বাংলাদেশকে সাব-রিজিয়নাল ট্রান্সশিপমেন্ট হাব হিসেবে দেখতে চাই

সাফল্যের সাথে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব পালনের পর ৩১ জানুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দিয়েছেন রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহান, এনপিপি, বিসিজিএমএস, এনডিসি, পিএসসি, বিএন। তার আগে ছিলেন বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের উপমহাপরিচালক চট্টগ্রাম বন্দরের সদস্যের (হারবার) দায়িত্বে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ব্লু-ইকোনমি সেলের সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।

রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহান কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৮৪ সালের ২৪ জুলাই বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে। ১৯৮৭ সালের জানুয়ারি তিনি কমিশনপ্রাপ্ত হন। এরপর দায়িত্ব পালন করেছেন নৌবাহিনীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে। জাতিসংঘ মিশনের অধীনে তিনি সিয়েরা লিওনে সামরিক পর্যবেক্ষক দলের টিম লিডার এবং হাইতিতে ব্যানকন-শান্তিরক্ষী কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছেন। বাংলাদেশের বন্দর, ব্লু-ইকোনমিসহ সার্বিক মেরিটাইম খাত নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেছেন বন্দরবার্তার সাথে।

একসময় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (হারবার) হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব সামলেছেন। সেখান থেকে আবার চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে। নতুন দায়িত্বকে কীভাবে দেখছেন?

এর আগেও আমি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (হারবার) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে এই অভিজ্ঞতার গুরুত্ব অমূল্য। এই অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নির্বিগ্নে পালনের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

সদস্য (হারবার) থাকাকালে নির্দিষ্ট একটি ক্ষেত্র নিয়ে দায়িত্ব পালন করেছি। এখন বন্দরের সামগ্রিক উন্নয়ন নিয়ে আমাকে পরিকল্পনা করতে হবে। অর্থাৎ চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বটা অনেক বেশি। সেখানে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকা-ের কথা চিন্তা করতে হবে ও তা চাঙ্গা রাখতে সবসময় আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে। কারণ বন্দরের মাধ্যমেই পুরো মেরিটাইম বাণিজ্য চলে এবং মেরিটাইম ট্রান্সপোর্টেশন হচ্ছে আমাদের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। আমদানি ও রপ্তানিকারকদের তাদের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বন্দরের মাধ্যমে যেতে হয়। পণ্য গন্তব্যে পৌঁছাতে একটা দিনের বিলম্বের জন্য আমদানি ও রপ্তানিকারকদের অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। রপ্তানিকারকদের ক্ষেত্রে রপ্তানি পণ্য নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট বন্দরে ডেলিভারি না হলে রপ্তানি বাতিল হওয়ার ঝুঁকি থাকে। অনেক ক্ষেত্রে এমনটা হয়েছেও। তাই রপ্তানি পণ্য নির্দিষ্ট সময়ে জাহাজীকরণের ব্যাপারে বন্দরকে সবসময় সচেষ্ট থাকতে হয়।

বিশ্বব্যাপীই অর্থনৈতিক উন্নয়নে বন্দরের গুরুত্ব বাড়ছে। সিঙ্গাপুর ও চীনের মতো দেশ বন্দরকেন্দ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনার সুবাদে অভাবনীয় অর্থনৈতিক সাফল্য পেয়েছে। বাংলাদেশেও সরকার বন্দরকেন্দ্রিক বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করছে। আগামী দিনের বাংলাদেশের জন্য নিরাপদ একটি বন্দর খাত গড়ে তুলতে আমাদের অগ্রাধিকার কী?

সমুদ্রবন্দর হচ্ছে অর্থনীতির বাতিঘর। দেশের আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে মূল ভূমিকাটাই পালন করতে হয় বন্দরকে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বন্দরের সামর্থ্য বৃদ্ধি এবং কাজের পরিধি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বহুমাত্রিক প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জনেরও অন্যতম নিয়ামক হয়ে উঠেছে বন্দরের এই আধুনিকায়ন ও সামর্থ্য বৃদ্ধি।

