বৈরুত বন্দর

বৈরুত বন্দর ছিল লেবাননের প্রধান সমুদ্রবন্দর। এছাড়া পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সর্ববৃহৎ ও ব্যস্ততম বন্দর ছিল এটি। ‘ছিল’ বলতে হচ্ছে, কারণ ২০২০ সালের আগস্টে ভয়াবহ এক বিস্ফোরণে মুহূর্তেই মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় এই বন্দর ও পার্শ্ববর্তী শহর এলাকা।

বৈরুত বন্দরের অবস্থান সেন্ট জর্জ উপসাগরের পূর্বাঞ্চলে, বৈরুতের ভূমধ্যসাগরীয় উত্তরাঞ্চলীয় উপকূলে। এর পূর্বে রয়েছে বৈরুত নদী।

বৈরুত পোর্ট শতাধিক বছরের প্রাচীন একটি বন্দর। এর যাত্রা ১৮৮৭ সালে অটোমান শাসনামলে। শুরুর দিকে এটি ফরাসি কোম্পানি কর্তৃক পরিচালিত হতো। ১৯৯০ সালে লেবানন সরকার বন্দরটির মালিকানা বুঝে নেয়।

বৈরুত বন্দরের হারবারটি কৃত্রিমভাবে তৈরি। এর আয়তন ১ বর্গকিলোমিটারের মতো। আর বন্দর কমপ্লেক্সের আয়তন ১ দশমিক ২ বর্গকিলোমিটার। বন্দরটিতে বার্থ রয়েছে ১৬টি। ২০০৪  থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বন্দরের কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনা করেছে বেসরকারি খাতের বৈরুত কনটেইনার টার্মিনাল কনসোর্টিয়াম (বিসিটিসি)। টার্মিনালটির কি সম্প্রসারণ করে এর দৈর্ঘ্য ১ কিলোমিটারের বেশিতে উন্নীত করা হয়েছে। এই কিতে রয়েছে ১৬টি পোস্ট-প্যানাম্যাক্স শিপ-টু-শোর গ্যান্ট্রি ক্রেন। এছাড়া অন-শোর কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য রয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যন্ত্রপাতি।

লেবাননের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমের পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ট্রান্সশিপমেন্ট কনটেইনার হ্যান্ডলিং করত বৈরুত বন্দর। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বন্দরের গুরুত্ব কিংবা কার্যক্রমের পরিধি অনেকটাই বেড়েছিল। ২০০৮ সালে যেখানে কনটেইনার পরিবহন হয়েছিল ৯ লাখ ৪৫ হাজার ১৪৩ টিইইউ। ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২ লাখ ২৯ হাজার ৮১ টিইইউ।

২০১৯ সাল পর্যন্ত হিসাব দেওয়া হচ্ছে, কারণ এরপরের সময়টা বৈরুত বন্দরের জন্য ইতিহাসের কালো এক অধ্যায়। সে বছরের ৪ আগস্ট ভয়াবহ এক বিস্ফোরণে মুহূর্তেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় বন্দর এলাকা। সঠিক উপায়ে সংরক্ষণ না করা অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের একটি গুদামে এই বিস্ফোরণের সূত্রপাত। এটি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, বন্দরের বড় একটি অংশ ও বেশির ভাগ অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে যায়। এই অবকাঠামোর মধ্যে বৈরুতের শস্যভা-ারও রয়েছে। এছাড়া বিস্ফোরণের  ঘটনায় অন্তত ২২১ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন ৬ হাজারের বেশি। গৃহহীন হয়ে পড়ে ৩ লাখের বেশি মানুষ। শত শত কোটি ডলার আর্থিক লোকসানের মুখে পড়ে বৈরুত শহর।

সেই ঘটনার পর বৈরুত বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এই বন্দর দিয়ে যেসব পণ্য হ্যান্ডলিং হতো, সেগুলোকে ত্রিপোলি ও টাইরের মতো ছোট বন্দরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

লেবাননের অর্থনীতি অনেকটাই আমদানিনির্ভর। বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে দেশটির মোট আমদানির ৬০ শতাংশ হতো বৈরুত বন্দর দিয়ে। তাই বলা যায়, লেবাননের অর্থনীতির স্বর্ণদার ছিল বৈরুত বন্দর। করোনা সংকটকালীন সময়েও পণ্য খালাস অব্যাহত রেখেছিল বন্দরটি। তবে বিস্ফোরণের পর বন্দরটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লেবাননে খাদ্যসংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। সেই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য পরে আংশিকভাবে খুলে দেওয়া হয় বন্দরটি। ১৬টি ক্রেনের মধ্যে ১২টি দিয়ে কার্যক্রম চালানো হয়।

আশার কথা হলো, বৈরুত বন্দরের কনটেইনার টার্মিনালকে আবার পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আর এই প্রকল্পে কাজ করবে ফরাসি শিপিং জায়ান্ট সিএমএ সিজিএম গ্রুপের সাবসিডিয়ারি সিএমএ টার্মিনালস। সম্প্রতি বৈরুত কনটেইনার টার্মিনাল সংস্কার এবং যন্ত্রপাতি ক্রয় ও প্রতিস্থাপনের জন্য ১০ বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে তারা।

চুক্তি অনুযায়ী মোট ৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করবে সিএমএ। এর মধ্যে ১ কোটি ৯০ লাখ ডলার প্রথম দুই বছরে সংস্কার ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য ব্যয় করা হবে।

বর্তমানে বৈরুত কনটেইনার টার্মিনালে বছরে সাড়ে ছয় লাখ টিইইউ হ্যান্ডলিং হয়। সিএমএ সিজিএমের পরিকল্পনা রয়েছে এই সক্ষমতা দ্বিগুণের বেশিতে উন্নীত করে বছরে ১৪ লাখ টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here