২০১৭ সাল শেষ অর্ধে এসে অন্যান্য সময়ের তুলনায় শিপিং ব্যবসায় বেশ মন্দা ভাব দেখা যাচ্ছে। তাই বিশ্ববাণিজ্যের হৃদপিন্ড হিসেবে পরিচিত এই খাতকে ফের চাঙা করে তুলতে বন্দর আর সংশিষ্ট টার্মিনালগুলো যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে সেগুলো বিবেচনায় আনা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

বর্তমান চিত্রটা বেশ পরিষ্কার

ক্রমবর্ধমান আয়তনের জাহাজগুলোর প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে লভ্যাংশ থাকছে খুবই কম। এতে বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়ছে। এ থেকে উত্তরণে বন্দরসমূহের উচিত ২০২০ বা এর পরবর্তী সময়ের জন্য নিজেদের প্রস্তুত রাখা এবং ভবিষ্যৎ উন্নয়নের মূল কেন্দ্রগুলো চিহ্নিত করা। কানাডিয়ান আইস হকি খেলায় যেমনটা বলা হয়ে থাকে ‘বল যেখানে আছে, সেখানে নয়, বরং যেখানে যাবে, সেখানেই তোমার থাকা উচিত।’

তবে বন্দরের মতো বিশাল এক অবকাঠামো, যেটি প্রতি মুহূর্ত কর্মচঞ্চল থাকে, প্রতিটি দিন যেখানে আসে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে এবং প্রতি মাসে আবশ্যিক কাজের তালিকা যায় বদলে – সেখানে ব্যবসা, বিনিয়োগ, নির্মাণ ও কৌশলগত আগাম পূর্বাভাস এবং তা বাস্তবায়ন করা কতখানি কঠিন তা বলা বাহুল্য। যথোপযোগী কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে বাহবা নেয়া যতটা সহজ, ব্যর্থতার দায়ভার নেয়াটা ততোধিক কঠিন। কারণ বন্দর নিয়ে আমাদের আজকের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি, সঠিক পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের উপর নির্ভর করছে নৌবাণিজ্যে ভবিষ্যত প্রজন্মের সাফল্য। ২০২০ বা ২০৩০ এর দশকে বৃহদাকার যে সব বাণিজ্য তরী সাগরে ভাসতে চলেছে, তাদের মোকাবেলা করতে আমাদের অধিকতর কৌশলী এবং বিচক্ষণ কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এক্ষেত্রে পরবর্তী দশকজুড়ে বন্দরে বিনিয়োগ নিয়ে দুটি ধারণা বহাল থাকবে Ñ বন্দরে ডিজিটাল বিপ্লব ঘটানো এবং নিরবচ্ছিন্ন পণ্য সরবরাহ নিশ্চিতকরণে এর প্রধান ভূমিকা অব্যাহত রাখা।

প্রথমত বন্দরের কার্যক্রম আরো গতিশীল করে তুলতে ডিজিটাল বিপ্লবের বিকল্প নেই। স¤পূর্ণ ডকিং এরিয়া ভেঙ্গেচুরে নতুন করে নির্মাণ শুধু সময়সাপেক্ষই নয়, অত্যন্ত ব্যয়বহুল। অত সময় এবং অর্থ – দু’ই বন্দর কর্তৃপক্ষের জন্য জোগাড় করা কঠিন হয়ে পড়ে। এর একটি সমাধান হতে পারে স¤পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে কার্গো হ্যান্ডলিং প্রক্রিয়া পরিচালনা করা। সেক্ষেত্রে ডিজিটাইলেজেশন কান্ডারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। তবে নৌবাণিজ্যে ডিজিটাল প্রযুক্তি এসে সবকিছু এক মুহূর্তে সহজ করে দেবে – এরকম ধারণা নিয়ে থাকা ভুল হবে। আমাদের স্মরণে রাখতে হবে বিজ্ঞানের এই উৎকর্ষের যুগেও নৌপ্রযুক্তি সর্বব্যাপী হয়ে উঠেনি। দূরবর্তী দূরত্বে পরিচালনের ক্ষেত্রে বলা যায়, অনিচ্ছায় হলেও জাহাজ চলাচল এখন হামাগুড়ি দিয়ে চলছে – যেহেতু অটোমেশন ঘিরে প্রাথমিক উদ্দীপনা হ্রাস পেয়েছে বহুলাংশে। সমস্যাটা প্রযুক্তির নয় মোটেও – তা গ্রহণ করার মানসিকতায়।

