হ্যাঁ, সমুদ্র বাণিজ্যেও শুরু হয়ে গেছে বিগ ডাটার ব্যবহার। শুধুমাত্র বন্দর নয়, পণ্য আদান-প্রদানের সম্পূর্ণ ভেল্যু চেইনকে গতিশীল ও সমন্বিত রাখতে, উন্নত পরিসেবা নিশ্চিত করতে বন্দরের প্রতিটি সূক্ষ তথ্যও এখন অতিজরুরী। বলা হচ্ছে গত ৩০০ বছরে মেরিটাইম বিশ্ব যেভাবে এগিয়েছে আগামী ১০ বছরেই পাল্টে যাবে আরও বেশি। তথ্যপ্রযুক্তির নতুন ব্যবস্থা বা বিদ্যমান ব্যবস্থার রূপান্তরের মাধ্যমে বন্দরগুলোকেই থাকতে হবে সকল উৎপাদন প্রবৃদ্ধির আলোচনার কেন্দ্রে।

শিপিং খাতকে যদি অর্থনীতির মূল স্তম্ভ বলা হয়, তাতে বোধ হয় খুব একটা ভুল হবেনা। কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রের তুলনায় অর্থনীতির এই বিভাগটি এখনও সেকেলেই রয়ে গেছে। তবে বর্তমানে পরিবর্তনের একটা স্পষ্ট লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এই পরিবর্তনে গতি আনয়নে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নিঃসন্দেহে অধিকতর উপযোগী ডেটা (তথ্য), বিশেষ করে তথ্য-উপাত্তের বিশ্লেষণধর্মী ব্যবহার। তাই ডেটা কেন্দ্রিক এই পরিবর্তনকে সামনে রেখে কিছু প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে।

কী করে বন্দরসমূহ এই তথ্য-উপাত্ত তৈরি করতে কিংবা তা ব্যবহার করে আরো বেশি কার্যকরী হওয়ার মাধ্যমে নিজেদের উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারে? এবং এই পরিবর্ধনশীল তথ্য-উপাত্ত ও তাদের বিশ্লেষণধর্মী ব্যবহার কি বন্দরসমূহের জন্য সুযোগ হিসাবে দেখা দিবে নাকি হুমকি হিসাবে? এই সকল তথ্য কী উপায়ে বন্দরকে সাপ্লাই চেইনের বিশাল ল্যান্ডস্কেপে নিজেকে সমন্বয় করে নিতে সাহায্য করবে এবং তাদের ভোক্তাদের আরো কার্যকর সেবা দিতে পারবে?

জাহাজমালিক, ব্যবস্থাপক, ব্রোকারেজ হাউজ, ফরোয়ার্ডিং এজেন্ট তথা বন্দরের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলে এখানে অর্থনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে থেকে কাজ করে। আমাজন, ওয়ালমার্ট, আলীবাবার মত জায়ান্ট কোম্পানিগুলো যারা নিজস্ব চার্টার্ড জাহাজের পাশাপাশি আলাদা টার্মিনাল লীজ নেয়ার কথা ভাবছে, তারাও কাঠামোগত পরিবর্তনের পথেই হাঁটছে। বিশ্ব বাণিজ্যের ৯০% শতাংশ সমুদ্রপথে হলেও মেরিটাইম দুনিয়ার শেষ উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারটি এসেছিল ১৯৫০ এর দশকে, যখন আইএসও কনটেইনার যাত্রা শুরু করে। কালের নিয়ম মেনে স্বাভাবিকভাবেই, প্রচলিত পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা একটি অবশ্যম্ভাবী পরিবর্তনের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে।