২০৪১ সালে উন্নত দেশ হওয়ার লক্ষ্য সামনে রেখে উন্নয়নমুখী বিপুল কর্মযজ্ঞ চালু রয়েছে সারা দেশে। এগুলো করার সময় লক্ষ্য রাখা হচ্ছে বন্দরের সাথে সহজ ও সাবলীল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার বিষয়টিও। পণ্য উৎপাদন ব্যয়ের সাথে পরিবহন ব্যয় যুক্ত হয়েই নির্ধারিত হয় পণ্যের দাম। ফলে পরিবহন ব্যয় বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই পণ্যের দামও বাড়বে। তার প্রভাব পড়বে বাজারের ওপর। এ কারণে উৎপাদিত পণ্য নির্বিঘেœ এবং স্বল্পতম সময়ে রপ্তানি করা এবং অন্যদিকে আমদানি পণ্য হিন্টারল্যান্ডে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি সুষ্ঠুভাবে করতে পারাটাই এ মুহূর্তে আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারের পরিকল্পনা উৎপাদন কেন্দ্রগুলো উপকূলীয় বন্দরগুলোর কাছাকাছি স্থাপন করা। এ লক্ষ্যে উপকূলীয় অঞ্চলে বেশ কয়েকটি নতুন বন্দর ও টার্মিনাল নির্মাণের কাজ চলছে। পাশাপাশি এখন আমাদের আরো যে কাজটি করতে হবে, তা হচ্ছে নিকট এবং দূরবর্তী শিল্পাঞ্চল বা উৎপাদনকেন্দ্রের সাথে বন্দরের মজবুত যোগাযোগ অবকাঠামো গড়ে তোলা। রপ্তানিতে প্রতিযোগিতাসক্ষমতা ধরে রাখতে হলে পণ্যের গুণগত মানের পাশাপাশি লিড টাইম কমিয়ে আনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য শক্তিশালী যোগাযোগ অবকাঠামো এবং দক্ষ বন্দরের কোনো বিকল্প নেই। সিঙ্গাপুর একটি বন্দরনির্ভর দেশ, দক্ষতাই যাকে তুলে দিয়েছে সাফল্যের শীর্ষে। আমদানি পণ্য দক্ষতার সাথে খালাস এবং দ্রুততার সাথে হিন্টারল্যান্ডে পাঠানো কিংবা রপ্তানি পণ্য দক্ষ ব্যবস্থাপনায় দ্রুততম সময়ে জাহাজে তুলে দেওয়ার কার্যক্রমে সামান্য দুর্বলতা থাকলেও পরোক্ষভাবে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতিতে। সরকারের সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তে এসব ঝুঁকি উত্তরণে এ মুহূর্তে কাজ করে যাচ্ছি আমরা। এ মুহূর্তেও চলমান রয়েছে অনেকগুলো প্রকল্প, যার লক্ষ্য বন্দর অবকাঠামোর আধুনিকায়ন এবং এর কাজের পরিধির আরো সম্প্রসারণ।

আমাদের অর্থনীতি দিন দিন বড় হচ্ছে। সেই সাথে বাড়ছে চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিং চাহিদাও। ক্রমবর্ধমান এ চাহিদার সাথে তাল মেলাতে বন্দরকেন্দ্রিক পরিকল্পনা কী?

করোনাকাল বাদ দিলে কয়েক বছর ধরে দুই অংকের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরের। ছয় বছরে কনটেইনার হ্যান্ডলিং দ্বিগুণের বেশি বাড়ার পেছনে ভূমিকা রেখেছে চট্টগ্রাম বন্দরের অব্যাহত সামর্থ্য বৃদ্ধি। কার্গো পরিবহন খাতে ছন্দ ফিরিয়ে আনা, শুল্ককাঠামোর প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ওঠার কারণে এই অর্জন সম্ভব হয়েছে।

প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০৪১-এ নির্ধারিত অভীষ্টে পৌঁছতে হলে অর্থাৎ ২০৪১ সালে উন্নত দেশের কাতারে উন্নীত হতে গেলে আমাদের বন্দরকে আরো বড় ভূমিকা রাখতে হবে। অভীষ্টে পৌঁছতে ২০৩১ সাল নাগাদ ৯ শতাংশ এবং ২০৪১ সাল নাগাদ ৯ দশমিক ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে আমাদের। আমদানি-রপ্তানিই হবে এক্ষেত্রে প্রধান নিয়ামক। ২০৩১ সাল নাগাদ আমদানিতে ১২ দশমিক শূন্য ৫ ও রপ্তানিতে ১১ দশমিক ৬৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। ২০৪১ সালে আমদানি প্রবৃদ্ধি হবে ১০ শতাংশ ও রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ১১ শতাংশ। বিদ্যমান বন্দর সুবিধায় আমদানি-রপ্তানির এ বিপুল চাপ সামাল দেওয়া যাবে না। সে কারণেই বিদ্যমান বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে।

