বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। মানচিত্রের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত এ শহরটিকে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে অভিহিত করা হয়। পাহাড়, সমুদ্র এবং উপত্যকায় ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য প্রাচ্যের রাণী হিসেবেও যার নাম ছড়িয়েছে। এশিয়ায় ৭ম এবং বিশ্বের ১০ম দ্রুততম ক্রমবর্ধমান এই নগরী উন্নয়নের পথযাত্রায় হতে চলেছে বাংলাদেশের সিঙ্গাপুর! এ প্রতিতুলনা একটু অবাক শোনালেও উন্নয়ন সংশ্লিষ্টরা এমনই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।

নতুন নতুন প্রকল্পে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ মাথাপিছু আয়ের শহর হতে পারে চট্টগ্রাম। বিশেষজ্ঞদের মতে, দুই লাখ কোটি টাকার ধারাবাহিক বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা আর চীন-ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক সংযোগকে গুরুত্ব দিয়ে নিকট ভবিষ্যতেই এ বন্দরনগরী একটি সমৃদ্ধ মেগাসিটিতে রূপান্তর হতে পারে।

২০১৬ সালের শুরুতেই চীন ও চট্টগ্রামের সংযোগ ঘিরে জাতীয় অগ্রগতির স্বপ্ন বুনেছিল দেশ। সে সময় ঢাকায় চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং-ইর নেতৃত্বে মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে চট্টগ্রাম-মিয়ানমার হয়ে কুনমিং পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগ, রামু-কক্সবাজার, রামু-গুনধুম ডুয়েলগেজ রেললাইন এবং মিরসরাই ও আনোয়ারায় ‘স্পেশাল ইকোনমিক জোন’ স্থাপনে আশাবাদ উঁকি দেয়। আর এই আশাবাদ চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে কার্যকর হওয়ার পথ উন্মুক্ত করে।

চট্টগ্রামকে ঘিরেই হচ্ছে কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মহেশখালী এলপিজি টার্মিনাল, বাঁশখালী কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রাউজানে ষষ্ঠ বিসিক শিল্প নগরী, বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বে-টার্মিনাল, ফ্লাইওভার ও পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে পারকি সৈকতে হোটেল ও অন্যান্য সুবিধা।

এর মধ্যে স্বপ্নের কর্ণফুলী টানেল নিয়ে নতুন করে আশার আলো দেখছেন স্থানীয় উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, বৃহত্তর চট্টগ্রাম তথা গোটা দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনবে এই টানেল। নদীর তলদেশে যোগাযোগের এমন পথ বদলে দিয়েছে বিশ্বের অনেক দেশের অর্থনীতি। মিয়ানমার হয়ে চীনের সঙ্গে সড়কপথে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়ার যে অপার সম্ভাবনা, তারও মাধ্যম হতে পারে এই টানেল।

এ প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি বলেন, ‘চীনের সাংহাই সিটির মতো চট্টগ্রাম নগরীতে পরিকল্পিত দুটি শহর গড়ে তুলতে চায় সরকার। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে সাড়ে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ টানেল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শীঘ্রই নির্মাণ কাজ শুরু হবে। নির্ধারিত সময়ে (চার বছর) নির্মাণকাজ শেষ হবে।’

সব ঠিক থাকলে আগামী ২০১৮-২০ সালের মধ্যে বৃহৎ আকারের প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ হবে। জানা গেছে, বিনিয়োগ আকর্ষণে চীনা উদ্যোক্তাদের জন্য আনোয়ারায় ৭৭৪ একর জমির ওপর আলাদা অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে। বেজা সূত্র জানায়, দেশের রফতানিমুখী জাহাজ নির্মাণ শিল্প, ইলেকট্রনিকস পণ্যসামগ্রী, ফার্নেস ও সিমেন্ট শিল্পকে সর্বাধিক প্রাধান্য দিয়ে আনোয়ারায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হবে। এছাড়া রাউজানে চট্টগ্রামের ষষ্ঠ বিসিক শিল্প নগরী প্রতিষ্ঠা হচ্ছে যার নির্মাণ কাজ ২০১৯ সালের মধ্যে শেষ হবে।

এদিকে আনোয়ারায় কোরিয়ান ইপিজেডটিতে বেশ কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে বিনিয়োগ করেছে। অন্যদিকে মিরসরাইয়ে শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনে উপযোগী করার জন্য ইতোমধ্যে সাড়ে ৫০০ একর ভূমিতে কাজ শুরু হয়েছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলটি স্থাপিত হলে এখানে আগামী ১৫ বছরে ৩০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এখানে গড়ে উঠবে বিমানবন্দর, ছোট নৌবন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্র, জাহাজ নির্মাণ শিল্প ও অটোমোবাইলসহ ভারী শিল্প-কারখানা। খুলে যাবে অর্থনীতির নতুন দুয়ার।

এ ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বে-টার্মিনাল নির্মাণ, লালদিয়া, পতেঙ্গা ও অত্যাধুনিক কর্ণফুলী কনটেইনার টার্মিনাল, অনুমোদনপ্রাপ্ত কয়লাবিদ্যূৎ কেন্দ্রের কয়লা ল্যান্ডিংয়ের জন্য বার্থ তৈরি, হিন্টারল্যান্ড সংযোগ, ‘গ্রিনপোর্ট’ কনসেপ্টকে ধারণ করে দূষণমুক্ত বন্দর প্রতিষ্ঠায় নানা প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। রয়েছে উড়াল সেতু, সড়ক সংস্কার, খাল-নদী খনন, পানি সরবরাহ প্রকল্পসহ বন্দর কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন, সিডিএ, ওয়াসা ইত্যাদি সংস্থায় হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। স্পেশাল ইকোনমিক জোন, টানেল নির্মাণসহ বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলোতে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে বলেও আশাবাদ রয়েছে চট্টগ্রামবাসীর।

চট্টগ্রামের সংসদ সদস্য, মঈন উদ্দিন খান বাদল জানান, চট্টগ্রামের উন্নয়নে দুই লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগের স্বপ্ন দেখা হচ্ছে। চট্টগ্রামের উন্নয়ন মানেই বাংলাদেশের উন্নয়ন, এটি জাতীয় উন্নয়নের সমার্থক। চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে বিনিয়োগের যে বৈশ্বিক আগ্রহ, এটিকে ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারলে চট্টগ্রাম অবশ্যই সিঙ্গাপুর হবে।’

চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন বলেন, ‘বিশ্বমানের নগরী গড়তে হলে বিনিয়োগ ও কাজে গতিশীলতার পাশাপাশি নাগরিক সমর্থন-সহায়তাও প্রয়োজন’।

হাজার বছর ধরে শিল্প বাণিজ্যের জন্য চট্টগ্রাম ঐতিহাসিকভাবেই আদর্শ জায়গা। চট্টগ্রামকে একটি অত্যাধুনিক নগরীতে রূপান্তরের সব সম্ভাবনাই এখন হাতের নাগালে, তবে এজন্য সর্বাগ্রে চাই স্বচ্ছতার সাথে সঠিক সমন্বয় ও উন্নয়ন কাজের গতিশীলতা। আর একটি উন্নত নগরীর নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষনে প্রয়োজন নাগরিকদের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here