তীব্র প্রতিযোগিতামূলক বাজার এবং ক্ষুরধার অর্থনীতির সময়ে বহু মালিক, অপারেটর এবং চার্টারিং সংস্থার কাছে প্রায়শই দরকারি তথ্যসমূহ পাওয়ার কোনো উপায় থাকে না। ফলস্বরূপ, পণ্য পরিবহন সিস্টেমের সামগ্রিক চিত্রটি সাধারণ জনগণ দূরের কথা, সংশ্লিষ্ট অনেকের কাছেও পরিষ্কার নয়। এ কারণে সামনে চলে আসছে মেরিটাইম বিশ্বের নতুন সব প্রযুক্তিগত অবদানের কথা। শিপিং ইন্ডাস্ট্রি এখন সর্বশেষ হালনাগাদ করা বিপুল তথ্যভান্ডার দ্বারা সুসজ্জিত, সেখান থেকে সমুদ্রগামী ভেসেলের সর্বশেষ অবস্থান, পণ্য এবং কার্গোর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, নিরবচ্ছিন্ন সাপ্লাই চেইন, বন্দরে জাহাজজটের খবর – সহজেই জেনে নিতে পারছে বন্দর এবং তার স্টেকহোল্ডাররা।

নতুন এ ব্যবস্থায়, বিস্তারিত ডেটা অ্যানালাইসিস এর সাথে যোগ হচ্ছে বিশ্লেষণধর্মী, দূরদর্শী ও কৌশলগত লজিস্টিক ম্যানেজমেন্ট। এটি নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, অপার ক্ষমতাশালী এসব যন্ত্র, তথ্য এবং পদ্ধতি ভবিষ্যতে বন্দর ও সমুদ্র বাণিজ্যের চেহারাই বদলে দিবে। মেরিটাইম দুনিয়ার সাথে জড়িত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, যারা দ্রুত ও ঝামেলাবিহীন বাণিজ্যে আগ্রহী তাদের জন্যও তা হবে আশীর্বাদস্বরূপ। উদাহরণে বলা যায়, সময়মতো উপযুক্ত তথ্যের অভাবে অনেক সময় বন্দরে জাহাজ নোঙর করা, অথবা ছেড়ে যাবার ঠিক আগের মুহূর্তে এসে নিতান্ত তাড়াহুড়োয় যাত্রার খুঁটিনাটি নিশ্চিত করতে হয়। অথচ সঠিক সময়ে দরকারি সব তথ্য হাতে পেলে পুরো প্রক্রিয়াটি হয়ে উঠতে পারে আরো নিখুঁত। পণ্যের জরুরি চাহিদা মোতাবেক আমদানিকারক হয়তো সেটাকে খুব দ্রুত বিক্রেতা দেশ বা কোম্পানি কাছ থেকে কিনলেন। এরপর সর্বোচ্চ গতিতে জাহাজ ছুটিয়ে এনে কেনো কেবলমাত্র বন্দরে জাহাজজটের কারণে ঢিমে তালে চলতে হবে বা অলস বসে থাকতে হবে, যেখানে বহু আগেই এ ধরনের অনাকাঙ্খিত সমস্যাগুলোর কথা জানা সম্ভব? এ কারণে প্রয়োজনীয় তথ্যের অধিকার হাতে পেলে তাতে কেবল বন্দরই যে উপকৃত হবে তা নয়, বরং ভোক্তা পর্যায়েও পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থার উপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

বলা যায়, পোর্ট এবং শিপিং খাত আমূল বদলের দ্বারপ্রান্তে। আবার, কাঙ্খিত ফল লাভের জন্য ইনফরমেশন সিস্টেমে ঠিক কোন ধরনের বা কতটা প্রাসঙ্গিক তথ্য ইনপুট হিসেবে যাচ্ছে সেটি দেখা দরকার। সদা ব্যস্ত শিপিং এজেন্সিগুলো তাদের মুঠোফোনে এক ক্লিকেই আজকাল জানতে পারে তাদের ভেসেল এই মূহুর্তে কোথায় আছে। খোলা সাগরে কঠিন বিপদসংকুল আবহাওয়া, আকস্মিক দুর্ঘটনা, জলদস্যুর উৎপাত এড়িয়ে যাত্রাপথ নির্বিঘœ রাখা সহজ কথা না। এ কারণে, স¤পূর্ণ মানষের হাতে ছেড়ে না দিয়ে প্রযুক্তির আশীর্বাদ গ্রহণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