বন্দরের ইকুইপমেন্ট বহরে নতুন নতুন যন্ত্রপাতি যুক্ত করার পাশাপাশি পতেঙ্গা উপকূলে ৯০৭ একর জমির ওপর বে-টার্মিনাল নির্মাণ করছে চট্টগ্রাম বন্দর। ২০২১ সালের জুনের মধ্যে টার্মিনালটির নির্মাণকাজ শেষ হবে। এখানে ১৯০ মিটারের চেয়ে বড় এবং সাড়ে ৯ মিটারের বেশি ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারবে। ৫ হাজার টিইইউ ক্ষমতাসম্পন্ন মাদার ভেসেলও নোঙর করতে পারবে এখানে। মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজও শুরু হয়েছে। ২০২৫ সালে বন্দরটি কার্যক্রমে আসবে। মোংলা ও পায়রা বন্দরের অবকাঠামো সমৃদ্ধির কাজ চলছে। এছাড়া আমাদের অন্যতম অগ্রাধিকার বে-টার্মিনাল তো আছেই। সব মিলিয়ে বলা যায় আগামী দিনের চাহিদা পূরণে আমরা সঠিক পথেই এগোচ্ছি।

বন্দরকেন্দ্রিক উন্নয়নে সরকারের এই যে বিপুল কর্মযজ্ঞ চলছে অর্থাৎ বিদ্যমান বন্দরগুলোর সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে, একই সাথে গভীর সমুদ্রবন্দরও নির্মাণ করা হচ্ছে। এসবের চূড়ান্ত লক্ষ্য কী?

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেমনটা বলেছেন, ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছতে চাই। উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছানোর পথে আমরা চট্টগ্রাম বন্দরকে সাব-রিজিয়নাল ট্রান্সশিপমেন্ট হাব হিসেবে দেখতে চাই। বাংলাদেশকে যদি সাব-রিজিয়নাল হাব হিসেবে ঘোষণা করা যায়, তাহলে আমরা লায়াবিলিটিজকে অ্যাসেটে রূপান্তর করতে পারব। সবসময়ই আমি এটা বলে থাকি।

এখন প্রশ্ন হলো কোন কোন বন্দর সাব-রিজিয়নাল ট্রান্সশিপমেন্ট হাব হিসেবে আমাদের বন্দরকে ব্যবহার করবে এবং কেনইবা ব্যবহার করবে? মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর চালু হলে চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা বন্দর একে ফিডার পোর্ট হিসেবে ব্যবহার করবে। আমাদের পাশর্^বর্তী দেশ ভারতের কলকাতা (বর্তমানে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বন্দর), হলদিয়া, বিশাখাপত্তনম, কাকিনাড়া ও আন্দামান-নিকবরের অর্থাৎ বঙ্গোপসাগর বেল্টের বন্দরগুলো এটি ব্যবহার করতে পারবে। আমাদের আরেক প্রতিবেশী মিয়ানমারের আকিয়াব, ইয়াঙ্গুন এবং থাইল্যান্ডের ফুকেটসহ আরো দুই-একটি ছোট বন্দরও এটি ব্যবহার করতে পারবে। অর্থাৎ এ বন্দরগুলো হবে মাতারবাড়ীকেন্দ্রিক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেন তারা মাতারবাড়ী ব্যবহার করবে? কারণ এই অঞ্চলের বন্দরগুলোর মধ্যে মাতারবাড়ীর ড্রাফট সবচেয়ে বেশি। ১৮ মিটার ড্রাফট হওয়ায় ১০ হাজার টিইইউ কনটেইনার ধারণক্ষমতার জাহাজ ভিড়তে পারবে এখানে।

