চট্টগ্রাম বন্দরের আবাসন ব্যবস্থা

চট্টগ্রাম বন্দরের অব্যাহত সাফল্যের পেছনে  রয়েছে কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিকদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, কর্মনিষ্ঠা ও নিরলস পরিশ্রম। তাদের উৎপাদনশীলতার সর্বোচ্চ স্তরকে কাজে লাগিয়ে ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির চাহিদা পূরণে কাজ করছে বন্দর। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মস্পৃহা বাড়াতে কর্তৃপক্ষের রয়েছে প্রণোদনামূলক আয়োজন। জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের সাথে সাথে মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণের উপর জোর দিচ্ছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। প্রায় সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাদের পোষ্যদের জন্য রয়েছে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত আবাসন ব্যবস্থা, হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ, ক্লাব, খেলার মাঠ, হাট-বাজার ও ধর্মীয় উপসানালয়।

বন্দরের কাজের বিশেষ ধরন ও প্রকৃতির জন্য নির্বিঘেœ এবং সূচারুভাবে তা পরিচালনার জন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মস্থলের কাছাকাছি থাকার ধারণা থেকেই আবাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠে। এখনকার আধুনিক সুযোগ-সুবিধাপূর্ণ আবাসন ব্যবস্থা অল্প সময়ের ব্যবধানে গড়ে ওঠেনি। আবাসনের ইতিহাস বন্দরের ইতিহাসের মতো পুরোনো না হলেও ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই বন্দরে নিয়োজিত শ্রমিক-কর্মীদের জন্য আবাসন সুবিধা গড়ে তুলতে সেসময়কার কর্তৃপক্ষের তৎপরতা দেখা যায়। পাকিস্তান আমলের (১৯৬৫-১৯৬৬) শেষ দিকে সদরঘাট থেকে বন্দর ভবন বর্তমান স্থানে স্থানান্তরিত হওয়ার পর থেকে বন্দর ভবনের কাছেই বর্তমান হাইস্কুল কলোনি, উত্তর ও দক্ষিণ আবাসিক এলাকায় ভবন গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়। এসময়ে রেল-পোর্ট ট্রাস্টের অধীনে বন্দর পরিচালিত হতো বলে রেলওয়ের অনেক জায়গায় বন্দরে কর্মরতদের জন্য আবাসিক ভবন তেরি করা হয়। পরবর্তীতে রেলওয়ে ও পোর্ট আলাদা হওয়ার প্রেক্ষিতে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় এসব ভবন ও জায়গার মালিকানার ক্ষেত্রে সৃষ্ট জটিলতা মীমাংসা করা হয়।

ষাটের দশকের মাঝামাঝি চিটাগাং কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি) এলাকার মহেশখাল সেতু এলাকায় বন্দরের নিজস্ব জায়গায় ৪র্থ শ্রেনির শ্রমিকদের নিজ উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল একটি কলোনি, যা ‘ঢাকা কলোনি’ হিসেবে পরিচিত ছিল। কর্মচারীরা নিজেরা কাঁচা ঘর গড়ে তোলে কলোনিতে। পরবর্তীতে অবশ্য বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্মচারীদের জন্য আবাসনের সকল সুযোগ-সুবিধা সরবরাহ করে। ১৯৮০ সালের দিকে কনটেইনার টার্মিনাল তেরির উদ্যোগ নেয়া হলে অন্যত্র সরিয়ে দেয়া হয় কলোনিটি।

বন্দরের সম্প্রসারণের প্রয়োজনে একসময় জেটির কাছাকাছি থাকা আবাসিক এলাকাগুলো স্বল্প দূরত্বে সরিয়ে নেয়া হয়। নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল তৈরির উদ্যোগ নেয়া হলে ১৯৯০ সালের দিকে ভেঙ্গে ফেলা হয় এ এলাকায় থাকা প্রায় ৫৭ ইউনিট বাসা। আর শ্রমিকদের বৃহত্তম আবাসিক এলাকা যা ‘লেবার কলোনি’ বলে পরিচিত ছিল ডক শ্রমিক ম্যানেজমেন্ট বোর্ড বিলুপ্তির সাথে সাথে এ কলোনিরও সমাপ্তি ঘটে। ২০০৮ সালে শ্রম অধ্যাদেশ গেজেট আকারে প্রকাশিত হলে সকল নিবন্ধিত শ্রমিকদের আত্মীকরণ করা হয়। এখন বেসরকারিভাবে বার্থ  ও টার্মিনাল অপারেটররা শ্রমিক নিয়োগের কাজটি করছে।