যেকোনো বন্দরের মূল কাজ শেষ পর্যন্ত নিজেদের দুর্বলতা ও শক্তির জায়গাটি চিহ্নিত করে সামর্থ্য ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে সর্বোচ্চ জোর দেয়া। আর অগ্রগামী ও কার্যকর বন্দর গড়ে তুলতে তথ্য আদান-প্রদানের সত্যিই কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে অবশ্য পুরোধা হিসেবে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে শিপিং টাইকুন মায়ের্¯‹, ইন্ডাস্ট্রিতে লঞ্চ করতে যাচ্ছে ‘ব্লকচেইন’ – ইলেকট্রনিক ডকুমেন্টেশন এবং  ট্র্যাকিং-এর এক বিশেষায়িত সিস্টেম। ব্লকচেইন এমন এক ডেটা ব্যবহার পদ্ধতি, যার মাধ্যমে সরবরাহ ব্যবস্থার যেকোনো প্রান্তের স্টেকহোল্ডার বা শিপমেন্ট এজেন্ট যেকোনো স্থানে থাকা কার্গো এবং দরকারি ফাইল ট্র্যাক করতে পারবে। নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ চক্রের ক্ষেত্রে এটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসবে। মায়ের্¯‹ এর চীফ ডিজিটাল অফিসার ইব্রাহিম গকচেন এর মতে, “সংস্কৃতি বদল হবে, বদলাবে দক্ষতার পরিভাষা, সহযোগিতার ক্ষেত্র, পাল্টাবে আরো অনেক কিছুই। আর সব কিছুর নিয়ামক থাকবে ভোক্তার চাহিদা।”