অবশ্য মাঝারি দূরত্বে চলাচলকারী জাহাজগুলোতে আজকাল সার্বক্ষণিক স্যাটেলাইট যোগাযোগ রয়েছে। যার মানে হলো জলের জাহাজ স্থলের বন্দর বা অফিসের সাথে ২৪ ঘন্টাই সংযুক্ত থাকছে। যেসব সিদ্ধান্তশুধু জাহাজের ব্রীজে বা ইঞ্জিনরুমে নেয়া হতো, তা এখন একই সময়ে তিন হাজার মাইল দূরের অফিসে বসেও নেয়া যায়।

ঠিক এই ধরনের উন্নয়ন বন্দরের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। গত বছরের এপ্রিলে ইউএস শ্রমমন্ত্রী থমাস পেরেজ এবং বাণিজ্যমন্ত্রী পেনি প্রিটজকার জার্মানির হামবুর্গ বন্দর পরিদর্শন করেন। সেখানে তাঁরা গিয়েছিলেন অল্টেনভের্ডার কন্টেইনার টার্মিনালে, যা পুরোপুরি অটোমেটেড। মন্ত্রী পেরেজ সেখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলেন। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যিক চাহিদা মেটাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বন্দরের জন্য নেয়া প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কিছু পদক্ষেপ তুলে ধরেন তিনি। পোর্ট অব লস এঞ্জেলস এবং পোর্ট অব লং আইল্যান্ড বিভিন্ন প্রকল্পে বেশ বড় অংকের বিনিয়োগ করেছে, অর্থাৎ বন্দর পরিচালন ক্ষমতা এবং দক্ষতা দুটোই বাড়বে সন্তোষজনক হারে। ভার্জিনিয়া বন্দর বলছে, পণ্যবাহী কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের ক্ষেত্রে অটোমেটিক স্ট্যাকিং ক্রেন বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম, যা আবার পরিবেশ বান্ধবও বটে। আসছে স্বয়ংক্রিয় প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং দূর নিয়ন্ত্রিত মনুষ্যবিহীন জলযান এবং স্ট্র্যাডল ক্যারিয়ার। এছাড়া রয়েছে স্বয়ংক্রিয় মুরিং ও বার্থিং সিস্টেম, অনশোর পাওয়ার এবং ক্রেন সুবিধা।

গ্লোবাল ইনস্টিটিউট অফ লজিস্টিকসের সিইও কাইরান রিং এর বিশ্বাস, একুশ শতকের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বোচ্চ নিদর্শন থাকবে পোর্ট ম্যানেজমেন্ট এর ক্ষেত্রে। বিনিয়োগকারী ও নীতিনির্ধারণী মহলে প্রাথমিকভাবে হয়তো এসব প্রকল্প উচ্চাভিলাষী মনে হতে পারে। কিন্তু বন্দরের চিরকালীন কিছু সমস্যা যেমন: শ্রমিক অসন্তোষ, রাজনৈতিক অস্থিরতা অথবা সীমিত জায়গা Ñ এসবের স্থায়ী সমাধান মিলবে।