স্বাধীনতার পর বন্দর পরিচালনায় নতুন গতি আসে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধান বন্দর হিসেবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন। আবাসন সুবিধা বৃদ্ধির অংশ হিসেবে বর্তমান হাইস্কুল কলোনিতে তৈরি করা হয় ৪-৫টি নতুন ভবন। মূলত এ সময় থেকে আধুনিক আবাসন ব্যবস্থার সূচনা ঘটে। এরপর ধাপে ধাপে বন্দরের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী-শ্রমিকদের জন্য গড়ে তোলা হয় আবাসিক এলাকা। বাসা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, উন্নত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা, সড়ক বাতি, খেলার মাঠ ও পার্কসহ পরিপূর্ণ আবাসন সুবিধা রয়েছে এসব এলাকাগুলোতে। আবাসিক এলাকাগুলোর সাথে হাসপাতাল ও বাজারের রয়েছে উন্নত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। নিয়মিত পানি সরবরাহ ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা রয়েছে প্রত্যেকটি ভবনে।

অধুনা বন্দরের পুরাতন ভবনগুলো ভেঙে পুনরায় আরো বেশি আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত আবাসিক ভবন তৈরি করা হচ্ছে। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে তৈরি করা হচ্ছে এসব আবাসিক ভবন। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের বিস্তৃতির সাথে সাথে বাড়ছে বন্দরের কর্মকান্ডের ব্যাপ্তি, উন্নয়ন কর্মকান্ড ও অপারেশনাল কার্যক্রম। ফলে নতুন করে যুক্ত হচ্ছে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী। নতুন-পুরাতন সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আবাসিক সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করছে কর্তৃপক্ষ।

বন্দর কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা আবাসিক এলাকা। বন্দরের মূল এলাকা থেকে দুই কিলোমিটারের মধ্যেই প্রায় সকল আবাসিক এলাকা তৈরি করা হয়েছে। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও সহজেই কর্মস্থলে যাতায়াত সুবিধা রয়েছে বলে সঠিক সময়ে কাজে যোগ দিতে পারেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এতে তারা যেমন মানসিক প্রশান্তি পান, তেমনি বন্দরের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতেও তা প্রতিনিয়ত ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

আবাসিক ভবন তৈরি, মেরামত ও বরাদ্দের মূল কাজটি করে থাকে প্রকৌশল বিভাগ। নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বাসা বরাদ্দ পেয়ে থাকেন বন্দর কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। এজন্য বন্দরের রয়েছে নিজস্ব আবাসন নীতিমালা। নীতিমালা অনুযায়ী কর্মচারীরা এ, বি, সি টাইপের  (বাসার ধরন) বাসা, ২য় শ্রেনির কর্মকর্তারা ডি টাইপের বাসা ও প্রথম শ্রেনির কর্মকর্তারা ই এবং এফ টাইপের বাসা পেয়ে থাকেন। বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, বোর্ড সদস্য, পরিচালক, বিভাগীয় প্রধান ও উপ-প্রধানদের জন্য  রয়েছে বাংলো। অবিবাহিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য রয়েছে ডরমেটরি সুবিধা। শ্রেনিভেদে বাসার আকার ও আয়তনে ভিন্নতা থাকলেও সকল আবাসিক এলাকায় সব ধরনের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান। রয়েছে উন্নত পানি-নিষ্কাশন ব্যবস্থা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা।

পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আবাসিক এলাকাগুলোতে ভবন তৈরি করে প্রকৌশল বিভাগ। পরবর্তীতে এগুলোর সংরক্ষণ ও সংস্কারের কাজটিও এ বিভাগ করে থাকে। ভবনের নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর প্রকৌশল বিভাগ আনুপাতিক হারে বন্দরের বিভিন্ন বিভাগকে বাসা বরাদ্দ দিয়ে থাকে। সংশ্লিষ্ট বিভাগ নিজস্ব কর্মচারীদের গ্রেড, বেতনস্কেল ও জ্যোষ্ঠতার ভিত্তিতে বাসা বরাদ্দ দেয়। তবে কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে প্রকৌশল বিভাগ নিজেই বরাদ্দ দিয়ে থাকে। বরাদ্দের সময় উভয় ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণভাবে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। প্রতি বছর বাসা খালি থাকা সাপেক্ষে এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে কর্তৃপক্ষ।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের আবাসন ব্যবস্থাপনার অধীনে ৪টি বড় আবাসিক এলাকা রয়েছে। এগুলো ছাড়াও বন্দরের আশেপাশের এলাকা ও স্বল্প দূরত্বে আরো ১০টি স্থানে রয়েছে বন্দরের নিজস্ব আবাসিক ভবন। বড় আবাসিক এলাকাগুলোর মধ্যে বন্দর উত্তর আবাসিক এলাকা, বন্দর পূর্ব আবাসিক এলাকা, বন্দর হাইস্কুল কলোনি, বন্দর দক্ষিণ আবাসিক এলাকা উল্লেখযোগ্য। এছাড়া সদরঘাট, অভয়মিত্রঘাট, বন্দর স্টেডিয়াম সংলগ্ন, আগ্রাবাদ ডেবার পাড়, স্টেশন কলোনি, চাক্তাই, এনায়েত বাজার, টাইগারপাস, আমবাগান ও ওয়্যারলেস কলোনিতে রয়েছে আবাসিক ভবন ও বাংলো। আবাসিক এলাকার ভেতরে ও বাইরে মোট ৭৩৪টি পাকা ও টিনশেড বিল্ডিংয়ে ৩ হাজার ৫৫ ইউনিট বাসা রয়েছে। এরমধ্যে উত্তর আবাসিক এলাকায় অবিবাহিতদের জন্য ৩২০টি ও সদরঘাটে ২৪০টি সিট রয়েছে। সর্বাধিক আবাসিক ভবন রয়েছে বন্দর উত্তর আবাসিক এলাকায়। ফ্যামিলি বাসা ও ডরমেটরি মিলিয়ে এখানে ৪১৮টি ভবনে ৮১২টি ফ্যামিলি এবং ১০টি ভবনে ৩২০ জন ব্যাচেলর থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। বন্দর পূর্ব আবাসিক এলাকায় রয়েছে ৫৩টি ভবন, যেখানে ৯৫০ ইউনিট ফ্যামিলি বাসা রয়েছে। বন্দর হাইস্কুল কলোনিতে ৩০টি ভবনে ১৮৭ ইউনিট ফ্যামিলি বাসা, বন্দর দক্ষিণ আবাসিক এলাকায় ৭৮টি ভবনে ১১৪ ইউনিট ফ্যামিলি বাসা রয়েছে। দক্ষিন আবাসিক এলাকায় রয়েছে সর্বাধিক ৩৭টি বাংলো যা মূলত বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালকবৃন্দ, বিভাগীয় প্রধান ও উপ-প্রধানরা পেয়ে থাকেন।