এ ধরনের ডিজিটালইজেশনের ফলে খরচের খাতা নীচে নামিয়ে আনার সাথে সময় সাশ্রয় এবং কর্মদক্ষতা বাড়ানোও সম্ভব হবে। মায়ের্স্ক এর প্রধান অর্থ কর্মকর্তা পিয়েরে ড্যানেট এবিষয়ে বলেন, “গত অর্থবছরে আমরা ভেসেলের কর্মদক্ষতার ৯৩ শতাংশ ব্যবহার করেছি। এই সংখ্যাকে আর ৯০ শতাংশের নীচে নামতে দেয়া হবে না। আমরা আর কখনোই ৮৮ শতাংশের দিনে ফেরত যাচ্ছি না।” বিশ্বখ্যাত আইটি প্রতিষ্ঠান আইবিএম এর সাথে মিলে মায়ের্স্ক রটারড্যাম এবং নিউয়ার্ক বন্দরে পরীক্ষামূলকভাবে ইতিমধ্যেই ব্লকচেইন সিস্টেম চালু করেছে। ড্যানেট বিশ্বাস করেন, পণ্য স্থানান্তরের তথ্য যত স্বচ্ছ ও হালনাগাদ করা হবে, পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা তত ভালোভাবে সাজানো সম্ভব। এতে ব্যয় সংকোচন এবং জাহাজজট পরিস্থিতির বৈপ্লবিক উন্নতি হতে বাধ্য। ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়ার অগ্রগতি মানে কিন্তু কিছু মানুষের কর্মসংস্থানের হ্রাস পাওয়া। ড্যানেটও তা স্বীকার করলেন, তবে সাথে এও যোগ করেন, “গতবছর আমাদের মোট খরচ ছিল প্রায় ২১ বিলিয়ন ডলার। বিক্রয় ও প্রশাসনিক কাজের মত পেপারওয়ার্কে যেখানে ২ বিলিয়নের চাইতে কম খরচ, অপারেশনাল কার্যক্রম চালু রাখা, টার্মিনাল ফি, ভেসেল এবং ইকুইপমেন্ট মেইনট্যানেন্স ফি, কর্মীদের ট্রান্সশিপমেন্ট এর মত টেকনিক্যাল কাজে ব্যয় Text Box: বিগ ডেটা কি: বিগ ডেটা এমন একটি শব্দবন্ধ যেটি বিশাল আয়তনের তথ্যভান্ডারকে নির্দেশ করে, কাঠামোবদ্ধ অথবা কাঠামোবিহীন। তবে এখানে তথ্যের পরিমাণগত প্রাচুর্যতা গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং সংস্থাগুলো সেই তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কী করছে, সেটিই আসল কথা। বিগ ডেটাকে বিশ্লেষণ করে যে ইনসাইট পাওয়া যাবে তা দিয়ে ব্যবসা পরিচালনায় অধিকতর দূরদর্শী এবং কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব। এর বৃহৎ এবং জটিল কলেবরের কারণে সাধারণ প্রচলিত ডাটা প্রসেসিং সফটওয়্যার দিয়ে বিগ ডাটা বিশ্লেষণ প্রায় অসম্ভব।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ: বিগ ডেটার মাধ্যমে আপনি যেকোনো উৎস থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত নিতে পারেন, কাজে লাগাতে পারেন বাণিজ্যের নানান চিরন্তন সমস্যার উপায় খুঁজতে, যেমন খরচ নীচের কোঠায় রাখা, সময় কমিয়ে আনা, নতুন পণ্যের উদ্ভাবন অথবা তার উন্নয়ন, সর্বোপরি বুদ্ধিমত্তার সাথে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা। বিগ ডেটাকে যখন উচ্চতর দক্ষতার সাথে বিশ্লেষণ করা হয়, তখন বাণিজ্য-সংক্রান্ত বেশ কিছু অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়। যথা: যেকোনো সমস্যা, ব্যর্থতা বা অপূর্ণতার মূল যথাসম্ভব রিয়েল টাইমে খুঁজে বের করা; ক্রেতার পণ্য কেনার ঝোঁক বা অভ্যাস বুঝে তৎক্ষণাৎ বিক্রয় কৌশল প্রবর্তন; মুহূর্তের মধ্যে সকল বাণিজ্য ঝুঁকি হিসাব করে ফেলা; ক্ষতিগ্রস্ত হবার পূর্বেই প্রতারণামূলক ঘটনা চিহ্নিত করা। 
এটি মনে রাখতে হবে যে, বিগ ডেটার কার্যকারিতা কখনোই সরাসরি এর প্রাথমিক ডেটা ভান্ডার থেকে আসে না। বরং এর সঠিক প্রক্রিয়াকরণ এবং বিশ্লেষণ করা গেলেই সেখান থেকে উঠে আসে অপরিসীম সম্ভাবনা।
ইতিহাস: বিগ ডেটা শব্দটি তুলনামূলক নতুন শোনা গেলেও ইন্টারনেট দুনিয়ায় এর ধারণাটি বেশ পুরনো। একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ইন্ডাস্ট্রি বিশ্লেষক ডাগ লেনি এই বিগ ডেটা ধারণাকে তিনটে ‘ভি’ দ্বারা সংজ্ঞায়িত করেন - ভলিউম, ভেলোসিটি, ভ্যারাইটি -আয়তন, গতি, বৈচিত্র্য। 
বিগ ডেটার ব্যবহার: বর্তমানে প্রধান যে ক্ষেত্রগুলোতে বিগ ডেটার ব্যবহার হচ্ছে সেগুলো হল- ক্রেতাকে বোঝা ও খোঁজার জন্য; ব্যবসায় চলতি ধারার পূর্বাভাস জানতে; জনস্বাস্থ্য, স্বাস্থ্য সেবা ও শিক্ষা ব্যবস্থায় উন্নয়নে; খুচরা ব্যবসায়; ভ্রমণ ও হসপিটালিটি খাতে; বৈজ্ঞানিক গবেষণায়; ক্রীড়া নৈপুণ্য উন্নয়নে; অপরাধ ঠেকাতে; শেয়ার মার্কেট ও অন্যান্য অর্থনৈতিক ট্রেডিংয়ে; মেশিন ও ডিভাইসের উন্নতি ঘটাতে; আমাজন বা ইউপিএস এর মত কুরিয়ার সার্ভিস পরিচালনায়।

হয়েছে ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার! তাই আমরা যতই প্রযুক্তিগত দিকে সমৃদ্ধ হব, চাকরির ক্ষেত্র সংকুচিত নয়, পালটে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।”

কয়েকটি বন্দরে ব্লকচেইনের পাইলট স্টাডিজের পর এ বছরের শেষ দিকে এসে স্নেহেইডার ইলেকট্রিক্সের সাথে মিলে এটিকে পুনঃনিরীক্ষা করছে মায়ের্স্ক। “বারবার পরীক্ষা করার মাঝে আসলে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে সমগ্র সাপ্লাই সিস্টেমের ঠিক কোন জায়গা বা কোম্পানি এই নতুন সফটওয়্যারে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে। প্রকৃতপক্ষে এটি একটি সাধারণ সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট, যেখানে পরীক্ষায় উৎরে গেলে একে অপারেশনে আনা হয়।”