স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি যে শুধু জেটি বা টার্মিনালে তৎপর থাকবে, তা নয়। বরং বন্দরের ভেতরে অথবা চারপাশের সকল ক্ষেত্র অটোমেশনের আওতায় আনা উচিত, একেবারে প্রবেশদ্বার থেকে শুরু করে। এতে সমুদ্রগামী ভেসেল এবং অফশোরে এর পরিচালন, লোডিং, ডকিং প্রক্রিয়ায় নিযুক্ত সকলের মধ্যে একই ছন্দে কাজ করার স্বাচ্ছন্দ্য ও গতি আসবে। বন্দরের যন্ত্রপাতি, টার্মিনাল এবং বিভিন্ন পরিসেবা – সকলে সমন্বয়ের মাধ্যমে কার্য সম্পাদন করলে সাশ্রয় হবে শ্রম এবং সময়ের। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বন্দরে ভিক্টোরিয়া ইন্টারন্যাশনাল কনটেইনার টার্মিনালে প্যানাম্যাক্স জাহাজের উপযোগী ছয়টি শিপ-টু-শোর গ্যান্ট্রি ক্রেন সমন্বিতভাবে কাজ করছে স্বয়ংক্রিয় ইয়ার্ড ক্রেনের সাথে যা টার্মিনালটিকে একটি ‘পেপারলেস টার্মিনাল’ এ পরিণত করেছে। লিভারপুল ২ পীল পোর্টে আছে অত্যাধুনিক অটোগেট প্রযুক্তি। এ সকল কর্মকান্ডের  উদ্দেশ্য আনলোডিংকারী ক্যারিয়ার ট্রাক টার্মিনালে প্রবেশের পূর্বেই পণ্যের নিরাপত্তা প্রদান, ঝুঁকি হ্রাস এবং দ্রুততর সময়ে আমদানি-রপ্তানি নিশ্চিত করা।

যখন পরিবহন সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছে, অবাধ তথ্যপ্রবাহ এবং পুনরাবৃত্তিমূলক সেবা যখন নিশ্চিত হয়, তখন কনটেইনার ভিত্তিক নৌবাণিজ্য সর্বোত্তমভাবে কাজ করছে বলা যায়। অতএব সহজেই অনুমেয়, কেন কনটেইনার খাতে অটোমেশন প্রকল্পে পূর্বের তুলনায় বেশি বরাদ্দ থাকা উচিত। সেক্ষেত্রে তেলবাহী ট্যাংকার, রো-রো, শুকনো বাল্ক জাহাজ বা কোস্টাল শিপিং সার্ভিসে ডিজিটাল সামর্থ্য কাজে লাগিয়ে অধিকতর লাভবান না হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমরা আশা করতে পারি পর্যটন জাহাজসমূহও স্বয়ংক্রিয়তার দিকে দ্রুত অগ্রসর হয়ে বিশ্ব পর্যটন-পরিবহনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলবে, যদিও নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে যন্ত্রের তুলনায় মানুষই বেশি নির্ভরযোগ্য।

পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নহীন রাখতে বন্দর কর্তৃপক্ষগুলো এখন আরো স্বচ্ছ, দক্ষ ও সমন্বিত। বন্দরের সকল বিভাগ, দপ্তর ও ব্যবহারকারী নিজেদের মধ্যে সুসংগঠিত থেকে একযোগে কাজ করার পাশাপাশি হিন্টারল্যান্ড এবং অন্যান্য বন্দরের সাথে যুক্ত থাকার নীতি গ্রহণ করছে। পোর্ট ম্যানেজমেন্ট এখন আর বিচ্ছিন্ন থেকে নয়, বরং আরো বিস্তৃত সুবিধা দেয়া এবং ডিজিটালি সংযুক্ত বিশাল নেটওয়ার্কের অংশ হওয়ার কথা ভাবছে। যেখানে জল এবং স্থল, দুই দিকেই সমান গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

কাইরান রিং বলেন, “নৌবাণিজ্যে স্বয়ংক্রিয়তা আনাটা অত্যাবশ্যক, তবে মূল লক্ষ্য নয়। উদ্দেশ্য হলো প্রস্তুতকারক, সরবরাহকারী হয়ে আমদানিকারক ও ভোক্তা – সকলকে একই সুতায় বাঁধা। তাই কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের ক্ষেত্রে আমরা যতই আধুনিক হই না কেন, সঠিক সমন্বয় না থাকলে পণ্য আমদানি ও রপ্তানির খরচ এবং সময় কিছুতেই কমিয়ে আনা সম্ভব নয়।”