বর্তমানে সিঙ্গাপুরকে আমরা ট্রান্সশিপমেন্ট হাব হিসেবে ব্যবহার করি। বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার সবাই সিঙ্গাপুরকেই ট্রান্সশিপমেন্ট হাব হিসেবে ব্যবহার করে। কলম্বো বা তানজাং পেলেপাস থেকেও আমরা পণ্য আনি। এসব বন্দর থেকে একটি জাহাজে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টিইইউ কনটেইনার আনা হয়। এর পরিবর্তে ১০ হাজার টিইইউ কনটেইনার আনা গেলে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ ফ্রেইট কমে যাবে। ব্যবসায়ীরা তখন এমনিতেই মাতারবাড়ী বন্দরকে বেছে নেবেন। কারণ, খরচ সাশ্রয়ের পাশাপাশি পণ্যের ডেলিভারিও তারা দ্রুত পাবেন। সুতরাং এই বন্দর হবে ট্রান্সশিপমেন্ট হাবের সার্ভিস পোর্ট এবং আমরা সেই আশা করতেই পারি। এজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের সুনীল অর্থনীতিকে, আমাদের মেরিটাইম সেক্টরকে ঢেলে সাজানোর যে মহাকর্মযজ্ঞ নিয়েছেন এবং তার যে ভিশন, তা বাস্তবায়ন করতে পারলে আমরা আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্য, অর্থাৎ ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বিশে^র কাতারে পৌঁছে যাব। তখন সেটা আর স্বপ্ন থাকবে না, বাস্তবে রূপায়িত হবে।

বিশ্বে ল্যান্ডলর্ড পোর্ট মডেল একটি পরীক্ষিত মডেল, যেখানে প্রতিষ্ঠিত কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি বন্দর কার্যক্রম পরিচালনায় একটি বড় ধরনের ভূমিকা পালন করে বেসরকারি খাত। বিশ্বের বহু দেশে সাফল্যের উদাহরণ তৈরি করেছে এই মডেল। বাংলাদেশে বন্দর খাতের উন্নয়নে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ উদ্বুদ্ধ করতে ঠিক কী জাতীয় পরিকল্পনা রয়েছে কর্তৃপক্ষের?

ল্যান্ডলর্ড পোর্ট মডেলে বন্দরসেবা প্রদান কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে থাকে বেসরকারি খাত, যারা নিজেরাই তাদের প্রয়োজনীয় উপরিকাঠামো, যেমন টার্মিনালে কার্গো হ্যান্ডলিং ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ, ব্যবহার ও সংরক্ষণের কাজ করে। আমদানি-রপ্তানির ক্রমবর্ধমান চাহিদা সামাল দিতে বাংলাদেশ সরকারও ল্যান্ডলর্ড পোর্ট মডেল বাস্তবায়নের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করছে। অনুরূপ এক সিদ্ধান্ত নিয়ে ভারত সরকারও কিছুদিন আগে রাষ্ট্রায়ত্ত ১২টি বন্দরের মধ্যে ১১টি আরো দক্ষতার সাথে পরিচালনার স্বার্থে দায়িত্বভার ছেড়ে দিয়েছে বেসরকারি খাতের হাতে। বিশ্বব্যাংকও সম্প্রতি তাদের এক প্রতিবেদনে এ ধারণার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে বলেছে, বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ বাড়িয়ে এখনই এবং অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ও তার দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশীরা বিপুল পরিমাণ লাভবান হতে পারে। বৈশি^ক বাজার থেকে বড় সাফল্য ঘরে তুলতে পারে।

সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বন্দর খাতের বিকাশ এবং সমুদ্র সম্ভাবনা কাজে লাগাতে এ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণের কথা বলা হয়। অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায়ও খাতটিতে বেসরকারি বিনিয়োগের কথা জোর দিয়ে বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোন কোন খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ তুলনামূলক লাভজনক হবে বলে মনে করেন? পাশাপাশি সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় নির্ধারিত লক্ষ্যগুলো অর্জনের বিষয়টি কীভাবে মূল্যায়লন করবেন? অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার নির্ধারিত লক্ষ্যগুলো অর্জনের বিষয়েইবা কী ভাবছেন?

প্রথমত অবকাঠামো খাত উন্নয়নের বিপুল বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে এখানে। আমদানি-রপ্তানি গতিশীল করতে বন্দর অবকাঠামো সম্প্রসারণ করা যেমন জরুরি, তেমনি এর অবকাঠামো সামার্থ্য বাড়ানো, যেমন আরো বেশি অটোমেশনের মাধ্যমে বন্দরের দক্ষতা বৃদ্ধি, বৈশি^ক বিধানের সাথে সঙ্গতি রেখে তাকে আরো পরিবেশবান্ধব করে তোলা ইত্যাদিও জরুরি। আমাদের মূল কাজ কার্গো আনা-নেওয়ায় স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করা। এসব খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ স্বভাবতই লাভজনক হবে। নীতিমালা প্রণয়ন ও অন্যান্য সমর্থন নিশ্চিত করবে সরকার। বস্তুত আমাদের এখানে প্রায় প্রতিটি খাতেই বেসরকারি বিনিয়োগের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।

