চট্টগ্রামের ইতিহাসে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি

ততদিনে ভারতবর্ষে শক্ত ঘাঁটি গেড়ে বসেছে পর্তুগিজেরা। কিন্তু বাণিজ্য করতে এসে দস্যুবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়া এবং স্থানীয় রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের কারণে ভারতের বিভিন্ন রাজা পর্তুগীজদের বিরুদ্ধে রীতিমত যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। সে সময় বাংলার দৃশ্যপটে আর্বিভূত হয় ওলন্দাজরা। পর্তুগীজ নাবিকদের দৌরাত্মের কারণে স্থানীয় শাসকদের ওলন্দাজদের উপর নির্ভরশীলতা বেড়ে যায়। আর এ কারণে তারা দ্রুত ব্যবসায় উন্নতি সাধন করতে থাকে।

ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্ম ১৬০২ সালে। ইন্দোনেশিয়ার বাটাভিয়া শহরকে কেন্দ্র করে তারা এশিয়া অঞ্চলে বাণিজ্য বিস্তার করে। এই সময় আরাকান ও বাংলার সিল্ক, কটন, চাল ও দাসের চাহিদা ছিল প্রচুর। ওলন্দাজ বণিকদের চড়া দামে এই সব পণ্য অন্যদের কাছ থেকে কিনে নিতে হতো ফলে লাভ হতো কম। তাই তারা সরাসরি বাণিজ্যের জন্য আরাকান ও বাংলায় বাণিজ্য ঘাঁটি স্থাপনের পরিকল্পনা করে। বাটাভিয়ার ডাচ কুঠির প্রধান জ্যান গাফ ১৬১৫ সালের মে মাসে দ্যুইভে নামের জাহাজে করে আরাকান ও বাংলার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। 

সেই সময় আরাকানের শাসক ছিলেন মেং খোমাং, যার আরেক নাম ছিল হুসেন শাহ। ১৬১২ সালে আরাকানের সিংহাসনে আরোহণের পর তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয় আরাকান ও চট্টগ্রাম অঞ্চলথেকে পর্তুগীজদের বিতাড়িত করা। কারণ পর্তুগীজরা এই সময় রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহে চট্টগ্রামের আরাকানী শাসকদের পক্ষ অবলম্বন করে।

ইতিহাসের এই প্রেক্ষাপটে আরাকানে আসে ওলন্দাজেরা। জ্যান গাফ আরাকান পৌঁছে রাজার কাছে সরাসরি বাণিজ্যের অনুমতি প্রার্থনা করেন। আরাকানে ব্যবসার সুযোগ মিললেও এই যাত্রায় তাদের আর বাংলায় পৌঁছা হয় না। সমুদ্র প্রচ- অশান্ত থাকায় গাফকে বাটাভিয়ায় ফিরে যেতে হয়। যেহেতু চট্টগ্রাম সে সময় আরাকান অধীনে ছিল তাই এই অভিযানের মধ্য দিয়েই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ওলন্দাজদের বাণিজ্যের পথ সুগম হয়।

আরাকানে বাণিজ্যের অনুমতি লাভের পর চট্টগ্রামের কাছে ডিয়াং নামক এলাকা ওলন্দাজদের অন্যতম বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হয়। এশিয়ায় তখন বাণিজ্য এবং উপনিবেশ বিস্তার নিয়ে পর্তুগীজ ও ওলন্দাজদের মাঝে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়। তবে চট্টগ্রামে ওলন্দাজরা তাদের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী পর্তুগীজদের সাথে সরাসরি কোনো ধরনের সংঘর্ষে লিপ্ত হয়নি। বরং ফিরিঙ্গিরা তখন বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোকজন অপহরণ করে চট্টগ্রামে নিয়ে আসত। আর রাজা, রাজার প্রতিনিধি কিংবা ওলন্দাজরা তাদের কিনে নিত। পরবর্তীতে ওলন্দাজরা তাদের ক্রীতদাস হিসেবে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে বিক্রি করে দিত। এছাড়া তারা বাংলার চাল, সিল্ক ও কটনের বাণিজ্যেও বেশ লাভবান হয়ে ওঠে।