সকল বন্দরকে অভিন্ন সিস্টেমের অংশ হয়ে উঠতে এখনো বহুদূরের পথ পাড়ি দিতে হবে। প্রশ্ন এসে যায় – পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থাকে একই শৃঙ্খলায় নিয়ে আসার সঠিক পথ তবে কী? পুরো ব্যবস্থাটির নিয়ন্ত্রণ আসলে কার হাতে থাকা উচিত এবং ঠিক কতখানি কার্যকর হবে সেটি? একটা উপায় হতে পারে যে, বন্দরে একটি অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা পরিচালনা করা যে, সকল বন্দরের জন্য অভিন্ন পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা প্রকৃতপক্ষে ফলপ্রসূ হবে কিনা? যেমনটা দেখা গেছে পোর্ট অব ভার্জিনিয়াতে। সেখানে নিরীক্ষা শেষে দেখা যায় ফুল অটোমেটেড টার্মিনালের কারণে দারুন ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে সম্পূর্ণ লজিস্টিক সিস্টেমের উপর। ধীরে ধীরে সকল বন্দর এই রূপান্তরের অংশীদার হতে যাচ্ছে, এ আশাবাদ করাই যায়।

অটোমেটেড টার্মিনালে কনটেইনার নামানোর সময়ের সাথে মিলিয়ে এটিকে খালাসের জন্য প্রাইম মুভার বা কনটেইনারবাহী ট্রাক আনানো হয়। ফলশ্রুতিতে মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যে আমদানিকৃত পণ্য বন্দর ত্যাগ করতে সক্ষম হয় এবং পণ্যজট অনেকাংশে হ্রাস পায়। কালক্ষেপণ যত কম, আমদানি খরচও তত নীচের দিকে থাকে। রেল ওয়াগন ব্যবহার, নতুন রেল ট্র্যাক স্থাপন ও সঠিক ব্যবহার, রেলের জন্য মার্শালিং ইয়ার্ড তৈরি – পণ্য স্থানান্তরে দ্রুততার নির্দেশক। যার সুফল ভোগ করে সাধারণ ভোক্তা।

জিপিএস ট্র্যাকিং সেন্সর এবং স্যাটেলাইট প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নয়নের ফলে তথ্য এখন খুবই সহজলভ্য। যদিও এ ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা খোলা সাগরে সবসময় সংযুক্ত থাকার ১০০% নিশ্চয়তা দেয় না, তবুও অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে নৌযোগাযোগ বর্তমানে ভালো অবস্থানে আছে। শেষ পর্যন্ত চৌকস বন্দর মানে দাঁড়ায় নৌবাণিজ্যের সফল পরিচালক। আর দিন শেষে বাণিজ্য মানে হল উচ্চতর লভ্যাংশ। এ কারণে ভবিষ্যতের বন্দরের জন্য এ সকল পদক্ষেপ খুবই জরুরি।

উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা তাকেই বলে যখন অবাধে তথ্য পাওয়ার সুবিধা থাকে। কেবলমাত্র তখন সামগ্রিক উন্নয়নের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হিসেবে বন্দরসমূহ একটি দেশকে নেতৃত্ব দিতে পারে। পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় ডিজিটালাইজেশন আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে গতি আনে, দক্ষতার ক্ষেত্রে প্রাণ সঞ্চার করে। অঞ্চলভিত্তিক বন্দরগুলো প্রতিযোগী নয়, বরং সহযোগী হিসেবে সমন্বয়ের মাধ্যমে করে মাধ্যমে আঞ্চলিক সমৃদ্ধিতে নিজ নিজ দেশের নেতৃত্ব দিতে পারে।

– রিচার্ড ক্লেটন: প্রধান মেরিটাইম করসপনডেন্ট, ফেয়ারপ্লে

ভাষান্তর: আফরোজা বিথী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here