নানা রকম বিধিনিষেধের বেড়ার ফাঁদে পড়ে এক সময় পর্দার আড়ালে থাকা নারী আজ নিজ যোগ্যতায় ছড়িয়ে পড়েছে সর্বক্ষেত্রে। মহাকাশচারী থেকে সাগরের অতলে গবেষণা, আকাশযানে উড়ান থেকে ন্যানোপ্রযুক্তির উদ্ভাবক – কোথায় নেই সে! কিন্তু বিস্ময়কর ভাবে পোর্ট ম্যানেজমেন্টে, সমুদ্র যাত্রায়, নৌ-প্রকৌশলে নারীদের স¤পৃক্ততার হার খুবই কম। আমাদের দেশে তো বটেই, উন্নত দেশগুলোতেও এই সংখ্যা খুব একটা বেশি না। বিশ্বব্যাপী পুরুষশাসিত মেরিটাইম ইন্ডাস্ট্রিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, বিভিন্ন বন্দরে যারা ইতিমধ্যে কর্মরত আছেন তাদের উন্নত প্রশিক্ষণ, বন্দর বা এর সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের উর্ধ্বতন পদে কাজ করার সক্ষমতার হার বাড়ানোর লক্ষ্যে আইএপিএইচ (ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব পোর্টস এন্ড হারবারস) ২২ মে, ২০১২ সালে জেরুজালেমে অনুষ্ঠিত বোর্ড অফ ডিরেক্টরদের বার্ষিক সাধারণ সভায় তাদের অঙ্গসংগঠন আইএপিএইচ উইমেন্স ফোরামের ঘোষণা দেয়। এই ফোরামটি আইএপিএইচ সদস্য বা সদস্য নয়, এমন সকল বন্দরের নারী কর্মকর্তাদের জন্য উন্মুক্ত। সুবিশাল নৌ-নেটওয়ার্কের অংশ হয়ে কাজ করে পেশাগত চ্যালেঞ্জ সমাধানে আগ্রহী, একত্রে কাজ করে কর্মক্ষেত্রে আরও সক্রিয় অবদান রাখতে ইচ্ছুক যে কোন নারীর জন্য এই ফোরামের দরজা খোলা।

ফোরামের প্রথম চেয়ারপারসন ছিলেন নিউজিল্যান্ড পোর্ট অফ অকল্যান্ডের জেনারেল ম্যানেজার ডায়ানে এডওয়ার্ডস। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্টেইনবার্গ এন্ড অ্যা¤প অ্যাসোসিয়েটস এর নাওমি কোগোন-স্টেইনবার্গ দায়িত্ব নেন। ফোরামের বর্তমান চেয়ারপারসন হিসেবে ২০১৬ সালের  জানুয়ারি মাসে দায়িত্ব নেন মালয়েশিয়ার সাবাহ বন্দরের জেনারেল ম্যানেজার সিতি নুরাইশাহ বিনতি আজিজান। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “শিপিং সেক্টরের মত পুরুষ প্রাধান্য পাওয়া পেশায় নারীদের টিকে থাকা মুশকিল – এই ধারণা বহু আগেই বাতিলের খাতায় চলে গেছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এখনো অনেক পথ পেরোনো বাকী। বেশ কিছু দেশে স্থানীয় সংস্কার ও রীতি-নীতির কারণে নারীরা যথেষ্ট যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও নৌ-খাতের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে উঠে আসতে পারছে না। কখনো কখনো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেই লুকিয়ে থাকে নানান অদৃশ্য বাধা, যাতে নারীরা যোগ্যতা সত্তেও উর্ধ্বতন পদে নিয়োগ পান না। আমার মতে, মেয়েদের জীবনের সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ব্যক্তিগত-পেশাগত জীবনে ভারসাম্য রক্ষা করা। মাতৃত্ব, পরিবার ইত্যাদি নিয়ে একটি মেয়ে যেভাবে ভূমিকা রাখে, সেটা করতে গিয়ে স্বভাবতই তাকে অনেক  সময় সমকক্ষ পুরুষটির চেয়ে কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়তে বাধ্য হতে হয়। সমুদ্র বিষয়ে নানা রকম সামাজিক ও ধর্মীয় রক্ষণশীল আচরণও এতে প্রভাব ফেলে। আমাদের সংগঠনের উদ্দেশ্য হল এই বাধাগুলো যথাসম্ভব অপসারণ করে নৌবিজ্ঞান ও বাণিজ্যে নারীর সমান অংশগ্রহণের পথ প্রশস্থ করা। সুযোগ পেলে নারী যোগ্যতায় পুরুষের চাইতে কম নয়, এটি প্রমাণিত সত্য।”

