কীর্তিকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে একটি অনুপম উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। অপারেশন জ্যাকপটের লোমহর্ষক, রোমাঞ্চকর কাহিনী সহ বন্দরের মুক্তিযুদ্ধ ও সোয়াত জাহাজ প্রতিরোধের ঘটনাবলী নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের প্র্রযোজনায় নির্মিত হতে যাচ্ছে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য যুদ্ধ চলচ্চিত্র। বন্দরের সাবেক চেয়ারম্যান এবং বর্তমান নৌপ্রধান এডমিরাল নিজামউদ্দিন আহমেদ মুক্তিযোদ্ধা নৌমন্ত্রী শাজাহান খান এর অনুপ্রেরণায় চলচ্চিত্রটি নির্মাণের এই ব্যতিক্রমী আয়োজনের উদ্যোগ নেন ও প্রস্তুতি কাজের সূচনা করেন। পরবর্তীতে মাননীয় নৌমন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধ, তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রীদের সাথে আলোচনা করে চলচ্চিত্রটি দ্রুত এগিয়ে নেবার নির্দেশ দেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে চবক এর বর্তমান চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম খালেদ ইকবাল এই চলচ্চিত্র নির্মাণকে তার অন্যতম অগ্রাধিকারমূলক কাজ হিসেবে গণ্য করছেন। এ কাজের সাথে যুক্ত সকলকে তিনি নিরন্তর প্রেরণা ও উৎসাহ যুগিয়ে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ শুরুর দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছেন।

চলচ্চিত্রটি নির্মাণের জন্য ইতোমধ্যেই তখনকার চট্টগ্রাম বন্দর ও সংলগ্ন এলাকার দৃশ্যপট ও জীবনধারা সম্পর্কে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ এবং আনুষাঙ্গিক গবেষণা প্র্রায় শেষ হয়ে এসেছে। পাশাপাশি ছবির পান্ডুলিপি প্রণয়নের কাজও অনেকদূর এগিয়েছে। সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে মেধাসম্পন্ন ও প্রথিতযশা ব্যক্তিবর্গ এ কাজে যুক্ত রয়েছেন। বন্দর কর্তৃপক্ষ এই চলচ্চিত্র নির্মাণকে তাদের জন্য অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ কাজ হিসেবে গণ্য করছেন এবং এ চ্যালেঞ্জ সফলতার সাথে সম্পন্ন করতে তারা দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ। সৃজনশীল এই প্রয়াসকে সফল করতে চবক এর সদস্য জাফর আলম, সচিব ওমর ফারুক, হিসাব বিভাগের কর্মকর্তা সন্দীপন চৌধুরী ও এস এম মারুফ সহ বন্দর কর্মকর্তাদের একটি দল নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন।

আ.ক.ম. রইসুল হক বাহার

মুক্তিযোদ্ধা, প্রাক্তন বন্দর কর্মকর্তা, সাংবাদিক ও লেখক, অপারেশন জ্যাকপট চলচ্চিত্র গবেষণা দলের সদস্য

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here