পরিবহন এবং লজিস্টিক খাতেও দক্ষতা ও গতিশীলতা সূচনার ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। অভিজ্ঞ কোম্পানির সাথে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ একটি চমৎকার বিকল্প হতে পারে এক্ষেত্রে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সাথে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এখানকার সড়ক এবং রেলের ফ্রেইট পরিবহন কোম্পানিগুলো অভ্যন্তরীণ শিপিং লাইনগুলোর সাথে অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে পারে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যে নতুন ধরনের বার্জ-সার্ভিস চালু করা সম্ভব হলে সড়কপথে ট্রাকযোগে কার্গো পরিবহনের ওপর চাপ কমবে। ফলে নৌপথের ব্যবহার বাড়লে লজিস্টিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। এ মুহূর্তে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে রয়েছি আমরা। আমাদের বন্দর, রেল, সড়ক ও নৌপরিবহন সেবাসহ প্রতিটি খাতের অব্যাহত উন্নয়ন নিশ্চিত করা আবশ্যক। আগামী দিনের ‘এশিয়ান টাইগার’ হয়ে ওঠার পথে দেশকে এগিয়ে নিতে আমাদের বেসরকারি খাতও বিনিয়োগের জন্য প্রস্তুত। আমরা, বিশেষত ভাবছি কাস্টমস, অবকাঠামো, লজিস্টিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি এবং কনটেইনার ট্র্যাকিং ও ট্রেসিং খাতের উন্নয়নের কথা।

সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে চট্টগ্রাম বন্দরের সাফল্যের স্বীকৃতি সরকারের তরফ থেকেই দেওয়া হয়েছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মূল্যায়নেই বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের লক্ষ্যমাত্রা পুরোপুরি অর্জন করেছে। অর্জনের দিক দিয়ে কোথাও কোথাও লক্ষ্যমাত্রাকেও ছাড়িয়ে গেছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রতিযোগিতাসক্ষমতা বাড়াতে বন্দরের দক্ষতা আরো বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুদক্ষ দিকনির্দেশনায় আমরা সেটা অর্জন করতে পারব বলে আশাবাদী।

বন্দর নিজেই এক ধরনের লজিস্টিক প্ল্যাটফর্ম, যার কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে চালাতে গেলে অনেকগুলো অংশীজনের সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য। বন্দর এবং অংশীজনদের মধ্যকার অতি প্রয়োজনীয় এই সমন্বয় প্রতিষ্ঠার কাজটি করছেন কীভাবে?

বন্দর শুধু তখনই তার সেরাটা দিতে পারে যখন তার সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি অংশীজন এতে পূর্ণাঙ্গ সমন্বয়ের মাধ্যমে তাদের দায়িত্বটুকু পালন করছেন। বিষয়টি রিলে রেসের মতো। একজন তার দৌড় শেষ করে আপনার হাতে ব্যাটন তুলে দেওয়ার পরই কেবল শুরু হতে পারে আপনার দৌড়। বিজয়ের লক্ষ্যে একাগ্রতা, সমন্বিত প্রয়াস ও সর্বোচ্চ অংশগ্রহণ ছাড়া সাফল্য এখানে অনিশ্চিত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নির্দেশনার ভিত্তিতে ২৪/৭ বন্দর চালু কার্যক্রম আরো জোরদার করা হয়েছে। ঘড়ির কাঁটা ধরে দেশের ‘নীলমণি’ এ বন্দরটিকে সদাপ্রস্তুত রাখতে চাইলে প্রতিটি অংশীজনের অনিবার্য অংশগ্রহণের বিকল্প নেই। ছুটির দিনে সরকারি-বেসরকারি অফিস খোলা রাখার চর্চাটি এখনো জোরালো হতে পারেনি কাজের সব ক্ষেত্রে। আমদানিকারকরা সময়মতো কনটেইনার ডেলিভারি না নেওয়ার কারণে বন্দরে জট বাড়ছে। দুর্বলতা রয়েছে, তবে এগুলো কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশ মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থা, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন এবং কোয়ারানটাইন বিভাগের মতো জরুরি অফিসগুলো ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ২৪/৭ সফল করতে বন্দর কর্তৃপক্ষ, কাস্টম অফিস, বিএসটিআই, কোয়ারানটাইন অধিদপ্তর, ব্যাংক এবং অন্যান্য অংশীজনের মধ্যে সমন্বয় আরো বাড়াতে হবে। কার্যক্রম সফল করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে তিন শিফটে কাজ চালু রাখার। গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন হিসেবে ন্যাশনাল বোর্ড অব রেভিনিউ (এনবিআর) ইতোমধ্যেই তাদের ৯৪ জন সহকারী রেভিনিউ কর্মকর্তা এবং ৯ জন সহকারী কমিশনারকে চট্টগ্রামে প্রেরণ করেছেন। অনুরূপ গতিশীলতা দেখা যাচ্ছে অন্যান্য অংশীজনদের মধ্যেও। পাশাপাশি বন্দর জনশক্তির দক্ষতা বৃদ্ধি ও কার্যক্রমে গতিশীলতা আনার লক্ষ্যে মধ্যম এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা রয়েছে কর্তৃপক্ষের। কাস্টম হাউস, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারসহ সকল অংশীজনকে ২৪ ঘণ্টা তিন শিফটে কাজ করতে হবে।

উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ বন্দরে কাস্টমসের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয় বন্দর চত্বরের বাইরে, কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরের ক্ষেত্রে তা ভিন্নরূপ। বন্দরের ভেতর কাস্টমস ডেলিভারি এবং পরীক্ষণ কার্যক্রমের কারণে বন্দরের স্বাভাবিক গতিশীলতা ক্ষুণœ হচ্ছে। এ অবস্থা উত্তরণের লক্ষ্যে কী ধরনের পরিকল্পনা রয়েছে আপনার?

বন্দর এলাকা থেকে এফসিএল কার্গোর আনস্টাফিং কিংবা দ্রুত ডেলিভারি নিশ্চিত করতে অফ-ডক সুবিধা বিনির্মাণের ওপর জোর দিয়েছে সরকার। এগুলো হতে পারে বেসরকারি কনটেইনার ফ্রেইট স্টেশন (সিএফএস) কিংবা ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (আইসিডি)। বর্তমানে ১৭টি বেসরকারি আইসিডি রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের কাছাকাছি। এসব স্থাপনায় কাস্টমস আনুষ্ঠানিকতার পাশাপাশি রাখা হয় স্বল্প-ঝুঁকির আমদানি পণ্য এবং খালি হওয়া কনটেইনার। তারা ৩৭টি পণ্যের আনস্টাফিং এবং ডেলিভারি দিতে পারে। চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর বর্তমান চাপ কমাতে আরো অন্তত ১২-১৩টি বেসরকারি আইসিডি গড়ে তোলার কথা ভাবা হচ্ছে। বন্দরের জট কমাতে বেসরকারি খাতে আরো আইসিডি এবং আইসিটি (ইনল্যান্ড কনটেইনার টার্মিনাল) নির্মাণের অনুমোদন দিতে যাচ্ছে সরকার। ঢাকা ও তার আশপাশের আইসিটিগুলো নৌপথে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে পণ্য পৌঁছে দেওয়ার কাজ করছে। চট্টগ্রাম বন্দরের সাপ্লাই চেইনের ওপর চাপ কমাতে ও তাকে আরো গতিশীল করতে আন্তরিক প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রয়েছে সরকার। আমি নিশ্চিত, যে আমাদের সম্মিলিত এসব প্রয়াসে সামনের দিনগুলোতে ব্যবসায়ের খরচও আশাতীত পরিমাণে কমে যাবে।

চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদানের আগে আপনি মোংলা বন্দরের দায়িত্ব পালন করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা মোংলা বন্দরকে কর্মচঞ্চল এক বন্দর হিসেবে দেখছি। বন্দরটির প্রতি ব্যবহারকারীদের এ আগ্রহের কারণ কী?