শতাধিক সদস্য সংখ্যার আইএপিএইচ উইমেন্স ফোরামের একটি উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ হল নারীদের বন্দর সম্পর্কিত বিষয়ে উচ্চতর পড়াশোনা ও বিষয়ভিত্তিক ট্রেনিং এর সুযোগ প্রদান। ফোরামটি দুই ধরনের বৃত্তি প্রদান করে থাকে। প্রথমটি হলো, ট্রেনিং স্কলারশিপ, যা প্রতি দুই বছরে একবার দেয়া হয়, এটি সাধারণত বন্দরে প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনামূলক কাজে কর্মরত সিনিয়র নারী কর্মকর্তাদের জন্য প্রযোজ্য। উচ্চতর পড়াশোনার ব্যবস্থার পাশাপাশি পুরস্কারের অর্থমূল্য ১৫,০০০ ইউএস ডলার, সাথে থাকছে ভ্রমণ খরচসহ ফোরামের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে আমন্ত্রণ, সেখানে নিজের গবেষণাপত্র উপস্থাপনের সুযোগ। ২০১৫ সালে প্রথমবার এ বৃত্তিটি পেয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ওকল্যান্ড বন্দরের অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যানালিস্ট লুয়ানা এ¯পানা।

অপর বৃত্তিটি বছরে একবার করে দেয়া হয়। এটি বিভিন্ন বন্দরে কাজ করেন এমন সকল নারী কর্মীদের জন্য, যারা পেশাগত দক্ষতার উন্নয়ন ঘটাতে আগ্রহী, সাফল্যের সাথে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছেন অথবা বন্দরের উল্লেখযোগ্য কোনো প্রকল্পের সাথে যুক্ত ছিলেন। বিজয়িনী ৫,০০০ ইউএস ডলার প্রাপ্তির সাথে পাবেন আইএপিএইচ এর বার্ষিক সাধারণ সভায় অংশগ্রহণ ও প্রবন্ধ পাঠের মাধ্যমে নিজের সফল প্রকল্পটি বিশ্বব্যাপী প্রচারের গৌরব। এক্ষেত্রেও সুযোগটি থাকবে ভ্রমণ খরচসহ। কেনিয়ার মোম্বাসা পোর্টের হিউম্যান রিসোর্স অফিসার সাইওভাতা এমবান্দি জিতে নিয়েছিলেন এ সম্মানটি।

২০১৭ সালের মে মাসে ইন্দোনেশিয়ার পর্যটন দ্বীপ বালিতে হয়ে গেল ফোরামের দ্বিবার্ষিক সম্মেলন। এবারের ট্রেনিং স্কলারশিপটির বিজেতা পানামা মেরিটাইম অথরিটিতে সিগন্যাল বিভাগে কর্মরত নিটজেরিয়া অলিভেট ওয়াটসন স্টুয়ার্ট। তিনি জিতে নিয়েছেন নগদ ১৫,০০০ ডলারের সাথে স্পেনের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট  অফ কাতালোনিয়াতে মেরিটাইম ল এন্ড পোর্ট ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে মাস্টার্স শ্রেণিতে পড়াশোনার সুযোগ, থাকছে ২০১৯ সালে চীনের গুয়াংজুতে অনুষ্ঠিতব্য ফোরামের পরবর্তী দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে নিজ রিসার্চ পেপার উপস্থাপনের আমন্ত্রণ। ১৬ প্রতিযোগীকে পিছনে ফেলে স্কলারশিপ পাওয়ায় স্টুয়ার্ট স্বাভাবিক ভাবেই দারুণ উচ্ছ্বসিত। ট্রেনিং শেষে প্রাপ্ত শিক্ষা ও দক্ষতা দিয়ে তিনি নিজ কর্মক্ষেত্র তথা দেশে অবদান রাখার পাশাপাশি ভবিষ্যতে বিশ্বের যেকোনো বন্দরের নারী কর্মীদের আজীবন বিনামূল্যে পেশাগত পরামর্শ দিতে চান।

