নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। সারাদেশে জালের মত ছড়িয়ে আছে অসংখ্য নদী। দেশ ও দেশের বাইরের বিভিন্ন উৎপত্তিস্থল থেকে ভূখন্ডের মধ্য দিয়ে কোথাও একা আবার কোথাও এক বা একাধিক ধারা মিলিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। নদী আর সাগরের সংযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে প্রাকৃতিক নৌযোগাযোগ ব্যবস্থার। নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বড় বড় শহর, বিস্তৃতি ঘটেছে ব্যবসা বাণিজ্য আর শিল্পের। বিভিন্ন জনপথকে একসূত্রে গেঁথে দিয়েছে নদী। বড় বড় নদীগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে নদী বন্দর। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা নিত্য প্রয়োজনীয় আর শিল্পপণ্য চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে লাইটার জাহাজে করে পৌঁছে যাচ্ছে এসব নদী বন্দরে। বিস্তৃত নৌযোগাযোগ ব্যবস্থা আর লাইটার জাহাজের নিরবিচ্ছিন্ন সেবা দেশের ব্যবসা বাণিজ্যকে করে তুলেছে প্রাণচঞ্চল।

চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন ও অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে এবং সারাদেশে লাইটার জাহাজের মাধ্যমে পণ্য পরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে ২০০৫ সালে বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স এসোসিয়েশন (বিসিভোয়া) ও কোস্টাল শিপ ওনার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (কোয়াব) একসাথে মিলিত হয়ে প্রতিষ্ঠা করেছে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল বা ডব্লিউটিসি। এ সেল গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল চট্টগ্রাম বন্দরের বর্হিনোঙ্গরে মাদার ভেসেল থেকে থেকে বন্দরের জেটি কিংবা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নৌপথে আমদানিকৃত পণ্য সহজে ও কম খরচে পৌঁছে দেয়া এবং চট্টগ্রাম বন্দর তথা দেশের টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে অভ্যন্তরীণ জাহাজ দ্বারা পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করা। ডব্লিউটিসি চট্টগ্রাম বন্দরের বর্হিনোঙ্গরে মাদার ভেসেলের অবস্থানকাল কমানোর পাশাপাশি বন্দরের সুনাম বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল গঠনের আগে আমদানিকারক ও লাইটার মালিকদের মধ্যে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল না। ফলে ভাড়া ও পণ্য পরিবহনে বিশৃঙ্খলা ছিল। ডব্লিউটিসি আমদানিকারক, কার্গো এজেন্ট এবং লাইটার জাহাজ মালিকসহ সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের মধ্যে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আমদানিকারকের দুয়ারে পণ্য পৌঁছানোর যুক্তি সংগত ভাড়া নির্ধারণ করে দেয় ডব্লিউটিসি, ফলে অতিরিক্ত ভাড়া গ্রহণের সুযোগ নেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার গন্তব্যে প্রতিটন সিমেন্ট ক্লিংকার পরিবহনে আমদানিকারককে লাইটার ভাড়া বাবদ ৪২৭ টাকা গুণতে হয়।

বর্তমানে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের অধীনে প্রায় ৭৫০ টির অধিক লাইটার জাহাজ চলাচল করে। যেগুলোর পরিবহন সক্ষমতা প্রায় ৯ লক্ষ মেট্রিক টন। ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের হিসাবমতে এসব লাইটার বছরে ১ কোটি ৮০ লক্ষ মেট্রিক টন পণ্য পরিবহন করে। ডব্লিউটিসি প্রতিষ্ঠার পর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা মাদার ভেসেল থেকে অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন গন্তব্যে পণ্য পরিবহনে কাজ করছে। সঠিক সময়ে মাদার ভেসেল থেকে পণ্য খালাসে লাইটার সরবরাহ করে ডব্লিউটিসি। ফলে আমদানিকারককে মাদার ভেসেলকে কোন প্রকার ক্ষতিপূরণ দিতে হয়না, এতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে।

আমদানিকারকের পণ্য পরিবহনে নৌপথে চলাচলকারী জাহাজগুলোকে নির্দিষ্ট নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। বর্হিনোঙ্গর থেকে পণ্য পরিবহনে ইচ্ছুক এমন নৌযানকে পণ্য পরিবহনের আগে অবশ্যই ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলে নিবন্ধিত হতে হয়। এক্ষেত্রে সরকারি রাজস্ব পরিশোধ ও সার্ভে সার্টিফিকেট ছাড়া কোন নৌযানকে পণ্য পরিবহনের অনুমতি দেয় না ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল। ফলে সরকারি রাজস্ব আদায়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে ডব্লিউটিসি। এছাড়া সরকারি নিষেধাজ্ঞা আছে ও রাজস্ব পরিশোধ করা হয়নি এমন পণ্য পরিবহনে লাইটার বরাদ্দ দেয় না ডব্লিউটিসি।

চট্টগ্রাম বন্দরে যেমন বর্হিনোঙ্গর থেকে জেটিতে জাহাজ ভিড়তে বার্থিং মিটিং পরিচালিত হয়, ঠিক তেমনি পণ্য পরিবহনে লাইটার জাহাজ বরাদ্দ দিতে প্রতিদিন ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের অফিসে বার্থিং মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। তবে মাদার ভেসেলের আধিক্য ও লাইটার জাহাজ স্বলতার কারণে মাঝে মাঝে বার্থি মিটিং অনুষ্ঠিত হয়না। আমদানিকারকের দেয়া লাইটার জাহাজের চাহিদার ভিত্তিতে লাইটার বরাদ্দ দেয়া হয়। আমদানিকারকের পক্ষে কার্গো বা পণ্যের এজেন্ট ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলে চাহিদা উত্থাপন করেন। শুধুমাত্র লাইটার বরাদ্দ দেয় এমন নয়, লাইটার কোন গন্তব্যে যাচ্ছে তা নিয়মিত মনিটরিংও করে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল। এছাড়া লাইটার বরাদ্দ পাওয়ার পর, আমদানিকারকের নির্দিষ্ট গন্তব্যে পণ্য খালাস পর্যন্ত যে কোন সমস্যা বা সৃষ্ট জটিলতা মীমাংশায় কাজ করে ডব্লিউটিসি। ফলে আমদানিকারকে পণ্যের কোন ধরণের ঝামেলা বা সমস্যায় পড়তে হয়না সঠিক সময়ে পণ্যের প্রাপ্তি নিয়ে। এছাড়া খাদ্যদ্রব্য ও কৃষিকাজে ব্যবহৃত সার পরিবহনের তথ্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে সরবরাহ করে ডব্লিউটিসি। ফলে একদিকে যেমন খাদ্যদ্রব্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করছে, ঠিক তেমনি দেশের কৃষি উৎপাদন প্রক্রিয়া স্বাভাবিক রাখতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে ডব্লিউটিসি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here