দেশের সব বন্দর নিয়ে মাল্টিমোডাল নেটওয়ার্ক তৈরি করবে পদ্মা সেতু

২৫ জুন উদ্বোধন হলো বহুল কাক্সিক্ষত পদ্মা সেতু। কোটি মানুষের স্বপ্নের এই সেতু দেশের যোগাযোগ খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যকেও গতিশীল করবে পদ্মা সেতু-এমনটাই বিশ্বাস সবার। দেশের আর্থ-সামাজিক ও বাণিজ্যিক উন্নয়নে পদ্মা সেতুর ভূমিকা কেমন হবে, সেই বিষয়ে বন্দরবার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান।

ঐতিহাসিক এক ক্ষণের সাক্ষী হলাম আমরা। আত্মমর্যাদা ও সক্ষমতার প্রতীক পদ্মা সেতু উদ্বোধন হলো। এ বিষয়ে আপনার অনুভূতি বলবেন…

এটি অবশ্যই বিরাট একটি অর্জন। এটি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী ও সাহসী সিদ্ধান্তের ফসল। শিল্পায়ন, পরিকল্পিত নগরায়ন, বাণিজ্যিক বিকাশ ইত্যাদি কার্যক্রম একটি দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। আর এই সবকিছুর জন্যই প্রয়োজন সংগতিপূর্ণ যোগাযোগব্যবস্থা। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের যোগাযোগব্যবস্থাকে নতুন এক উচ্চতায় নিয়ে যাবে। পদ্মা সেতু আমাদের আত্মনির্ভরশীল ও আত্মমর্যাদার ভিত রচনা করেছে।

এ তো গেল উপযোগিতার দিক থেকে পদ্মা সেতুর গুরুত্ব। বিভিন্ন হিসাব-নিকাশ ও পরিসংখ্যানের মাধ্যমে এটি তুলে ধরা সম্ভব। কিন্তু যে বিষয়টি কোনো পরিসংখ্যান ফুটিয়ে তুলতে পারবে না কিংবা কোনো হিসাবের মাধ্যমে যেটির মাহাত্ম্য প্রকাশ করা যাবে না, সেটি হলো সক্ষমতা ও আত্মমর্যাদার পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হওয়া।

পদ্মা সেতু করতে গিয়ে আমরা বহু চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছি। কিন্তু তাতে হতোদ্যম হয়ে পড়িনি। বিদেশি অর্থায়নকারীরা মুখ ফিরিয়ে নিল। তাতেও আমরা দমে যাইনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত  আমরা মাথা নিচু করে তাদের কথামতো চলিনি, আত্মমর্যাদার বিষয় সেখানে।

অর্থনৈতিকভাবে এই সেতু কীভাবে অবদান রাখবে?

আমরা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সাহস করতে পেরেছি, কারণ বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে আজ আর তথাকথিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ নয়। আমরা এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। শিগগির উন্নত দেশের তালিকায় নাম লেখাব। এই অগ্রযাত্রায় বড় ভূমিকা রয়েছে রপ্তানি আয়ের।

আপনারা জানেন দেশের রপ্তানি বাণিজ্যের প্রাণভোমরা হলো চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর। দেশের মোট সমুদ্র বাণিজ্যের ৯২ শতাংশের বেশি সম্পন্ন হয় এই বন্দর দিয়ে। কিন্তু বিশ্বের অন্যসব বন্দরের মতো এই বন্দরেরও সক্ষমতার একটা সীমা রয়েছে। দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিসর যে হারে বাড়ছে, তাতে বন্দরব্যবস্থার সম্প্রসারণ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন ও সম্প্রসারণমূলক কাজ চলমান রয়েছে। এর পাশাপাশি আমাদের অন্যান্য বন্দরের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমকে বেগবান করার দিকেও নজর দিতে হবে।

দেশের দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর মোংলা এখন সক্ষমতার দিক থেকে অনেকটা এগিয়েছে। আমরা এই বন্দরকে কাজে লাগাতে পারি। তুলনামূলক নবীন পায়রা বন্দরেরও দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে অবদান রাখার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। এ দুটো বন্দরই পদ্মার ওপারের। ট্রানজিট সুবিধার আওতায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় পণ্য পরিবহনে কেন্দ্রীয় ভূমিকা রাখতে পারে মোংলা ও পায়রা। পদ্মা সেতু সেই কাজটা সহজ করে দেবে।

কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে নির্মাণাধীন গভীর সমুদ্রবন্দরকে সাব-রিজিওনাল হাব হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য রয়েছে আমাদের। চট্টগ্রাম বন্দরেও চালু হয়েছে ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট। মোংলা ও পায়রাকে সংযুক্ত করে একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করতে পারলে আমরা আমাদের ভৌগোলিক অবস্থানগত সুবিধা সর্বোচ্চভাবে কাজে লাগাতে পারব। পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ মাল্টিমোডাল কানেক্টিভিটি তৈরির মাধ্যমে আমাদের সেই সুযোগ করে দেবে।

আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে যদি কিছু বলতেন…

পদ্মা সেতুর আর্থ-সামাজিক গুরুত্ব ভালোভাবে অনুধাবন করতে হলে বঙ্গবন্ধু সেতুর দিকে একটু নজর দিতে হবে। এই সেতু দেশের উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিক হালচাল বদলে দিয়েছে অনেকখানি। সেখানে কৃষি প্রক্রিয়াজাত কারখানার সংখ্যা অনেক বেড়েছে। উত্তরবঙ্গের কৃষকদের কৃষিপণ্য সহজেই রাজধানীসহ সারা দেশে চলে যাচ্ছে। বলা যায় বঙ্গবন্ধু সেতু উত্তরবঙ্গের কৃষকদের সরাসরি বাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছে।

বঙ্গবন্ধু সেতু চালুর পর উত্তরবঙ্গবাসীর কর্মসংস্থানের সুযোগ বেড়েছে, যা দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক হয়েছে। সেতু চালু হওয়ার আগে যেখানে রাজশাহী বিভাগে দারিদ্র্যের হার ছিল ৬০ শতাংশের বেশি, সাম্প্রতিক সময়ে তা ৩০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।

পদ্মা সেতুও দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে একইভাবে অবদান রাখবে। সেখানে নতুন শিল্প-কারখানা হবে, বিদ্যমান শিল্প খাতগুলোর সম্প্রসারণ হবে, গতিশীল হবে পর্যটন খাত, কৃষিজাত পণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প এবং এ খাতের পণ্যের নতুন বাজার তৈরি হবে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য মৌলিক এসব বিষয় নিশ্চিত হলে আঞ্চলিক উন্নয়নবৈষম্য বলে তখন আর কিছু থাকবে না।

দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উৎপাদিত পাট ও পাটজাত পণ্য চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে কনটেইনারে করে বহির্বিশ্বে রপ্তানি হয়। এসব পণ্য ফেরি পার হয়ে বন্দরে নিয়ে আসতে দীর্ঘ সময় লেগে যেত। এ ছাড়া চিংড়ি ও কাঁকড়া হিমায়িত পণ্য হিসেবে রপ্তানি হয়, যা দ্রুত জাহাজীকরণের প্রয়োজন হয়। বিশ্বের প্রায় সব বন্দরের সাথে চট্টগ্রাম বন্দরের নিয়মিত জাহাজ চলাচল থাকায় হিমায়িত পণ্য দ্রুত পরিবহনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে এবং কম খরচে সহজে এসব রপ্তানি পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে আসা সম্ভব হবে; যা রপ্তানি প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে। পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাথে থ্রি-আর (রোড, রেল ও রিভার) কানেক্টিভিটি নিশ্চিত হয়েছে। ইন্টারমোডাল কানেক্টিভিটির মাধ্যমে যা চট্টগ্রাম বন্দরকে দেশের সব অঞ্চলের সাথে যুক্ত করার পাশাপাশি নেপাল, ভুটান ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যসমূহের সাথে যুক্ত করে সাব রিজিওনাল হাবে পরিণত হওয়ার পথকে সুগম করেছে। তাই বলা যায়, পদ্মা সেতু এ অঞ্চলের কার্যকর যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়ে অর্থনীতির গেম চেঞ্জার হিসেবে কাজ করবে।

বন্দরবার্তাকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

আপনাকেও ধন্যবাদ। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের এই মাহেন্দ্রক্ষণ উপলক্ষে বন্দরবার্তার সব পাঠক, চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মী ও অংশীজনদের অভিনন্দন জানাচ্ছি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here