আবাসিক এলাকাগুলোর বাইরে সর্বাধিক আবাসিক ভবন রয়েছে মনোহরখালীতে। এখানে ২৬টি ভবনে ১০৮ ইউনিট ফ্যামিলি বাসা ও অবিবাহিতদের জন্য ২৪০টি সিট রয়েছে। এরপরে যথাক্রমে সদরঘাটে ১৩টি ভবনে ৮৩ ইউনিট ফ্যামিলি বাসা, অভয়মিত্রঘাটে ১১টি ভবনে ৮২ ইউনিট ফ্যামিলি বাসা, আগ্রাবাদে ৬৮টি ভবনে ৬৯ ইউনিট ফ্যামিলি বাসা, এনায়েত বাজার এলাকায় ৫টি ভবনে ৫ ইউনিট বাসা  ও ২টি বাংলো রয়েছে, স্টেশন কলোনিতে ৪ টি ভবনে ৪ ইউনিট ফ্যামিলি বাসা, চাক্তাইয়ে ২টি ভবনে ২ ইউনিট বাসা, ওয়্যারলেসে ১টি ভবনে ১ ইউনিট ফ্যামিলি বাসা, আমবাগান এলাকায় ২টি ভবনে ২ ইউনিট বাসা ও টাইগারপাসে ২টি ভবনে ২ ইউনিট ফ্যামিলি বাসা রয়েছে।

এছাড়াও সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অধীনে নতুন নতুন আবাসিক ভবন গড়ে তোলা হচ্ছে। ২০০৯ সাল থেকে অদ্যাবধি গত ৮ বছরে বন্দর উত্তর ও পূর্ব আবাসিক এলাকায় বিভিন্ন টাইপের ৪১২ ইউনিট বাসা তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া আরো ৫৭০ ইউনিট বাসা তৈরির কাজ চলমান রয়েছে। এর মধ্যে ১ম শ্রেণীর কর্মকর্তাদের জন্য ৩৬ ইউনিট, কর্মচারীদের জন্য এ, বি ও সি টাইপের যথাক্রমে ৩০, ৪৬৮ ও ৩৬ ইউনিট বাসা রয়েছে। মাস্টার প্ল্যানের অধীনে বন্দর হাইস্কুল কলোনিতে ১ম শ্রেনির কর্মকর্তাদের জন্য ৯ তলা বিশিষ্ট আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত ভবন নির্মাণের কাজ  শুরুর পথে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কনসালটেন্ট নিয়োগ করা হয়েছে। কর্মচারীদের জন্য বন্দর উত্তর আবাসিক এলাকায় প্রায় ৫০ একর জায়গার উপর ১০১টি ভবন নির্মাণের প্রকল্প এগিয়ে চলছে। যেখানে এ, বি ও সি টাইপের প্রায় ৩ হাজার ৬৬০ ইউনিট বাসা নির্মাণ করা হবে। ইতিমধ্যে ৭২ ইউনিট অর্থ্যাৎ ২টি ভবনের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। পর্যায়ক্রমে শতভাগ আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নতুন প্রকল্প গ্রহণ করার পরিকল্পনা রয়েছে কর্তৃপক্ষের।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here