করোনা মহামারির মধ্যে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাকে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি কৃতজ্ঞ যে দুর্যোগকালীন সময়ে আমার ওপর আস্থা রেখে মোংলা বন্দর পরিচালনার গুরু দায়িত্ব তিনি আমাকে দিয়েছিলেন। আমি উনার এই আস্থার সম্মান রাখার চেষ্টা করেছি। চট্টগ্রাম বন্দরের সদস্য (হারবার) হিসেবে আমার যে অভিজ্ঞতা ছিল সেটা আমি মোংলা বন্দরে কাজে লাগিয়েছি।

আপনারা জানেন, দীর্ঘদিন যাবৎ মোংলা বন্দর একটি লোকসানি বন্দর। ৭০ বছরের পুরনো মৃতপ্রায় বন্দরটিকে জাগিয়ে তোলা ছিল আমার জন্য বিরাট একটা চ্যালেঞ্জ। দায়িত্ব নেওয়ার পর দেখলাম বন্দরে ঠিকমতো জাহাজ আসে না। এর কারণ অনুসন্ধান করে প্রথমেই যে সমস্যাটা দেখলাম তা হলো নাব্যতা সংকট। বন্দরের ব্যবস্থাপনাও বেশ দুর্বল ছিল। দেখা গেল, একই জায়গা থেকে অ্যাপ্রাইজিং হচ্ছে, ডেলিভারি হচ্ছে আবার পরীক্ষাও হচ্ছে। এতে বন্দরের উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে। এসব সমস্যা চিহ্নিত করার পর একটি আন্তর্জাতিক বন্দর যেভাবে পরিচালিত হয়, মোংলা বন্দরের ক্ষেত্রেও তা চালু করলাম। অ্যাপ্রাইজিং, এক্সামিনেশন, ডেলিভারি, রপ্তানি ও স্টাফিং-আনস্টাফিংয়ের জন্য আলাদা আলাদা ইয়ার্ড করা হলো। এতে বন্দরের কার্যক্রম একটা শৃঙ্খলায় চলে এল এবং বন্দরের উৎপাদনশীলতা বেড়ে গেল।

আরেকটা কাজ যেটা করলাম তা হলো আউটার বারে ক্যাপিটাল ড্রেজিং নির্ধারিত সময়ের এক মাস আগেই শেষ করে ফেললাম। ফলে হারবার এলাকার নাব্যতা বেড়ে গেল। আমাদের ওয়েবসাইট ও আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ককে কাজে লাগিয়ে সবাইকে আমরা বোঝাতে সক্ষম হলাম যে, বন্দরে সাড়ে ৯ মিটার থেকে ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ আনা সম্ভব এবং মোংলা বন্দর ব্যবহারের আহ্বান জানালাম। চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়েও মোংলা বন্দরের ট্যারিফ যে অনেক কম, সেটাও আমরা তুলে ধরলাম। এতে দেখা গেল এক মাসে ১৩০টির মতো জাহাজ চলে এসেছে। আগে যেখানে বছরে ৫০টি জাহাজ আসত না।

জেটির পাশেও নাব্যতা কম ছিল এবং ৭ থেকে সাড়ে ৭ মিটারের বেশি ড্রাফটের জাহাজ আসতে পারত না। এরপর মেইনটেন্যান্স ড্রেজিংয়ের আওতায় বন্দরের নিজস্ব সক্ষমতায় আমরা জেটি হেডে ড্রেজিং করলাম। এর মধ্য দিয়ে ৮ থেকে সাড়ে ৮ মিটারের জাহাজ জেটি হেডে আনার চেষ্টা করলাম এবং তাতে আমরা সফলও হলাম।

মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ বর্তমানে আমদানি ও রপ্তানিকারকদের সাথে বৈঠক ও যোগাযোগের মাধ্যমে বন্দরের নাব্যতা বৃদ্ধিসহ সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়টি তুলে ধরছে। অবকাঠামো উন্নয়নসহ বিভিন্ন ধরনের সংস্কার এনে বন্দরে পণ্য ডেলিভারি ও জাহাজীকরণ কাজে আমূল পরিবর্তন এনে বন্দরকে গতিশীল করা হয়েছে। এর ফলে দ্রুততম সময়ে পণ্য খালাস করা সম্ভব হচ্ছে। পণ্যের নিরাপত্তার জন্য বন্দরের স্থাপনাসমূহকে সিসিটিভির আওতায় আনা হয়েছে। বন্দরে নতুন নতুন কনটেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিং যন্ত্রপাতিও সংযোজন করা হয়েছে। বন্দরের ট্রাফিক, মেকানিক্যাল ও মেরিন বিভাগের কর্মকা-কে ঢেলে সাজানো হয়েছে। বন্দরের ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন আনার পাশাপাশি বন্দরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জবাবদিহির আওতায় আনা হয়েছে। এসবের ফলে ব্যবহারকারীরা মোংলা বন্দর ব্যবহারে আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন।

আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করার মতো এবং তা হলো খাদ্যসামগ্রী ও গাড়ি আমদানির জন্য মোংলা বন্দর খুবই উপযোগী। ৪০ শতাংশ খাদ্যপণ্য এবং গাড়ি মোংলা বন্দর দিয়ে আমদানির জন্য সরকার একটি এসআরও জারি করেছে। আমরা এটাকে প্রচারের কাজে ব্যবহার করলাম। খাদ্যদ্রব্যের জাহাজকে অগ্রাধিকার দিতে থাকলাম। গাড়িবাহী জাহাজগুলোর ফ্রেইট কমিয়ে দিলাম। ফলে যেসব শিপিং এজেন্ট ও ফ্রেইট ফরোয়ার্ডাররা আগে মোংলা বন্দরের প্রতি অনীহা প্রকাশ করতেন, তারাও এখন বন্দরটি ব্যবহার করছেন এবং জাহাজের সংখ্যা বেড়ে গেছে। মোংলা বন্দরের শেডগুলো এখন গাড়িতে ভরা থাকে। এই গাড়ির কারণে মোংলা বন্দরের রাজস্বও বেড়ে গেছে।

বন্দরের ইনার বারের ড্রেজিংয়ের কাজও শুরু হয়েছে। এটা শেষ হলে জেটিতে ৯-১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারবে। এছাড়া সেতু চালু হলে সড়কপথে ঢাকা ও উত্তরবঙ্গের সাথে মোংলা বন্দরের দূরত্ব সবচেয়ে কম হবে এবং পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে পণ্যবাহী গাড়ি নেপাল, ভুটানসহ আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে চলে যাবে। মোংলা বন্দরের গুরুত্ব তখন অন্য মাত্রায় পৌঁছে যাবে। তবে এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ হলো বন্দরের যে নাব্যতা আমরা তৈরি করেছি সেটি ধরে রাখা। এজন্য নিয়মিত মেইনটেন্যান্স ড্রেজিং করতে হবে।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ব্লু-ইকোনমি সেলের সদস্য হিসেবে অর্থনীতির নতুন এই ফ্রন্টটি নিয়ে কাজ করেছেন আপনি। নৌসদর দপ্তরের পরিচালক (ব্লু-ইকোনমি) থাকাকালেও খাতটি নিয়ে কাজ করার সুযোগ হয়েছে আপনার। ব্লু-ইকোনমিতে বাংলাদেশের সম্ভাবনা এবং তা কাজে লাগাতে আমাদের প্রস্তুতি সম্পর্কে কিছু বলুন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে ২০১২ সালে মিয়ানমার ও ২০১৪ সালে ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা-সংক্রান্ত বিরোধ শান্তিপূর্ণভাবে নিষ্পত্তির মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরের ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারজুড়ে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে সামদ্রিক মৎস্য আহরণ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ, শিপিং, মেরিন পর্যটনকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দুয়ার উন্মোচিত হয়েছে। সঠিক গবেষণা ও দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির মাধ্যমে অমূল্য এ সম্পদ আহরণ করতে হবে। এ লক্ষ্যে কাজও শুরু হয়েছে। গভীর সমুদ্রে মৎস্যসম্পদের জরিপে আরভি মীন সন্ধানী ২০১৬ সালেই বাংলাদেশে এসেছে এবং জরিপকাজ চলছে। চলছে গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কাজও। সমুদ্রগামী জাহাজ শিল্পেও একটা জাগরণ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তারাও এ খাতে বড় বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে আসছে। জাহাজ আমদানিতে সরকারের নীতিসহায়তা এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। সমুদ্রগামী জাহাজের বহর শক্তিশালী হলে পণ্য পরিবহন বাবদ জাহাজভাড়ার উল্লেখযোগ্য অংশ দেশে রাখা সম্ভব হবে, যা অর্থনীতিতে বাড়তি শক্তি জোগাবে।

বন্দরবার্তাকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ

বন্দরবার্তাকেও ধন্যবাদ। শুরু থেকেই আপনারা বন্দরবার্তাকে একটি সময়োপযোগী ও মানসম্মত কনটেন্টসমৃদ্ধ প্রকাশনা হিসেবে এগিয়ে নিয়েছেন। প্রকাশের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে বন্দরবার্তা বাংলাদেশের মেরিটাইম খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলেই আমার বিশ্বাস।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here