পোর্ট অব লন্ডন

টেমস নদীর তীরে অবস্থিত পোর্ট অব লন্ডন ছিল একসময় বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমুদ্রবন্দর। এছাড়া ২০২০ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের বৃহত্তম সমুদ্রবন্দরের তকমা ছিল এই বন্দরের দখলে।

বর্তমানে বন্দরটি পরিচালনা করে পোর্ট অব লন্ডন অথরিটি (পিএলএ)। এই পাবলিক ট্রাস্টটি ১৯০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।

ইউরোপের অন্যান্য ঐতিহাসিক বন্দর যেমন অ্যান্টওয়ার্প ও রটারডামের মতো লন্ডন পোর্টেরও বেশির ভাগ কার্যক্রম এখন নদীর মোহনার দিকে স্থানান্তর করা হয়েছে। এর বড় কারণ হলো এখনকার জাহাজগুলো আগের চেয়ে আকারে বেশ বড়। তাই নদীর তুলনামূলক গভীর অংশের দিকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে ইউরোপের অনেক বন্দরের কার্যক্রম। বর্তমানে লন্ডন পোর্টের পূর্বদিকের সম্প্রসারিত অংশে ক্রুজ লাইনার, রো-রো ফেরি ও সব ধরনের কার্গো হ্যান্ডলিং করা হয়।

পোর্ট অব লন্ডন প্রায় হাজার দুয়েক বছরের পুরনো একটি বন্দর। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে লন্ডন শহরের পত্তনের সঙ্গে সঙ্গেই এই বন্দর শহরটির অর্থনৈতিক কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শহরটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধির সমার্থক হয়ে দাঁড়ায় লন্ডন পোর্ট। আঠারো ও উনিশ শতকে বিশ্বের ব্যস্ততম বন্দর ছিল এটি। টেমসের তীরজুড়ে প্রায় ১১ মাইল বিস্তৃত ছিল এই বন্দর এলাকা। দেড় হাজারের বেশি ক্রেন দিয়ে প্রতি বছর প্রায় ৬০ হাজার জাহাজ হ্যান্ডলিং করা হতো এই বন্দরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি জার্মান বোমারু বিমানগুলোর অন্যতম টার্গেট ছিল লন্ডন পোর্ট।

লন্ডনে উল্লেখযোগ্য পরিমাণের বাণিজ্য প্রথম দেখা যায় ব্রিটেন যখন রোমান শাসনাধীন ছিল তখন। সেই সময়েই লন্ডন পোর্টের প্রথম হারবার নির্মাণ করে রোমানরা। সে সময় বন্দরের বার্থ নির্মাণ করা হয়েছিল কাঠের ফ্রেম ব্যবহার করে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতকের দিকে বন্দর দ্রুত প্রসার পায়। তবে পঞ্চম শতকে রোমানরা ব্রিটেন ছেড়ে চলে গেলে লন্ডনের বাণিজ্যিক কার্যক্রমে ভাটা নামতে শুরু করে। ফলে লন্ডন পোর্টের জৌলুসও কমে যায়।

উনিশ শতকের শুরু পর্যন্ত লন্ডন পোর্টে পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের প্রায় পুরোটাই সম্পন্ন হতো পুল অব লন্ডন নামে পরিচিত অংশ দিয়ে। আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এই পুল দিয়ে লন্ডনের আন্তর্জাতিক ও উপকূলীয় বাণিজ্যে অভূতপূর্ব উত্থান দেখা যায়। লন্ডনের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কয়লার চাহিদাও বাড়তে থাকে। ফলে পুল দিয়ে যত জাহাজ বাণিজ্য করত, তার দুই-তৃতীয়াংশই ছিল কয়লাবাহী। ১৭৫০ থেকে ১৭৯৬-এই সময়ের মধ্যে লন্ডন পোর্টের উপকূলীয় বাণিজ্য প্রায় দ্বিগুণে উন্নীত হয়।

উনিশ শতকে লন্ডন পোর্টে বেসরকারি কোম্পানির উদ্যোগে বেশ কয়েকটি এনক্লোজড ডক সিস্টেম নির্মাণ হয়। নৌ-জলদস্যুদের হামলা থেকে সুরক্ষা দিতে এসব ডকের চারপাশে উঁচু দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছিল। লন্ডন পোর্ট পরিচালনার জন্য ১৯০৮ সালে রয়েল কমিশনের মাধ্যমে পিএলএ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯০৯ সালে পিএলএ বেসরকারি মালিকানাধীন অনেকগুলো ডকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। একই সঙ্গে টেমস নদীর বিস্তীর্ণ অংশের নিয়ন্ত্রণও লন্ডন সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে বুঝে পায় পিএলএ।

দায়িত্ব পাওয়ার পর পিএলএ গভীর পানির চ্যানেল খনন, নতুন ডক নির্মাণ ও বিদ্যমান ডকগুলোর সংস্কারে নজর দেয়। এর সুফলও পেয়েছিল তারা। পিএলএর পরিচালনায় ১৯৩৯ সাল নাগাদ লন্ডনের বার্ষিক বাণিজ্য বেড়ে ৬ কোটি টনে উন্নীত হয়, যা সে সময়ে যুক্তরাজ্যের মোট বাণিজ্যের প্রায় ৩৮ শতাংশ ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই ধারায় ভাটা পড়ে এবং ক্লাইড ও লিভারপুলের বন্দরগুলো লন্ডন পোর্টের জায়গা নিয়ে নেয়। বিশ্বযুদ্ধ শেষে হারানো গৌরব আবার ফিরে পায় লন্ডন পোর্ট। ১৯৬০-এর দশকে পুনরায় ৬ কোটি টন বাণিজ্যের মাইলফলক স্পর্শ করে বন্দরটি।

২০২১ সালের লয়েড’স লিস্টে কনটেইনার বন্দরের তালিকায় লন্ডন পোর্টের অবস্থান ৬৯তম। ২০২০ সালে বন্দরটি দিয়ে ২৭ লাখ ৭২ হাজার টিইইউ কনটেইনার পরিবহন হয়েছিল।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here