নতুন ধারার কনটেইনার শিপমেন্ট থেকে উপকৃত হতে গেলে এর প্রতিটি ধাপ ডিজিটাল হতে হবে, সমগ্র প্রক্রিয়া থেকে কাগজের ব্যবহার অবলুপ্ত হবে এবং পরিবহন ব্যবস্থার সাথে জড়িত সকলে একই তথ্য পাবে বলে স¤পূর্ণ স্বচ্ছতা বজায় থাকবে। “শিপাররা প্রায়ই জানতে চায় যে তাদের বক্সটা এখন কোথায় আছে। এখন শিপমেন্ট-ট্রান্সশিপমেন্ট প্রক্রিয়ায় যতবার কনটেইনার কোনো পোর্টে প্রবেশ করে বা বেরিয়ে যায়, ততবার বিস্তারিত এবং সময়সাপেক্ষ কার্গো চেকিং এবং ডকুমেন্টেশন প্রক্রিয়া পার হতে হয়। এটি যথেষ্ট বিরক্তিকর।” বলছিলেন গকচেন। প্রতি বছর এভাবে শিপিং লাইনগুলোর ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় হয় শুধু পণ্যের বৈধতার কাগজ সংগ্রহ করতে। সুতরাং আশা করা যায়, অদূর ভবিষ্যতে নতুন প্রবর্তিত পদ্ধতিটি দ্বারা এ ধরনের অনাকাঙ্খিত ব্যয়ের লাগাম টানা সহজ হবে। তবে ব্লকচেইন কখনই ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়ার শেষ কথা নয়, একে বলা যেতে পারে পরিবর্তিত বন্দর ব্যবস্থার একটি অংশ।

বন্দর পরিচালনা এবং দক্ষতা বৃদ্ধির কাজটি আগের চাইতে এখন অনেকটাই সহজতর করে তোলার পিছনে প্রযুক্তিগত যেসব ব্যাপার নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে, তাদের মধ্যে অন্যতম হলো ভেসেল ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (ভিটিএমএস)। প্রাথমিক পর্যায়ে বন্দর ব্যবহারকারী জাহাজসমূহের গতিবিধি পরিচালন সুবিধা এবং নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে যার উদ্ভব। এটি এমন এক সমন্বিত ব্যবস্থা, যা দুর্ঘটনা এড়িয়ে, পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত না করে এবং অবশ্যই নিরাপদে সমুদ্রগামী জাহাজের ডকিং প্রক্রিয়া পরিচালনা করতে সক্ষম। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নজরদারি নিশ্চিত করে খোলা সাগরে জলদস্যু কিংবা অন্যান্য বিপদ থেকে জাহাজের নিরাপত্তা বিধানেও পারঙ্গম এই পদ্ধতিটি। তবে তথ্য-প্রযুক্তির এই বিশ্বায়নের যুগে সময়ের পরিক্রমায় এটি আরো সমৃদ্ধ ও বহুমুখী হয়ে ওঠার অপেক্ষায়। ভিটিএমএস এখন এমনভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে যে, অদূর ভবিষ্যতে এটি বিশ্ব বাণিজ্যের নীতি নির্ধারক, অবিচ্ছিন্ন পণ্য পরিবহন এবং পরিবেশবান্ধব হিসেবে দারুণ কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে জায়গা করে নিবে। এই পদ্ধতি থেকে সর্বোচ্চ ফায়দা পেতে হলে বন্দরগুলোকে তথ্য আদান-প্রদানের ধারনার ব্যাপারে ভিন্নভাবে চিন্তা করতে হবে। স্টেকহোল্ডারদেরও ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম এবং এর কর্মকান্ড সম্পর্কে চিরাচরিত যে দৃষ্টিভঙ্গি, তা বদলানো অনিবার্য।

