কোবে বন্দর

জাপানের চতুর্থ ব্যস্ততম বন্দর কোবে। জাপানের মধ্যাঞ্চলীয় হিয়োগো প্রিফেকচারে ওসাকা উপসাগরের কোল ঘেঁষে অবস্থিত বন্দরটি আন্তর্জাতিক সমুদ্র পরিবহন নেটওয়ার্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ১৩০ দেশের পাঁচ শতাধিক বন্দরের সঙ্গে এর সংযোগ রয়েছে। কেবল কমোডিটি ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টারই নয়, বরং বিনোদনের জন্যও জনপ্রিয়তা রয়েছে এর। 

কোবে বন্দরের রয়েছে মনোমুগ্ধকর ল্যান্ডস্কেপ। বন্দরটি রোকো পর্বতমালার পাদদেশে অবস্থিত। এই রোকো পর্বতমালা মৌসুমি ঝোড়ো হাওয়া থেকে বন্দরকে সুরক্ষা দেয়। কোবে বন্দর ঘেঁষে রয়েছে হানশিন ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়া। কৌশলগত অবস্থানের সুবিধার কারণে বড় বড় সব ইস্পাত ও জাহাজ নির্মাণকারী কোম্পানি কোবেতে তাদের শিল্প-কারখানা স্থাপন করেছে। এছাড়া খাদ্যপণ্য, ছোট অ্যাপ্লায়েন্স এবং যোগাযোগ ও পরিবহন যন্ত্রপাতির কারখানাও গড়ে উঠেছে সেখানে।

শুধু ব্যবসায়ীই নয়, পর্যটকদের কাছেও কোবে বন্দরের কদর রয়েছে বেশ। ক্রুজ পোর্ট হিসেবে বন্দরটি জনপ্রিয়। রোকো পর্বতমালার পাদদেশে হওয়ায় বন্দরটি প্রতিষ্ঠায় বেশ মুন্সিয়ানা দেখাতে হয়েছে কর্তৃপক্ষকে। কারণ সেখানে সমতল জমি রয়েছে খুব কম। এ কারণে বন্দরের বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের জন্য বেশ কয়েকটি কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করা হয়েছে।

কোবে বন্দর প্রথম উন্মুক্ত করা হয় ১৮৬৮ সালে। সে সময় এর নাম ছিল হিয়োগো বন্দর। জাপানের পশ্চিমে এটি ছিল অন্যতম প্রথম বাণিজ্যিক বন্দর। শুরুর দিকে বন্দরটি পরিচালিত হতো তৎকালীন সামন্ততান্ত্রিক সামরিক সরকার তাকুগাওয়া শোগুনাতের অধীনে। ১৮৭১ সালে জাপানের ঐতিহ্যবাহী সামন্ত্রতন্ত্র বিলুপ্ত হলে বন্দরটি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়। বর্তমানে বন্দরের প্রশাসক হিসেবে কাজ করছে কোবে সিটি গভর্নমেন্ট। আর কনটেইনার, লাইনার ও ফেরি টার্মিনালসহ অন্যান্য টার্মিনাল নির্মাণ, ইজারা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে কোবে পোর্ট টার্মিনাল করপোরেশন (কেপিটিসি)।

কোবে বন্দরের দীর্ঘ পথচলায় আরও কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা রয়েছে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রপক্ষ বি-২৯ বোমারু বিমান থেকে এ বন্দরে বোমা ফেলা হয়। এতে প্রায় ৯ হাজার মানুষের মৃত্যু ও শহর এলাকার এক-পঞ্চমাংশ ধ্বংস হয়ে যায়। ১৯৭৫ সালে সিটি কাউন্সিল কোবে বন্দরে পারমাণবিক অস্ত্রবোঝাই জাহাজ প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এর ফলশ্রুতিতে মার্কিন যুদ্ধজাহাজগুলোর বন্দরে প্রবেশ বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯৫ সালে গ্রেট হানশিন ভূমিকম্প বন্দরে আঘাত হানে। রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৩ মাত্রার এই ভূমিকম্পের কারণে দুই লাখের বেশি মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। প্রাণহানি ঘটে প্রায় ৪ হাজার ৬০০ মানুষের। বন্দরের বেশির ভাগ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বন্দরসেবায় নেমে আসে স্থবিরতা। ১৯৯৭ সালে বন্দরের পুনর্গঠন সম্পন্ন হয়। ভূমিকম্পে প্রায় ১০ লাখ কোটি ইয়েনের ক্ষয়ক্ষতি হয়, সেই সময় যা ছিল জাপানের জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশের সমান।

১৯৭০-এর দশক ছিল কোবে বন্দরের জন্য স্বর্ণযুগ। সে সময়ে বন্দরটি থেকে বিশ^ব্যাপী সর্বাধিক পণ্য সরবরাহ করা হয়। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত এটি বিশ্বের ব্যস্ততম কনটেইনার পোর্ট ছিল। হানশিনের সেই ভূমিকম্প বন্দরের এতটাই ক্ষতি করেছে যে, পুনর্গঠনের পরও এটি আর তার আগের অবস্থানে ফিরে আসতে পারেনি।

কোবে বন্দরের রয়েছে মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট সুবিধা। সমুদ্র, আকাশ ও স্থলপথে এ বন্দরে পণ্য আনা-নেওয়া করা যায়। বন্দরে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য রয়েছে রোকো আইল্যান্ড কনটেইনার টার্মিনাল। এসব টার্মিনালে রয়েছে মোট চারটি বার্থ, যেখানে পানির গড় গভীরতা ১৪ মিটার। এছাড়া বন্দরের পোর্ট আইল্যান্ড কনটেইনার টার্মিনালে রয়েছে ছয়টি বার্থ। এই টার্মিনালের মোট আয়তন ৭ লাখ ৮৬ হাজার ৮৮০ বর্গমিটার।

বন্দরে ক্রুজ টার্মিনাল হিসেবে রয়েছে কোবে পোর্ট টার্মিনাল ও নাকা পিয়ার ক্রুজ টার্মিনাল। এর মধ্যে কোবে পোর্ট টার্মিনালে রয়েছে ছয়টি বার্থ। আরও রয়েছে কেপিটিসি কনভেনশনাল লাইনার টার্মিনাল ও রোকো আইল্যান্ড ফেরি টার্মিনাল।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের একটি মেগাপ্রকল্পের সঙ্গে কোবে বন্দরের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। দেশের প্রথম মেট্রোরেলের কোচগুলো নির্মাণ হচ্ছে জাপানে। আর সেগুলো কোবে বন্দর থেকে মোংলা বন্দর হয়ে নদীপথে ঢাকায় আনা হচ্ছে।

Facebook Notice for EU! You need to login to view and post FB Comments!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here