১৬৮৫ সালেই চট্টগ্রাম দখলের চেষ্টা ব্রিটিশদের

ব্রিটিশদের দখলে চট্টগ্রাম

ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের আগমন ব্যবসায়ী হিসেবে। কিন্তু ব্যবসা ও ক্ষমতা নিরঙ্কুশ বিস্তারের লক্ষ্যে ক্রমশ তারা এখানকার রাষ্ট্রনীতিতে হস্তক্ষেপ শুরু করে। অবস্থানগত কারণে ব্রিটিশদের বাণিজ্য প্রসারে চট্টগ্রাম বন্দর ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে বাংলার শাসকদের সাথে দ্বন্দ্ব, অন্যদিকে মগ জলদস্যু এবং অন্যান্য ঔপনিবেশিক দেশগুলোর উপর আধিপত্য বিস্তার করতে ১৬৮৫ সালে ব্রিটিশরা প্রথম চট্টগ্রাম দখলের চেষ্টা চালায়। এডমিরাল নিকেলসনের নেতৃত্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নৌবহরের চট্টগ্রাম বন্দর দখলের প্রচেষ্টা সেবার ব্যর্থ হয়। অবশেষে ১৭৬০ সালে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব মীর কাশেম বর্ধমান ও মেদিনীপুরসহ চট্টগ্রামকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চিফ ভেরলেস্টের কাছে হস্তান্তর করেন।

ব্রিটিশ-বার্মা যুদ্ধ

১৭৮৪ সালে বার্মার শাসক আরাকান রাজ্য দখল করে নেয়। স্বাধীনতা লাভের প্রচেষ্টায় আরাকানের কিছু নাগরিক বার্মার শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যায়। এরা মূলত চট্টগ্রাম, আসাম ও মণিপুরের জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে বার্মা রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করত। ১৮২৪ সালে আরাকানে নিযুক্ত বার্মিজ গভর্নর এই বিদ্রোহীদের নিশ্চিহ্ন করতে আসামের কাছাড়, জৈন্তাপুর এবং চট্টগ্রামের গভীর জঙ্গলে একদল সেনা পাঠায়। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে বার্মা সরাসরি ব্রিটিশদের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। আরাকান সেনাদলটি নাফ নদীর তীরে অবস্থিত শাহপরী দ্বীপ দখল করে নেয়। এরপর সেখান থেকে ৮০০০ বার্মিজ সেনার একটি দল চট্টগ্রাম শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পথে তারা রামুতে অবস্থিত ব্রিটিশ সেনা ছাউনিতে হামলা চালায়। এই ঘাঁটির দায়িত্বে ছিল ৩০০ দেশীয় সিপাহী, যাদের কাছে ছিল কিছু দেশি অস্ত্র আর দুটি বন্দুক। এই সেনাদলকে সহজেই পরাজিত করে বার্মিজ বাহিনী চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। তবে তাদের এই অভিযান বর্ষার কারণে থেমে যায়। প্রবল বৃষ্টিপাতে পাহাড়ি রাস্তা চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়লে তারা রামুতে অবস্থান করতে থাকে। কিন্তু ইতিমধ্যে ব্রিটিশরা বার্মার রাজধানী রেঙ্গুন আক্রমণ করলে বার্মিজ এই বাহিনীকে রাজধানী রক্ষার লড়াইয়ে সেখানে ফিরে যেতে হয়। এভাবেই বার্মার শাসকদের চট্টগ্রাম অভিযানের ইতি ঘটে।