এতে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই যে, জাহাজ, বন্দর এবং টার্মিনালসমূহের মধ্যে সর্বক্ষণ ত্রিমুখী যোগাযোগ থাকা আবশ্যক। প্রত্যেকের অপারেশনাল ইনফরমেশন কম সময়ে আরো বেশি শেয়ার হওয়া দরকার। প্রক্রিয়াটি সুষ্ঠুভাবে স¤পন্ন করতে বিভিন্ন সেক্টরে বেশ কিছু মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে এখনই। ব্যবহারকারীরা যেন বন্দর থেকে সর্বোচ্চ সেবা লাভ করতে পারে, সে জন্য ভিটিএমএস সিস্টেমকে দেখা হচ্ছে সমুদ্রযাত্রাকে অধিকতর পরিকল্পিত এবং ভেসেল ট্রাফিক সুচারুরূপে পরিচালনা করার অন্যতম শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে। কিন্তু এখনো বন্দরগুলো যার যার অভ্যন্তরীণ তথ্যের ব্যাপারে যথেষ্ট রক্ষণশীল আচরণে অভ্যস্ত। প্রতিযোগিতার দুনিয়ায় কখনো হয়তো এটি স্বাভাবিকই।

ইদানিং অবশ্য আঞ্চলিক বা প্রতিবেশী বন্দরগুলোর মধ্যে অবিচ্ছিন্ন উপকূল গড়ে তোলার লক্ষ্যে তথ্য আদানপ্রদানের মাধ্যমে মাদার এবং সিস্টার ভেসেল ট্রাফিক কন্ট্রোলের একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে এবং তাঁর ফলও বন্দরগুলো হাতে হাতে পাচ্ছে। ফিনল্যান্ড উপসাগরে এস্তোনিয়া, রাশিয়া, ফিনল্যান্ডের বন্দরগুলো এর আদর্শ উদাহরণ। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সাথে আইসল্যান্ড-নরওয়ে গড়ে তুলেছে ‘সেফ-সী-নেট’ নামক এক অনন্য নেটওয়ার্ক। ফলাফল: এর সব কয়টি বন্দর বিগত বছরের তুলনায় রেকর্ড সংখ্যক টিইইউস পণ্য পরিবহন করেছে। প্রকৃতপক্ষে, ভিটিএস কে সাধারণ একটি ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা সফটওয়্যার না ভেবে আগামী প্রজন্মের বন্দরকে নেতৃত্বদানকারী আবশ্যিক একটি উপাদান হিসেবে ভাবতে হবে। কারণ, উন্নত বিশ্বে এরই মধ্যে সিস্টেমটিকে কেন্দ্রে রেখে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে চলেছে। বন্দরে নিরাপত্তা আর টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে সুইডিশ মেরিটাইম এজেন্সি চালু করতে যাচ্ছে সী-ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম। ইইউ এর তহবিল থেকে প্রস্তুতকৃত মোনালিসা প্রজেক্টের বিস্তৃত রূপ এটি, যার ভিত্তিই হল বিভিন্ন পোর্টের মাঝে অবাধ তথ্যপ্রবাহ।

কানাডার পূর্ব উপকুলের সেইন্ট জন নদীর মোহনায় অবস্থিত সেইন্ট জন বন্দর – কার্গো ধারণক্ষমতার দিক থেকে দেশের তৃতীয় বৃহত্তম বন্দর। অতি সম্প্রতি তারা ভিটিএস হালনাগাদ করেছে, মূল উদ্দেশ্য সেই একটিই – বন্দর এবং স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে দ্রুততর তথ্য আদান-প্রদান নিশ্চিত করা। আজ থেকে দুই কি তিন বছরের মধ্যে ছোট-বড় সব ধরনের ভেসেল স্যাটেলাইট আপলিংকের মাধ্যমে ভূমির সাথে ২৪ ঘন্টা যুক্ত থাকবে, দশ বছর আগে যাকে কল্পনা বলে মনে করা হত। সবার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য পেতে তাই একটি সার্বজনীন ডাটাবেজের সাথে যুক্ত থাকা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। এর জন্য প্রযুক্তিগত দিক থেকে লাগবে একটি ওপেন সোর্স ইন্টারফেস, সহজেই যে কেউ তথ্য জমা করতে পারবে সেখানে। তবে তার চাইতে বড় চ্যালেঞ্জ হল, মানসিকতায় পরিবর্তন আনা। ভিটিএমএস ডাটা শেয়ারিং সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে।

-আফরোজা বীথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here