নাইজেরিয়ান পোর্টস অথরিটির অকুপেশনাল হেলথ শাখার অ্যাসিস্টেন্ট জেনারেল ম্যানেজার এনগোজি ওবিকিলি পেয়েছেন বাৎসরিক অপর বৃত্তিটি। ৫,০০০ ডলারের সাথে তিনি পাচ্ছেন ২০১৮ সালে আজারবাইজানের বাকুতে হতে যাওয়া আইপিএএইচ এর বার্ষিক সভায় নিজের প্রবন্ধ পাঠের সম্মান। তার দৃষ্টিতে, এই পুরষ্কার প্রাপ্তির ফলে তিনি আসলে পেয়েছেন বিশ্বের নানা দেশের, হরেক ভাষার, বিভিন্ন জাতির মানুষের সাথে দেখা করার এবং অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সুবর্ণ সুযোগ। পেশাগত সমস্যা সমাধানের বিভিন্ন কৌশল, বন্দর ব্যবস্থাপনা কি করে আরো শক্তিশালী করা যায় বা বন্দরভিত্তিক কর্মক্ষেত্রে নারীদের বিগ্ন মোকাবেলার উপায় – এ ধরণের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শেয়ার করার জন্য বৈশ্বিক একটি প্ল্যাটফর্মে যেতে পারছেন তিনি।

প্রতিষ্ঠানের প্রচারণামূলক বা নারীদের অধিক হারে সম্পুক্ত করার জন্য বৃত্তি প্রদান ছাড়া আর কী ধরনের উদ্যোগ আছে? এমন প্রশ্নের জবাবে চেয়ারপারসন বিনতি আজিজান আশাব্যঞ্জক জবাব দেন। “বিভিন্ন বন্দরের মধ্যে কর্মকর্তা ও কর্মচারী – উভয় স্তরে অচিরেই আমরা এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম চালু করতে যাচ্ছি। এছাড়া বন্দর বিশেষজ্ঞদের সাথে নবীন নারী কর্মকর্তাদের বিশেষ ট্রেনিং সেশন থাকবে। এছাড়াও সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে মেরিটাইম ও লজিস্টিক সাপোর্ট সিস্টেম ব্যবহার করে দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ থাকছে। শিপিং দুনিয়ার অন্যান্য সংগঠনগুলো, যারা আমাদের মত একই উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছে, তাদের সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধি, একই ইস্যুতে একযোগে কাজ করতে চাই। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, ডব্লিউআইএসটিএ (উইমেন্স ইন্টারন্যাশনাল শিপিং অ্যান্ড ট্রেডিং অ্যাসোসিয়েশন), আইএমও-ডব্লিউআইএমএ (উইমেন ইন মেরিটাইম অ্যাসোসিয়েশন), আংকটাড নারী উদ্যোগ কর্মসূচী এবং ডব্লিউআইএলএটি (উইমেন ইন লজিস্টিক অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট।”

আইএপিএইচ তালিকাভুক্ত চট্টগ্রাম বন্দরে কর্মরত নারীদের সামনেও রয়েছে ফোরামের দুই ধরনের বৃত্তি অর্জনের হাতছানি। এবারের আয়োজনের পালা ফুরিয়ে গেছে, কিন্তু আগামী বছরের জন্য চোখ রাখুন এই ঠিকানায়: www.iaphworldports.org/news| যোগ দিতে পারেন ফেসবুক IAPH Women’s Forum গ্রুপে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here