চট্টগ্রামে সিপাহী বিদ্রোহ

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের সময় চট্টগ্রাম অঞ্চল কোম্পানির কাছে শান্তিপূর্ণ এলাকা হিসেবে বিবেচিত ছিল। তবে ১৮৫৭ সালে সারা ভারতে সিপাহী বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়লে চট্টগ্রামেও তার প্রভাব পড়ে। চট্টগ্রামে ১৮৫৭ সালের ১৮ নভেম্বরে দেশীয় সিপাহীদের নিয়ে গঠিত ৩৪ নেটিভ ইনফেন্ট্রি বাহিনীর দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ কোম্পানি বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তারা প্রথমে জেলখানায় হামলা চালায় এবং সেখানকার কারাবন্দীদের মুক্ত করে দেয়। এরপর বিদ্রোহীরা সরকারি তিনটি হাতি এবং ট্র্রেজারি লুট করে। ট্রেজারি থেকে লুট করা ২৭,৮০০ পাউন্ড অর্থ এবং হাতি নিয়ে সিপাহীরা ত্রিপুরার (কুমিল্লা) পাহাড়ি অঞ্চলে চলে যায়। ট্রেজারি লুটের সময় দেশীয় একজন পুলিশ কনস্টেবল বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হয়। যদিও সিপাহীদের উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা, এদেশি মানুষের রক্তপাত ঘটানো নয়। বিদ্রোহীরা পাহাড়ি এলাকায় পৌঁছালে ত্রিপুরার রাজা এবং স্থানীয়রা তাদের আটক করে ব্রিটিশদের কাছে হস্তান্তর করে।

বন্দরের প্রাণ ফিরল আসামের চা’য়ে!

ভারতে ব্রিটিশ শাসনের শুরুতে কলকাতা বা চট্টগ্রাম নয়, বন্দর হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের হুগলীর সমৃদ্ধি ঘটে। তবে সিপাহী বিদ্রোহের পর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যবহার বাড়তে শুরু করে। ১৮৮৫ সালে প্রকাশিত ব্রিটিশ ইম্পিরিয়াল গেজেটে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজের আগমন বাড়তে থাকার বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করা হয়। সেখানে দেখা যায় ১৮৮১-৮২ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজের আগমন এবং এই বন্দর দিয়ে আমদানি ও রপ্তানির পরিমাণ বিগত বছরগুলোর তুলনায় দারুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই কারণে বন্দরে পণ্য পরিবহনে গতি আনতে ১৮৮৩ সালে ব্রিটিশ সরকার চটগ্রাম থেকে দাউদকান্দি পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

১৮৬০-৬১ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে ৬৬টি জাহাজ প্রবেশ করে। সে বছর এই বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি ও রপ্তানির সামগ্রিক পরিমাণ ছিল ৯,৭৪৩ টন। পরবর্তী পাঁচ বছরে চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যবহার নাটকীয় রকমের বৃদ্ধি পায়। ১৮৬৫ সালে মোট ২২১টি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে প্রবেশ করে এবং মোট রপ্তানি-আমদানি পণ্যের পরিমাণ ছিল ৪৪,২৮২ টন।

১৮৮১-৮২ সালে এই বন্দরে ৭৭১টি জাহাজ ভেড়ে  এবং এই সময়ে ১,৭৩৬,৪৮০ সেন্টাম ওয়েট বা হাইড্রোওয়েট টন (এক সেন্টাম বা হাইড্রোওয়েট টন সমান ১১২ পাউন্ড) পরিমাণ পণ্য আমদানি করা হয়, যার মূল্য ছিল  ৪৭১,৮৬১ পাউন্ড। চট্টগ্রাম থেকে রপ্তানি পণ্য নিয়ে ৭৭৩টি জাহাজ বন্দর ত্যাগ করে, যার পরিমাণ ছিল ২৫১,৩৪৩ সেন্টাম বা হাইড্রোওয়েট টন, আর এর মূল্য ছিল ১৪০,৮৩০ পাউন্ড। এই অর্থ বছরে বন্দরের মোট আয়ের পরিমাণ ছিল ৬,০৮২ পাউন্ড।

বন্দরের এই প্রবৃদ্ধির একটি প্রধান কারণ আসামের চা। সেই সময় ইংল্যান্ডকে চড়া মূল্যে – শুধু রূপার পরিবর্তেই চা কিনতে হত চীন থেকে। তাই স্কটল্যান্ডের নাগরিক রবার্ট ব্রুস ১৮২৩ সালে আসামে চায়ের গাছ আবিস্কার করলে, সেখানে চা বাগান তৈরির হিড়িক পড়ে যায়। এই চা রপ্তানির জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত বন্দর হিসেবে বিবেচিত হয় চট্টগ্রাম। যার ফলে চাল ও পাটের সাথে আসামের চা ঊনবিংশ শতকের শেষ পর্যায়ে চট্টগ্রাম বন্দরের পুরোনো গৌরবের অনেকটা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here