এই সময় বার্মায় ওলন্দাজ জাহাজের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। কারণ বার্মা রাজার সন্দেহ ছিল আরাকানের নৌবাহিনীকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে ওলন্দাজরা সাহায্য করছে। এরপর ১৬২১ সালে ভারতের মুঘল বাদশা জাহাঙ্গীরের সেনাপতি ইব্রাহিম খান চট্টগ্রাম আক্রমণ করলে ওলন্দাজরা আরাকানের নৌশক্তিকে সাহায্য করে। এ যুদ্ধে বাদশা জাহাঙ্গীর পরাজিত হন। এতে এই অঞ্চলে ওলন্দাজদের প্রতিপত্তি বেড়ে যায়।

থিরি থুডাম্মা বা সালিম শাহ ১৬২২ সালে আরাকানের সিংহাসনে আরোহন করেন। তিনি তার ভাইকে চট্টগ্রামের শাসক হিসেবে নিয়োগ দেন। পর্তুগীজদের প্রতি কঠোর অবস্থানের কারণে রাজা ওলন্দাজদের বিশেষ সুবিধা প্রদান করেন।

১৬২৪ সালে আরাকান রাজা ওলন্দাজদের কাছে বছরে ২,০০০ থেকে ৩,০০০ দাস বিক্রির প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। দাস ব্যবসা বৃদ্ধির কারণে ১৬২৫ সালে বাংলা থেকে ১০,০০০ নাগরিককে আরাকানে তুলে আনা হয়। কিন্তু এক মহামারিতে ৪,০০০ বন্দীর করুণ মৃত্যু ঘটে। অবশিষ্টদের স্বাস্থ্যও ভেঙে পড়ে। ফলে দাস ব্যবসায় দারুণ মন্দা দেখা দেয়। 

অন্যদিকে ১৬৩১ সালে স্থানীয় ওলন্দাজ প্রধানের বাটাভিয়ায় পাঠানো এক তথ্যে জানা যায়, আরাকান এবং বাংলায় কয়েক বছর ধরে তেমন চাল উৎপন্ন হয়নি। এতে চাল ব্যবসায় মন্দা এবং এই অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এর প্রভাব ওলন্দাজ বাণিজ্যের উপর পড়ে। 

রাজা নারাপাতি আরাকানের সিংহাসনে আরোহন করার পর চট্টগ্রামে ওলন্দাজদের ব্যবসা আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে – এটা ১৬৩৮ সালের কথা। রাজার অনুমতিক্রমে সে সময় ওলন্দাজদের একটি নৌবহর আরাকান রাজ্যে ঘুরে বেড়াতো মূলত এই অঞ্চলে ওলন্দাজ বাণিজ্য জাহাজের নিরাপত্তা প্রদানের জন্য।  

১৬৪৩ সালে রাজা নারাপাতি অসুস্থ হয়ে পড়লে বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে রাজার নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পড়ে। এই সময় ওলন্দাজ বাণিজ্য বহরটিকে মরুহাং-এ আটকে ফেলা হয়। এর সকল পণ্য বাজেয়াপ্ত এবং ক্যাপ্টেনসহ নাবিকদের বন্দী করা হয়। যার ফলে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ওলন্দাজদের ব্যবসা ও প্রভাব দুই দারুণ হ্রাস পায়।         

বাংলার নবাব শায়েস্তা খান ১৬৬৬ সালে তার চট্টগ্রাম অভিযানে ওলন্দাজদের নৌযান দিয়ে সাহায্য করতে বলেন। বিনিময়ে নবাব চট্টগ্রামের কিছু অঞ্চল প্রদান এবং এই বন্দরে ওলন্দাজদের বাণিজ্য শুল্ক মওকুফের বিষয়টি বিবেচনার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। ওলন্দাজরা নবাবকে সাহায্য করতে রাজী হলেও বাটাভিয়া থেকে সে সাহায্য এসে হাজির হয় ১১ অক্টোবর ১৬৬৬ তারিখে। কিন্তু তার নয় মাস আগেই বুজুর্গ উম্মিদ খানের হাতে চট্টগ্রামের পতন ঘটে। এ অঞ্চলে তাদের বাণিজ্যে ভাটা পড়ার এটিও একটি কারণ। তবে অচিরেই সেই মন্দাভাব কাটিয়ে আঠারো শতকের ৩০-এর দশক পর্যন্ত এ অঞ্চলে তারা বাণিজ্য বিস্তার অক্ষুণœ রাখে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here